অন্তহীন💜 পর্ব-৯

0
3485

#অন্তহীন💜
#পর্ব_৯+১০
#স্নিগ্ধা_আফরিন

“হঠাৎ অভ্যস্ত জীবনের সব পাল্টে গেল। নিজের সাথে জড়িয়ে গেল অন্য কেউ।যার আশা কখনোই করিনি।
জীবনের নিয়ম কখন, কোথায় কী ভাবে যেন এক নিমেষে বদলে দেয় সব কিছু।পাল্টে দেয় পথ।আহা জীবন!”

ঘড়ির কাঁটায় রাত ১টা।ঘুমন্ত চৈতির পাশেই শুয়ে আছে প্রহন। ঘুম নেই চোখ জুড়ে। মাথার মধ্যে হাবিজাবি চিন্তারা ঘুরপাক খাচ্ছে।যার কোনো যুক্তি নেই।ঘার ঘুরিয়ে চৈতির দিকে তাকালো প্রহন।গোলাপি রঙের ডিম লাইটের মৃদু আলোতে পুরো রুম আলোকিত। প্রহনের থেকে বেশ দূরত্ব বজায় রেখে বিছানার এক কোণে গুটিসুটি মেরে বিড়াল ছানার মতো ঘুমিয়ে আছে চৈতি। প্রহন চোখ সরিয়ে ফেললো। কপালের ওপর এক হাত রেখে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু ঘুম পরীরা যেনো আজ শপথ করেছে, কোনো ভাবেই প্রহনের চোখে ধরা দিবে না।

বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছেন সরদার সাহেব। চিন্তায় ঘুম নেই চোখে। বাজার থেকে বাড়ি ফেরার পথে খবর পেলেন রিফাত ঢাকা থেকে এসে গেছে। অজানা আশঙ্কায় বুকের ভেতর কেপে উঠছে সরদার সাহেবের।
চৈতির জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল সরদার সাহেব কে। তিনি কড়া গলায় না করে দিয়েছিলেন। এমন জঘন্য একটা ছেলের হাতে কিছুতেই নিজের মেয়েকে তুলে দিতে রাজি ছিলেন না সরদার সাহেব।
কত হুমকি দিলো রিফাত।”এত মেয়েকে ছেড়ে আপনার মেয়েকে পছন্দ করেছি, বিয়ে করতে চেয়েছি,ওরে যদি বিয়ে করতে না পারি তাহলে এই দুনিয়া ছাড়তে হবে আপনার মেয়ে কে।কথাটা মাথায় রাইখেন।”
রিফাতের কথাটা মনে পড়তেই কেঁপে উঠলেন সরদার সাহেব।ছেলেটা যে ভীষণ খারাপ।
শোয়া থেকে উঠে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকেন। আদরের মেয়ে কে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলো বাবার মন। বিছানা থেকে নেমে দাঁড়িয়ে দরজার সামনে যেতেই মনে পড়লো, মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। নিজের হাতে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন তিনি। প্রহন আছে চৈতির রুমে। সরদার সাহেব বিষন্ন মনে ব্যালকনিতে চলে গেলেন। সেখানে রাখা আরাম কেদারায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

_______

নিশীথিনির গাঢ় অমা দূর করে পূর্ব দিগন্তে উদয়মান দিনমনির রাঙা প্রভায় রঙিন হয়ে উঠেছে ধরিত্রী। বুকের উপর ভারি কিছুর অনুভবে ঘুম ভেঙ্গে যায় প্রহনের। চোখ মেলে তাকাতেই চৈতির ঘুমন্ত মুখটা নজরে এলো। ঘুমের ঘোরেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আছে।
জানালার পর্দার ফাঁকে বাইরে তাকালো প্রহন। অনেক বেলা হয়ে গেছে। জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে এক ফালি রোদ এসে লুটোপুটি খাচ্ছে মেঝেতে।
চৈতি কে নিজের কাছ থেকে সরাতে চাইলে মেয়েটা আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাকে। ঘুমের মধ্যেই বিড় বিড় করে,”আম্মু আরেকটু এমন করে থাকো না। আমি ঘুমাই।”

চৈতির বিড়বিড় করে বলা কথা শুনে কপাল চাপড়াতে থাকে প্রহন। ঘুমন্ত চৈতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মৃদু স্বরে ডাকলো,
“পিচ্চি উঠো। সকাল হয়ে গেছে।”

নড়েচড়ে উঠলো চৈতি। প্রহনের কাছ থেকে সরে গিয়ে ঘুমের মধ্যেই উত্তর দিলো,”কয়টা বাজে?”

