#অন্তহীন💜
#পর্ব_২৪
#স্নিগ্ধা_আফরিন
চওড়া বক্ষের উষ্ণতা পেয়ে পাখির ছানার মতো গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে চৈতি। দুই হাতের আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে রেখেছে প্রহন। বাইরের পরিবেশ বৃষ্টিময়। ঠান্ডা ও বটে। জানলার পর্দার ফাঁক দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে প্রহন।সিইও স্যারের বলা কথা গুলো মনে পড়তেই বড় একটা শ্বাস ফেললো সে।
একটু আগে যখন সিইও স্যারের মুখে ওমন কথা শুনে ছিলো তখন মনে হচ্ছিল চাকরিটা বোধহয় গেল।
কিয়ৎক্ষন পূর্বের ঘটনা,
সিইও স্যারের কথা শুনে প্রহন বলে উঠে,
“সরি স্যার। আমি আপনার কথাটা ঠিক বুঝতে পারিনি।”
“বুঝতে পারবে না তো।আমার কাছ থেকে লুকোনোর কি খুব প্রয়োজন?একটা বার জানালে কি ক্ষতি হতো?”
“আসলে স্যার আমার কিছু করার ছিল না।”
“প্রহন, তোমার মায়ের যে শরীর এতটা খারাপ তা আমাকে বলতে তো পারতে। তোমাকে বলেছি না আমাকে আপডেট জানাতে। তাহলে তুমি বললে না কেন তোমার মায়ের ক্রিটিক্যাল অবস্থা। ভাগ্যিস রিমন আমাকে জানিয়েছে তোমার কিছু টাকার দরকার এবং ছুটির দিন বাড়িয়ে দিতে না হলে তো আমি জানতেই পারতাম না।”
সিইও স্যারের কথা শুনে থ হয়ে গেল প্রহন।কী ভেবেছিল সে আর কী হলো? তবে রিমন কে অনেক ধন্যবাদ দিতে মন চাইছে প্রহনের।টাকার দরকার না থাকলে ও আরো কয়েক দিন ছুটি প্রয়োজন ছিল প্রহনের।
“আসলে স্যার,,”
“কী আসল নকল করছো বলো তো? তোমার কত টাকা লাগবে বলো। মায়ের চিকিৎসা তো করাতে হবে তাই না?এত লজ্জা করার কিছু নাই।”
“না না স্যার।টাকার দরকার নাই। আপনি বরং আমাকে আরো কয়েক দিনের ছুটি বাড়িয়ে দিন।”
“আচ্ছা। তোমার মা হসপিটাল থেকে রিলিজ হয়ে বাড়িতে গেলে আমাকে জানিও।”
“আচ্ছা ঠিক আছে স্যার।”
নড়েচড়ে উঠলো চৈতি। ঘুমের ঘোরে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আছে প্রহন কে। ঘুমন্ত চৈতির মুখের উপর থেকে চুল সরিয়ে দিয়ে গালে আলতো করে অধর ছোঁয়ায় প্রহন।নিদ্রায় শায়িত প্রেয়সীর অজান্তে দুই বার তার গালে অধর ছুঁয়েছে রিক্ত প্রেমিক। শুনেছি, বিয়ের পর নাকি প্রেমিকরা স্বামী হয় আর স্বামীরা নাকি কখনো প্রেমিক হতে পারে না। অথচ বিয়ের পরেই তো সম্পর্কটা হারাম থেকে হালাল হয়।আর হালাল সম্পর্কে মহান সৃষ্টিকর্তা এমনিতেই ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে দেন।
বউয়ের জন্য সবটুকু ভালোবাসা খুব যত্ন করে রেখেছে প্রহন। জন্ম একবার, জীবন ও একটাই,মন একটা সেই মনের অধিকারী তো একজনই হবে। ভালোবাসা টা তো সবার মাঝে বিলিয়ে দেওয়ার জিনিস না।যে যাকে ইচ্ছা তাকেই ভালোবাসায় ভরিয়ে দেওয়া যাবে।
