শেষ রাত পর্ব-২২

0
1549

#শেষ_রাত
#পর্বঃ২২
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

‘তোর কি মনে হচ্ছে না দুলাভাইকে বিয়ে করার সিদ্ধান্তটা তুই ঠিক নিয়েছিস! আমার কেন যেন মনে হচ্ছে দুলাভাই তোর জন্য পারফেক্ট। দুলাভাই-ই একমাত্র ব্যক্তি যে তোকে ভালো রাখতে পারবে।’

সানির কথার প্রতিত্তোরে আমি কিছুই বললাম না। নির্লিপ্ত চোখজোড়ার দৃষ্টি নামিয়ে একদম পায়ের কাছে এনে স্থির করলাম। আশেপাশের হৈচৈ আর সানির বলা একের পর এক কথা কোনটাই কানে এসে পৌঁছালো না। আমার মস্তিষ্কে চলতে থাকা চিন্তাধারা গুলো একটা জায়গায় এসে থমকে গেল। পৃথিবীর কেউ কারও জন্য পারফেক্ট নয়। কেউ কাউকে পুরোপুরি ভালো রাখতে পারে না। কেউ বিনাকারণে কাউকে ভালোবাসে না। প্রয়োজন ছাড়া পৃথিবীতে কিছুই হয় না। কারণ ছাড়া একটা পাতাও নড়ে না। সব কিছুতেই কারণ আছে, স্বার্থ আছে। আচ্ছা ধ্রুবর ভালোবাসা কি সত্যি! আর সত্যি হলেও এই ভালোবাসার কারণ কি? আমার ভগ্নহৃদয়ের প্রতি সহানুভূতি? না-কি জোরজবরদস্তি হয়ে যাওয়া স্ত্রীকে মেনে নেওয়ার প্রচেষ্টা? হঠাৎ করেই কেন ভালোবাসা হলো? এত এত প্রশ্নের জবাব কে দিবে আমায়? ধ্রুব কি দিতে পারবে আমার সকল প্রশ্নের জবাব!
ক্লাসে রুমে এসে পা রাখতেই আমার মস্তিষ্ক স্থির হয়ে গেল। পরিবর্তন হলো আমার মন। বিশৃঙ্খল সকল চিন্তাভাবনা তালাবদ্ধ করে রাখলাম মনের মাঝে। মস্তিষ্কে পুরোটা জুড়ে শুধুই পরিক্ষা নিয়ে ভাবতে লাগলাম। মনি মা’র কথা মনে পরতেই মনটা ভালো হয়ে গেল। তার মেয়ে আমি। তার সব ইচ্ছে পূরণ করতে হবে আমাকে। মোহনা আপু না পারলেও আমাকে পারতে হবে। খুব মনোযোগ দিয়ে পরিক্ষা দিলাম। যতটা আশা করেছিলাম তার চেয়েও ভালো লিখেছি পরিক্ষার খাতায়। ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেইটের কাছে এসে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার অবচেতন মন বলছে ধ্রুব আমাকে নিতে আসবে। আমি অপেক্ষা করলাম। একমিনিট, পাঁচ মিনিট, দশমিনিট অনেকটা সময় ধরেই অপেক্ষা করলাম। ধ্রুব আসলেন না। এমন কি ফোন করে কিছু জানালেনও না। আমি তবুও পথ চেয়ে রইলাম ধ্রুবর জন্য। সানি হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিল। ক্লান্ত গলায় বলল-

‘দোস্ত চল না আমরা একাই চলে যাই। দুলাভাই বোধহয় আসবে না। শুধু শুধু দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করার কোনো মানে হয় বল!’

সানি কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে কিছু একটা ভাবলো। পরক্ষণেই উত্তেজিত হয়ে বলল-

‘কি অদ্ভুত! দুলাভাই আসবে কি-না তা ওনাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলেই তো হতো৷ কি বোকা আমরা। এতক্ষণ কেন আসলো না এই বুদ্ধি! যাইহোক সময় নষ্ট না করে দুলাভাইকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস কর আসবে কি-না।’

আমি শান্ত চোখে সানির দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ক্ষীণ স্বরে বললাম-

‘আমি কখনো ওনাকে নিজে থেকে ফোন দেইনি।’

সানি প্রচন্ডরকম অবাক হয়ে আমার দিকে তাকায়। চোখের ছানা বড় বড় করে অবিশ্বাসের গলায় বলল-

‘তুই দুলাভাইকে নিজে থেকে ফোন দিস নি মানে কি? বিয়ের এতদিন হয়ে গেলো অথচ তুই দুলাভাইকে একবারও নিজে থেকে কল করিসনি?’