বালিশের পাশ থেকে মোবাইল হাতে নিয়ে সময় দেখে প্রহন জবাব দিলো,”৭টা৫৫।৮টা বেজে গেছে মনে করো।”
ঘুম ঘুম কন্ঠে চৈতি আবদার করে বসলো,”আরেকটু ঘুমাই?”

পিচ্চি বউয়ের আবদার কী অপূর্ণ রাখা যায়? হয়তো যায়। কিন্তু প্রহন তা অপূর্ণ রাখাতে চায় না।এতে পাপ হবে। ভীষণ পাপ!
প্রহন আর ডাকলো না। থাকুক ঘুমাক। শোয়া থেকে উঠে গেল সে।
.
.
ড্রইং রুমের সোফায় প্রহন কে বসে থাকতে দেখে রুপা বলে উঠলো,
“চৈতি এখনো ঘুম থেকে উঠেনি?”

“না ঘুমাচ্ছে।”

রুপা আর কিছু না বলে চৈতির রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। বেশি বেলা করে ঘুম থেকে উঠলে শরীর ভালো থাকে না। রুপা চৈতির রুমে এসে দেখলো ঘুম থেকে উঠে বসে চোখ কচলাচ্ছে চৈতি। রুপার চোখ পড়লো চৈতির পায়ের দিকে।
“পায়ে এটা কি চৈতি?”

রুপার কথা বুঝতে না পেরে লাফিয়ে উঠলো চৈতি।
“ভয় পাচ্ছো কেন?”জোঁক না তো। পায়েল টার কথা বলেছি।”

“যে ভাবে বলছো মনে হয়েছে জোঁক ধরেছে পায়ে।”

“জোঁকে ভয় পাও যে তাই মনে হয়েছে। এখন বলো এত সুন্দর একটা পায়েল কে দিলো?”

দুই হাত দিয়ে চুলের খোঁপা করতে করতে চৈতি ছোট্ট করে উত্তর দিলো,”উনি।”

মুচকি হাসলো রুপা।”আংটি দেয়নি? বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তো সবাই আংটি দেয়। তোমার ভাইয়া ও তো দিয়েছে।”

“জানি না আমি। শুধু রাতে পায়েল টা পড়িয়ে দিয়েছেন।”

“সবার চেয়ে ভিন্ন জিনিস দিয়েছে। ব্যাপারটা সুন্দর!”
চৈতির রুমের জানালার পর্দা সরিয়ে দিতে দিতে রুপা বলে উঠলো,”শ্বশুড় বাড়িতে এত বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে থেকো না। মানুষে খারাপ বলবে।”

“ঐ দিন ১০ টা পর্যন্ত ঘুমিয়ে ছিলাম।”

“কেউ কিছু বলেনি?”
“না।”
“নতুন নতুন কেউ কিছু বলে না।আস্তে আস্তে সবাই বলবে।”

রুপার কথার উত্তর দিলো না চৈতি। উঠে ওয়াস রুমে চলে গেল। ভবিষ্যতে কী হবে তা তখনই দেখা যাবে।
.
.
চার দিন প্রায় কেটে গেল। প্রহনের ছুটি আর মাত্র তিন বাকি আছে। চৈতি কে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসার সময় মেয়েটা অনেক কান্নাকাটি করেছে আজ। মেয়ের কান্না দেখে দেখেছেন জুনাইদা। সরদার সাহেবের ও মন খারাপ ছিল।মন সায় দিচ্ছিল না মেয়েকে যেতে দিতে। কিন্তু তিনি নিরুপায়। চাইলে আরো একদিন চৈতি কে নিজের কাছে রাখতে পারতেন। কিন্তু আপদ এসে জুটেছে গ্রামে। মেয়ের কোনো প্রকার ক্ষতি হোক চান না সরদার সাহেব।
.
বিকেলের দিকে নিজের রুমে শুয়ে আছে প্রহন। চৈতি রুমে নেই। রান্না ঘরে মিসেস ইয়াসমিন এর সাথে গল্প করছে আর মিসেস ইয়াসমিন সন্ধ্যার নাস্তা বানাচ্ছেন।আছরের আজান দিয়েছে অনেক্ষণ আগেই। পড়ন্ত বিকেলের এই সময়টায় চা খাওয়া রোজকার রুটিনের মধ্যে পড়ে প্রহনের। রুমে থেকেই চৈতি কে ডাক দিলো,
“পিচ্চি এক কাপ চা দিয়ে যাও তো।”

