অনুভূতিতে তুমি 💖পর্ব-২৮

0
2857

#অনুভূতিতে_তুমি 💖
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_২৮

[ এই পর্বটি অন্য পর্বের তুলনায় অধিক বড়। ফেসবুক লাইটে শো নাও করতে পারে.. ]

“নিরু কে তুমি দেখতে পাও এই কথা সত্য!

ফাহানের প্রশ্নের উত্তর দিতে বিলম্ব করল না মেহেরিন। শীতল গলায় বলে উঠে,

“হুম পাই!

“যখন নিরু আসে তখন নাকি বেলী ফুলের ঘ্রাণ পাও তুমি এটা সত্য!

“হুম।

“মাঝরাতে স্টোর রুমে বসে থাকো সেখানে তোমার দি আর বাবা’র স্মৃতি রাখা।

“হুম থাকি।

“কেন?

“ভালো লাগে খুব।

“নিরু কে কখনো ছুঁয়ে দেখেছিলে?

“ছোঁয়ার চেষ্টা করলেই দি চলে যেত।

“তবুও ছুঁতে!

“হুম ইচ্ছে করতো খুব!

“নিরু কখনো তার মৃত্যুর রহস্য বলে নি তোমায়?

“না বলে নি!

“নিরুর মতো নিজের বাপি কে দেখতে পাও না।

“না!

“কেন পাও না?

মেহেরিন ফাহানের দিকে তাকাল। তার সামনে চেয়ারে বসা সে। তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে সে। তার চোখের নজর মেহেরিন’র উপর। এক পলকের জন্যও সরছে না তা। মেহেরিন হেসে বলল,

“এর কারণ আমার জানা নেই।

“তোমার দি মা/রা যাবার এতো দিন পরেও তাকে দেখতে পাও। তোমার কি মনে হয় এটা তোমার কল্পনা।

“না এটা সত্যি!

“মৃ/ত মানুষ কখনো ফিরে আসে না মেহেরিন।

“আমার দি এসেছে, আমাকে অনেক ভালোবাসতো দি। আমাকে ছাড়া কখনো সে থাকতে পারে না।

ফাহান মুচকি হেসে একটু নড়েচড়ে বসল। বলে উঠল,

“এখন বুঝতে পারলে তোমার সমস্যা কোথায়? তুমি এটা মেনে নিতে রাজি তোমার বাবা মা/রা গেছে কিন্তু নিরু যে নেই এটা তোমার মন থেকে সরাতে চাইছো না।

মেহেরিন’র চেহারায় বিরক্তের একটা ছাপ দেখা গেল। মনে হলো সে বিরক্ত। ফাহান হেসে বলে উঠে,

“আচ্ছা বাদ দাও! তোমার মনে হয় নিরু কে খু/ন করা হয়েছে তবে এটা কেন মনে হয় না বাবা কেও খু/ন করা হয়েছে।

মেহেরিন ভ্রু কুচকালো। ফাহান একটা পেপার মেহেরিন’র হাতে দিয়ে বলল,

“তোমার বাবা হার্টের কোন প্রবলেম ছিল না মেহেরিন। তবে তিনি শ্বাসকষ্টের রোগী ছিলেন। মূলত এসব রোগীরা ভয়ংকর বা অপ্রত্যাশিত কিছু চোখের সামনে দেখলেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। আর তখন তাদের শ্বাসকষ্ট উঠে যায়। আর এই রিপোর্ট অনুযায়ী তিনি শ্বাসকষ্টের কারণেই মা/রা গেছে। এখন তুমি বলো, মিথ্যে কেন বললে!

মেহেরিন হেসে ফেলল। মেহেরিনের ঠোঁটের কোনের হাসি ফাহানের অবাকের কারণ হলো। ভ্রু কুন্চিত হলো তার। মেহেরিন হেসে বলল,

“আপনার মনে হয়, আমার বাবা কে আমি মেরে/ছি!

ফাহান খানিকটা থতমত খেল। অতঃপর বলে উঠে,
“তেমনটা করলে মোটিভ থাকা দরকার।

“তা জোগাড় করেছেন।

“তেমন কিছুই পাই নি আমি…

“তা হলে এই কথা কেন বলছেন?

