অন্তহীন💜 পর্ব-২৬

0
2262

#অন্তহীন💜
#পর্ব_২৬
#স্নিগ্ধা_আফরিন

শহর জুড়ে হিমেল পরশ, রাতের উষ্ণতার পারদ ক্রমাগত নিম্নমুখী।বাইরে ঠান্ডা হলে ও ঘুমন্ত মানবির উষ্ণ নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে লোমশ বুকে। ঘড়ির কাঁটা টিকটিক শব্দ করে জানান দিচ্ছে ১টার ঘরে এসেছে সে। নগরীর কলোহল নেই এই গভীর রজনীতে।মাঝে মাঝে দুই একটা গাড়ির হর্নের আওয়াজ যেনো ঝংকার দিয়ে উঠছে নিস্তব্ধ পরিবেশে।রাত জাগা পাখি গুলো ডাকছে। আচমকা ঘুম ভেঙ্গে যায় চৈতির। ঘুম ভাঙ্গতেই রাত জাগা পেঁচার ডাক কর্ণপাত হতেই গা ভারী হয়ে এলো যেনো। বুকের ভেতরে ও কেঁপে উঠলো। অদ্ভুত রকমের পাখির ডাকটাকে ভীষণ ভয় পায় চৈতি। ছোট বেলায় শুনে ছিলো,এই পাখি ডাকলে নাকি আপন কেউ মারা যায়। যদি ও এটা যুক্তিহীন গ্রাম্য প্রচলিত কথা।রাত জাগা পাখির কাজই তো রাতে ডাকা। কিন্তু এই ডাকটা শুনলে কেন জানি শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠে।
ভয়ে প্রহনের পিঠে খামচে ধরে বুকে মুখ গুঁজে দেয় চৈতি। চৈতির খামচে ধরার কারণে প্রহন ঘুমঘুম কন্ঠে বলে উঠে,”আছি তো আমি।ভয় পাচ্ছো কেন? কোনো দুঃস্বপ্ন দেখেছো?”
চৈতি উত্তর দিলো না। চোখ থেকে ঘুম পুরোপুরি হারিয়ে গেছে। প্রহন চৈতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,”ঘুমিয়ে পড়ো।ভয় পাচ্ছো কেন? কিচ্ছু হবে না।সব ঠিক আছে।”
ভালো লাগে, খুব ভালো লাগে এক অন্যরকম শান্তি লাগে মনের গহীনে যখন কিছু না বললেও কেউ একজন বুঝে যায়। চৈতি প্রহনের কাছ থেকে সরে গেল। দূর থেকে আশা পাখির ডাকটাও নেই এখন। দূরে সরে গিয়ে পাশ ফিরে শুতেই কোমর জড়িয়ে ধরে নিজের বুকের সাথে চৈতির পিঠ ঠেকিয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বললো,”দূর সরে থাকার জন্য এত দূর থেকে আসিনি।”
______________
একটা সুন্দর সকাল। দুই দিন একনাগাড়ে বৃষ্টি হবার পর আজ অম্বরে আদিত্যর দেখা মেলেছে।টানা দিন দুই নীরদের সাথে লুকোচুরি খেলে আজ ধরিত্রীতে তেজ ছড়াতে পেরে ক্ষান্ত হলো সূর্য।গাছ গাছালি সতেজ, ছাদের উপর থেকে পুষ্পের মিষ্টি সৌরভে মৌ মৌ করছে চারপাশ।মুক্ত আকাশে পাখা মেলে উড়ছে স্বাধীন পাখিরা।
ঘুম থেকে উঠেই গোছগাছ শুরু করে দিয়েছে চৈতি। সরদার সাহেব ফোন করে জানিয়ে দিয়েছেন আটটা বাজার আগেই যেনো পৌঁছে যায়।
সকালের নাস্তা টা করে যাওয়ার জন্য নিষেধ করেছেন তিনি। এমন অদ্ভুত মানুষ ও হয়?হয়তো হয় এই যে যেমন সরদার সাহেব।
ব্যাগের চেইন টেনে দেয়াল ঘড়ির দিকে এক পলক তাকালো চৈতি।৬টা বেজে ৪৫ মিনিট। প্রহন তৈরি হয়ে বিছানায় বসে বসে ভ্রু কুঁচকে চৈতির কাজ করা দেখছে। মেয়েটা আজকে ও শাড়ি পড়েছে। কলাপাতা রঙের শাড়িটার পার গোলাপি রঙের। প্রহন অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল রমনীর দিকে। নিজের মনে নিজেই বলে উঠে,”ভাবা যায় এই মেয়েটাকে বিয়ে করতে আমি রাজিই ছিলাম না।অথচ আজ এই মেয়েকে ছেড়ে থাকতে ও আমার দম আটকে আসে।”
মিসেস ইয়াসমিন হাতে করে একটা গয়নার বাক্স নিয়ে আসলেন প্রহনের রুমে। বিছানার উপর বাক্সটা রেখে চৈতির হাত ধরে কাছে টেনে নিলেন।মোটা মোটা দুটো বালা পরিয়ে দেন চৈতির হাতে।কানে বড় দুল দিতে পারে না দেখে মাঝারি সাইজের দুল পরিয়ে দিলেন। গলায় সাধারণ ডিজাইনের হার পরিয়ে দিয়ে চৈতির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসেন মিসেস ইয়াসমিন। চৈতির ডান হাতের কণে আঙ্গুলটাতে হালকা কামড় দিয়ে বললেন,”কারো নজর না লাগুক।”
মায়ের কথা শুনে প্রহন বলে,”পেত্নীর উপর আবার কোন পেত্নীর নজর পড়বে বলো?”
