#অন্তহীন💜
#পর্ব_৭+৮
#স্নিগ্ধা_আফরিন
ঘরোয়া ভাবে বউ ভাতের আয়োজন করা হয়েছে প্রহনদের বাড়িতে। বিয়েতে উপস্থিত থাকা আত্মীয়স্বজন আর চৈতিদের বাড়ির লোকজন নিয়েই বউ ভাতের পর্ব চুকাতে চান রেদোয়ান চৌধুরী।কম হলেও ৪০ জন মানুষের খাবার রান্না করতে হবে। ছাদের এক কোনায় রান্নার আয়োজন করা হয়েছে। বাবুর্চিদের কাজের তদারকি করছেন রেদোয়ান চৌধুরী এবং প্রহনের মামারা।
কাজিন রা সবাই গেস্ট রুমে বসে আড্ডায় মেতে উঠেছে। তাদের হাসির শব্দে মেতে আছে চৌধুরী বাড়ি।
সেই কখন থেকে প্রহনের ঘাড়ে মালিশ করে যাচ্ছে চৈতি। প্রহন চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে।
“পিচ্চি,মালিশ করছো না কী হাত বুলিয়ে দিচ্ছো বুঝতে পারছি না।”
“এর চেয়ে জোরে মালিশ করতে আমি পারি না।”
শোয়া থেকে উঠে বসলো প্রহন। চৈতির মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“অনেক ধন্যবাদ বাচ্চা।আর প্রয়োজন নেই।”
দরজায় টোকা পড়লো। প্রহন দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলো, মিসেস ইয়াসমিন হাতে শাড়ি গয়না নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
“আসো আম্মু।”
মিসেস ইয়াসমিন মুচকি হেসে ভেতরে প্রবেশ করে বিছানার উপর হাতের জিনিস গুলো রাখলেন। তার পর প্রহনের উদ্দেশ্যে বললেন,
“এখন রুম থেকে যাও। আমি আমার মেয়েকে বউ ভাতের জন্য সাজিয়ে দিবো।”
“বাহ তোমার মেয়ে হয়ে গেলো?”
“হুম।ও তো আমার মেয়ে। এখন যাও তুমি।”
বিছানা থেকে নেমে রুম থেকে বেরিয়ে গেল প্রহন। মিসেস ইয়াসমিন রুমের দরজা বন্ধ করে চৈতির দিকে এগিয়ে গেলেন। চৈতির হাতের মুঠোয় মলম দেখে জিজ্ঞেস করলেন,
“হাতে মলম কেন?কী হয়েছে?”
“উনার ঘাড়ে ব্যথা করছিল।তাই মালিশ করে দিয়েছি।”
চৈতির কথা শুনে মুচকি হাসলেন মিসেস ইয়াসমিন। চৈতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
“স্বামী সোহাগী হয়ে থাকিস।”
“এখন যা তো, ব্লাউজ, পেটিকোট টা পড়ে আয়। আমি সুন্দর করে শাড়ি পড়িয়ে সাজিয়ে দিবো।”
মিসেস ইয়াসমিন এর কথা বুঝতে না পেরে চৈতি কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করে বসলো,
“সাজতে হবে কেন? আমার শাড়ি পড়তে যে ভালো লাগে না। সামলাতে পারি না।”
“আজ যে তোর বউ ভাত মা।আর বউ ভাতের অনুষ্ঠানে সুন্দর করে শাড়ি পড়ে সাজুগুজু করতে হয়। আজকের পর থেকে তোর ইচ্ছে না করলে আর কখনো শাড়ি পড়তে আমি বলবো না।”
চৈতি অবাক নয়নে চেয়ে আছে মিসেস ইয়াসমিন এর দিকে। তার মা ও তাকে এই ভাবে বুঝতে পারেন না তার জানা মতে। আবার পরক্ষনেই মনে হয়,
হয় তো বুঝতে পারে। শুধু প্রকাশ করেন না।
.