প্রহনের আদেশ শুনে মিসেস ইয়াসমিন মুচকি হেসে বললেন,”আমার ছেলেকে কী যাদু করেছিস বল তো মা? বিয়ের আগে তো বিয়েই করতে রাজি ছিল না।আর এখন কোনো কিছু লাগলেই তোকে খুঁজছে।”

মিসেস ইয়াসমিন এর কথায় খানিক লজ্জা পেলো চৈতি।তা দেখে মিসেস ইয়াসমিন চৈতির হাতে এক কাপ চা ধরিয়ে দিয়ে বললেন,”এত লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই।যা চা টা ওকে দিয়ে আয়।”

উপর নিচ মাথা নেড়ে সায় দেয় চৈতি। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে প্রহনের রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।
চৈতির চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন মিসেস ইয়াসমিন।

রুমে এসে প্রহন কে দেখলো না চৈতি। কিন্তু চৈতি কে দেখলো প্রহন। গম্ভীর কণ্ঠে বললো,”আমি বেলকনিতে আছি।”

প্রহনের কন্ঠস্বর শুনে সে দিকে এগিয়ে যায় চৈতি। প্রহন আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। চায়ের কাপ টা এগিয়ে দিয়ে বললো,”আপনার চা।”

চৈতির হাত থেকে চায়ের কাপ টা নিয়ে তাতে চুমুক দিতেই ঠোঁট আর জিহ্বা পুড়ে যায় প্রহনের।তা দেখে হেসে কুটিকুটি হচ্ছে চৈতি। চৈতির হাসি দেখে ভ্রু কুঁচকে চৈতির দিকে তাকালো প্রহন।হাত দিয়ে ঠোট মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করলো,”এত হাসার কী আছে?”
প্রহনের প্রশ্ন শুনে চৈতি ও প্রহনকে প্রশ্ন ছুঁড়ে মারে,”ফু না দিয়েই গরম গরম চা একেবারে খাওয়ার কী আছে?”

“বাহ কী প্রশ্ন।গরম গরম চা খাওয়ার অভ্যাস আছে আমার।আর চা গরমই খায়।ঠান্ডা না।”

চৈতি বেলকনি থেকে চলে যেতে যেতে বললো,
“অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো না।”

চৈতির বলা কথাটা শুনে চুপ হয়ে গেল প্রহন। মেয়েটা কত বড় একটা সত্যি বললো। আসলেই কোনো কিছু নিয়েই অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করা উচিত না। চৈতির বলা কথাটা শুনে বেশ কিছুক্ষণ থম মেরে ছিলো প্রহন। কেন জানি কথাটা তার মন ছুঁয়ে গেছে।
.
সন্ধ্যায় প্রহনকে বাইরে বের হতে যেতে দেখে মিসেস ইয়াসমিন বললেন,”ফেরার সময় তোর পিচ্চি বউয়ের জন্য চকলেট নিয়ে আসিস।”

প্রহন মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
“তুমি না বললে ও নিয়ে আসতাম।”

“কত মোহাব্বত বউয়ের প্রতি। বিয়ের জন্য তো রাজিই হতে চাইছিলি না। বিয়ের দুই দিনেই এত মোহাব্বত বউয়ের প্রতি? এতো ভালোবাসা?”

“ভুল বলছো। ভালোবাসা না।এইসব আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।ওর বাবাকে আমি কথা দিয়েছি ওরে কখনো কষ্ট পেতে দিবো না। আমি শুধু সেই কথাই রাখার চেষ্টা করছি এবং বিয়ে নামক বাঁধনে জড়িয়ে আমার উপরে যে দায়িত্ব পড়েছে আমি সেই দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করছি।”

প্রহনের কথা শুনে মিসেস ইয়াসমিন বললেন,
“শুধু দায়িত্ব পালন করলেই সংসার করা যায় না। দায়িত্ব পালনের মধ্য শুধু এই সব কিছু পড়ে না। ভালোবাসার ও প্রয়োজন পড়ে। স্বামীর ভালোবাসা
ছাড়া একটা মেয়ে কখনোই সুখী হতে পারে না।”

