#অনুভূতিতে_তুমি 💖
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে)
#পর্ব_৪৮
“আমার ঘরে কি করছো তুমি!
কথাটা শুনে চমকে উঠল মেহেরিন। পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখল দরজার ওপাশে দাঁড়ানো নির্ঝর। মেহেরিন ঔষধের পাতা টা রেখে বলল,ঔষধ খেয়েছেন কি না দেখতে এসেছিলাম।
নির্ঝর ঘরে ঢুকল। মেহেরিন এগিয়ে গেল তার কাছে। দুজন মুখোমুখি! মেহেরিন শুকনো ঢোক গিলল। হাসি হাসি মুখে বলল, ওই ঔষধ টা এখন খেয়ে ফেলবেন। আর এই ঔষধ টা ( হাত দিয়ে ইশারা করে ) ঘুমানোর আগে খেয়ে ফেলবেন।
নির্ঝরের কানে মেহেরিন’র কথা আদৌও ঢুকছে বলে মনে হলো না। সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেহেরিন’র চোখের দিকে। তার মনে হচ্ছে এই চোখের ভাষা সে পড়তে পারে। মেহেরিন’র ডাকে চোখ সরিয়ে ফেলল সে। হঠাৎ চোখ গেল মেহেরিন’র গলার কাছে থাকা ক্ষ*তটার দিকে। নির্ঝর অদ্ভুত ভঙিতে গলার দিকে ইশারা করে বলে উঠলো, তোমার এটা এখনো সারে নি।
“সারবে কি? কিছু কি হয়েছে?
“কেন তোমার এটা কি ব্যাথা করছে না।
মেহেরিন হেসে বলল, না করছে না। এসব ব্যাথার অস্তিত্ব নেই আমার কাছে। তবে মজার একটা বিষয় হলো কিন্তু নির্ঝর। আমি যেমনটা করেছিলাম ঠিক তেমনটা ফেরত পেলাম।
“মানে!
মেহেরিন হেসে কাছে এসে দাঁড়াল। বলে উঠল, আমিও এখানেই একজন কে আ*ঘাত করেছিলাম। তাই আমিও সেরকমই পেলাম। কথায় বলে না, মানুষ তার কর্মের ফল ভোগ করে ঠিক তেমন। কিন্তু আপনাকে ভালোবেসে কোন ভুলের মাশুল দিচ্ছি তা বুঝতে পারছি না!
“কাকে আঘা*ত করেছিলে তুমি!
“জানতে চান!
নির্ঝর ভ্রু কুঁচকালো! মেহেরিন তার শার্টের বোতামে হাত দিল। হতভম্ব হয়ে মেহেরিন’র হাত ধরে বাঁধা দিল সে। মেহেরিন হেসে তার হাত সরিয়ে বলল, বিশ্বাস করতেন পারেন। অন্যকিছু করছি না। একটা জিনিস দেখানোর ইচ্ছা আছে আপনাকে।
বলেই শার্টের কয়েকটা বোতাম খুলল। অতঃপর নির্ঝর কে ধরে আয়নার সামনে আনল। শার্ট টা সরিয়ে দিয়ে ঘাড়ের আ*ঘাত টা দেখাতে লাগল। যদিও আঘা*তের অস্তিত্ব জোড়ালো নয় তবুও বোঝা যাচ্ছে এখানে আঘা*ত পেয়েছিল নির্ঝর। হাত বোলালো সেই স্থানে। আয়নায় তাকিয়ে দৃষ্টি তার ঘাড়ের কাছে। কিভাবে এই আঘা*ত লাগল মনে করতে পারছে না নির্ঝর। মেহেরিন হেসে বলল, আমি করেছিলাম আপনাকে আঘা*ত!
“তুমি? কেন?
