অন্তহীন💜 সূচনা পর্ব

0
5783

১৫ বছরের একটা মেয়েকে বিয়ে করার মতো এত নিচু মন মানসিকতার মানুষ আমি না আব্বু।

তোমার মন মানসিকতা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। বিকেলে মায়ের সাথে গিয়ে মেয়েটাকে দেখে আসবা।আর একটা কথা মাথায় ঢুকিয়ে নাও।ঐ মেয়েকেই বিয়ে করতে হবে তোমার।
কথা গুলো বলেই প্রহনের রুম থেকে বের হয়ে যান রেদোয়ান চৌধুরী।

প্রহনের রাগে গা কাঁপছে।রাগে ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখা কাঁচের ফুলদানিটা ছুঁড়ে মারে ফ্লোরে। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,,,

একজন আর্মির ক্যাপ্টেন হয়ে এই আমি কিনা বিয়ে করবো ক্লাস 9 এ পড়া একটা মেয়েকে?
তোমাদের মাথা ঠিক আছে তো?

মিসেস ইয়াসমিন এতক্ষণ বিছানায় বসে ছিলেন।বসা থেকে উঠে প্রহনের কাছে এগিয়ে গিয়ে প্রহনের কাঁধে হাত রেখে বললেন,,

তোমার আব্বু যখন বলেছে তখন তোমাকে বিয়েটা করতেই হবে প্রহন।

আব্বু বললেই করতে হবে নাকি?লাইফটা আমার। আমি কাকে বিয়ে করবো না করবো তার সিদ্ধান্ত আমি নিবো।

মিসেস ইয়াসমিন মুচকি হেসে বললো,
জীবন টা তোমার হলেও, তোমার জীবনের সাথে জড়িত আছে আমাদের জীবন ও। ভুলে যেও না তোমার আব্বু একজন হার্টের পেশেন্ট।

তাই বলে আমি,,,,

আর একটা ও কথা না প্রহন। তোমার আব্বু যেটা একবার ঠিক করে ফেলেছে তা আর বেঠিক হবে না। তোমার আব্বু কথা দিয়ে দিয়েছেন। বিকেলে আমার সাথে গিয়ে দেখে এসো তোমার হবু বউ কে।

আমার দেখার দরকার নেই। বিয়ে যখন করতেই হবে ওকে ডান। আমি বিয়ে করবো কিন্তু আমি মেয়েটাকে দেখার প্রয়োজন বোধ করি না।

তোমার যেমন ইচ্ছে। পছন্দ হলেও বিয়ে করতে হবে আর না হলেও বিয়ে করতে হবে।
মুচকি হেসে কথা গুলো বলে মিসেস ইয়াসমিন ও রুম থেকে বের হয়ে চলে গেলেন।

রাগে দুঃখে প্রহন বিছানায় বসে দুই হাত দিয়ে মাথার চুল গুলো টেনে ধরলো।বিড় বিড় করে বললো,,
নিজের মা বাবাই আজ অপরিচিতদের মতো বিহেব করছে।
.
সরদার বাড়ির এক মাত্র মেয়ে চৈতি।বড় দুই ছেলের পর এই মেয়েই যেনো সরদার সাহেবের চোখের মণি। মেয়েটা দেখতে বেশ সুন্দরী।চুল গুলো ও চোখে পড়ার মতো। সরদার সাহেবের টাকা পয়সার অভাব নেই। একমাত্র মেয়ে কে রাজকুমারী করে রাখার মতো সাধ্য উনার আছে।
কিন্তু বেশ কয়েক মাস আগে থেকেই গ্রামের বখাটে যুবকদের নেতা রিফাতের চোখ পড়ে চৈতির উপর।
স্কুল থেকে আসার সময় কত বাজে উক্তি শুনতে হয় চৈতির।রিফাতের জন্য বাইরে বের হওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে চৈতির।

এই রিফাতের নামে এমন কোনো কথা নেই যা সরদার সাহেবের কানে আসে না।এই তো মাস খানেক আগের কথা,
গ্রামের সাধারণ কৃষক সফিক মিয়ার মেয়ে কে ধর্ষণ করেছে।
পুলিশে খবর দিয়েও কোনো লাভ হয়নি। পুলিশ কিচ্ছু করেনি এই রিফাতের।বরং বুক ফুলিয়ে চলা ফেরা করছে সবার চোখের সামনে।
শেষ পর্যন্ত সফিক মিয়ার মেয়ের কী হয়েছিল জানেন?
লজ্জায়, ঘৃণায়,কষ্টে বড় গাছের ডালে ফাঁস খেয়ে দুনিয়ার বুক থেকে বিদায় নিয়েছে।অথচ এই রিফাতের কিছুই হয়নি।

