বিন্নি ধানের খই পর্ব-১৩

0
3533

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_১৩
#মিদহাদ_আহমদ

মদ খেয়ে মাতাল হয়ে উঠা যে স্বামীকে নিয়ে আমি আমার স্বপ্ন দেখা শুরু করেছি নতুন করে, সেই স্বামী যখন আরেকটা মেয়ের স্কেচ দেখিয়ে বললো, ‘সে আমার প্রেমিকা’ আমি তখন একেবারে থমকে গেলাম। স্থির বয়ে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। বারান্দার লাল সাদা লাইটের ভেতরে আসিফের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, কেমন জানি প্রফুল্লতা কাজ করছে তার মধ্যে! আমি আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করার মতো সাহস আর পেলাম না। যাকে বলে একেবারে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া! আসিফ নিজ থেকেই বললো,

‘আমি যখন ক্লাস নাইনে ভর্তি হয়েছি জালালাবাদ ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজে, তখন সেই মেয়েটার সাথে আমার পরিচয়৷ ঠিক পরিচয়টা বলতে গেলে, আমরা একসাথে বাসে আসা যাওয়া করতাম। সে ক্লাস এইটে তখন। মিষ্টি একটা মেয়ে। একটা মেয়ের মধ্যে যে বাচ্চামো স্বভাবগুলো আঁকড়ে থাকে একটা বয়স অবধি তার মধ্যে এগুলো ছিলো না। আমিও টিনেজ। নতুন করে সবকিছুতেই ভালোলাগা কাজ করা শুরু করেছে। সারাদিন স্কুলে ক্লাস শেষে যখন স্কুলের বাসে করে বাসায় ফিরতাম, তখন প্রতিদিন ওকে আমার অপজিট সাইটের সিটে বসে থাকতে দেখতাম। এই শুরু। তারপর কত কেচ্চা কত কাহিনী! আমাদের মাঝে একটা সুন্দর বন্ডিং হয়ে গেলো। আমি তাকে প্রপোজ করলাম পরের একুশে ফেব্রুয়ারিতে। এই দিনটাও ছিলো স্পেশাল। সে ভালো নাচ জানতো। স্কুলের অডিটোরিয়ামে তার একক নৃত্য হলো। কী তাল! কী লয়! গানের সাথে ওর নাচে যেনো এক মোহনীয় আবেশ নিয়ে এলো গোটা মহলে! আমার আগে থেকেই তার সবকিছু ভালোলাগে। সেদিনের ভালোলাগার পর আর আটকাতে পারলাম না নিজেকে। তাকে সরাসরি বলেই দিলাম নিজের ভেতরে কথাটা। দিন দুয়েক পর সাইন পেলাম, সে রাজি। আমি একেবারে আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে বসলাম!’

এই বলেই আসিফ চুপ করে গেলো। আমি নিরবে তার কথা শুনে যাচ্ছিলাম। মাঝখানে কোন কথাই আমি বললাম না আর। আসিফের এই চুপ করে থাকার সিদ্ধান্তে সে অনড়। কথার মাঝখানে চুপ হয়ে থাকা শুরু হলে আর কথাই শুরু হয় না। আসিফ সিগারেট ধরালো। তারপর বললো,

‘তুমি রুমে চলে যাও। এখানে থাকলে সিগারেট তোমার ক্ষতি করবে’

দরজায় নক করলো এমন সময়ে আমার ননদ। সে ঢুকে আসিফকে বললো,

‘আর এভাবে মদ সিগারেটে কতদিন সংসার করবি তুই? কিছু তো বুঝেশুনে চল এবার! মা তামান্নার বিয়ে ঠিক করছেন৷ তুই তো এসবে কোন খেয়াল রাখিস না! ছেলের বাসা থেকে ফোন করে জানিয়েছে তারা আগামীকাল পানচিনি করে ফেলতে চায়। তাদের সময় শর্ট। অনেক আয়োজন করতে হবে। তাদের কথার উপর তো আর কথা বলা যায় না।’

বোনের কথা শুনেও আসিফ কোন রিয়েক্ট দেখালো না। আমি বললাম,

‘ আপা এতো তাড়াতাড়ি? মাত্রই না তারা কনে দেখে গেলো আর এত তাড়াতাড়ি পানচিনি বিষয়টা…’

‘কেন? তোমার অসুবিধা? তোমার বাপের বাড়ি থেকে টাকা এনে আমার বোনের পানচিনি করছি? তোমার সব বিষয়ে এতো নাক গলাতে হবে কেন নুপুর? নাকি এইটা একটা স্বভাবে পরিণত হয়ে উঠছে তোমার?’

‘আশ্চর্য আপা! কী বলছো তুমি এসব? সে এই বাড়ির বউ। সিদ্ধান্তে তারও মতামত থাকতে পারে। আর তার মতামতে গুরুত্ব দেয়া আমাদের দরকার অবশ্যই! সে একদম ফেলনা কেউ তো না। আর কথায় কথায় বাপের বাড়ি বাপের বাড়ি এসব কী?’