মেহেরিন এসে দাঁড়াল নির্ঝরের সামনে। কিঞ্চিত হেসে বলল, মনে আছে আপনার সেই দিনের! আপনি আমার ঠিক এতোটা কাছে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। বলতে চেয়েছিলেন কিছু। কিন্তু আমি তা শুনতে অগ্রাহ্য করে কাঁচের টু*করো ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম আপনার এখানে। মনে পড়ে সেই রাতের কথা নির্ঝর। মেহেরিন হাত দিয়ে নির্ঝরের ঘাড় স্পর্শ করে। নির্ঝরের চোখের সামনে ভেসে উঠে কিছু স্মৃতি। চোখ বন্ধ করে নেয় সে। শুধু এতো টুকু মনে পড়ে ব্যাথায় কুঁকড়ে হাটু গেড়ে বসে পড়ে সে। কোন একটা মেয়ে র*ক্ত হাতে দৌড়ে চলে যায়। চোখ মেলে তাকায় নির্ঝর। মেহেরিন কে খুব কাছে দেখতে পায় সে। মুহূর্তেই দূরে সরে যায় সে। অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে। দম নিতে কষ্ট হয় তার। কিছু একটা হয়েছে বলে ভাবতে থাকে সে। মেহেরিন তার কাছে এসে সামলানোর চেষ্টা করে। নির্ঝর মাথায় হাত রেখে চিৎকার করতে থাকে। মেহেরিন বিচলিত হয়ে পড়ে। বলে উঠে, নির্ঝর কষ্ট হচ্ছে আমার, কি হয়েছে বলুন না আমায়। খুব কি কষ্ট হচ্ছে!
নির্ঝর খানিকক্ষণ’র জন্য থেমে যায়। দম নেবার চেষ্টা করে। অতঃপর মেহেরিন’র দিকে ফিরে। মেহেরিন চোখে অশ্রু ভাসমান। নির্ঝর কে দেখেই জড়িয়ে ধরে সে। অশ্রু গড়িয়ে পড়ে তার। মুখ ফুটে বলে, আপনার কোথায় কষ্ট হচ্ছে নির্ঝর, কি কারণে কষ্ট হচ্ছে। ( নির্ঝরের মুখের দিকে ফিরে ) খুব কি কষ্ট হচ্ছে বলুন না!
“জানতে চাও আমার কষ্টের কারণ!
মেহেরিন অশ্রু ভরা চোখে তাকিয়ে থাকে। নির্ঝর এক টানে নিজের থেকে সরিয়ে ফেলে তাকে। খুব জোড়ে তার বাহু চেপে ধরে। ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠে মেহেরিন। নির্ঝর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেহেরিন’র দিকে। দাঁতে দাঁত বলে, তুমি! আমার কষ্টের কারণ একমাত্র তুমি। যতবার তোমাকে দেখি ততোবার এক অচেনা কষ্ট আমার বুকে এসে বাসা বাঁধে। আমাকে খুব কষ্ট দেয় তা। আমি সইতে পারি না সেই কষ্ট।
“নির্ঝর..
“তাই তুমি আর কখনো আসবে না আমার সামনে। আর কখনো না। কখনো আসবে না এই ঘরে। আমাকে সবসময়ের জন্য একলা ছেড়ে দিবে বুঝলে।
“নির্ঝর আমার কথাটা একবার শুনুন!
বলেই নির্ঝরের গালে হাত রাখে। নির্ঝর তার হাতটা সরিয়ে নেয়। অতঃপর হাত ধরে ঘর থেকে বের করে দেয় তাকে। মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেয়। মেহেরিন দরজায় হাত রেখে মেঝেতে বসে পড়ে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে।
দরজা বন্ধ করতে না করতেই বুকের মাঝে অচেনা সেই ব্যাথার আর্বিভাব ঘটে। দরজায় হেলান দিয়ে মেঝেতে বসে পড়ে নির্ঝর। বুকে হাত দিয়ে সেই ব্যাথা কমানোর চেষ্টা করে। এই ব্যাথার কোন ঔষধি নেই তার কাছে।
ছোট অর্ণব পুতুল হাতে দূর থেকে দাঁড়িয়ে থেকে মেহেরিন কে কাঁদতে দেখে। তার ছোট মন বলছে কিছু একটা হয়েছে মাম্মি আর ড্যাডির মাঝে। আচ্ছা ড্যাডি কি বকা দিয়েছে মাম্মি কে। কিন্তু কেন বকা দেবে। আমার ড্যাডি তো খুব ভালো!
