#অন্তহীন💜
#পর্ব_২৩
#স্নিগ্ধা_আফরিন
প্রহনের গলার আওয়াজ পেয়ে সবাই ততক্ষণে গেস্ট রুমে এসে হাজির। মুহিতের শার্টের কলার চেপে ধরে প্রহন কে রেগে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো চৈতির। প্রহনের এত রাগ আজ প্রথম দেখছে সে।
মুহিত প্রহনের দিকে তাকিয়ে বললো,”সরি দোস্ত। আমি তো তোকে জেলাস করানোর জন্য ওমন করে বলেছি। কিন্তু তুই এতটা রেগে যাবি বুঝতে পারিনি।”
মিসেস ইয়াসমিন প্রহনের হাত থেকে মুহিতের শার্টের কলার ছাড়িয়ে দূরে সরিয়ে দিয়ে বললেন,”কী হয়েছে তোদের?”
প্রহন রাগে গজগজ করছে। রেদোয়ান চৌধুরী মুহিতের কাছে গিয়ে শার্ট ঠিক করে দিয়ে বললেন,”কী হয়েছে মুহিত? প্রহন এত রেগে আছে কেন?”
রেদোয়ান চৌধুরীর প্রশ্নের উত্তরে প্রহন বলে উঠে,”কারন ও চৈতি কে নিয়ে বাজে মন্তব্য করেছে।”
প্রহনের কথা শুনে কেঁপে উঠলো চৈতি।বাজে মন্তব্য মানে?মনে মনে ভাবলো সে,”রিফাত যেমন বাজে কথা বলতো সে রকম কিছু কী?”
প্রশ্ন সূচক দৃষ্টিতে প্রহনের দিকে তাকালো চৈতি। প্রহনের দৃষ্টি মুহিতের দিকে। তার দিক থেকে চোখ সরিয়ে চৈতির দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে ধমক দিয়ে উঠলো প্রহন।”এখানে কী করছো তুমি? রুমে যাও বলছি।”
প্রহনের চিৎকারে ঘাবড়ে গেল চৈতি। দ্রুত পায়ে হেঁটে রুমে চলে গেল সে।
মিসেস ইয়াসমিন প্রহনের কাছে গিয়ে বললেন,”কী বলেছে মুহিত?”
“আন্টি আমি তো প্রহন কে জেলাস করানোর জন্য বলেছিলাম। কিন্তু ও যে এত রেগে যাবে বুঝিনি।বুঝলে এমন করে কখনোই বলতাম না।”
“আমি তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করিনি মুহিত। প্রহন কে জিজ্ঞেস করেছি।তাই আমি মনে করি আমার প্রশ্নের উত্তর প্রহনের দেওয়া উচিত।”
“কী বলেছে জানো, আমার বউ নাকি অনেক হট। নজর খারাপ হয়ে গেছে ওর।”
প্রহনের বলা কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলেন মিসেস ইয়াসমিন এবং রেদোয়ান চৌধুরী।
“ছিঃ মুহিত। তোমার কাছ থেকে এটা আশা করিনি। চৈতি তোমার বন্ধুর বউ। মেয়েটা অনেক ছোট তোমাদের চেয়ে। ছোট বোন হয় তোমার। তাকে নিয়ে এমন কথা ছিঃ”
“আন্টি আমি তো শুধু জেলাস….”
মুহিতের পুরো কথা শেষ করতে না দিয়ে মিসেস ইয়াসমিন বলে উঠলেন,”এটা কোন ধরনের জেলাস করানোর উপায় বলো আমাকে? তোমার যদি প্রহন কে জেলাস করতেই হবে তাহলে অন্য ভাবে ও তো করতে পারতে। এমন কথা বলে শুধু শুধু সবার চোখে নিজেকে খারাপ প্রমান করার দরকার কি ছিল? আচ্ছা সব কিছু বাদ দিলাম।আজ যদি চৈতি তোমার বোন হতো তাহলে কি এমন করে বলতে পারতে?”