ফাহান ভ্রু কুঁচকে বলল,
“আমি এই কথা একবারও বলি নি মেহেরিন। কথাটা তুমিই বলেছ!

“ইনডাইরেক্টলি তাই বলার চেষ্টা করছেন। আচ্ছা ছাড়ুন। আমার বাবা’রা আমরা দুই মেয়ে ছাড়া আর কেউই ছিল না। আর তার সম্পত্তি তাই আমাদের দু’জনের অধিকার ছিল। এখন আপনি ভাববেন সব সম্পত্তি একা ভোগ করার জন্য আমি দি কে মেরে/ফেলেছি। আর এই সত্য আমার বা/বা জানে বলে তাকেও মেরে/ফেলেছি কি তাই তো!

ফাহান কোন কথা না বলে নিশ্চুপ হয়ে মেহেরিন’র কথা শুনছে। মেহেরিন এবার উঠে দাঁড়াল। ফাহানের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলে উঠলো,

“আপনার পেশা একজন সাইক্রেটিস। তবুও একজন গোয়েন্দা হবার চেষ্টা করছেন। এখন যাই করুন না কেন তা ঠিক ভাবে করার চেষ্টা করুন।

বলেই ফাহানের ঘর থেকে বের হতে নিলে পেছন থেকে ফাহান তাকে ডাক দিল। মেহেরিন পিছনে ফিরতেই ফাহান কপি মগে চুমুক দিয়ে মেহেরিন কে উদ্দেশ্য করে বলল,

“তা সম্ভব না, তোমার দি মা/রা যাবার আগে তার ভাগের সম্পত্তি সব তোমার জিজু নামে করে গেছে।

মেহেরিন ভ্রু কুঁচকে তাকালো ফাহানের দিকে। এক পা এগিয়ে সামনে এলো সে। ফাহান উঠে দাঁড়াল। হাঁটতে হাঁটতে মেহেরিন’র সামনে এসে দাঁড়াল সে। বলে উঠল,

“তোমার বাবা মা/রা যাবার আগে তার লাস্ট কল তোমার জিজু ছিল। খোঁজ চালিয়েছি আমি। শুধু তথ্য গুলো ঠিক ছিল কি না তা নিশ্চিত হলাম।

মেহেরিন মুখ সরিয়ে নিয়ে বলল,
“এসব অনেক আগেই জানি আমি!

“তবুও কেন মিথ্যে বললে আমায়?

মেহেরিন’র মুখ লাল হয়ে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে ধরল সে। ফাহানের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

“কাকে কাকে সত্য বলবো আমি। এসব অনেক আগেই কোর্টে বলেছি। কিন্তু তা মিথ্যে বলে দোষারোপ উল্টো আমার কাছেই এসেছে।‌সবাই বলেছে আমি সম্পত্তি’র লোভে নিজের দি কে মেরে/ছি। যতদিনে প্রমাণ করলাম সম্পত্তি সব জিজুর নামে ততোক্ষণে তারা এই কাহিনী বানালো জিজু কে সম্পত্তি দেওয়ার কারণে রেগে গিয়ে দি কে মেরে/ফেলেছি আমি। এটা কি সত্যি’ই বিশ্বাস যোগ্য। মায়ের জায়গা যাকে দিয়েছিলাম তাকে খু/ন করার অভিযোগ উঠলো। কিন্তু শেষ অবদি প্রমাণ না করতে পারায় কিছুই করতে পারলো না। তবুও নিজের মন কে কিভাবে বোঝাতাম আমি।

ফাহান কফি মগে চুমুক দিয়ে মেহেরিন’র কথা শুনেই যাচ্ছে। মেহেরিন’র গলা ততোক্ষণে ভারী হয়ে আসছিল। তার চোখের কোনে অশ্রু জমতে শুরু করেছে। তবুও মেয়েটা খুব শক্ত। এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়তে দেয় নি। মেহেরিন একটু দম ছেড়ে বলে উঠল,

“বাবা’র মৃতু অস্বাভাবিক, জানি আমি! আর আমার এটাই মনে হয় জিজু আছে এর পিছনে। এখন যাই হোক না কেন সত্যি টা আমি বের করেই ছাড়বো।