দৌড়ে ঘরের ভেতর ঢুকে যায় অর্ণব। আলমারির ভেতর পুতুল হাতে চুপচাপ বসে থাকে সে। খুব ভয় করছে, মন বলছে বড় কিছু হবে। কিন্তু কি?
আজ চতুর্থ দিন, অর্ণব মেহেরিন’র সাথে অফিসে চলে গেছে। নির্ঝর একাই বাড়িতে বসে আছে। বাড়িতে বসে থাকতেও ভালো লাগছে না তার। বাইরে বের হবার উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হলো সে। মেহেরিন’র ঘরের দরজা খোলা দেখে নির্ঝর উঁকি দিল ঘরের মাঝে। কেমন একটা চিরচেনা গন্ধ নাকে এলো তার। ঘরের ভেতর পা রাখল নির্ঝর। পুরো ঘরটা দেখছে সে। হঠাৎ করেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো কিছু। নির্ঝর শক্ত চোখে তাকিয়ে রইল। নিজেকেই তার সামনে দেখছে সে। তার সামনে দিয়েই হেঁটে যাচ্ছে। নির্ঝর তার পিছু পিছু যাচ্ছে।
সে হেঁটে বেলকনির কাছে গেল। নির্ঝর এসে দাঁড়াল সেখানে। ভ্রু কুঁচকে গেল তার। মেহেরিন দাঁড়ানো এখানে। পেছন থেকে তার কোমর জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইল সে। নির্ঝর এগিয়ে গেল এসব ছুঁতে, কিন্তু মুহূর্তেই সবকিছু হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। নির্ঝরের শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে এখন। সে দ্রুত বেরিয়ে এলো সেখান থেকে। ঘরের ভেতর আসতেই মনে হলো পুরো ঘর জুড়ে সে দাঁড়িয়ে আছে। তার মাথা ঘুরছে, অস্থির লাগছে। ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে সে। দাঁড়াতে খুব কষ্ট হচ্ছে। মাথায় অসহ্য যন্ত্রনা। হাঁপিয়ে উঠল নির্ঝর। পড়ে গেল মেঝেতে! অতঃপর আর কিছু মনে নেই তার!
চোখ মেলে তাকাল নির্ঝর! এখনো সেই ঘরের মেঝেতেই সে। ঘরের চারদিক তাকিয়ে ঢোক গিলল সে। মাথায় অসহ্য যন্ত্রনা। দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছে তার , তবু দাঁড়াল সে। দুলতে দুলতে গেল নির্ঝরের দিকে। না আর কখনো আসবে না এই ঘরে। এই ঘরে এলেই তার দম বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম। কেমন এক অদ্ভুত অস্থিরতা, সহ্য হয় না এসব নির্ঝরের। কষ্ট হয় তার!
নিজের ঘরে এসে বিছানায় ধপাস করে শুয়ে পড়ল সে। ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে। শান্ত করার চেষ্টা করছে নিজেকে। কি ছিল এসব। মেহেরিন নামের মেয়েটা যেন তার মাথায় ভর করে আছে। পারছে না তাকে সরাতে। পুরো মাথা জুড়ে এই মেয়েটা। একে ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে ভাবতে পারছে না সে..