‘অহ আচ্ছা! এখন তুই তোর বউয়ের হয়ে সরদারি করবি? বোনের পানচিনির কথা বলতে এলাম তখন তো কোন কথা বের হলো না মুখ থেকে। বউয়ের বিষয়ে মুখ অন? বোনের সিদ্ধান্তে তোর অফ? বাহ বাহ! বাহ!’

ননাস আমাকে শাশুড়ির রুমে যেতে বললেন।

আমি ননাসের সাথে বের হয়ে শাশুড়ির রুমে গেলাম। শাশুড়ি বললেন,

‘আগামীকাল ইফতার শেষে তারা আসবে। রাতের খাবার দাবার হবে আরকি। তোমার বাবা মাকে বলে দিও আসতে। সময়মতো ভালো কাপড়ে যেনো আসে। মেয়ের শ্বশুরবাড়ির লোকেরা আমাদের পুত্রবধূর শ্বশুর বাড়ির লোকেদের দেখতে চাইতে পারে। আর বাসায় আয়োজন করা সম্ভব না৷ চায়নিজে আমি কথা বলে রেখছি৷ চায়নিজে সবকিছু হবে। আমাদের ওদের সব মিলিয়ে দুইশো লোক হয়ে যাবে।’

‘এতো লোক মা?’

‘এই এক জায়গায় ছোটলোকের মেয়ের সমস্যা। এতো লোক আসবে তো তোর সমস্যা কোথায়?’

আমি যেনো ভেতরে লজ্জায় লাল হয়ে যেতে লাগলাম। বুঝতে পারলাম বারবার তাদের এসব কথায় নিজের কথা বলে উঠাটা কেমন মানাচ্ছে না আর। হয়তো নিজে ছোট ঘর থেকে এসেছি এজন্য অথবা আমার কাছে এসব লোক দেখানো খরচাকে অপচয় মনে হয়। এজন্যই নাকি! ভেতরে ভেতরে জাগা প্রশ্নগুলোর উত্তর আমি যেনো খুঁজে পাচ্ছিনা এই মুহূর্তে!

এদিকে ভেতরে ভেতরে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে আসিফের কথাগুলো! মেয়েটা তার প্রেমিকা! এর কোন সুরাহা তো আমি করতে পারলাম না। তড়িঘড়ি করে রুমে গেলাম। দেখি আসিফ নেই। খাটে গিয়ে বসলাম। ভীষণ মন খারাপের মাঝে মাকে কল করলাম। বললাম, আগামীকাল আমার ননদের পানচিনি হবে চায়নিজে। মা জিজ্ঞেস করলো,

‘কেমন আছিস রে?’

মায়ের এই কেমন আছিসের উত্তর আমি আজকাল আর দিতে পারি না। ভেতরে চাপা কষ্ট নিয়ে কেউ ভালো থাকতে পারর না। মাকে বললাম,

‘ভালো ঘর, ভালো বিছানা, তিনবেলা খাবার, নাকে হীরার নাকফুল, হাতে স্বর্ণের চুড়ি। এইতো আছি। তোমার স্বপ্নের মতোই সুখে আছি মা।’

‘মায়ের উপর এখনও রাগ কাটেনি রে মা? আগামীকাল আসার সময়ে ঈদের কাপড়চোপড় নিয়ে আসবো। তোর বাবা আবারও চড়া শোধে ঋণ এনেছে। সবকিছু তোর শাশুড়িও চাহিদামতো হবে। গতদিন তোর ছোটভাই তোর বাবার সাথে গিয়েছিলো না তোদের বাসায় ইফতার নিয়ে? তখন সে শুনে ফেলেছে তোর শাশুড়ির চাহিদাগুলো। আমিও তোর বাবা কে বুঝিয়েছি। দেখিস মা, তোর মুখ যাতে উঁচু থাকে এর সব ব্যবস্থা আমরা করবো। ‘

আমার মাথা আর জায়গায় রইলো না। আমি মাকে আচ্ছামত কথা শুনিয়ে দিলাম কতক্ষণ। কথাগুলোর সারমর্ম ছিলো এমন যে,

‘আমার বয়স্ক অসুস্থ বাবার ঘাড়ে যে এই ঋণের বোঝা চাপাচ্ছো, এগুলোর খেসারত তো তাকেই দিতে হবে তাইনা? নাকি এগুলো তুমি দিয়ে দিবা? তোমার ভাই দিয়ে দিবে? বড়লোক ঘরে মেয়ে বিয়ে দিয়েছো এটাই তো অনেক তাইনা? এখন বারেবারে এই সেই এইটা সেইটা দিতে দিতে নিজে মরে যাবা নাকি?’