মিসেস ইয়াসমিন খুব সুন্দর করে শাড়ি পড়িয়ে দিলেন চৈতি কে।চুল আঁচড়ে খোঁপা করে দিলেন। চোখে গাঢ় করে কাজল টেনে দিলেন।ফর্সা হাতে সোভা পেলো ঝকঝকে কয়েক খানা স্বর্নের চুড়ি। গলায় হার, কানে দুল।অধর জুড়ে গোলাপি লিপস্টিক।
সাজানো শেষে চৈতির দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন মিসেস ইয়াসমিন।
হঠাৎ কী মনে করে চৈতির ডান হাতের কনিষ্ঠা আঙ্গুলে আলতো করে কামড় দিয়ে বললেন,
“কারো নজর না লাগুক।”
“তোমাদের সাজগোজ কী শেষ হয়নি আম্মু? আমি কী আজ গোসল করবো না নাকি?”
মিসেস ইয়াসমিন দরজা খুলে দিলেন।
“আমার কাজ ও শেষ। তুই আসলি ও সঠিক সময়ে।আয় ভেতরে আয়। আমি যাই এখনো অনেক কাজ বাকি আছে।”প্রহন কে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন মিসেস ইয়াসমিন।
এই সাজগোজ নিয়ে প্রহনের সামনে যেতে কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছে চৈতির। প্রহনের কন্ঠস্বর শুনেই সে বেলকনিতে গিয়ে নিজেকে আড়াল করে রাখার চেষ্টায় মরিয়া হয়ে ওঠে।
রুমের ভেতর এসে চৈতি কে দেখতে না পেয়ে প্রহন বার কয়েক ডাক দেয়।
“পিচ্চি কোথায় তুমি?”
প্রহনের ডাক চৈতির শ্রবণেন্দ্রিয়তে পৌঁছালেও জবাব দেয় না সে। বুকের ভেতর কেমন দ্রিম দ্রিম করছে।
অবাক হলো প্রহন।”রুমের ভেতর থেকে আবার কোথায় গায়েব হয়ে গেল?কী আশ্চর্য!”
পরক্ষনেই মনে হলো,হয়তো ওয়াস রুমে গেছে।
প্রহন বেলকনির উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। তোয়ালে রাখা আছে সেখানে।ওটা আনার জন্যই মূলত বেলকনিতে যেতে হবে তাকে। বেলকনিতে আসতেই আঁখি জোড়া আটকে গেল নীল শাড়ি পড়া নবীনা কিশোরীকে দেখে।
মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে এলো,
“মাশাআল্লাহ।”
চৈতির লাজুকতা আরো কয়েক দফা বেড়ে গেলো।যার জন্য নিজেকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছিল শেষ পর্যন্ত তার সামনেই পড়তে হলো।
লজ্জায় আনন জুড়ে ছেয়ে গেলো লাল আভা।গাল লাল হলো।নাক লাল হলো।কান অব্দি লাল হয়ে গেল। পায়ের নখ দিয়ে ফ্লোর খামচে ধরার ব্যর্থ চেষ্টায় মেতে উঠলো।
প্রহন দেখলো, খুব কাছ থেকেই দেখলো, তার নবীনা কিশোরী বউয়ের লাজুকতায় ছেয়ে যাওয়া বদন খানি।
এক পা এক পা করে চৈতির দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো প্রহন। চৈতি চোখ মুখ খিঁচে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।কোমরে আলতো স্পর্শে কেঁপে উঠলো সে। বরফের নেয় শীতল হয়ে গেল শরীর। লজ্জাবতী কিশোরী বউয়ের লাজুকতা আরো কয়েক ধাপ বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য চৈতির কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
“লজ্জাময়ী এতো লজ্জা পাওয়ার কারণ কী?সেজে গুজে হাসব্যান্ড এর সামনে যেতে এত লজ্জা?”