বলেই ঘন ঘন শ্বাস নিতে লাগল সে। ফাহান মুচকি হেসে বলল,

“যদিও আমি কফি এতোটা ভালো বানাই না তবুও আজকের কফি টা খুব ভালো। তুমি চাইলে ট্রাই করতে পারো।

মেহেরিন’র কপালে ভাঁজ পড়লো। সে না বলার আগেই ফাহান তার জন্য কফি বানাতে চলে গেল।

—-

বাগানের এক কোনে চেয়ারে বসে ল্যাপটব টিপছে মেহেরিন। তার পাশেই অর্ণব বসে দেখতে তাকে। বাড়িতে গাড়ি ঢোকার আওয়াজ এলো। মেহেরিন পিছনে তাকিয়ে দেখল নিরব আসছে। তাকে দেখে আবারো ল্যাপটবে মুখ গুজল সে। নিরব এসে অর্ণব কে কোলে নিল। একটু আদরও করল। অর্ণবের অস্বস্তি লাগছে। তাই সে চলে এলো তার কাছ থেকে। মেহেরিন কে জড়িয়ে ধরল।‌ নিরব হতাশ হয়ে চেয়ারে বসে পড়ল। মেহেরিন অর্ণবের কপালে চুমু খেয়ে বলল,

“তুমি ঘরে যাও, মাম্মি কাজ সেরে আসছে ঠিক আছে।

অতঃপর মিস মারিয়া কে ডেকে অর্ণব কে তার হাত ধরে ঘরে পাঠাল। নিরবের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে আবারো কাজে মনোযোগ দিল।

“কোন খবর আছে নাকি?

“না তেমন কিছু নেই।

“ক্লাইন্টদের সাথে মিটিং ফিক্স করেছিস।

“দুদিন পর মিটিং…

“আর বলছিস কোন খবর নেই।

নিরব কিছু না বলেই অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। মেহেরিন ল্যাপটব রেখে নিরবের দিকে তাকিয়ে বলল,

“কি ভাবছিস এতো?

“ডঃ ফাহান এরকম কিছু একটা নাম না তার।

“হুম কেন?

“আজ সে এসেছিল আমার কাছে।

“ওহ আচ্ছা! তো এতে এতো টেনশন করার কি আছে।

নিরব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল মেহেরিন’র দিকে। ঠোঁট ভিজিয়ে বলে উঠে,
“খুব অদ্ভুত অদ্ভুত কথা জিজ্ঞেস করছিল তোর ব্যাপারে।

“করতে দে..

“উনি নাকি তোর চিকিৎসা করতে এসেছে, এই কি তার চিকিৎসার নমুনা।

“আচ্ছা ছাড় না এসব!

নিরব মুখ ঘুরিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মেহেরিন হেসে বলল,

“আচ্ছা চা খাবি তো, তুই বস আমি নিয়ে আসছি।

মেহেরিন কোলের ল্যাবটপ টা টেবিলে রেখে দাঁড়িয়ে গেলো। নিরব ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকালো। মেহেরিন একগাল হেসে ঘরের ভেতর হাঁটা ধরল। নিরব ল্যাবটপ হাতে নিয়ে মেহেরিন’র পিছন পিছন যেতে লাগলো।