সন্ধ্যায় বাসায় ফিরল মেহেরিন। নির্ঝরের এমন অবস্থার মাঝে কিছুতেই অফিস যেতে রাজি ছিল না সে। গুরুত্বপূর্ন ছিল বলেই বের হতে হলো তাকে। অর্ণব কে গাড়ি থেকে নামিয়ে দ্রুত রওনা দিল নির্ঝরের ঘরে। তাকে না দেখা অবদি শান্ত হতে পারছে না সে।
পুরো ঘর জুড়ে অন্ধকার। গোধূলি লগ্নের লাল আভা এসে পড়ছে মেঝেতে। নির্ঝর শুয়ে আছে নিঃশব্দে। দরজার আড়াল থেকে মেহেরিন দাঁড়িয়ে রইল। নির্ঝর কি ঘুমিয়ে আছে না জেগে। দেখতে ইচ্ছে করল খুব। কিন্তু ঘরের মাঝে পা রাখার আগেই তা পিছিয়ে নিল। না ঘরে ঢুকতে দেখলে যদি নির্ঝর রেগে যায়, তাহলে তার মাথার যন্ত্রণা বেড়ে যাবে। কষ্ট পাবে সে, মেহেরিন এটা দেখতে চায় না। নির্ঝরের যখন ভালো লাগবে নিজ থেকেই বের হবে সে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে পিছিয়ে গেল মেহেরিন। অর্ণব দৌড়ে নির্ঝরের ঘরেই আসতে নিল। মেহেরিন তাকেও আটকে দিল।
নির্ঝর ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে ফিরল। ভেবেছিল মেহেরিন বোধহয় আসবে, না সে তো এলো না। কিন্তু গাড়ির আওয়াজ শুনেছে সে। তাহলে তাকে দেখতে কেন এলো না সে। নির্ঝর উঠে দাঁড়াল। অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছিল সে। ঘুম থেকে উঠেও বিছনায় শুয়ে ছিল। দুপুরে কিছু খাওয়া হয় নি তার। শরীর খুব দুর্বল লাগছে তার। ধীরে ধীরে পা বাড়িয়ে দরজার কাছে আসল সে। বাইরে উঁকি দিয়ে দেখল অর্ণব কে নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকছে মেহেরিন। বিষন্নতা আঁকড়ে ধরল তাকে। এ কেমন অদৃশ্য দেওয়াল তৈরি হয়েছে তাদের মাঝে। মনে হচ্ছে পুরো প্রকৃতি অপেক্ষা করছে তাদের বিচ্ছেদের। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারো ঘরের দিকেই হাঁটা ধরল নির্ঝর। হিসেব গুনতে লাগলো। কিন্তু সময় যেন ওই এক জায়গায় আটকে আছে। বুকের মাঝে তীব্র যন্ত্রণা! এসব কিছুর উপসর্গ কে? মেহেরিন! কিন্তু কেন?