প্রহনের নিঃশ্বাস ঘাড়ের উপর পড়তে শরীর জুড়ে ঝংকার দিয়ে উঠলো। লজ্জাবতী গাছের মতো একে বারে নুয়ে পড়লো কীশোরি।
চৈতির কোমর ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে এলো প্রহন।
তোয়ালে নিয়ে চলে যেতে বললো,
“এতো লজ্জা পাওয়ার কিছু নাই। তোমাকে এত সুন্দর লাগছে না বুঝছো পিচ্চি। রুপকথার গল্পের সেই শেওড়া গাছের পেত্নির মতো লাগছে। তোমাকে আমি এখন থেকে পিচ্চি পেত্নি বলেই ডাকবো।”
হৃদপিন্ডের গতি কমলো না চৈতির। কিছুক্ষণ আগের কথা মনে পড়তেই আরো কয়েক গুণ বেড়ে যাচ্ছে।
____________
পুরো এক দিন পর কলিজার টুকরো মেয়েকে দেখে অশান্ত হৃদয় শান্ত হলো সরদার সাহেবের। বাবার আদরের রাজকন্যা যে চৈতি। সেই আদুরে কন্যা কে ছেড়ে থাকতে বাবার তো কষ্ট হবেই।
অতিপ্রিয় মানুষ টাকে দেখে অভিমানরা উবে গেল চৈতির মনের কোণ থেকে। সরদার সাহেব পরম মমতায় বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরলেন মেয়েকে।
কপালে চুমু খেয়ে আদুরে গলায় শুধালেন,
“ভালো আছিস আম্মা?”
কান্না আটকে রেখে ধরা গলায় ছোট্ট করে জবাব দিলো,”হুম”
বাবার কাছ থেকে সরে এসে মায়ের কাছে যায় চৈতি।পরম মমতায় জুনাইদা ও মেয়েকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরলেন।
রুপা,সিফা, সজিব, সাদিক সবার সাথে কুশল বিনিময় করে আবারো বাবার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। রেদোয়ান চৌধুরী এক রাশ মুগ্ধতা নিয়ে চেয়ে আছেন বাবা মেয়ের সংলাপ।
মেয়েটা এখনো তাকে একটা বাবারে জন্য বাবা বলে ডাকলো না। গোপনে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে সরদার সাহেবের সাথে আলাপ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
চৈতির সাথে মেচিং করে নীল রঙের পাঞ্জাবি গায়ে দিয়েছে প্রহন।ক্যান্টনমেন্টে থাকলে সব সময় ক্লিন শেভ করা লাগতো।গাল ভর্তি দাড়ি তার পছন্দের তালিকায় পড়ে না। কয়েক দিন শেভ না করায় খোঁচা খোঁচা দাড়ি তে বেশ মানিয়েছে তাকে।ফর্সা লোমশ হাতে ব্রান্ডের কালো রঙের ঘড়িটা বেশ মানিয়েছে।
সরদার সাহেব সহ সবাই কে সালাম জানালো প্রহন। উনাদের রেস্ট করতে বলে আবারও রুমে ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো।রুপা আর সিফা চৈতিকে ঘিরে ধরলো। দুইজনের মাঝখানে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“চৈতি আমাদের ননদাই কী দিয়েছে বললে না তো?”
“কিছু দেয়নি ভাবি।”
চৈতির উত্তর শুনে সিফা বলে উঠলো,
“তাহলে হাতে গলায় স্বর্নের গয়না গুলো কে দিয়েছে?”
“ভালো মা।”
“তোমার শ্বাশুড়ি?”
“হুম”
“তোমার আব্বু যে গয়না দিয়েছেন সে গুলো কোথায়?”
“ভালো মায়ের কাছে।”
রুপা আর কথা বাড়ালো না। তবে এটা ভেবে খারাপ লেগেছে যে তার একমাত্র ননদ কে তার ননদাই কোনো উপহার দেয়নি।
প্রহনদের বাড়িতে এখন মানুষে ভরপুর। খাওয়া দাওয়ার পর্ব চুকিয়ে সরদার সাহেব আর রেদোয়ান চৌধুরী প্রহন আর চৈতি কে নিয়ে কথা বলতে ব্যস্ত। দুই জন দুই জন কে মানিয়ে নিতে পারছে তো? চেষ্টা করছে তো ওরা?