রান্না ঘরে চা বানাচ্ছে মেহেরিন। তার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে ল্যাবটপ দেখার ছলে মেহেরিন কে লুকিয়ে দেখছে নিরব। কে বলবে এই মেয়ে টাকে কতো ভালোবাসে সে। সারাক্ষণ শুধু তার’ই কল্পনায় মগ্ন সে। মেহুর ভালোবাসা পাগল করেছে তাকে, মুগ্ধ করেছে। এই মুগ্ধতা যে কমবার নয়। তবে এই ভালোবাসা যে প্রকাশ করতে পারছে না সে। প্রকাশ করা কি উচিত নয়? কদিন’ই বা একা একা ভালোবেসে যাবে সে। তার এই ছোট্ট মনে তার মেহুর জন্য থাকা অনুভূতি কি আদৌও সে প্রকাশ করতে পারবে না। হুট মেহেরিন নজর তার দিকে পড়তেই তার দিকে তাকাতেই দ্রুত চোখ সরিয়ে নিল সে। মেহেরিন ঠোঁটের কোনে হাসি রেখে চা কাপে ঢেলে এনে রাখল নিরবের সামনে।
অতঃপর তার সামনে চা রেখে আবারো রান্না ঘরের দিকে যেতেই নিরব তার হাত খানা ধরে ফেলল। মেহেরিন খানিকটা অবাক হলো। নিরব ধীরে মেহেরিন’র কাছে এসে দাঁড়াল। মেহেরিন’র গালে হাত রেখে চুমু খেল কপালে। তবে আফসোস! তার এই কল্পনা টুকু সত্যি হতে পারল না। মুহূর্তেই তার কল্পনা জগৎ ছেড়ে বের হয়ে এলো সে। মেহেরিন’র ডাকে কল্পনা ভাঙল তার। মেহেরিন তাকে রেখে অর্ণবের কাছে গেল। নিরব হেসে চায়ের কাপ টা হাতে নিল। এমন কল্পনা একবার না বহুবার দেখেছে সে। তবে শুধু কল্পনায় না, বাস্তবে মেহেরিন কে কাছে চায় সে। তার ভালোবাসার রঙে রাঙাতে চায়। তবে সব ভালোবাসা কি রঙ তুলিতে রঙিন হয়!

ফাহান ভেবেই যাচ্ছে মেহেরিন’র সমস্যা ঠিক কোথায়? কয়েকদিন ধরেই এটা ধরার চেষ্টা করছে সে। কেন এই মেয়ে টা এতো অস্বাভাবিক। শুধু’ই কি প্রিয়জনকে হারানোর কষ্ট নাকি একাকিত্ব!

রাত ৮ টা। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। ফাহান হাতে কফি মগ টা নিয়ে বৃষ্টি উপভোগ করছে। আজকের বৃষ্টি টা সুন্দর। বৃষ্টি না ঝিরিঝিরি পড়ছে আর না বেশি জোরে। আজ আকাশও গর্জন করছে না। নিরিবিলি এক ধরনের বৃষ্টি। আকাশ থেকে কতো পানিই না ঝড়ে পড়ছে এই মাটিতে। সতেজ করছে পুরো প্রকৃতি। এমন দৃশ্য আর কদিন’ই বা দেখা যায়। ফাহান আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,

“এই বৃষ্টি খুব জলদি থামবে বলে মনে হচ্ছে না!

ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকাল। চোখ বন্ধ করে বৃষ্টি পড়ার আওয়াজ শুনতে লাগল। হঠাৎ করেই কিভাবে মেহেরিন’র মুখটা ভেসে উঠলো তার সামনে। চোখ বন্ধ রেখেই ভ্রু কুঁচকে নিল সে। মেহেরিন’র বৃষ্টিতে ভেজা সেই রুপ ফুটে উঠছে তার সামনে। তার সারা মুখে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু পানির কণা, থিতুনি বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ার দৃশ্য দেখতে পাচ্ছে সে। ফাহান চোখ মেলে তাকাল। গাড়ির চাবি টা নিয়ে বের হয়ে গেল সে।

মেহেরিন অর্ণব কে খাওয়ানো শেষে তাকে নিজের কোলের মাঝে বসাল। অতঃপর দু হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল তাকে। তার কানের কাছে কথা বলতে লাগল যাতে কিছুটা হলেও নিজ থেকে কথা বলে সে। হঠাৎ করেই ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। নিরবের কল করার কথা ছিল। তা ভেবে না দেখেই কল রিসিভ করে কানে দিল। বলে উঠল,

“প্রেজেন্টেশন আমি তৈরি করে ফেলেছি, তুই টেনশন নিস না।

“কিসের প্রেজেন্টেশন বানালে তুমি মেহেরিন।

অবাক হলো মেহেরিন। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল ডঃ ফাহান!

“ওহ সরি, ডঃ ফাহান। আমি ভেবেছিলাম নিরব!

“ওহ তাই বলো, নাহলে আমি ভাবছি তোমাকে আবার কি প্রেজেন্টেশন দিলাম আমি।

“হঠাৎ করে কল করলেন, জরুরি কোন কথা?

“জরুরী তো অবশ্যই!

“জ্বি বলুন।

“না এভাবে না, দেখা করো!

