কোনো_এক_শ্রাবণে পর্ব-১৪

কোনো_এক_শ্রাবণে

পর্ব-১৪

শাহাজাদী মাহাপারা (জোহুরা খাতুন)

শার্টের দোকান গুলো থেকে ক্যাজুয়াল শার্ট কিনলো মাহাপারা বাংলাদেশি ব্র‍্যান্ডের। এবং তা প্যাক করে গিফট ও করে দিলো দাস্তান কে। মল থেকে বের হয়ে মাহাপারা ট্যাক্সি ডাকলো। যদিও দাস্তান চেয়েছিলো মাহাপারাকে ড্রপ করতে কিন্তু মাহাপারা অপরিচিতো কারো থেকে ফেভার নিতে চায়নি।
এরপর কিছুদিন মাহাপারার ভালোই কাটলো।

বন্ধুদের সাথে উইকেন্ডের দিন ডিনারে যাবার প্ল্যান বানালো মাহাপারার বন্ধুরা। ডিনারের পর বের হয়েছে সবাই কিছুক্ষণ ব্রিজে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে। ব্রিজের অপর পাশটায় দেখা যাচ্ছে একজোড়া দম্পতিকে যারা সহাস্যে সেল্ফি তুলে যাচ্ছে। মাহাপারার চোখটা তাদের দিকেই আটকে আছে। হঠাৎ অপর দিক থাকা দম্পতিরও নজর পড়লো তার উপর৷ কিছুক্ষণের জন্য কি হলো কে জানে মাহাপারা ছুট লাগালো। জেনো অপ্রত্যাশিত কিছু দেখার থেকে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা। কিন্তু চোখ বন্ধ করে দৌড় দিলে যা হয় আরকি। মাঝপথেই বাধা পেলো। সামনে থাকা মানুষটার বুকে। মুখ উঠিয়ে ছোট বাচ্চাদের মত দু হাতে চোখ মুছে উপরের দিকে তাকালো মাহাপারা। চেনা অবয়ব সামনে তার বহু বছরের চেনা অবয়বটার বুকেই আছড়ে পড়লো সে। ক্রন্দন স্বর জেনো ধীরে ধীরে বেড়েই চলছে৷ আশেপাশে শা শা করে গাড়ি চলে যাচ্ছে কিন্তু তার জেনো আর হুশ ফিরছেনা। পিছনে দুজোড়া চোখ ছাড়াও আরও কিছু দৃষ্টি ক্রন্দনরতার দিকেই আটকে আছে। তার মাঝে সামনে দাড়ানো দুজোড়া দৃষ্টির উৎকন্ঠা দেখেই বুঝে নিয়েছে সব। মাহাপারাকে নিজের মাঝেই জাপটে ধরে স্থান ত্যাগ করলো সে।পিছনে ফেলে গেলো একরাশ বিস্ময় ভরপুর দৃষ্টি।

——————————————————–
রুবাবার শরীর দিন দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে। ইদানীং তার সময় কাটে নির্ভান আর জারওয়ার সাথে হেসে খেলে।
দোলার ছমাসের ছুটির অর্ধেক বাবার বাড়িতে আর বাকি অর্ধেক শশুরবাড়িতে কাটাবে বলে ঠিক করেছে। যদিও শশুর বাড়িতে এখন কেউ নেই। দোলার শাশুড়ী আর মেয়ে এখন শুরুর তিনমাস এখানেই থাকবে। আর জাদিদ অফিসের কাজে একমাসের জন্য অস্ট্রেলিয়ায় গিয়েছে।
নিপাও সপ্তাহখানেকের মতো থেকে সিলেট ফিরেছে।তার আরও কিছুদিন থাকার মন ছিলো। কিন্তু তার কানাবাবার খাওয়াদাওয়ায় সমস্যা হবে তাই সে ফিরে গিয়েছে।রুবাবার সাথেও নিপার মন কষাকষি কেটে গিয়েছে। জারওয়া ভূমিষ্ট হয়েছেই এই পরিবারের জন্য অনেক অনেক খুশি নিয়ে।