আমি প্রতিত্তোরে ছোট্ট করে একটা শ্বাস ফেলে দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম। রাস্তার দিকে তাকাতেই দেখলাম ভাইয়া আসছে। আমার সামনে এসেই হাঁটুতে দু’হাত ভর দিয়ে ঝুঁকে হাঁপাতে লাগলো। নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে ক্লান্ত গলায় বলল-

‘ওই রোডে প্রচুর জ্যামরে অনু। জানিস তোর জন্য কতটা পথ আমার হেঁটে আসতে হয়েছে!’

আমার সরু দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম ভাইয়ার ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত মুখের দিকে। দু-হাত আড়াআড়ি ভাবে ভাঁজ করে সন্দিহান কন্ঠে বললাম-

‘আমি বলেছি তোকে আসতে?’

‘তুমি বলো নাই কিন্তু তোমার স্বামী মানে আমার ধ্রুব ভাইয়ের হুমুক তার মহারানীকে যেন আমি যত্নসহকারে কোলে করে বাসায় নিয়ে যাই।’

ভাইয়ার বিকৃতভাষ্য শুনে আমি জ্বলন্ত চোখে চাইলাম। পরক্ষনেই নিজের রাগ সামলিয়ে নিয়ে শান্ত গলায় প্রশ্ন করলাম-

‘উনি তোকে আসতে বলেছে কেন?’

‘আরে ধ্রুব ভাইয়ের-ই তো আসার কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই নাকি জরুরী কাজ পরে গেছে তাই তো আমাকে ফোন করে বললো তোকে নিয়ে যেতে। এখন চল তাড়াতাড়ি। অন্য রাস্তা দিয়ে ঘুরে যেতে হবে। সানি তুইও চল।’

ভাইয়া তৎক্ষনাৎ একটা অটোরিকশা থামিয়ে আমাদের নিয়ে উঠে পরলেন। বেশ খানিকটা পথ যেতেই তীক্ষ্ণ শব্দে আমার ফোন বেজে উঠল। আমি ফোন হাতে নিতেই স্কিনে ধ্রুবর ছবি আর তার নিচে স্পষ্ট একটা নাম ভেসে উঠলো ‘তুলতুলের আব্বু।’ নিজের অজান্তেই খানিকটা স্বস্তি বোধ করলাম।

‘কিরে ফোন রিসিভ করছিস না কেন!’

সানি আমার গায়ে হাল্কা ধাক্কা দিতেই আমি অপ্রস্তুত হয়ে দ্রুত ফোন রিসিভ করলাম। সাথে সাথেই ধ্রুব নিম্ন স্বরে বললেন-

‘সরি আমি আসতে পারিনি৷ আসলে হঠাৎ করেই একটা জরুরি কাজ পরে গিয়েছিল। তাই শাকিলকে বলেছি যেন আপনাকে নিয়ে আসে।’

‘ঠিক আছে সমস্যা নেই। আমি বুঝতে পারছি।’

ধ্রুব কিছুটা সময় নিশ্চুপ থেকে ভীষণ আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করলেন-

‘পরিক্ষা ভালো হয়েছে?’

আমি ছোট করে ক্ষীণ স্বরে বললাম ‘হ্যাঁ’।

‘এখন কি রাস্তায়?’

‘ হুম।’

‘শাকিল আছে সাথে?’

‘ হুম আছে।’

আমাদের কথার মাঝে আচমকাই ভাইয়া সামনে থেকে ধমকে উঠলো৷ রাগে চিড়বিড় করে বলল-

‘এসব কি ধরনের কথাবার্তা অনু! হ্যাঁ, হুম এসব কেমন কথা? আমার তো শুনেই বিরক্ত লাগছে ধ্রুব ভাইও নিশ্চয়ই বিরক্ত হচ্ছে। তুই কি লজ্জা পাচ্ছিস আমার সামনে কথা বলতে! অদ্ভুত ব্যাপার তো। আমি তো তোকে কখনও আমার সামনে লজ্জা পেতে দেখিনি।’

ভাইয়ার কথার সুর টেনেই সানি কৌতুক করে বলল-

‘নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে একটু আধটু লজ্জা পাওয়াটাই স্বাভাবিক শাকিল ভাই।’

এতক্ষন লজ্জা না পেলেও সানি আর ভাইয়ার কথায় এবার আমি সত্যি সত্যিই লজ্জা পেলাম। লজ্জাভাব আরও প্রখর হলো যখন ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে ধ্রুবর তরল ভঙ্গির হাসি শুনতে পেলাম। লজ্জায় লাল হতে লাগলাম আমি। ইচ্ছে করলো নিজেকে আড়াল করে নেই সব কিছু থেকে। কিন্তু এটা সম্ভব না কিছুতেই না। ধ্রুব নামক এই নির্লিপ্ত মানুষটার কারনেই প্রতিদিন নতুন নতুন অনুভূতির সঙ্গে নিজেকে পরিচিত করতে হবে।