চৈতির পড়াশোনা নিয়ে বেশ কঠোর সরদার সাহেব।
“দেখুন ভাই, আমার মেয়ের রেজিস্ট্রেশন এখনো হয়নি। আমি ওর স্কুল থেকে টিসি নিয়ে আসবো। আপনি শুধু ওকে এখানকার ভালো একটা স্কুলে ভর্তি করে দিবেন। পড়াশোনার খরচ লাগলে আমি দিবো।”
“ছিঃ ছিঃ এটা কি কথা বললেন আপনি? চৈতি শুধু আপনার মেয়ে নয়। প্রহনের সাথে বিয়ে হবার পর থেকেই ও আমারো মেয়ে।আর বাবা হয়ে আমি আমার মেয়ের খরচ চালাতে পারবো না?এটা কেমন কথা হলো?”
সরদার সাহেব এবং রেদোয়ান চৌধুরীর কথার মাঝে কথা বলে উঠলো প্রহন। উনাদের পাশ দিয়েই যাচ্ছিল সে। কথা গুলো কানে আসতেই কিছু বলার প্রয়োজন বোধ করলো সে।
“পিচ্চির,সরি চৈতির সব কিছুর রেসপনসিবিলিটি আমার।আমি যেহেতু তার হাসব্যান্ড সেহেতু তার প্রয়োজনীয় সকল চাওয়া, ইচ্ছে,স্বপ্ন পূরণ করার দায়িত্ব ও কর্তব্য আমার।”সরদার সাহেবের চোখের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় প্রহন বললো,
“বাবা আপনি চৈতির পড়াশোনা ওর কোনো কিছু নিয়েই চিন্তা করবেন না। আমি আছি তো।”
প্রহনের “আমি আছি তো” কথাটা শুনে একরাশ প্রশান্তি তে বুকটা ভরে গেল সরদার সাহেবের। নিশ্চিত হলেন তিনি। আদরের রাজকন্যা টা সত্যিই একজন সত্যিকারের রাজকুমার পেল।
_______
সরদার সাহেবদের সাথে চৈতি আর প্রহন কে ও নিয়ে গেলেন। বাবার বাড়িতে যাবার কথা শুনেই খুশিতে আত্মহারা চৈতি। পুরো একদিন কে তার পুরো একটা বছর মনে হয়ে ছিল।
চেনা সে ভিটা। চেনা পরিবেশ, চেনা আপন মানুষ গুলোর সাথে থাকবে আহা এ যে এক অন্যরকম শান্তি।
চৈতিদের বাড়িতে না আসলে তো আসল চৈতি কে দেখতেই পারতো না প্রহন। ভাগ্যিস এসেছিল।”এত চঞ্চল এই পিচ্চি? বুঝতেই পারিনি।”
চঞ্চল চৈতি কে দেখে প্রহন তার নতুন এক নাম রাখলো, “চঞ্চলা হরিণী”
চলবে,,,,
#অন্তহীন💜
#পর্ব_৮
#স্নিগ্ধা_আফরিন
সূর্য মামা খেপেছে আজ। ভীষণ তার তেজ।
ক্লান্ত বিকেল,আকাশ রক্ত লাল! পরিযায়ী পাখিদের ছড়া ছড়ি আকাশ জুড়ে।সাঝঁবেলা ঘনিয়ে আসছে যে। সূর্য অস্ত যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। একটু পরেই ধরিত্রী জুড়ে নিশিথীনির গাঢ় অমা নেমে আসবে।
চৈতিদের বাড়ির ছাদের এক কোনায় দাঁড়িয়ে নিচের বাগানের দিকে তাকিয়ে আছে প্রহন। চৈতি কে হাসতে দেখছে, ছুটাছুটি করতে দেখছে, পেয়ারা গাছের ডালে বসে পেয়ারা খেতে দেখছে। মুক্ত পাখির মতো উড়ে বেড়াচ্ছে মেয়েটা। প্রহন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু হিসেব নিকেশ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
“এই মেয়ে কে নিয়ে আমি আর পারলাম না। কোথায় জামাইয়ের আশেপাশে থাকবে, কখন কী প্রয়োজন তা দেখবে তা না করে মেয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে।”
কথা গুলো বলতে বলতে রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে আসলেন জুনাইদা। হাতে বরাবরের মতই এক কাপ চা। সরদার সাহেব বাজারে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন। মেয়ের জামাই আসছে অনেক কেনাকাটা করতে হবে।
জুনাইদা চায়ের কাপ টা সরদার সাহেবের হাতে দিয়ে বললেন,
“চৈতির কান্ড দেখেছেন?”