চলবে,,,,,
#অন্তহীন💜
#পর্ব_১০
#স্নিগ্ধা_আফরিন

খোলা জানালার ফিকে রোদ্দুরে নবিনা কিশোরী কোমল আঁধারে শাড়ির কুচি ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ আগেই মিসেস ইয়াসমিন চৈতি কে খুব সুন্দর করে শাড়ি পড়িয়ে দিয়ে গেছেন। হাঁটতে গিয়ে তাল সামলাতে না পেরে কুচির ভাঁজে পা আটকে অগোছালো হয়ে যায় শাড়ির কুচি গুলো। বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো সে।
সবাই তৈরি হয়েছে রেদোয়ান চৌধুরীর বন্ধুর মেয়ের হলুদের অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য। রেদোয়ান চৌধুরীর কলেজ লাইফের খুব ভালো বন্ধুর মেয়ের বিয়ে। কতো বার করে নিমন্ত্রণ করে গেলো। না গেলে খুব বাজে দেখাবে বিষয় টা। চৈতি জানে না শাড়ি পড়ে এত সাজগোজ করার কারণ। মিসেস ইয়াসমিন শাড়ি পড়িয়ে দিয়েছেন,সাজিয়ে দিয়েছেন টু শব্দটি ও করেনি চৈতি।

শাড়ির কুচি অগোছালো রেখেই বিছানায় বসে পড়লো সে। প্রহন সবে বাইরে থেকে এসেছে।গাল ফুলিয়ে চৈতি কে বিছানায় বসে থাকতে দেখে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
“গাল ফুলিয়ে বসে আছো কেন পিচ্চি?”

কী বলবে চৈতি? শাড়ির কুচি নষ্ট হয়ে গেছে? না কি চুপ চাপ বসে থাকবে?বুঝে উঠতে পারছে না।

চৈতির উত্তর না পেয়ে প্রহন আবারো জিজ্ঞেস করলো,
“কী হয়েছে বলো আমাকে?”

“আসলে আমার পায়ের সাথে আটকে শাড়ির কুচি নষ্ট হয়ে গেছে।”মিনেমিনে গলায় উত্তর দিলো চৈতি।

প্রহন মুখ ফুলিয়ে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো। চৈতির কাছে গিয়ে হাত ধরে টান মেরে সোজা দাঁড় করিয়ে দিলো।ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসে একটা একটা করে শাড়ির কুচি ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

চৈতি কে ডাকার জন্য মিসেস ইয়াসমিন প্রহনের রুমের সামনে আসেন। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে, খুব যত্ন সহকারে প্রহন কে চৈতির শাড়ির কুচি ঠিক করে দিতে দেখে মুচকি হাসলেন। হাতের মোবাইল টা দিয়ে তাদের আড়ালে ক্যানডিড একটা ছবি তুলে নিলেন।

চৈতির শাড়ির কুচি ঠিক করে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো প্রহন। ভালো করে একবার চৈতির দিকে তাকালো।একটা কিছুর অভাব আছে। সেই জিনিস টা থাকলে পরিপূর্ণ হতো চঞ্চলা হরিণীর সাজটা। বিছানার উপর রাখা হলদে রঙের পাঞ্জাবি টা নিয়ে ওয়াস রুমে চলে গেল প্রহন।
মিসেস ইয়াসমিন যথেষ্ট সৌখিন। কোথাও যাওয়ার সময় চৈতি আর প্রহনের জন্য এক রঙা ড্রেস বের করে রাখেন। মিসেস ইয়াসমিন এর এই সব কান্ডে চৈতি বেশ অবাক হয়।

উজ্জল শ্যাম বর্ণের মানুষটাকে হলদে রঙের পাঞ্জাবিতে বেশ স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। চৈতি আজ প্রথম বার প্রহনের দিকে ভালো করে তাকালো।এক প্রকার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে লাগলো তার নিজস্ব মানুষ টাকে।ব্রেন্ডের কালো ঘড়িটা হাতে পড়তে পড়তে প্রহন চৈতিকে বললো,
“এই বাচ্চা,কী দেখছো এমন করে? একবারেই দেখে মুখস্থ করে ফেলবা আমাকে? একটু কমিয়ে দেখো।সারা জীবন এই আমাকে দেখতে দেখতেই না বিরক্ত হয়ে পড়ো। আমি তোমার আছি।সো কমাই দেখো পিচ্চি পেত্নী।”