প্রহনের কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে চোখ ছোট ছোট করে তাকায় চৈতি। কোমরে দুই হাত রেখে কিছুটা ঝুঁকে গিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,”আমাকে পেত্নীর মতোন লাগে কোন দিক থেকে?”
প্রহন ঠাট্টার স্বরে বলে,”সব দিক থেকেই পেত্নীর মতো লাগে।পেত্নী সুন্দরী।”
বলেই হেসে উঠে প্রহন। তার হাসির সাথে যোগ দেন মিসেস ইয়াসমিন ও। চৈতি দুই জনের দিকে তাকিয়ে রাগে গজগজ করতে করতে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। উদ্দেশ্যে রেদোয়ান চৌধুরীর কাছে বিচার দেওয়া।
‍”আচ্ছা মতন বকা না খাওয়ালে হবে না। আমাকে পেত্নী বলা বিচার দিবো আব্বু কে।”বিড় বিড় করতে করতে রেদোয়ান চৌধুরীর রুমের সামনে চলে গেল চৈতি। রেদোয়ান চৌধুরী হাতে ঘড়ি পড়ছিলেন। দরজার সামনে চৈতি কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুচকি হেসে ভেতরে ডাক দিলেন। চৈতি কে গাল ফুলিয়ে থাকতে দেখে আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করলেন,”আমার মাটার কী হয়েছে?”
চৈতি রেদোয়ান চৌধুরীর মুখের দিকে তাকিয়ে অভিযোগি কন্ঠে বললো,”আপনার ছেলে আমাকে পেত্নী বলেছে। তার কথা শুনে ভালো মা কিছু না বলে হাসছে।”চৈতির এহেন কথায় রেদোয়ান চৌধুরী হাসবেন না কাঁদবেন বুঝতে পারছেন না। চৈতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,”তুই প্রহনকে শাখামৃগ বলে দিবি। তাহলে শোধ বোধ হয়ে যাবে।”
চৈতি ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলো,”শাখামৃগ টা আবার কী?”
রেদোয়ান চৌধুরী কপাল চাপড়ালেন। সত্যি বলতে শাখামৃগর অর্থ তিনি নিজেও জানেন না।
.
সরদার সাহেবের বাড়িতে যাওয়ার পথে হসপিটাল থেকে নিজের মোবাইল টা নিয়ে আসে প্রহন। পেশেন্ট এর অবস্থা আগের চেয়ে অনেক ভালো।তার কাছ থেকেই প্রহন জানতে পারে আসলে তার মোবাইল টা চুরি করা হয়েছিল খুব সতর্ক ভাবে।চুরি করে দৌড়ে রাস্তা পার হতে গিয়েই কভার ভ্যানের ধাক্কায় আহত হয়ে যায় মহান মোবাইল চোর। প্রহন এই কথা শুনে চোরের উদ্দেশ্যে বলেছিল,”আরো আরো করো চুরি।চুরি করে দৌড়ে যাওয়ার সময় গাড়ির ধাক্কায় পটল তুলতে চলে যাও।হাত পা সব ঠিক আছে আল্লাহ সব কিছু ঠিক করেই দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। তাহলে কাজ করে খাইলে কী হয়?”
প্রহনের কথা শুনে প্রত্যত্তরে চোর মহাশয় বলেছিল,”প্রেমিকার জন্মদিন আজ। তাকে একটা দামী মোবাইল গিফট করতে চেয়ে ছিলাম। আমার কাছে এত টাকা ছিল না তাই চুরি করতে বাধ্য হয়েছি।”
ছেলেটার ভাগ্য ভালো ছিল যে সে অসুস্থ ছিল।তা না হলে এতক্ষণে গালে হাত দিয়ে মুখের ভেতরের দাঁত খুঁজতে হতো।
চুরি করা মোবাইল প্রেমিকা কে গিফট করে মহান প্রেমিক হতো ভাবা যায় এটা?এরাই তো সত্যি কারের প্রেমিক। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মোবাইল চুরি করে পালাতে গিয়ে এক্সিডেন্ট হয়ে হসপিটালে পরে থাকে।
প্রহন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে বলে উঠে,”তা যার জন্য আমার মোবাইল চুরি করলা সেকি আসছে তোমারে দেখতে?”
পাশ থেকে ছেলেটার এক বন্ধু বলে,”ও মরলেও নাকি ওর প্রেমিকার কিছু যায় আসে না।”
আহারে ভালোবাসা।কেউ একজন তাকে খুশি করতে মোবাইল চুরি করে দৌড়ে পালাতে গিয়ে এক্সিডেন্ট হয়ে মরতে মরতে বাঁচলো আর সে বলে কিনা ছেলেটা মরলে ও তার কিছুই যায় আসে না। অদ্ভুত!
প্রহনের মায়া হলো ছেলেটার জন্য।দেখে ভদ্র ঘরের ছেলেই মনে হয়। ছেলেটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,”এখন ও অনেক সময় আছে ছোট ভাই। সত্যি কারের ভালোবাসা চিনতে শিখো।”