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সরদার সাহেব প্রশ্ন করলেন,
“কী করেছে আমার আম্মা?”
“বাড়িতে আসার পর শাড়ি বদলে সেলোয়ার কামিজ পরে ছুটে বেড়াচ্ছে। এই মেয়ের যে বিয়ে হয়েছে, স্বামীর সাথে বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসছে সেই খেয়াল কী আছে?”
“আহ জুনাইদা। আমার মেয়ের এত সব মাথায় নিয়ে ঘুরার বয়স হয়নি। তুমি একটু নিরিবিলিতে ওরে বুঝাই ও।”
জুনাইদা সরদার সাহেবের দিকে এক নজর তাকিয়ে চলে গেলেন রান্নাঘরে। রুপা রান্না ঘরের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।সিফা পেঁয়াজ কুচি করছে। দুই দিন ধরে রুপার শরীর টা ঠিক ভালো যাচ্ছে না। রুপা কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জুনাইদা চায়ের কাপে চা ঢালতে ঢালতে বললেন,
“বড় বউ, একটু কষ্ট করে মা চৈতি কে ডেকে দাও না।”
“আচ্ছা মা। আমি ডাকছি ওকে।”
রুপা রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় প্রহন কে চোখে পড়লো।ছাদ থেকে নামছে। রুপা কে দেখে প্রহন বললো,
“পিচ্চি কে একটু ডেকে দিবেন ভাবি?”
রুপা মুচকি হেসে জবাব দিলো,
“আমার ননদকে ছাড়া বুঝি মন টিকছে না?”
“আসলে তা না। একটু দরকার ছিল তাই আর কি।”
“আমি চৈতি কেই ডাকতে যাচ্ছি।”
রুপা সদর দরজা পেরিয়ে চলে গেল বাগানের দিকে। প্রহন চৈতির রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো।
_______________________
বাগানে এসে গলা উঁচু করে চৈতির নাম ধরে ডাক দিলো রুপা। কিন্তু চৈতির কোনো সাড়া পেল না। বাগানের ভেতর খুঁজতে লাগলো। কোথাও পেলো না চৈতি কে।
বাগানে চৈতি কে না পেয়ে রুপা ভাবলো ছাদে আছে। পরক্ষনেই মনে হলো,
প্রহন ছাদ থেকেই নেমে এসে চৈতি কে ডেকে দিতে বলেছে।ছাদে থাকলে তো প্রহন ডেকে দিতে বলতো না। “তাহলে মেয়েটা কোথায় গেল? একটু পরেই সন্ধ্যা হয়ে যাবে।”রুপা জলদি করে বাড়ির ভেতরে চলে গেল। রান্না ঘরে ঢুকে হাঁপাতে হাঁপাতে বলতে লাগলো,
“চৈতি কী কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না মা।”
রুপার কথা শুনে ঘাবড়ে গেলেন জুনাইদা। বুকের মাঝে ধক করে উঠলো। হাতের কাজ রেখেই তিনি সরদার সাহেবের রুমে ছুটে গেলেন।
সহধর্মিণী কে এমন ছুটে আসতে দেখে বসা থেকে উঠে সরদার সাহেব জিজ্ঞেস করলে,
“কী হয়েছে?”
“চৈতি কে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।”
“কী? বাগানে,ছাদে খুঁজে দেখেছো ভালো করে? গাছের উপর উঠে বসে নেই তো আবার?”