—–
পঞ্চম দিন…
ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে আছে। সময় যত’ই পেরিয়ে ততোই নির্ঝর কে হারানোর ব্যাথা আঁকড়ে ধরছে তাকে। কি করবে সে, কিছুই বুঝতে পারছে না। নির্ঝর বাড়িতে নেই, বাইরে গেছে অনেকক্ষণ! সেই সকালেই বের হয়েছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলল। নির্ঝরের ফোনের নাম্বার টাও নেই। নাহলে কল করা যেত। অর্ণব নেই বাড়িতে, মা এসে নিয়ে গেছে। তাকেও যেতে বলেছিল কিন্তু মেহেরিন যায় নি। চেয়েছিল তাদের সবাই আজ রাতের খাবার তাদের বাড়িতেই খেতে। কিন্তু নির্ঝরের হুদিস পাওয়া গেল না। মেহেরিন বলে দিল নির্ঝর কে নিয়েই আসবে সে। শব্দ করে শ্বাস ফেলল, মুখের কথা কাজে প্রমাণ করা সহজ নয়। ফোন হাতে নিয়ে কল করল ফরহাদ কে। হয়তো সে জানবে নির্ঝরের খবর।
ফরহাদের সাথে কথা বলার পর হতাশ হয়ে উঠে দাঁড়াল মেহেরিন। সেও জানে না নির্ঝরের খবর। তবে আশ্বাস দিল, তাকে দ্রুত’ই বাসায় পাঠাবে সে। নির্ঝরের খাটেই বসে ছিল এতোক্ষণ। উঠে দাঁড়িয়ে দেওয়ালে টাঙানো ছবি গুলো দেখতে লাগল। স্মৃতি যত আঁকড়ে থাকে ততোই তা মানুষকে কষ্ট দেয়। কিন্তু এসব স্মৃতি কি করে ভুলে যাবে সে। নির্ঝরের সাথে কাটানো এক একটা মূহুর্তে অতি মূল্যবান তার কাছে। ল্যাম্পশেডের পাশে ঔষুধ গুলো পড়ে আছে। নির্ঝরের ঔষধ খাওয়া হয় নি, কে জানে কেমন আছে। ঔষধ গুলো খুব দরকারি ছিল।
বাইরে গাড়ির আওয়াজ পাওয়া গেল। মেহেরিন দ্রুত ঘর থেকে বের হলো। বাইরে বাজ পড়ার আওয়াজ। আজ বৃষ্টি হবে, বোধহয়। মেহেরিন’র খুব ইচ্ছে করছে নির্ঝরের সাথে বৃষ্টিতে ভিজতে।
আজ সারাদিন অনামিকার খোঁজ করেছিল নির্ঝর। না তার আগের বাসায় পায় নি তাকে। কিছুদিন ধরে কেউই নাকি দেখে নি তাকে। ফোনের নাম্বার টাও জোগাড় করতে পারি নি। বিরক্তি চেপে ধরছে তাকে। রেগে গাড়ি থেকে বের হতে নিবে এই সময় ফরহাদের ফোন। ফোন রিসিভ করে গাড়ি থেকে বের হলো নির্ঝর।
“বল?
“কোথায় তুই!
“বাড়িতে!
“কোন বাড়িতে..
“যেই বাড়িতে রেখে গেছিস সেখানেই!
“কখন এলি, সারাদিন কোথায় ছিলি। মেহেরিন তো তোর চিন্তায় অস্থির। খানিকক্ষণ আগেও আমাকে কল করে বলল তোর খবর নিতে। আচ্ছা নির্ঝর কি শুরু করেছিস তুই একটু বলবি। এটা কেমন আচরণ তোর।
কথা বলেই যাচ্ছে ফরহাদ। নির্ঝরের চোখ দরজার সামনের দিকে। মেহেরিন দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। কোন কথাই ছাড়া ফরহাদের কল কেটে দিল নির্ঝর। ঠান্ডা বাতাস বয়ে আছে। প্রকৃতি বলে দিচ্ছে বৃষ্টির আগ মুহূর্তে এটা। এই বোধহয় বৃষ্টি নামবে। মেহেরিন হেঁটে বাইরে আসতেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নামল। মেহেরিন এগিয়ে নির্ঝরের যত কাছে আসছে ততোই বোধহয় বৃষ্টির গতি বাড়ছে। নির্ঝর উপরের আকাশের দিকে তাকাল। মেহেরিন এখন তার একদম কাছে। মেঘে পুরো আকাশ ঢাকা পড়ে গেছে , তবুও বৃষ্টিতে ভিজা মেহেরিন’র মুখখানি দেখতে পারছে সে। মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছে এখনই কেঁদে দেবে। গলার ভারী স্বর তাই’ই প্রমাণ করে দিল।
“কোথায় ছিলেন সারাদিন। ঔষধ ঠিক মতো খাচ্ছেন না কেন আপনি?