রুবাবা অসুস্থ থাকায় আমেরিকা যাওয়ার প্ল্যান ক্যান্সেল করেছে নাফি। ইদানীং ঋতুর শরীর ভালো যাচ্ছেনা। নাফি খেয়াল করেছে। কাজের চাপে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে পারছেনা। নির্ভানের বার্থডে সামনে। এবার ৩ বছরে পড়বে নির্ভান। নিজের ওকালতি ছেড়ে নিপার অনুপস্থিতিতে বাবার অফিসে বসেছে নাফি। নিপা যখন ফিরে আসবে একবারে সব তার হাতে বুঝিয়ে দিবে নাফি৷ অফিসের চেয়ারে বসে টেবিলের উপর থাকা ফটো ফ্রেইমটার দিকে চেয়ে রইলো নাফি। সামনে এক মগ গরম ধোঁয়া ওঠা কফি। ছবিটা হসপিটালে তোলা। নির্ভানকে নাফির কোলে তুলে দিচ্ছে ঋতু। বেয়াজিদ ঠিক তখনই ছবিটা তুলে ছিলো। সবই এখন সুখ স্মৃতি। নির্ভানের সাথে নাফির প্রথম দেখার দিন মনে পড়লো। আল্ট্রাসনোগ্রামের সময় ছোট্ট নির্ভানকে দেখেছিলো নাফি। বেমানান হলেও সেদিন প্রথম সে বাবা হবার অনুভূতি টের পেয়েছিলো। আচ্ছা জন্ম দিলেই কি শুধু পিতা হয়! কই সেতো কখনো নির্ভানকে নিজের রক্ত না বলে ভাবেনি। বরং নির্ভানকে দেখলে সবাই নাফির কপি বলে।একজন এমন সন্তানের দ্বায়িত্ব নিতে পারা সাহসের আর ভাগ্যেরও ব্যাপার। অফিস থেকে বাড়িতে গেলে যখন নির্ভান ছুটে এসে ঝাপিয়ে পড়ে তার বুকে। তখন কি অদ্ভুত আনন্দ হয় নাফির। যেদিন নির্ভান না আসে সেদিন সব কিছু খালি খালি লাগে তার। সে বুঝে যায় নিশ্চই নির্ভানের কিছু হয়েছে। তাহলে পিতা হতে হলে বায়োলজিকাল হবার ট্যাগ কেনো লাগাতে হবে? নির্ভানের জন্য সে সব করতে পারে৷ তার আজ, কাল এবং আগামী সব কিছুই নির্ভানকে ঘিরেই হবে। পিয়ন এসে কিছু ফাইল দিয়ে গেলো তার রুমে। কফির কাপে চুমুক দিয়ে পাশে থাকা আরেকটা ফটো ফ্রেমের দিকে নজর গেলো তার। দোলার বিয়ের ছবি। এই ছবিটা সত্যিই পরিপূর্ণ একটা সুন্দর পরিবারের ছবি। ছবিতে সবাই হাসি মুখে চেয়ে আছে। খুশি জেনো চোখ দিয়েও ঠিকরে পড়ছে। সামনের ডিভানে বর কনের বেসে দোলা জাদিদ বসা। দু পাশের দু সোফায় দোলার শাশুড়ী,রুবাবা আর শফিক বসা ডিভানের পিছনে নাফির কোলে নির্ভান, তার পাশে ঋতু,নিপা আবরার,মাহাপারা,বেয়াজিদ, সূচনা, নসিমা,কামাল সবাই দাড়ানো।এত সুন্দর পরিবারটা আর বিচ্ছিন্ন। ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো নাফির। মায়ের অসুস্থতার জন্য ইউএস যাওয়া হলোনা। কে জানে মাহাপারা সেখানে একা কিভাবে আছে! খুব দ্রুত একবার মাহাপারার সাথে দেখা করতে যাবে সে।