চৈতির মাথা হাতের উপর থেকে সরিয়ে বালিশের উপর রাখলো প্রহন। ধীরে সুস্থে চৈতির কাছ থেকে সরে বিছানা থেকে নেমে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
সময় টা তখন বিকেল সাড়ে ৫টা।আজ গোধূলি নেই।অন্তরীক্ষ জুড়ে লাল নীল হলুদ কমলা রঙের সুন্দর সংমিশ্রণ নেই। ধূসর রঙের নীরদ বাহনে ভরে আছে অম্বর। বৃষ্টি থামার নাম নেই। ঝিরঝির করে পড়ছে তো পড়ছেই। চারদিকে ঝাপসা আঁধার।
মিসেস ইয়াসমিন চুলায় খেচুরি বসিয়েছেন। রেদোয়ান চৌধুরী গরম চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন আর মনোযোগ সহকারে বইয়ের অবাস্তব কাহিনী পড়ছেন।
বই পড়ুয়া বাবাকে এক পলক দেখে মায়ের কাছে চলে গেল প্রহন। রান্না ঘরের দরজায় হেলান দিয়ে মায়ের দিকে তাকালো প্রহন।
বেশ অনেক দিন পর মাকে আজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। চোখের চশমাটার পাওয়ার বাড়াতে হবে। শরীরের চামড়ায় ভাঁজ পড়ছে। চোখের দৃষ্টি শক্তি ও কমে গেছে আগের চেয়ে। মাথার চুল পাকা ধরেছে।
তবু ও কি সুন্দর, স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে মাকে। কোমরে শাড়ির আঁচল গুঁজে মন দিয়ে রান্না করছেন।মা বাবা কে ছেড়ে থাকার চিন্তা ও করতে পারে না সে। অথচ সময় যত যাচ্ছে বাবা মা কে হারিয়ে ফেলার ভয় ও তত বাড়ছে।তারা যে বৃদ্ধ হচ্ছে।
মিসেস ইয়াসমিন এর চোখ পড়লো তার দিকে তাকিয়ে থাকা প্রহনের দিকে।
বড্ড আদরের ছেলে তার। প্রহন তার বাবা মায়ের দ্বিতীয় সন্তান। প্রহনের আগে মিসেস ইয়াসমিন আর রেদোয়ান চৌধুরীর ঘর আলো করে তাদের রাজকন্যা জন্ম নেয়। মিসেস ইয়াসমিন খুব শখ করে মেয়ের নাম রেখেছিলেন ইতি।ইতির বয়স যখন দুই মাস তখন ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল ছোট মেয়েটা। জীবনের গল্পের ইতি টেনে মা বাবার কোল খালি করে পরপারে পাড়ি জমায়।তাই হয়তো মিসেস ইয়াসমিন এবং রেদোয়ান চৌধুরী চৈতির মূল্যটা বুঝতে পারেন। চৈতি কে ও নিজেদের মেয়ের মতোই ভালোবাসেন।
প্রহন মায়ের দিকে এগিয়ে গেল। মুচকি হেসে বললো,”কী রান্না করছো আম্মু?”
মিসেস ইয়াসমিন তরকারি নাড়তে নাড়তে বললেন,”খেচুরি আর গরুর মাংস ভুনা।”
দীর্ঘ শ্বাস নিলো প্রহন।”আহ্ কী সুন্দর ঘ্রান আসছে। রান্নার জন্য তুমি কিন্তু বেস্ট আম্মু।”
মিসেস ইয়াসমিন প্রহনের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রত্যত্তরে বললেন,”চৈতির রান্না ও কিন্তু অনেক মজার। একবার খেলে আরেক বার খেতে চাইবি না।”
মায়ের কথা শুনে কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকালো প্রহন।
“মজার আবার একবারের বেশি খাওয়া যাবে না এর মানে কি আম্মু? তার চেয়ে ও বড় কথা চৈতি রান্না পারে নাকি?”