“এই বৃষ্টিতে?

“তোমার বাড়ির সামনেই আছি আমি।

“ওহ তাহলে বাড়িতে আসুন।

“না কথা এখানে বলা যাবে না।

“তাহলে…

“বাইরে আসো, আমি অপেক্ষা করছি!

মেহেরিন কিছু বলার আগেই কল কেটে গেল। মেহেরিন মিস মারিয়া’র কাছে অর্ণব কে রেখে বাড়ির বাইরে আসলো। অতঃপর বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাড়ির বাইরে চলে গেল। আশপাশ তাকিয়ে ফাহানের গাড়ি দেখতে পেল সে। গাড়ির কাছে যাবার আগেই হুট করেই তার হাত ধরে টান দিল সে। মেহেরিন সামনে ঘুরে দেখল ফাহান ছাতা হাতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ফাহান বলে উঠে,

“তুমি বৃষ্টিতে ভিজে কেন এসেছো, ছাতা আনতে পারো নি।

মেহেরিন থতমত খেয়ে গেল। কিছু বলবে তার আগেই ফাহান তার হাত ধরে বৃষ্টির মাঝে চলতে শুরু করল। নিরবের গাড়ি সবেমাত্র এসে ভিড়ল মেহেরিন’র বাসার সামনে। মেহেরিন কে ডঃ ফাহানের সাথে চলে যেতে দেখে দম বন্ধ হয়ে গেল সে। কঠিন মুখ চোখ করে তাকিয়ে রইল তাদের দিকে।

ফাহানের এমন হুট করেই হাত ধরাতে হতবাক মেহেরিন। শান্ত গলায় বলে উঠল,

“ডঃ ফাহান হাতটা ছাড়ুন আমার।

“ওহ সরি!
বলেই ফাহান হাত ছেড়ে দিল। কিন্তু মুখ ঘুরিয়ে মুখ টিপে হাসল সে। এক ছাতার নিচে হাঁটছে দুজন। অনেক পথ’ই হাটল। মেহেরিন বলে উঠল,

“আমরা কোথায় যাচ্ছি?

“লক্ষ্য ছাড়া হাটছি, দেখি কোথায় এসে ঢেকে!

মেহেরিন ভ্রু কুঁচকে ফাহানের দিকে তাকাল। ফাহান হেসে বলল,
“সিরিয়াসলি নিয়ে ফেললে নাকি, আচ্ছা বলছি! সামনের পার্ক টা অবদি যাবো। বৃষ্টিতে হাঁটতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু একা একা হাঁটতে ভালো লাগল না বলে তোমার সঙ্গ নিলাম।

“বাসায় অর্ণব আমার অপেক্ষা করছে।

“হাম তা জানি। তোমার বেশি সময় নেবো না আমি। কিছু কথা জিজ্ঞেস করব।

“আপনারা সাইক্রেটিস রা সারাক্ষণ প্রশ্ন করা নিয়েই ভাবেন।

“প্রশ্ন হচ্ছে উওরের সন্ধান!

মেহেরিন ফাহানের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে ছাতার নিচ থেকে বেরিয়ে এলো। ফাহান বলে উঠে,

“আরে মেহেরিন বাইরে বৃষ্টি তো! ভিজে যাবে..

মেহেরিন পিছনে ফিরে বলল,
“হয়তো একটু বেশিই উওরের সন্ধানে থাকেন। তাই আপনার চোখে পড়ছে না বৃষ্টি থেমে গেছে।

ফাহান মাথার উপর থেকে ছাতা সরিয়ে দেখল আসলেই বৃষ্টি থেমে গেছে। সে মুচকি হেসে ছাতা টা বন্ধ করে নিল।

পার্কে এসে মেহেরিন বড় গাছ টার নিচে এসে দাঁড়াল। ফাহান সামনে বরাবর ল্যাম্পপোস্ট’র নিচে দাঁড়াল। মেহেরিন দাঁড়িয়ে তার মুখ টা দেখতে পেল। তার মুখটা মলিন হয়ে আছে। ফাহান তাকিয়ে আছে তার দিকেই। মেহেরিন চোখ নামিয়ে ফেলল।‌ ফাহান বলে উঠল,

“অর্ণবে প্রিয় জিনিস তার থেকে কেড়ে নিলে কি করে সে?