“বড় বউ গিয়েছিল চৈতি কে ডাকতে। কিন্তু ও কোথাও চৈতি কে খুঁজে পায়নি। বাগানে,ছাদে কোথাও নেই।”
চিন্তায় কপালে ভাঁজ পড়লো সরদার সাহেবের। মাথায় হাত রেখে স্তব্ধ হয়ে বসে পড়লেন।
জুনাইদা দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। জুনাইদার পিছনে পিছনে সরদার সাহেব ও গেলেন।
জুনাইদা সবাইকে ডেকে নিয়ে গেলেন চৈতি কে খোঁজার জন্য।”আজ যদি মেয়েটা নিজে থেকে লুকিয়ে থাকে খুঁজে পেলে ঠাঁটিয়ে এক চড় খাবে আমার হাতে।”মনে মনে কথা গুলো বললেন জুনাইদা।
বেশ খানিকক্ষণ খোঁজার পর ও চৈতির দেখা মিললো না।এত সময় পর ও চৈতিকে রুমে আসতে না দেখে রুম থেকে বেরিয়ে আসলো প্রহন।বাড়ি ফাঁকা।কেউ নেই।ভ্রু কুঁচকে গেলো প্রহনের।”হঠাৎ করে সবাই গেল কোথায়?”বাইরে থেকে চিল্লাচিল্লির শব্দ পেয়ে সেখানে যায় প্রহন।
“আব্বু আমাকে গাছের উপর থেকে নামাওওও।”
আচমকা চৈতির গলার স্বর শুনে সবাই চুপ হয়ে যায়। সবাই গাছের উপরে দেখতে থাকে। প্রহনের চোখ পড়ে চৈতি যে গাছে ঝুলিয়ে আছে সেই গাছের মগডালে।
বিচিলিত কন্ঠে প্রহন বলে উঠলো,
“পিচ্চি এত উপরে উঠছো কেন? শক্ত করে গাছের ডাল চেপে ধরো।ভয় পেও না।”
প্রহনের দৃষ্টি অনুসরণ করে সবাই চৈতির দিকে তাকালো। সরদার সাহেবের বুকের উপর থেকে যেন ভারি পাথর সরে গেল। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লেন তিনি।
প্রহন নিচে থেকে চৈতিকে গাছ থেকে নামার কৌশল শিখিয়ে দিচ্ছে। সেনাবাহিনীর সদস্য হওয়ার ফলে এই সব ট্রেনিং তার নেওয়া হয়েছে।
প্রহনের কথা মতো চৈতি মগডাল থেকে অনেক টা নিচে নেমে আসে। ভয়ে জান যায় যায় অবস্থা।মনে মনে সে প্রতিজ্ঞা করেই ফেলেছে আর জীবনে ও এত বড় গাছে উঠবে না।
গাছের গোড়ার কাছাকাছি আসতেই হাত ফসকে পড়ে যায় চৈতি। পড়ে যাওয়ার সময় গলা ফাটিয়ে বলে,
“মাটিতে পড়লেই মরে যাবো আমি। আমাকে ধরোওওও।”চৈতির কথা সবাই বুঝে উঠার আগেই ধপ করে মাটিতে পড়ে গেল। সবাই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে চৈতির দিকে। সরদার সাহেব ছুটে এলেন মেয়ের কাছে। বাবাকে দেখেই আহ্লাদে কেঁদে উঠলো চৈতি।গাল ফুলিয়ে নাক টেনে টেনে কান্না করছে। প্রহন আরেক দফা অবাক হয়ে কান্নারত চৈতি কে দেখছে।
সরদার সাহেব পরম মমতায় চৈতি কে দাড়ঁ করিয়ে বুকের মাঝে শক্ত করে চেপে ধরলেন।একটু আগেই বয়ে যাওয়া ঝড়ে অশান্ত মনটা এক নিমিষেই শান্ত হয়ে গেলো। মেয়ের কান্না থামাতে আদুরে গলায় বললেন,
“কিচ্ছু হয়নি আম্মা। কাঁদে না।”
চৈতি বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে ঠোট ফুলিয়ে ডান হাতটা এগিয়ে দিয়ে বললো,”কেটে গেছে।”