প্রহনের কথায় খানিক লজ্জা পেলো চৈতি।”আমি তোমার আছি” কথাটায় বুক কেঁপে উঠলো কিশোরী চৈতির।যার কথা জানলো না প্রহন।লজ্জায় মুখ খানি রক্তবর্ণ ধারণ করেছে।
চোখ নামিয়ে নিলো।ফ্লোরের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো।
চৈতির লজ্জা মাখা মুখের দিকে তাকিয়ে বিড় বিড় করে নিজে নিজেই প্রহন বলে উঠলো,
“লজ্জার ড্রাম একে বারে। সামান্য কথাতেই এত লজ্জা?বাহ ভালো। কপাল করে লজ্জাময়ী পেলাম একটা।”

ড্রইং রুম থেকে মিসেস ইয়াসমিন প্রহন আর চৈতি কে ডাক দিলেন।ড্রেসিং টেবিলের মোবাইল হাতে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল প্রহন। প্রহনের পিছন পিছন চৈতি ও চললো। সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় ঘটলো আরেক বিপত্তি।পা ফসকে পড়ে যেতে গিয়ে প্রহনের কাঁধের উপর শক্ত করে খামচে ধরে।এখনি গড়িয়ে পড়ে অঘটন ঘটে যেতো। ভাগ্যিস প্রহন সামনে ছিল।

পেছনে ফিরে চৈতি কে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“শাড়ি সামলাতে না পারলে পড়তে যাও কেন?”
নিচে থেকে দাঁড়িয়ে মিসেস ইয়াসমিন চৈতি কে করা প্রশ্নের উত্তর দেন।”আমি পড়িয়েছি চৈতি কে।”

“অন্য ড্রেস করালেও পারতে। পিচ্চি মেয়ে এই শাড়ি সামলাতে গিয়ে কতবার হিমশিম খাচ্ছে দেখছো না?”

প্রহনের কথা শুনে চৈতি ধীর কন্ঠে জবাব দিলো,
“শাড়ি সামলাতে শিখছি।তাই আরো বেশি বেশামাল হয়ে যাচ্ছে।”

মায়ের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে চৈতির দিকে তাকালো প্রহন।”শাড়ি সামলাতে হবে না। অন্য ড্রেস পরে আসো যাও।”

“শাড়ি না সামলাতে পারলে আপনাকে সামলাবো কী করে?
চৈতির এহেন কথায় বাকরুদ্ধ প্রহন। মিসেস ইয়াসমিন আর রেদোয়ান চৌধুরী মুখে হাত দিয়ে মিটি মিটি হাসছেন।
প্রহন আর কিছু বলার মতো পেলো না।চুপ করে চলে গেল। প্রহন কে চুপ করে চলে যেতে দেখে মনে মনে হাসলো চৈতি।যাক চুপ করিয়ে দেওয়া গেল।
.
গাড়ি করে যাওয়ার সময় প্রহনের চোখে পড়ে সেই কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা।যেই জিনিসটার কারনে তার চঞ্চলা হরিণীর সাজ অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে।গাড়ি থেকে নেমে ফুটপাতের পাশে অবস্থিত দোকান থেকে তাজা গোলাপ আর বেলি ফুলের গাজরা কিনে পাঞ্জাবির পকেটে ঢুকিয়ে আবারো গাড়ির কাছে ফিরে আসে।

চৈতির পাশেই বসে ফেসবুকের নিউজ ফিড স্ক্রল করছে প্রহন। কৌতূহলী চৈতি হঠাৎ প্রহন কে জিজ্ঞেস করে উঠে,”কোথায় যাচ্ছি আমরা?”

মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থেকেই প্রহন উত্তর দিলো,”আব্বুর বন্ধুর মেয়ের বিয়েতে।”

চৈতি আর কিছু বললো না।চুপ করে বাইরের দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ করলো। প্রহন এক পলক চৈতির দিকে তাকিয়ে আবারো নিজের কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো।

গন্তব্যে পৌঁছে গেলে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায় প্রহনরা। মিসেস ইয়াসমিন আর রেদোয়ান চৌধুরীর সঙ্গে চৈতি ও ভেতরে চলে যেতে লাগলে পেছন থেকে চৈতি কে দাঁড়ানোর জন্য ইশারা করে প্রহন। শান্ত মেয়ের মতো চৈতি ও দাঁড়িয়ে পড়লো। চৈতি কে দাঁড়িয়ে যেতে দেখে মিসেস ইয়াসমিন বললেন,
“কিরে মা দাঁড়িয়ে পরলি কেন?”