মেহেরিন শীতল গলায় বলল,
“প্রথমে প্রথমে মুখ ভার করে বসে থাকবে। চোখ মুখ সব লাল হয়ে যাবে। এর কিছুক্ষণ’র মধ্যেই ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে শুরু করবে সে।

ফাহান হেসে বলল,
“কারো প্রিয়জন হারিয়ে গেলে সে কি করবে?

মেহেরিন রাতের খোল আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কাঁদবে.. কষ্ট পাবে!

“নিরু মা/রা যাবার পর তুমি কয়দিন কাঁদলে?

মেহেরিন চোখ মুখ মলিন করে তাকিয়ে রইল ফাহানের দিকে। মেহেরিন’র আবছা মুখ দেখতে পাচ্ছে সে। ফাহান এগিয়ে এসে বলতে লাগল,

“স্বীকার করতে শিখো মেহেরিন তোমার প্রিয় মানুষ গুলো নেই আর পৃথিবীতে। তুমি হারিয়ে ফেলেছ তাদের। এতে তোমার কষ্ট হচ্ছে, খুব কষ্ট। আর সেই কষ্ট যতোই নিজের মাঝে রাখবে ততোই তা কুড়ে কুড়ে খাবে তোমাকে। মানুষ কাঁদে নিজের মন হালকা করার জন্য। কেউ কাঁদলে এটা তার দুর্বলতা হবে এটা ভাবার কোন কারণ নেই। কাঁদলে মানুষের মন হালকা হয়। মানুষ নতুন করে বাঁচতে শিখে। সেই বেঁচে থাকার স্বাদ কি তুমি নিতে চাও না।

মেহেরিন’র গলা ধরে আসছিল। মেহেরিন চোখ মুখ কঠিন করে ফেলল। সেখান থেকে চলে যেতে নিলেই ফাহান তাকে টেনে গাছের সাথে আঁটকে দিল। বলে উঠল,

“পালিয়ে যাচ্ছো কেন? সবকিছু থেকে পালিয়ে গেলেই তা তোমার পিছু ছাড়বে না। সত্যি টা স্বীকার করো মেহেরিন। তোমার বোন আর বেঁচে নেই। মা/রা গেছে সে। তার ঝুলন্ত লা/শ সবার প্রথমে দেখেছিলে তুমি। তাকে বাঁচাতে পারো নি বলেই সেই আক্ষেপ তোমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। নিজেকে দায়ী করছো তুমি! এমনটা কিছু না।

মেহেরিন মুখ ঘুরিয়ে নিল। তার শরীর কাঁপছে। কেঁপে কেঁপে বলে উঠল,

“এএএ..মমন এমন কিছু না।

“সত্যি কি তাই!

মেহেরিনি মাথা নেড়ে বলল,
“হুম!

ফাহান সরে এলো মেহেরিন’র কাছ থেকে। বলে উঠল,
“ঠিক আছে!

বলেই একা বেরিয়ে এলো পার্ক থেকে। খানিক দূর অবদি হেঁটে এলো। পিছনে তাকিয়ে দেখতে পেলো না মেহেরিন কে। আবারো হেঁটে পার্কের কাছেই গেলো সে। দেখল গাছের নিচে ছোট বাচ্চাদের মতো হাঁটু গেড়ে বসে নিশ্চুপ ভাবে কাঁদছে মেহেরিন। ফাহান এগিয়ে এলো না। দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। সে চাইলো মেহেরিন কাদুক। কাদলে তার মন হালকা হবে।‌ বেশি কিছু না হলেও আজকের রাত টা শান্তিতে ঘুমাতে পারবে সে।

কাঁদতে কাঁদতে মেহেরিন’র হেঁচকি উঠে এলো। ফাহানের মনে হলো এবার তাকে থামানো উচিত। সে এগিয়ে গেল মেহেরিন’র দিকে। তার সামনে দাঁড়িয়ে তাকে ডাকতেই মেহেরিন কান্না থামিয়ে দিল। ফাহান বলে উঠে,