চৈতির কথা শুনে প্রহন হাত ধরে দেখতে লাগলো। সত্যিই হাতের কনুই ছিলে গেছে। সেখান থেকে রক্ত বের হচ্ছে।
“বেশ হয়েছে।বানরের মতো আরো গাছে গাছে লাফা।যা,,নামলি কেন? গাছের ডালেই রাতে থেকে যেতি। শয়তান মেয়ে।”
“আহ জুনাইদা! আমার আম্মাকে আর চিল্লিও না তো। এমনিতেই হাতের কনুই ছিলে গেছে।যাও বাড়ির ভেতরে যাও।”
“ছোট থেকে এই আপনার আশকারা পেয়ে পেয়ে এত বেপরোয়া হয়েছে।আদরে আদরে বাঁদর করে তুলেছেন।”
জুনাইদার কন্ঠে যথেষ্ট রাগ। চৈতির দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে হনহন করে হেঁটে চলে গেলেন তিনি। তার পেছন পেছন রুপা আর সিফা ও চললো।
সরদার সাহেব মুচকি হেসে প্রহনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“বুঝলে বাবা এই মেয়ের জন্য তোমার শ্বাশুড়ির বিরুদ্ধে যেতে হয় আমার।আর এত এত কথা মুখ বুজে শুনতে হয়। মেয়ের রাগ সব আমার উপর ঝারে।”
__________
ঘড়ির কাঁটায় তখন সময় ৭টা বেজে ২৫ মিনিট। চৈতির ডান হাতের কনুইয়ের রক্ত পরিষ্কার করে বেশ দক্ষ হাতে ব্যান্ডেজ করে দেয় প্রহন। বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে চৈতি। তার পাশেই বসে মোবাইলে কিছু একটা করছে প্রহন।
টেবিলের উপর সাজিয়ে রাখা বই গুলোর দিকে চোখ পড়তেই নড়েচড়ে বসলো চৈতি।তাকে এত নড়তে দেখে প্রহন জিজ্ঞেস করলো”কি হয়েছে পিচ্চি?”
“আমার আসলে বই পড়তে খুব ইচ্ছে করছে।”
“কোন ধরনের বই?”
চৈতি টেবিলের উপর রাখা বই গুলোর দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো,
“পাঠ্য বই।”
“গল্পের বই ছেড়ে পাঠ্য বই পড়তেও কারো ইচ্ছে জাগে?বাহ বেশ ভালো তো।কোন বিষয় নিয়েছো নবম শ্রেণীতে?”
“সাইন্স।”
“গুড স্টুডেন্ট। তাহলে একটা প্রশ্নের উত্তর দাও তো, ভিনেগারে কোন ধরনের এসিড থাকে?”
এই প্রশ্নের উত্তর টা জানা আছে চৈতির।স্কুলে একদিন স্যার বলেছিলেন।সেটাই মাথায় রেখেছিল সে।তাই দেরি না করে চট করেই উত্তর দিয়ে দিলো,
“ইথানয়িক এসিড।”
প্রহন মুচকি হেসে বললো,
“রাইট। তুমি খুব ভালো ছাত্রী পিচ্চি। পড়ালেখার প্রতি এত আগ্রহ দেখে ভালো লাগলো। কিন্তু এখন পড়তে হবে না। কয়েক দিন পর থেকেই শুরু করে দিও।”
চৈতি ছোট্ট করে উত্তর দিলো,”আচ্ছা।”
অন্যদের সাথে কথার ঝুড়ি নিয়ে বসা চৈতি প্রহনের সামনে কতই না শান্ত।
“পিচ্চি বা পা টা দাও তো।”
প্রহনের কথা মতো বিনা বাক্যে প্রহনের দিকে পা বাড়ায় চৈতি। পকেট থেকে একটা পায়েল বের করে সযত্নে চৈতির পায়ে পড়িয়ে দিয়ে প্রহন বললো,
“ভাবিদের দেখিয়ে দিও। এই পায়েলটা তোমার হাসব্যান্ড তোমাকে দিয়েছে।পা টা বড্ড খালি খালি লাগছিলো।একটা পায়েল এর প্রয়োজন ছিল।”
চলবে,,,,