——————————————————–
শুক্রুবারের দিনটা নিপার কাটে ভালো ভালো খাবার রান্না করে। বিয়ের আগে নিপা রান্না ব্যাপারটাকেই বিরক্তিকর ভাবতো অথচ এখন সেই ঘন্টার পর ঘন্টা রান্না ঘরে গরমে কাটিয়ে দেয় শুধু মাত্র একজনকে খুশি করার উদ্দেশ্যে। তার পৃথিবীটা এখন শুধু একজনের চারপাশেই গোল গোল ঘুরছে। রান্না ঘরে দাঁড়িয়ে নিপা তরকারি নাড়ছে আর গুন গুন করছে৷ এই রান্নার সময় গুনগুনের স্বভাব নসিমা ম্যাডামের থেকে রপ্ত করেছে সে। নসিমার কথা মনে পড়তেই খিলখিল করে একা একাই হেসে উঠলো নিপা। এবার বাবার বাড়ি গিয়ে চমৎকার জিনিস দেখেছে তারা৷ ডাইনিং রুমে সবাই বসে মাহাপারার সাথে ভিডিও কলে কথা বলছিলো নসিমা বরাবরের মতোই রান্না করছে আর গুনগুন করে গান গাইছে।
তার মতে রান্নার সময় গান গাইলে খাবারের টেস্ট বাড়ে। কামাল রান্না ঘরের দিকে গেলো নাস্তার ট্রে আনতে ভিতরে গিয়ে দেখে নসিমা ঘেমে একশা। কামাল নসিমার শাড়ির আচঁল দিয়ে তার কপালের ঘাম টুকু মুছে দিতেই বাহির থেকে হৈ হৈ করে আওয়াজ শুনতে পেলো। লজ্জায় নসিমা কামাল কাচুমুচু হয়ে পালাই পালাই অবস্থা।
আসলে নিপা ট্যাব নিয়ে নসিমার সাথে মাহাপারার কথা বলিয়ে দেয়ার জন্য কিচেনে এসেছিলো। তার পেছন পেছন নাফি দোলা আর ঋতুও এসেছিলো। কামালের কান্ড দেখে ওরা কামালকে নির্ঘাত টিজ করলো।
নসিমার লাল হয়ে যাওয়া চেহারার কথা মনে করে আরেকদফা হাসলো নিপা।

“পাগলের মতো একা একা কেনো হাসছো?”
“এমনি” “আজ কি স্পেশিয়াল রান্না হচ্ছে দেখি?” আবরার করাইয়ের উপর তাকাতেই নিপা পাশে ঢাকা দেয়া পাতিলের ঢাকনাটা সরিয়ে দিলো। পাতিলের ভিতরে থাকা বাষ্পে আবরারের চশমা ঘোলা হয়ে গেলো। আবরার ঘাড় ঘুরিয়ে নিপার দিকে তাকাতেই নিপা আরেক দফা হেসে লুটোপুটি খেলো।
“আমার কানাবাবা ” কথাটা বলেই আবরারের চোখের চশমা খুলে শাড়ির আচঁলে মুছে আবার চোখে পরিয়ে দিলো।

——————————————————–
ডিনারের টেবিলে বসে নাফির সাথে কথা বলছিলো সূচনা। আজ ৩ বছরের মতো হতে চলেছে সূচনা অস্ট্রেলিয়ায়।জাদিদ অপর পাশে বসা। অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে একই শহরে কাজ পড়ে যাওয়ায় সূচনাদের এখানেই উঠেছে। সূচনার হাজব্যান্ড নিঃসন্দেহে একজন জেন্টাল ম্যান। স্বামী এক ছেলে নিয়ে বেশ আছে সূচনা। মা বাবার বা ভাই কারো সাথেই যোগাযোগ নেই তার। নাফির সাথে এবং সেই সূত্রে এই পরিবারের সবার সাথেই কম বেশি কথা হয় তার। নাফি হেল্প না করলে সেদিন হয়তো বের হতে পারতো না সে বাড়ি থেকে৷ হলুদের কাপড়েই বের হয়েছিলো। নাফি ফ্লাইটে উঠিয়ে দিয়েছিলো। এরপর যে পরিস্থিতি এতটা বিগড়ে যাবে তা কল্পনার বাহিরে ছিলো সূচনার। তার মায়ের জন্য বেয়াজিদের জীবনটাও নষ্ট হলো। আর বেয়াজিদের মাহাপারাকে ত্যাগ করে সূচিকে বিয়ে করায় বেয়াজিদের সাথেও সম্পর্ক চুকেবুকে গিয়েছে। তাই সে কারো সাথেই যোগাযোগ রাখেনা। এখন তার পরিবার বলতে তার সংসার আর না চাইতেও জুড়ে যাওয়া বন্ধুত্বের সম্পর্ক নাফির সাথে।
ঋতু পিছন থেকে এসে নাফির কাঁধে হাত রেখে দাড়ালো৷ সূচনার সাথেও কিছুক্ষণ কথা বললো।জাদিদ ও কথা শেষ করে উঠে গেলো ল্যাপটপের সামনে থেকে। সারাদিনের প্রেশারে সে এখন ক্লান্ত। দোলার সাথে কিছুক্ষণ আগেও কথা হয়েছে তাই সে এখন একটা লম্বা ঘুম দিবে।