“অনেক কেঁদেছ, যথেষ্ট হয়েছে।

মেহেরিন দ্রুত দাঁড়িয়ে উঠলো। ঘন ঘন শ্বাস নিতে লাগল সে। তার হাত কাঁপছে। ফাহান তার দিকে রুমাল টা এগিয়ে দিল। মেহেরিন তা হাত বাড়িয়ে নেবার আগেই জ্ঞান হারিয়ে ফাহানরে উপরে এসে পড়ল। ফাহান তাকে দ্রুত ধরে ফেলল। তার মুখ খানি দেখে চুল গুলো কানে গুঁজে দিল। কোলে তুলে নিল তাকে। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় তার কান্না মাখা মুখটা দেখতে পেলো সে। কিছু আছে এই মুখের মাঝে। ফাহান কে আকৃষ্ট করল তা। প্রথমবারের মতো সে স্বীকার করতে বাধ্য হলো তার মনের অনুভূতি টুকু মেহেরিন’র জন্য। আর এই অনুভূতির নাম ভালোবাসা! এ কথা তার মন স্বীকার করতেই তার ঠোঁটের কোনে হাসি দেখা দিল। বির বির করে বলে উঠলো,

“তোমার সেই বৃষ্টি ভেজার দৃশ্য দেখেই আমি প্রথম তোমার প্রেমে পড়েছিলাম, তা তখন না বুঝতে পারলেও এখন ঠিক’ই বুঝছি আমি!

ধীরে ধীরে নিজের প্রেমে পড়তে বাধ্য করালো সে মেহেরিন কে। মেহেরিন’র জীবনে এই প্রথম কোন পুরুষের ভালোবাসা পেল সে। তার জন্য এই ভালোবাসা’র দাম অনেক ছিল। সে ভাবল কেউ একজন তো আছে যে কি না তাকে ভালোবাসবে, আগলে রাখবে তাকে। নিজের সবটুকু দেবে তাকে। আর সেই মানুষটি ফাহান কে মনে হলো তার। তবে ফাহানের এতো বড় মনে ছোট একটা বাচ্চার প্রতি থাকা ক্ষোভ বাড়তে লাগলো ধীরে ধীরে আর তা পুরোপুরি ভাবেই মেহেরিন’র অগোচরে। মেহেরিন’র এই ধারণা ছিল’ই না তার ভালোবাসার মানুষটি তার জীবন’কেই ভালোবাসতে পারে নি।

বর্তমানে…

ডঃ রাহেলা চোখের সমস্যা টা আবারো খুললেন। নির্ঝর এখনো এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তার চোখে মুখে এখনো আগ্রহ! এমন একজন শ্রোতা পেয়ে ভালো লাগছে তার। ডঃ রাহেলা শ্বাস ফেলে বললেন,

“তাদের এই প্রেম অনেকদিন ধরেই টিকেছিল। তাদের বিয়ের কথাও একবার কানে এলো। তবে হুট করেই কি হলো বুঝতে পারলাম না। তাদের দুজনের মাঝে সবকিছু আলাদা হয়ে গেল। কিন্তু তা কেন এটা আমার জানা নেই। কেটে গেল আরো কয়েকমাস। তবে একটা কথা, ফাহানের চলে যাওয়াতে মেহেরিন একবারের জন্যও কিন্তু ভেঙে পড়েনি। একদম স্বাভাবিক রেখেছিল সে নিজেকে। তবে আমি জানতাম এটা শুধুই তার দেখানো। তার চিকিৎসা তখন আমিই চালিয়ে যেতে লাগলাম। একসময় দেখলাম তার পুরো চিন্তা ভাবনা অর্ণবকে নিয়ে। অর্ণব কে নিয়েই সারাদিন তার পড়ে থাকা। মাঝে মাঝে অফিসের কাজ ছেড়ে অর্ণব কে নিয়ে তার বসে থাকা দেখে ভেবে নিলাম এবার হয়তো সত্যিই স্বাভাবিক সে। তবে অর্ণব ততোদিনেও স্বাভাবিক হয় নি। অতঃপর হঠাৎ করেই অর্ণব দেখলো তোমায়। সেদিন প্রথমবার সে নিজ থেকেই তোমাকে ডাক দিলো। হয়তো তুমি তা শুনতে পারো নি তবে মেহেরিন’র কাছ থেকে আড়াল হয় নি। অর্ণব তোমাকে নিজের ড্যাডি বলেই ভেবে নিল। মেহেরিন সমস্ত কথা এসে বললো আমায়। তারপরের সব কথা তো তোমার জানাই!