আমি শেষমেশ সোজা না করলাম যে ঈদের আগে যেনো কোন কাপড়চোপড় না দেয়। আমার কথাগুলো কখন যে আমার ননাস এসে শুনছিলো দরজায় দাঁড়িয়ে আমি আর সেদিকে খেয়াল করিনি। রুমে ঢুকে বললো,

‘তোমার বাবা মা যখন দিতে চাইছেন, দিতে পারছেন তখন কেন তাদের না করলা? এসব নিয়ম সব বাবারাই পালন করে। এগুলো নতুন কোন নিয়ম না।’

আমি বললাম,

‘আমার অসুস্থ বাবাকে আমি আর অসহায় দেখতে চাই না। এই নিয়মের মধ্যে আমি থাকতে পারবো না।’

আমার এই মুখের উপরে বলা কথা শুনে আরও কিছু কথা শুনিয়ে আমাকে রুম থেকে ননাস চলে গেলো। আমি বিছানায় আড়মোড়া দিয়ে শুয়ে রইলাম। মাথায় ঝিম ধরে বসেছে যেনো চিন্তার পাহাড়। অবসন্ন শরীর যেনো নিস্তেজ করে দিচ্ছে আমার মন মানস। আমি যেনো আর কাজ করার শক্তি পাচ্ছি না। বারবার মাথায় ঘুরতে, কে সে মেয়ে! আমাকে জানতেই হবে।

রাতে কখন আসিফ রুমে এসেছে আমার আর খেয়ালে ছিলো না। এখন বাজছে সকাল দশটা। আসিফ বেহুশের মতো শুয়ে আছে। বিছানার উপর মদের খালি বোতল, সিগারেটের প্যাকেট, লাইটার, ইয়ারফোন সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা। গিটারটা মাটিতে পড়ে আছে। গিটার তো এখানে থাকার কথা না। রিডিং রুম থেকে নিশ্চয়ই আসিফ গিটার নিয়ে এসেছে! তাহলে রাত্রে ঠিকই গান করেছে সে। আমি কি এতোই গভীর ঘুমে ছিলাম যে গিটার দিয়ে বাজানো গানটাও শুনতে পারিনাই! গিটারটা তুলে এক পাশে রাখলাম। আসিফ খালি গায়ে শুধু হাফ প্যান্ট পরে শুয়ে আছি। তার উপর একটা কাঁথা টেনে দিলাম। ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে আসতেই দেখি বাড়িভর্তি মেহমান। সব আসিফের মামার বাড়ির লোকজন! আসিফের মামি আমাকে দেখে বললেন,

‘কী নুপুর? শ্বশুরবাড়িতে কখন ঘুম থেকে উঠা লাগে এর তামিজ জানো না? রমজান মাস তো কী হয়েছে? এখন বাজে কয়টা? আমরা মেহমানরা এসে বসে আছি সকাল আটটা থেকে। আজ তোমার ছোট একমাত্র ননদের পানচিনি। বাসা ভর্তি লোকজন থাকবে কাজ থাকবে। এসব দেখতে হবে না নাকি?’

শাশুড়ি তার ভাইর বউকে বললেন,

‘তা আর বলো না ভাবি। কী এক বউ এনেছি কোন কাজের না। ‘

ননদ এসে ডাক দিলো আমাকে। রুমে নিয়ে বললো,

‘কুসুম গরম পানি এনে আমার পা একটু ধুয়ে মাসাজ করে দাও ভাবি। কুসুম গরম পানি দিয়ে পা পরিস্কার করে মেহেদি দিব।’

আমি বললাম,

‘এই কাজটা তো তুমি নিজেও করে ফেলতে পারো তাইনা?’

‘তুমি করে দিলে সমস্যা?’

‘সমস্যা তো আমি বলিনি।’

আমার ননাস এসে হাজির হয়ে গেলো সেই সময়েই। বললো,

‘এই সামান্য কাজটা করে দিতে তোমার প্রবলেম নাকি নুপুর? আশ্চর্য! ‘

আমি আর না করলাম না। কুসুম গরম পানি দিয়ে আমার ননাসের পা ধুয়ে দিলাম। এমন সময়ে রুম থেকে শুনতে পেলাম আমার শাশুড়ি কাকে যেনো বলছেন,

‘এতো তাড়াতাড়ি চলে এলেন আপনারা? আপনাদের তো দাওয়াত দিয়েছি ইফতারের পরে, রাত্রের৷ এখন ইফতারের আগে দিন দুপুরে চলে এলেন যে!’

‘না আসলে চলে এসেছি নুপুর বলেছে যে তাড়াতাড়ি আসতে তাই!’

আমার মায়ের গলা শুনে আমি বেরিয়ে আসলাম ননদের রুম থেকে। চোখ ভরে কান্না চলে এলো আমার। বাড়িভর্তি লোকের সামনে আমার শাশুড়ি আমার মাকে এভাবে অপমান করছেন! মেয়ে হয়ে এ যেনো আমার বাধ ভাঙ্গার বেলা চলে এসেছে!

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here