মিসেস ইয়াসমিন এর প্রশ্নের উত্তর নেই মুহিত এর কাছে।সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
“মা ওকে চলে যেতে বলো। আমার আগের ফ্রেন্ড মুহিত আর এই মুহিত এর মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ। আগের মুহিত মেয়েদের সম্মান করতে জানতো। কিন্তু এই মুহিত জানে না।”
“দেখ দোস্ত আমি মজার ছলে বলেছি। তুই কেন এতো সিরিয়াসলি নিলি?”
“আজ যদি তোর পছন্দের মানুষটিকে আমি কিংবা অন্য কেউ এমন করে বলতো তোর কী রাগ হতো না?যাই হোক আমার মেজাজ আর খারাপ করিস না। তুই চলে যা।যে দিন আবার আগের সেই মুহিত হতে পারবি সেদিন আমার সামনে এসে দাঁড়াবি।এর আগে না।”
_______
প্রকৃতি তখন বৃষ্টিতে ভিজতে ব্যস্ত। চারদিকে ঝাপসা হয়ে গেছে।বেলকনির গ্রিলের উপর একটা চড়ুই পাখি আধ ভেজা হয়ে ঠোঁট দিয়ে পালক খুঁটছে। বৃষ্টি পড়ার শব্দ স্পষ্ঠ। বৃষ্টির ছিটকে পড়া পানিতে বেলকনির ফ্লোর ভিজে একাকার। একটা হাত বৃষ্টির পানিতে ভিজতে ব্যস্ত। রুম থেকে কেউ একজন ঘুমন্ত কন্ঠে বারবার করে বলে যাচ্ছে,”বৃষ্টিতে ভিজে যাবে। রুমে আসো চৈতি। বৃষ্টির পানি সয় না তোমাকে।আসো বলছি।”
কে শুনে কার কথা চৈতি তো আপন খেয়ালে বৃষ্টি উপভোগ করছে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। চোখে মুখে পানির ছিটা এসে পড়লেই চোখ কুঁচকে ফেলে সে।কী এক সুন্দর অনুভূতি।
শোয়া থেকে উঠে বসে প্রহন।নিজে গিয়ে নিয়ে না আসলে মেয়েটা আসবে না।বড্ড বেশি সাহস বেড়েছে। একদমই কথা শুনতে চায় না।
বেলকনি থেকে হাসির শব্দ শুনতে পাচ্ছে প্রহন। চৈতি হাসছে,একা একা নিজের সাথে।
“তুমি আমার একটা কথা ও শোনো না চৈতি। তোমাকে বলেছি না রুমে আসতে।”
প্রহন কে বেলকনির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে গেল চৈতি। প্রহনের হাত ধরে বললো,”চলুন না আজ আবার বৃষ্টিতে ভিজি।”
“মাইর চিনো?সে বার কেমন জ্বর উঠে ছিল মনে নাই? বৃষ্টিতে ভেজার দরকার নেই।”
প্রহনের কথা শুনলো না চৈতি।আবারো চলে গেল বৃষ্টির পানি ছুঁতে। সেখানে দুই মিনিট দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই তার মনে হলো সে শূন্যে ভাসছে।
হাত পা ছুড়তে ছুড়তে বললো,”আরেএএ আপনি আমাকে কোলে নিলেন কেন? ছাড়ুন বলছি।”
প্রহন চৈতির কথার উত্তরে বলে উঠলো,”সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে আঙ্গুল বেকা করতে হয়। এতবার বললাম রুমের ভেতর এলে না তাই তো বাধ্য হয়ে আমাকেই কোলে নিয়ে যেতে হচ্ছে।”
রুমের ভেতর নিয়ে এসে চৈতি কে বিছানার উপর বসিয়ে দিল প্রহন। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিয়ে বললো,”একটা মানুষ এত চিকন হয়?৪০ কেজি ওজনের ও তো হবে না তুমি।”
চৈতি ঠোঁট ফুলিয়ে অভিমানী কন্ঠে বললো,”আপনি আমায় শুধু শুধু নিয়ে আসলেন কেন?”
“ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হবেই বা কেন?”
“আমার ভালো লাগে বৃষ্টি দেখতে। ভিজতে তো দিবেন না।তাই বলে কি দেখতে ও দিবেন না?”