নির্ঝর চোয়াল শক্ত করল। ধার ধার কন্ঠে বলল, তোমাকে এসব নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।
বলেই চলে যেতে নিল। মেহেরিন চেঁচিয়ে বলল, তাহলে কে করবে। ওই অনামিকা!
নির্ঝর দাঁড়িয়ে গেল। পেছন ফিরে বলল, হ্যাঁ তো। আর তো কয়েকটা দিন। তারপর অনামিকার সাথেই থাকবো আমি। আর তুমি আমার উপর নজর রাখছো।
“না রাখছি না , ফরহাদ বলেছে আপনি অনামিকা কে খুঁজছেন। কেন খুঁজছেন তাকে নির্ঝর, কি চান আপনি? কেন করছেন এমনটা?
“আমি শুধু রেহাই পেতে চাই তোমার থেকে। সহ্য হচ্ছে না আমার কিছু। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বার বার।
মেহেরিন আবারো কাছে এসে দাঁড়াল। মেয়েটা এবার সত্যিই কাঁদছে। “সত্যি কি তাই! আমার থেকে রেহাই পেতে চান আপনি। কেন? তাহলে কেন এসে বলেছিলেন আমাকে ভালোবাসেন আপনি। আমি তো বলেছিলাম আমি আপনাকে ভালোবাসি না। তারপরও আমাকে জোর করেছেন আপনি। কেন করলেন এমনটা। কেন আমাকে এতোটা দুর্বল করে দিলেন নিজের প্রতি। কেন কথা দিয়েছিলেন আমাকে ছেড়ে কখনো যাবেন না। বলুন? কেন বলেছিলেন? কথা বলছেন কেন? এখন এভাবে দাঁড়িয়ে কি দেখছেন আপনি। কথা বলুন!
“আমার কিছু মনে নেই!
“তাহলে মনে করুন না! মনে করুন। ( নির্ঝরের গালে দু”হাত মেহেরিন। বিষণ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তার দিকে। ) মনে করার চেষ্টা করুন। আপনার, আমার পুরনো দিনের কথা। আমাদের পুরোনো স্মৃতি!
নিজের সাথে নির্ঝরের মাথা ঠেকাল মেহেরিন। ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে মেহেরিন। বলে উঠল, মনে করুন নির্ঝর আমাদের ভালোবাসার কথা। আমাকে জড়িয়ে ধরিয়ে বলেছিলেন আপনি আমায় ভালোবাসেন। এসব কি করে মিথ্যে হয় নির্ঝর। বলেছিলেন তো আমি শুধু আপনার মেহু। একবার মেহু বলে ডাকুন আমায়।
নির্ঝর শুকনো ঢোক গিলল। মেহেরিন তার দিকেই তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টি মেহেরিন’র ওষ্ঠজোড়ার দিকে। ঠোঁট জোড়া কাঁপছে মেহেরিন’র। মেহেরিন এগিয়ে এসে চুমু খেল নির্ঝরের ঠোঁট। চোখ বন্ধ করে নিল নির্ঝর। মেহেরিন নির্ঝরের গলা জড়িয়ে ধরল। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল, অনুভব করুন নির্ঝর। আপনার অনুভুতিতে আমি ছিলাম। সেখানে শুধু মাত্র আমার বাস ছিল। আপনি কখনো পারেন না তা অন্য কাউকে দিতে কখনো না।
বৃষ্টিতে ভিজছে দুজন। নির্ঝর চোখ মেলে তাকাল। বলে উঠল, কোন অনুভূতি নেই মেহেরিন।
মেহেরিন থমকে গেল। হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল নির্ঝরের দিকে। নির্ঝর তার গলা ছাড়িয়ে দূরে সরে গেল। আবারো বলল, তুমি নেই আমার অনুভূতিতে, আমার কোন কিছুতে তোমার অস্তিত্ব। নেই তুমি আমার মাঝে। আমি অনুভব করতে পারছি না তোমায়!