বিষন্নতার চাদরে মোড়ানো রাতের আকাশ। ধূসর কালো মেঘগুলো ভাসছে বাতাসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। প্রবলবেগে বইছে বৈশাখের ঝোড়ো হাওয়া। আকাশের দিকে উদাসীন চোখে চেয়ে আনমনেই ভাবতে লাগলাম ধ্রুব এখন কি করছে? তিনিও কি আমার মতোই এই বিষন্ন আকাশ দেখছে? ওনাকেও কি ছুঁয়ে দিচ্ছে এই বিশৃঙ্খল বাতাস? ভীষণ এলোমেলো হয়ে আছে আমার মন। কাল দুপুর থেকে ধ্রুবর সঙ্গে একবারও কথা হয়নি। ধ্রুব ফোন দেয়নি আর আমিও ফোন করে ওনার খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করিনি। মনি মা’র কাছেও লজ্জায় কিছু জিজ্ঞেস করতে পারিনি। সব কিছুতেই যেন একটা দ্বিধাবোধ কাজ করে। ইচ্ছে করলেও সব ইচ্ছে পূরণ করতে মন সায় দেয় না। দ্বিধাবোধ আর অস্বস্তিতে বাধা পরে যায় সকল ইচ্ছে। ফোনের রিংটোনের শব্দে আমার ভাবনায় ছেদ পরলো। ক্ষীণ বিরক্তি নিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ালাম। ধ্রুব ফোন করেছে। খানিকক্ষণ স্থির চেয়ে থাকলাম স্কিনের দিকে। কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন রিসিভ করে কানের কাছে ধরলাম। ফোনের অপরপ্রান্তের মানুষটা নির্লিপ্ত কন্ঠে বললেন-

‘আমি অপেক্ষা করছি। দু মিনিটের মধ্যে বাহিরে আসুন।’

আমাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই ধ্রুব লাইন কেটে দিলেন। আমি হতভম্ব হয়ে ফোন হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। পুরো বিষয়টা যেন মাথার উপর দিয়ে গেল। এই রাতের সময় বাহিরে কিভাবে? আর উনি অপেক্ষা করছেন মানে কোথায় অপেক্ষা করছেন? সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই ধ্রুবর সতর্কবার্তা এসে পৌঁছালো আমার ফোনে। ‘এক মিনিট বাকি জলদি আসুন।’ ধ্রুব মেসেজ দেখেই আমি হড়বড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম। ড্রয়িং রুমে কাউকে না দেখে পা টিপে চুপিচুপি বেরিয়ে এলাম বাসা থেকে। গেইটের কাছে আসতেই গাড়ি নিয়ে ধ্রুবকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। দু হাত পকেটে গুঁজে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। ল্যাম্পপোস্টের আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তার শান্ত শীতল মুখশ্রী। আমি ওনার দিকে এগিয়ে এসে বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করলাম-

‘ভেতরে না এসে এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আর আমাকেই বা বাহিরে আসতে বললেন কেন?’

ধ্রুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। পকেট থেকে হাত বের করে তার এলোমেলো চুলে নিখুঁত কাজ চালিয়ে দিলেন। সুন্দর করে চুল গুলো গুছিয়ে নিয়ে আমার প্রশ্ন পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে বললেন-

‘ Let’s go’

‘কোথায় যাবো?’

আমার প্রশ্নে ধ্রুব খুব সহজ গলায় বললেন-

‘আমি যেখানে যাবো সেখানেই।’

আমি ভ্রু কুচকে ফেললাম। ওনার কথায় নাকোচ করে বললাম-

‘আমি কোথাও যাবো না। আমার ইচ্ছে করছে না। বাসায় কেউকে বলে বের হইনি।’

ধ্রুব বাঁকা হাসলেন। অতি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন-

‘আপনার ইচ্ছে না করলেও যেতে হবে। if i call you, you have to be there.’

আমি আগের মতোই ভ্রু কুচকে বিস্মিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ধ্রুব বোধহয় কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলেন। কড়া গলায় বললেন-

‘যা বলেছি তা করুন। তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে বসুন তুলতুলের আম্মু।’

আমি যন্ত্রের মতো চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসলাম। ধ্রুবও বসলেন। আমার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে বললেন-

‘সিট বেল্ট লাগিয়ে নিন।’

ধ্রুবর কথা মতোই আমি সিট বেল্ট লাগিয়ে নিলাম। গাড়ি চলছে। এলাকার গলি পেড়িয়ে চলে এলো অন্য রাস্তায়। আমি কিছুটা ইতস্তত করে বললাম-

‘কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে? আর বাসায় এসে ভেতরে যান নি কেন? আম্মু আমাকে না পেয়ে চিন্তা করবে তো।’

‘বউয়ের সাথে প্রেম করতে এসেছি। এতে আমার বোকাসোকা শ্বাশুড়ি ভিলেন হবেন বলে তো মনে হয়না।’

চলবে…

[রিচেক করা হয়নি। ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here