মিসেস ইয়াসমিন এর সোজা সাপ্টা উত্তর,”পারে না। আমার মতন রান্না শিখেয়ে দিবো চৈতি কে।যেনো কখনো আমার অনুপস্থিতিতে ও আমার রান্নার মতন রান্নার স্বাদ পাস।”
মায়ের কথা শুনে বুকের ভেতর কেপে উঠলো প্রহনের। পেছন থেকে মাকে জড়িয়ে ধরে নরম গলায় বললো,”তোমার আর বাবার অনুপস্থিতির সময়টা কখনো না আসুক। আমি তোমাদের ছেড়ে থাকতে পারবো না।”
প্রহনের কথা শুনে হাসেন মিসেস ইয়াসমিন। ছেলেটা ছোট থেকেই মা বাবার জন্য পাগল। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,”অনেক সময় তো হলো। চৈতি কে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুল। মেয়েটা দুপুরে ও ঠিক মতো খায়নি।”
প্রহন ছোট্ট করে উত্তর দিলো,”হুম।”
রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে গেল প্রহন। শীত শীত অনুভব হতেই ঘুম ভেঙ্গে যায় চৈতির। আঁখি পল্লব মেলে তাকিয়ে রুমের ভেতর শুধু নিজেকেই আবিষ্কার করলো সে। দুই হাত দিয়ে চোখ কচলিয়ে দৃষ্টি পরিষ্কার করলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে প্রহন কে খুঁজলে। কিন্তু পেলো না। দুপুরে কেন জানি খুব রাগ হয়েছিল প্রহনের উপর। সামান্য কাঁধ ধরতেই কী রাগটাই না করেছিল। সেই সব কথা মনে পড়তেই আনমনে হাসলো চৈতি। কেন জানি মাঝে মধ্যে মনে হয় এই মানুষটি কে ছাড়া তার চলবেই না। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই মানুষ টা কেই চাই তার। রুমের ভেতর এসে চৈতি কে বিছানায় বসে বসে এমন মুচকি মুচকি হাসতে দেখে শয়তানি হাসে প্রহন। চৈতির কাছে গিয়ে বলে উঠে,”কী বউ, ঘুমের মধ্যে কী রোমান্টিক স্বপ্ন দেখেছো যে এমন করে মিটিমিটি হাসছো?”
প্রহনের এহেন কথায় হাসি মিলিয়ে যায় চৈতির। বিরক্ত হয়ে বলে উঠে,”আপনার কী এই সব কথা ছাড়া অন্য কোনো কথা জানা নাই?”
চৈতি কে রাগিয়ে দিতে সক্ষম হয় প্রহন। আরেক টু রাগিয়ে দেওয়ার জন্য বলে উঠে,”একটু এই দিকে আসো তো, কপালে একটা আদর দিই।”
এহেন কথায় বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নেমে দাঁড়ায় চৈতি। কাভার্ডের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করে বলে,”দূরে থাকুন। একদম কাছে আসবেন না।”
কাউকে জ্বালানোর সুযোগ পেলে তা হাত ছাড়া করতে নেই।সুযোগ কাজে লাগাতে হয়। সেই কাজটাই এখন করছে প্রহন।এক পা এক পা করে চৈতির দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললো,”একটু কাছে যাই না।কী হবে? কিচ্ছু হবে না তো।”
চৈতি আমতা আমতা করে বললো,”ভালো লাগে না আমার। দূরে থাকুন প্লিজ।দম আটকে আসে।”
চৈতির কথা শুনে দাঁড়িয়ে পড়লো না প্রহন। বরং একদম চৈতির কাছে এগিয়ে গেল। চৈতি সরে যেতে নিলে চৈতির হাত ধরে টেনে নেয় প্রহন। দুই হাতের আলিঙ্গনে জড়িয়ে নেয় কিশোরী বউ কে।অন্য এক নেশায় আসক্ত কন্ঠে বলে উঠে,”তুমি মরে যাও চৈতি। আমার ভালোবাসায় দম আটকে একেবারে মরে যাও।”
#চলবে,,,