চৈতির কথা শুনে প্রহন প্রত্যত্তর করলো না। বিছানায় শুয়ে পড়লো। চৈতির হাত ধরে টান মেরে নিজের বুকের উপর ফেলে গায়ে কম্বল টেনে দিলো। চৈতির চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,”ঘুমাও।”
বাঁধ সাধলো চৈতি। ফিসফিস করে বললো,”আপনি ঘুমান। আপনি ঘুমিয়ে পড়লেই তো আমি বৃষ্টি ছুঁতে পারবো।”
চৈতির মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে শান্ত কন্ঠে ভয়ঙ্কর হুমকি দিলো প্রহন।”একবার শুধু বিছানা থেকে নেমে দেখো তোমার পা ভেঙ্গে বিছানায় শোয়াই রাখবো।”
গোপনে দীর্ঘ শ্বাস ফেললো চৈতি। বিড়াল ছানার মতো শান্ত হয়ে প্রহনের বুকের ভেতর শুয়ে পড়লো। বৃষ্টি থামলে রাতের দিকে হয়তো নিজের বাবার বাড়িতে যাওয়া হবে।আর যদি বৃষ্টি পড়তেই থাকে আজ আর যাওয়া হবে বলে মনে হয় না চৈতির।
.
সময় টা তখন বিকেলের। তবে নিত্যদিনের মতো আজ আর অন্তরীক্ষে দিনমনির আধিপত্য নেই।অম্বর আজ অভ্ররের দখলদার।ভারি বর্ষণে ভিজছে পাহাড়, রাজপথ, কোলাহল পূর্ণ ব্যস্ত নগরীর অলি গলি।সতেজ হচ্ছে গাছের পাতা।বড় বড় গাছের মগডালে ভিজে একাকার হয়ে নষ্ট হচ্ছে বোবা পাখির বাসা।
প্রহনের রুমের বেলকনিতে একটা বিড়াল ডাকছে ম্যাউ ম্যাউ করে। অন্ধকার সুনসান নীরবতায় ভরপুর রুমের ভেতর নিদ্রায় আচ্ছন্ন দুই জন মানব মানবি।
বাহিরে বৃষ্টি থামার নাম নেই।মুষল ধারে বৃষ্টি হচ্ছে। এই বৃষ্টির সময় গরম গরম খেচুড়ি হলে মন্দ হয় না বলেই মিসেস ইয়াসমিন রান্না ঘরে চলে গেলেন খেচুড়ি রান্না করতে।রন্ধন প্রিয় মানুষের একটাই কাজ সঠিক একটা সময় আসলে সুন্দর একটা খাবার রান্না করে পরিবারের সবাই কে খাওয়ানো। রেদোয়ান চৌধুরী বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে বই পড়ছেন। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে আর তিনি রুমে বসে বই পড়ছেন। বৃষ্টির সময়টা বই পড়ার অন্যতম সুন্দর একটা সময়।
সাথে এক কাপ গরম চা বা কফি হলে জমে যাবে।
রেদোয়ান চৌধুরী হাঁক ছাড়লেন,”ইয়াসমিন,এক কাপ চা দিও তো।”
.
বুকের উপর ঘুমিয়ে থাকা ঘুমন্ত চৈতির চোখের সামনে এলোকেশ গুলো এসে জড়ো হয়েছে। প্রহন সেই চুল গুলো বারবার কানের পিছে গুঁজে দিয়ে ঘুমন্ত মুখটা দেখে মায়ায় আটকে পড়ার পথ খুঁজে চলেছে।
ঘুমাবে না বলে ও মেয়েটা ঘুমাচ্ছে। অথচ তার নিজের চোখে বিন্দু পরিমাণ ও ঘুম নেই। বালিশের পাশে মোবাইল টা বেজে চলেছে।হাত বাড়িয়ে মোবাইল টা নিলো প্রহন। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে আছে সিও স্যারের নাম্বার।
অবাক হলো প্রহন। সকালে ও স্যারের সাথে কথা বলেছে সে। হঠাৎ আবার কল দিল কেন বুঝলো না।বার কয়েক রিং হতেই কল রিসিভ করে সালাম দিলো।
সালামের জবাব শোনার পর স্পষ্ঠ শুনতে পেল,”আমি তোমার কাছ থেকে এটা আশা করিনি প্রহন।”
#চলবে,,,