আরাম কেদারায় বসে বসে এই সব কথাই ভাবছেন সরদার সাহেব। সন্ধ্যা হবার সময় ঘনিয়ে আসছে। প্রকৃতি তার তিমির রুপ ধারণ করে নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এক কাপ চা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন জুনাইদা সরদার। স্বামীর চিন্তিত মুখের দিকে তাকাতেই চিন্তারা এসে ভীড় জমায় জুনাইদার মুখে।

“আপনার চা।”
জুনাইদার কন্ঠ শুনে ভাবনার ঘোর থেকে বেড়িয়ে আসেন সরদার সাহেব। অর্ধাঙ্গিনীর হাত থেকে চায়ের কাপ টা নিয়ে তাতে চুমুক দেন।

জুনাইদা চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে সরদার সাহেব থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
-“চৈতি কোথায়? দেখছি না যে!এই সময় তো আমার কাছে এসে ঘুর ঘুর করে।”

-“আপনার মেয়ে তো চুপটি করে বসে থাকার মেয়ে না। হরিণীর মতো লাফিয়ে বেড়াচ্ছে।”

-“এই অবেলায়?”মেয়েকে একটু চোখে চোখে রাখো।বড্ড দুশ্চিন্তা হয়।”
জুনাইদা আর কথা বাড়ালেন না।দ্রুত হেঁটে চলে গেলেন।
বাড়ির পেছনের বাগানের পেয়ারা গাছে এই বার বেশ ডাগড় ডাগড় পেয়ারা ধরেছে। সরদার সাহেবের রুম থেকে বের হয়ে চৈতি কে সারা বাড়ি খুঁজে ও পেলেন না জুনাইদা।
এই মেয়ে চুপটি করে বসে থাকার মেয়ে নয়। প্রচন্ড চঞ্চল। সারাদিন চঞ্চলা হরিণীর নেয় লাফালাফি করেই বেড়ায়।জুনাইদা হাক ছাড়লো,
‘চৈতি’

চৈতির কোনো সাড়া পেলেন না। বাগানের দিকে চলে গেলেন তিনি। উচ্চ স্বরে বার কয়েক ডাক দিলেন চৈতি কে।
পেয়ারা গাছের ডালে বসে নিচে দাঁড়িয়ে থাকা মায়ের দিকে তাকিয়ে মুখে হাত চাপা দিয়ে হাসছে চৈতি।এই দিকে জুনাইদা মেয়েকে কোথাও দেখতে না পেয়ে ভেতরে ভেতরে ভয় পেয়ে বসেছেন।

আশেপাশে তাকাতে তাকাতেই জুনাইদার চোখ পড়লো পেয়ারা গাছের উঁচু ডালটায় যেখানে পা ঝুলিয়ে বসে বসে পেয়ারায় কামড় বসাচ্ছে চৈতি।

এই অসময়ে তুই এই পেয়ারা গাছের ডালে কি করিস চৈতি? নেমে আয় জলদি।
তোর আব্বু তোকে খুঁজছেন।

বাবার কথা শুনেই ঢোক গিললো চৈতি।চট জলদি গাছ থেকে নেমে মায়ের হাতে কয়েকটা পেয়ারা ধরিয়ে দিয়ে ছুটে বাবার রুমে চলে গেল।

সরদার সাহেব তখনও আরাম কেদারায় বসে বাইরের সবুজের সমারোহ প্রকৃতিকে দেখায় ব্যস্ত।

বাড়ির সবার সামনে লাফালাফি করলেও বাবার সামনে ভেজা বেড়াল ছানার মতো চুপসে যায় চৈতি।

নিজের পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে ডান পাশে তাকান সরদার সাহেব। চৈতি দাঁড়িয়ে আছে। চৈতি কে দেখে মুচকি হেসে বললেন,,

-“আম্মা, কোথায় ছিলি এত সময়?”
-“বাগানে। পেয়ারা খেতে মন চাইছিল তাই।”
-“গাছে উঠে ছিলি?”
“হুম”

সরদার সাহেব আর কিছু না বলে চৈতির ডান হাতটা ধরে উনার সামনে রাখা মোড়ায় বসিয়ে দিলেন। চৈতি প্রশ্ন চোখে বাবার দিকে তাকালো।

সরদার সাহেব মেয়ের দিকে কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে রইলেন।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করলেন,

“আব্বু কে ছেড়ে থাকতে তোর কষ্ট হবে না আম্মা?”
চৈতি অবাক চোখে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
আমি তো তোমাদের ছেড়ে কোথাও যাবো না আব্বু।
আর গেলে তো তোমাদের সাথেই যাবো।

সরদার সাহেব কি বলবেন কিছু বুঝতে পারছেন না। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা জুনাইদা শাড়ির আঁচলে নিজের ভেজা চোখ মুছে চলে গেলেন।