———————————————————–
হোটেলে ফিরে কার্ড পাঞ্চ করে দরজা খুলে ভিতরে গেলো বেয়াজিদ।সূচি সারাপথে কোনো কথা বলেনি৷
দরজা বন্ধ করতেই দেখলো বেয়াজিদ বিধ্বস্ত চেহারায় বসে আছে। ডিভানের উপর বসে সূচি একগাল হাসলো।
” আপনার প্রেয়সী তো আপনাকে ছাড়া ভালোই আছে। দারুণভাবে তার জীবন কাটাচ্ছে। ন্যাকা কান্না করে আরেকজনের বুকেও ঝাপিয়ে পড়েছে বাহ!”
বেয়াজিদ ক্লান্ত চোখে দেয়ালের দিকে চেয়ে আছে।
” আমিতো ভেবেছিলাম আপনি যেভাবে তাকে ভালোবেসে জ্বলে পুড়ে মরছেন যে আমার দিকে চেয়ে দেখারও সময় নেই সেও হয়তো এভাবেই কষ্ট পাচ্ছে। অথচ এখানে না এলেতো জানতেই পারতাম না আপনার প্রেমিকার ওহ দুঃখিত এক্স এর এই অবস্থা। ” বেয়াজিদ রক্তচক্ষু নিয়ে সূচির দিকে একবার নজর দিলো। সূচি আর কিছু বলার সাহস পেলোনা তবে যতটুকু বলেছে তাও কম কিসে!

সূচি জানতো মাহাপারা সেখানে আসবে তবে সাথের লোকটার কথা জানতো না। ব্যাপারটা তার জন্যও অপ্রত্যাশিত ছিলো।
কিন্তু যা হয় ভালোর জন্যই হয়। এতেও তো তার ভালোই হয়েছে। আশা করা যায় বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে তার আর বেয়াজিদের সম্পর্ক আর আগের মতো থাকবেনা। তবে এটা অবশ্যই মানতে হবে মাহাপারা সুন্দরী সত্যিই রূপে ঐশ্বর্যা।

—————————

রং বেরঙের প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে চারপাশে। নদীর ধার দিয়ে কেউ একজন হেঁটে আসছে। অবয়বটা স্পষ্ট না। ঝাপসা চেহারা। শাড়ির আচঁল উড়ছে ধীরে ধীরে অবয়বটা কাছে আসছে। কিন্তু পথ জেনো শেষ হচ্ছে না। যত কাছে আসছে ততই জেনো দূরে চলে যাচ্ছে।হঠাৎ অবয়বটা স্পষ্ট হলো তার নাম ধরে ডাকতেই তা মিলিয়ে গেলো। ধরতে চেয়েও হাতছাড়া হয়ে গেলো।
মাহাপারা বলে বিছানায় উঠে বসলো বেয়াজিদ। ঘুম ভেঙে গিয়েছে তার। তার চিৎকারে সূচিও জেগে উঠলো। আশেপাশে চেয়ে দেখলো বেয়াজিদ, কোথাও মাহাপারার উপস্থিতি নেই। স্বপ্ন দেখছিলো।
একগ্লাস পানি এগিয়ে দিলো সূচি পানি পান করে বেয়াজিদ ওয়াশরুমের দিকে এগুলো। শাওয়ার ছেড়ে তার নিচে বসে রইলো কিছুক্ষণ।নিজের মনে মনেই আওরাতে লাগলো “মাহাপারা আমার নেই আর।”