হসপিটালের কাহিনীটাই চৈতি কে বলছিলো প্রহন। চৈতির সামনেই বসে ছিল প্রহন। আচমকা চৈতি প্রহন কে জড়িয়ে ধরে প্রশান্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,”আমি সত্যি কারের ভালোবাসা পেয়েছি।চিনতে ও শিখে গেছি।”
প্রহন মুচকি হাসে।অধর জুড়ে হাসির রেখা টেনেই বলে,”দিন দিন তুমি বেশিই জড়িয়ে ধরছো চৈতি।হুট হাট করে এতো জড়িয়ে ধরছো কেন? লজ্জা করে না একটা পুরুষ কে এমনে হুট করে জড়িয়ে ধরতে।”

শার্টের উপরেই প্রহনের বুকের উপর কামড় বসায় চৈতি।আরো একটু জড়িয়ে ধরে বলে,”আমার একান্ত ব্যাক্তিগত সম্পদকে আমি যখনই মন চাইবে জড়িয়ে ধরবো। তাঁতে আপনার কী?”

হাসলো প্রহন।আলতো করে চৈতির কপালে অধর ছুঁয়েই বলে “আমার কথা আমাকেই ফিরিয়ে দিচ্ছো?চালাক হয়েছো দেখছি।”

চৈতি প্রহনের কাছ থেকে দূরে সরে গেল।জুনাইদা ডাকছেন। রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,”এই পর্যন্ত কয়বার আমার কপালে চুমু খেলেন বলেন তো?”

প্রহন মুচকি হেসে উত্তর দিলো,”দুই বার।”

“মিথ্যেবাদী। পাঁচ ছয়বার তো দিয়েছেন।”
চৈতির কথা শুনে অবাক হলো প্রহন। শুধু দুই বারই চৈতির জানতে দিয়েছে। প্রহন অবাক হয়ে বললো,”তুমি কি জানো?”
চৈতি মুচকি হেসে বললো,”কপাল,গাল গুলো তো আমারই।”

#চলবে,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here