“নির্ঝর…
আর দাঁড়াল না নির্ঝর। ছুটে চলে এলো সেখান থেকে। মেহেরিন এই বৃষ্টির মাঝেই মেঝেতে বসে পড়ল। তার চোখের অশ্রু মিশে যাচ্ছিল কান্নায়। ঘরে ঢোকার পর মনে হলো নির্ঝর প্রাণ ফিরে পাচ্ছে। সে মিথ্যে বলছিল। তার অনুভূতিতে কেউ আছে। কেউ আছে তার অস্তিত্ব জুড়ে। গতকাল স্বপ্নে তাকে দেখেছে নির্ঝর। তবে তার মুখটাই দেখতে পারে নি সে। নির্ঝরের ধারণা সেই স্বপ্নের মেয়েটাই তার অনুভূতি। তবে সেটা মেহেরিন নয়। মেহেরিন হতে পারে না। অন্যকেউ! হ্যাঁ এটা অন্যকেউ!
নীলিমা এই বৃষ্টির মাঝে অপেক্ষা করছে মেহেরিন আর নির্ঝরের। তার ধারণা ছিল তারা আসবে না। তবুও আশা বেঁধেছিল। তবে মনে হচ্ছে ধারণা টাই সত্যি হয়েছে। অর্ণব সোফায় গুটিসুটি মেরে বসে আছে। খেয়াল করছে বাচ্চা টা আগের মতো আর হেসে হেসে কথা বলে না। দুষ্টুমি করে না। কেমন শান্ত হয়েই থাকে। আবারো কি তাহলে আগের মতো হয়ে যাচ্ছে। রিদুয়ান সাহেব অর্ণব কে কোলে করে অনেক গল্প করলেন। নিজের হাতে খাইয়ে দিলেন। এমনকি রাতে নিজের সাথে ঘুমানোর জন্য তার ঘরে নিয়ে গেলেন।
অপেক্ষার প্রহর কাটিয়ে নীলিমা ঢুকল রিদুয়ানের ঘরে। রিদুয়ানের কোলেই অর্ণব ঘুমিয়ে পড়েছে। নীলিমা বিছানার পাশে বসে বলে, ছেলে মেয়ে গুলো এলো না।
“থাক মন খারাপ করো না।
“মন করছি না গো, চিন্তা হচ্ছে। কি হবে ওদের? ওদের দুজনের জন্য তো বেচারা অর্ণব কষ্ট পাচ্ছে
“জানি না, অপেক্ষা করো। দেখো ভাগ্য কি বলে!
“ভাগ্যের আশায় বসে থাকতে পারছি না আমি। যদি ভাগ্য খারাপ কিছু রাখে তখন। না আমি আর ভাবতে পারছি না। ওরা তো ওরাই কিন্তু অর্ণব। এতো কষ্ট করে একটু স্বাভাবিক হচ্ছিল বাচ্চা টা আর এখন।
“কি করবে বলো!
“কিছু জানতে চাই না। তুমি মেহেরিন কে কল করে বলে দাও অর্ণব আমার কাছেই থাকবে। আপাতত যতদিন ওদের মাঝে কিছু ঠিক না ততোদিন এখানেই থাকবে।
“তুমি কাঁদছো?
“কি করবো তাহলে, আমার ছেলে মেয়ে কেউই ভালো নেই। কি হচ্ছে এসব। কার দোষ দেবো আমি। তুমিই বলো।
“শান্ত হও, কেঁদো না।
“সবকিছু তো ঠিক’ই ছিল। একটা সাজানো সংসার এভাবে ভেঙে গেল।
“নীলিমা!
“ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল নীলিমা। বলে উঠল, কিছু ঠিক নেই গো, কিছু ঠিক নেই!
এই বিলাপের কোন জবাব দিতে পারল না রিদুয়ান চৌধুরী। শুধু অর্ণবের মাথায় হাত বোলাতে লাগল সে।
#চলবে….