নির্ঝর এখন তার চোখ সরালো। ঘাড়ে হাত রেখে ঘাড় নাড়াল। তার ঘাড় ব্যাথা করছে। অর্ণবের প্রথম ড্যাডি ডাকের কথাটা অফিসের কথা মনে করিয়ে দিল তাকে। সে মুচকি হাসল।‌ডঃ রাহেলা বলল,

“নির্ঝর আর ইউ ওকে!

“হুম!

“সরি তোমাকে বিচ্ছেদের কারণটা বলতে পারছি না আমি। তবে একটা কথা বলতে পারি!

নির্ঝর অবাক চোখে তাকাল। ডঃ রাহেলা বললেন,

“ফাহানের সাথে বিচ্ছেদের পর মেহেরিন যেভাবে অর্ণব কে আগলে রাখতে শুরু করল এতে মনে হচ্ছে তাদের বিচ্ছেদ অর্ণবের সাথে যুক্ত!

নির্ঝর মাথা নাড়িয়ে এপাশে তাকাল। এর মাঝেই দরজায় কড়া নাড়ল। নির্ঝর পেছন ফিরিয়ে দেখল অর্ণব উঁকি দিয়ে তাকে দেখছে। তাকে দেখে বলে উঠল,

“ড্যাডি!

“অর্ণ সোনা!

বলেই কোলে তুলে তাকে। ডঃ রাহেলা হেঁসে বলেন,
“খুব মিস করছিল অর্ণব তোমায়!

অর্ণব হেসে মাথা নাড়ল। নির্ঝর হেসে তার কপালে চুমু খেয়ে বলল,
“সরি সোনা। এজন্য তোমাকে আমি একটা না দুটো আইসক্রিম খাওয়াবো ঠিক আছে। কিন্তু মাম্মি কে বলবে না প্রমিস!

বলেই হাতের কনিষ্ঠা আঙ্গুল এগিয়ে দিল। অর্ণব তার কনিষ্ঠা আঙ্গুল তাতে রেখে বললো,

“প্রমিস!

ডঃ রাহেলা হেসে উঠেন। নির্ঝর অর্ণবের গাল টেনে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মাথায় এখন শুধু একটাই কথা বাকি অতীত কে বলবে তাকে। হুট করেই একটা নাম এসে ঠেকল তার মাথায়। নির্ঝর নিজের মাথার চুল এলোমেলো করে বলল,

“হুম পেয়ে গেছি।

ডঃ রাহেলা বলে উঠেন,
“হোয়াইট?

“বাকি অতীত যে বলবে তাকে। তবে হ্যাঁ ডঃ রাহেলা অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

ডঃ রাহেলা মুচকি হাসেন। নির্ঝর তাকে বিদায় দিয়ে দরজার কাছে এসেও আবারো ডঃ রাহেলা’র দিকে তাকিয়ে বলল,

“তবে হ্যাঁ ডঃ রাহেলা , আমার দেখা মেয়েদের মধ্যে আপনি একজন যাকে সিগারেট খেলে অনেক সুন্দর লাগে।

ডঃ রাহেলা খানিকটা অবাক হলেন। নির্ঝর দাঁত বের হেসে বলল,

“অবশ্যই একদিন নিজের এক্স হাসবেন্ড’র সামনে এভাবে সিগারেট খাবেন। দেখবেন সে নতুন করে আপনার প্রেমে পড়বে।

ডঃ রাহেলা ভ্রু কুঁচকে বলেন,
“মেয়েদের সাথে ফ্লাটিং করার অভ্যাস এখনো গেলো না তোমার নির্ঝর!

নির্ঝর হেসে বেরিয়ে এলো সেখান থেকে। নির্ঝরের হাসি দেখে অর্ণবও হাসতে লাগলো। নির্ঝর মুখ ফুলালো। অর্ণব ও তার সাথে মুখ ফুলাল। নির্ঝর ফুট করে তা গালে হাত আঙুল রেখে খোঁচা দিল। অর্ণব দাঁত বের করে হেসে দিল।

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here