“পিচ্চি আমার সাথে যাবে। তুমি আব্বুর সাথে চলে যাও আম্মু।”
প্রহনের কথা শুনে মিসেস ইয়াসমিন আর দ্বিমত করলেন না।দ্রুত পা চালিয়ে চলে গেলেন।

মিসেস ইয়াসমিন চলে যেতেই প্রহন চৈতির দিকে এগিয়ে আসে।ভ্রু কুঁচকে প্রহনের দিকে তাকিয়ে আছে চৈতি। পকেট থেকে বেলি ফুলের গাজরা টা বের করে নিজের হাতে স্বযত্নে চৈতির চুলের খোঁপায় পড়িয়ে দেয় প্রহন।
চৈতি অবাক হয়ে শুধু প্রহনের কর্ম কান্ড দেখছে।

গাজরা পড়িয়ে দিয়ে চৈতির কাছ থেকে সরে এসে চৈতির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,
“এই আবার পারফেক্ট হয়েছে।”

ডান হাত দিয়ে খোঁপায় গুঁজে দেওয়া ফুল স্পর্শ করে চৈতি। প্রহন চৈতির কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিস ফিস করে বলে,
“খুব সুন্দর লাগছে পিচ্চি পেত্নী।”

সুন্দর বললো, আবার পেত্নীও বললো?এটা কোন ধরনের প্রশংসার মধ্যে পড়ে বুঝলো না চৈতি।
প্রহন আলগোছে চৈতির হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে হাঁটতে শুরু করলো।

প্রহনের স্পর্শ পেয়ে কেঁপে উঠলো চৈতি। এই প্রথম অন্য কোনো পুরুষ বিনা অনুমতিতে তার হাত ধরার সাহস পেল। চৈতি কিচ্ছু বললো না। কিচ্ছু না!
_____________

বিয়ে বাড়ীতে মানুষের ভিড়।এত এত ছেলে মানুষের ভেতরে দুই হাত দিয়ে চৈতি কে আগলে ভেতরে নিয়ে যায় প্রহন।
বিয়ে বাড়ীর কোনো রুম খালি নেই। রুম গুলোতে মানুষে ভরপুর। রেদোয়ান চৌধুরী উনার বন্ধু আফজাল হোসেনের সাথে আলাপ করতে ব্যস্ত। মিসেস ইয়াসমিন চৈতি কে দেখে এগিয়ে আসলেন। বিয়ের কনে কে দেখতে যাবেন চৈতি কে সাথে নিয়ে।
প্রহন চৈতিকে সাবধানে থাকতে বলে বাবার কাছে এগিয়ে গেল। আফজাল হোসেন কে সালাম দিয়ে কথা বার্তায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
মিসেস ইয়াসমিন চৈতির হাত ধরে বউ দেখতে চলে গেলেন।
এত মানুষের ভিড়ে দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে চৈতির। মানুষের হইচই এ মুখরিত চার পাশ।

কনেকে এখনো সাজানো শেষ হয় নি। রুমের দরজা বন্ধ করে পার্লারের লোকেরা সাজাচ্ছে। বিয়ের অনুষ্ঠানে পুরোনো এক বান্ধবীর সাথে দেখা হয়ে মিসেস ইয়াসমিন এর। বেশ অনেক দিন পর পুরোনো সখীকে দেখে তার সাথে কথা বলতে থাকেন মিসেস ইয়াসমিন।

চৈতি একা দাঁড়িয়ে ছিল। অচেনা একটা ছেলে চৈতির সামনে এসে দাঁড়াতেই ঘাবড়ে যায় চৈতি। ছেলেটাকে দেখে অল্প বয়সের মনে হলো চৈতির কাছে।১৯ কিংবা ২০ হবে তার বয়স।
ছেলেটা চৈতির দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। অস্বস্তিতে দম আটকে যাচ্ছে চৈতির।
কিছুক্ষণ পর ছেলেটা চৈতির উদ্দেশ্যে বলে উঠে,
“আপনাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে।”

মাকে আর চৈতি কে নাস্তা করার জন্য ডাকতে আসছিল প্রহন। মাঝপথে ছেলেটার বলা কথা শুনে দাঁড়িয়ে পড়ে।
চৈতির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে প্রহন বলে উঠে,
“উনার সৌন্দর্যের প্রশংসা করার জন্য উনার হাসব্যান্ড আছে। তোমাকে এত প্রশংসা করতে হবে না ভাই।”

#চলবে,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here