সরদার সাহেব মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বুকের ভেতর। কিছু দিন পরেই হয় তো এই বুক শূন্য করে দিয়ে তার একমাত্র আদরের মেয়ে চলে যাবে অন্য কারো বাড়িতে।
.
.
এক কাপ কফি হাতে নিয়ে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে রাতের শহর দেখছে প্রহন। বুকের ভেতর অস্থিরতা বিরাজমান।বাবা মায়ের হুট করেই এমন একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার মানেটা কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছে না তার।
সপ্তাহের ছুটিতে বাড়ি এসেছে প্রহন। একদিন তো পেরিয়েই গেলো।বাকি রইলো আর মাত্র ছয় দিন। কোনো ভাবে যদি এই ছয় দিন মা বাবাকে মানানো যেতো তাহলে সেনানিবাসে গেলে আর তিন চার বছরেও ফিরতো না সে।

একজন আর্মি ক্যাপ্টেন হয়ে বাল্য বিবাহ করার মতো নিচু একটা কাজ কে সমর্থন করতে মন মানছে না প্রহনের।
রাত কম হয়নি। দেয়াল ঘড়িটা টুং টুং আওয়াজ করে জানান দিচ্ছে সে ১২র ঘরে এসে পৌঁছে গেছে।

প্রহন বেলকনি থেকে রুমে আসলো।মা বাবার উপর জেদ করে রাতের খাবার টাও খায়নি।

শুধু মাত্র বাবা একজন হার্টের পেশেন্ট বলেই সব কিছু সহ্য করে নেওয়ার চেষ্টা করছে প্রহন।না হলে আজকেই আবার সেনানিবাসে ফিরে যেতো।
.
.
বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে চৈতি। ঘুমের মাঝেও মেয়েটা বড্ড চটপটে।শান্ত হয়ে কোনো কাজ করা এই মেয়ের পক্ষে হয়তো সম্ভব না।

সরদার সাহেবের পাশেই ঘুমিয়ে আছেন জুনাইদা। কিন্তু সরদার সাহেব দুচোখ এক করতে পারছেন না। শোয়া থেকে উঠে তিনি চলে গেলেন মেয়ের রুমে।
পুরো বিছানা দখল করে ঘুমিয়ে আছে চৈতি। সরদার সাহেব মেয়ের মাথার কাছে বসলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কপালে চুমু খেলেন। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,,

“আমাকে ক্ষমা করিস আম্মা। আব্বু যা করছে তোর ভালোর জন্যই করছে।”
.
.
সকাল থেকে আত্মীয় স্বজনের আগমন ঘটছে প্রহনদের বাড়িতে। আত্মীয় স্বজন বলতে প্রহনের ফুফুরা আর মামা মামিরা।ঘটা করে এখন কিছুই করতে চাচ্ছেন না রেদোয়ান চৌধুরী।
সূর্যের সোনালী আভা জানালার কাছ ভেদ করে প্রহনের চোখে মুখে পড়তেই ভ্রু কুঁচকে গেলো তার। সেই ভোরে উঠে নামাজ পড়ে আবার ঘুমিয়ে ছিল প্রহন। সেই আরামের ঘুম টা সূর্য মামা ভেঙ্গে দিলো। দুই হাত দিয়ে চোখ কচলাতে কচলাতে শোয়া থেকে উঠে বসে প্রহন। বালিশের কাছ থেকে মোবাইল টা হাতে নিয়ে দেখে বেলা দশটা।
.
.
নয়টার দিকে স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে ছিল চৈতি। পরিবারের সবাই বারন করে দিয়েছে আজ স্কুলে যেতে। চৈতি তো মহা খুশি আজ স্কুলে যেতে হবে না বলে।আর রাস্তায় ঐ রিফাতের কূট উক্তির সম্মুখীন হতে হবে না।

বড় ভাবী চৈতির রুমে এসে বিছানার উপর একটা জামদানী হলুদ রঙের শাড়ি রাখলেন। সাথে প্রয়োজনীয় গয়না।শাড়ি দেখে ভ্রু কুঁচকে গেলো চৈতির।
কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞাস করে ফেললো,,
শাড়ি চুড়ি কিসের জন্য ভাবী?

রুপা কিছু বলতে যাবে তখনই জুনাইদা রুপা কে ডেকে বললেন,
বড় বউ,এই দিকে আসো। চৈতির সব প্রশ্নের উত্তর সে পেয়ে যাবে।

মায়ের এমন কথার আগা মাথা কিছুই বুঝলো না চৈতি। কিন্তু এটা খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে আজ কিছু একটা ঘটবে।

চলবে,,,,

#অন্তহীন💜
#সূচনা_পর্ব
#স্নিগ্ধা_আফরিন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here