এই ঠান্ডার মাঝেও সূচি নাইট রোব গায়ে এই হোটেলের একচিলতে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। তার এখন একটা নিটের প্রয়োজন। ড্রিংক করা ছেড়ে দিয়েছিলো বহু আগেই। কিন্তু এখন এক প্যাগ না নিলেই নয়।দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সে। পাশ ফিরতেই বেয়াজিদ কে দেখলো। তার হাতে দুটো উইস্কির গ্লাস।সূচি বেয়াজিদের চোখের দিকে তাকিয়ে তার হাত থেকে উইস্কির গ্লাসটা নিয়ে এক ঢোকে আধ গ্লাস উইস্কি গিলে ফেললো। বেয়াজিদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো “গ্রীন স্পট?”বেয়াজিদ মাথা উপর নিচে করলো। ” আইরিশ উইস্কি, আগে আমস্টারডাম থাকতে পছন্দের লিস্টে ছিলো। তবে এখন আর ড্রিংক করি না। ভেবেছিলাম তোমার নেশা ধরে গিয়েছে তাই ড্রিংক করে কি হবে!”বেয়াজিদ একবার সূচির দিকে তাকালো। জীবনে শোনা অনেকগুলো চিজি লাইনের মাঝে এটি একটা। মুচকি হাসলো সে। সূচি আকাশের দিকে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ তারপর বেয়াজিদকে উদ্দেশ্য করে বললো “প্রথম ভালোবাসা ভোলা যায় না তাই না?” বেয়াজিদ হুম করে অস্ফুট শব্দ করলো। “আমিও ভুলতে পারিনি। আমাদের মাঝে খুব একটা পার্থক্য নেই। আমি আমার প্রথম ভালোবাসাকে পেয়েও পাইনি। আর তুমি পেয়েও হারিয়েছো। এইটুকুই।” কথাটা বলেই সূচি আরো ২ প্যাগ উইস্কি গিলে বিছানায় গিয়ে ব্ল্যাংকেট মুড়ে উল্টো হয়ে শুয়ে পড়লো। বেয়াজিদের আর ঘুম এলো না সারা রাত।
————————————————————
মাহাপারা বসে আছে কাউচের উপর৷ হেচকি তুলে তুলে কাঁদছে৷ থামছে আবার কাঁদছে।কফি ফিল্টার থেকে ধোঁয়া ওঠা এক মগ গরম কফি এনে তার হাতে দিলো দাস্তান। কাঁপা হাতে কফিতে চুমুক দিয়ে নিজের চোখই বড় হয়ে গেলো মাহাপারার। উহ করে উঠতেই সামনে দাড়ানো লোকটা খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠলো। মাহাপারা একবার মাথা উঁচু করে উপরের দিকে দেখে নিলো তারপর আবার কান্না শুরু।

”ম্যা’ম উইল ইউ স্টপ ক্রায়িং? ইটস হার্টিং মি।”
মাহাপারা চট করে লোকটার দিকে তাকালো সে কাঁদলে কারো কষ্টও হয়?
তার অবাক হওয়া দৃষ্টি বুঝে নিলো লোকটা।
“হেই নট ইন দ্যাট সেন্স আই মেন্ট ইন আনাদার ওয়ে। ইটস ইররিটেইটিং টু লিসেন দ্যাট হুউউউউউউ সাউন্ড।সো প্লিজ ডোন্ট ক্রায়”।

মাহাপারা একরাশ বিরক্তিভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকালো। তারপর বিড়বিড় করে বললো “শালা বদমাশ আমার কান্না ওর কাছে বিরক্তিকর লাগে তাহলে নিয়ে এলো কেন এখানে?”

“বিড়বিড় করে গালি দিয়ে লাভ নেই৷”

চকিতে তাকালো মাহাপারা, বিস্ময়ে তার চোখ দুটো অক্ষিকোটর থেকে বেরিয়ে আসবে মনে হচ্ছে সাড়ে সর্বনাশ-
আয়হায় ইউ নো বাংলা ভাষা?

“হাহা হ্যাঁ মা বাঙালি ছিলেন তো।তাই শিখে নিয়েছি।”

“আমি দুঃখিত।”

“ইটস ওকে।”

“আর কি কি ভাষা জানো?”

“টার্কিশ, উর্দু,ইট্যালিয়ান, জার্মানি।”

“ওয়াও এত ভাষা জানো?”

“হ্যাঁ। আমার স্কুলিং যেখানে হয়েছে ওখানে তো বিভিন্ন জায়গার স্টুডেন্টরা স্কুল চেইঞ্জ করে পড়তে আসতো। তো বন্ধুদের মাধ্যমেই শেখা৷”

“বাহ! দারুণ ট্যালেন্ট।”

“হ্যাঁ আমার বহু ট্যালেন্ট আছে ধীরে ধীরে নজরে পড়বে। আপাতত কফি শেষ করো ঠান্ডা হচ্ছে। আমি শাওয়ার নিয়ে আসি।”

মাহাপারা কফিতে চুমুক দিলো। মন ভালো হয়ে গেলো তার।

কফি শেষ করে মাহাপারা এদিক ওদিক দেখতে লাগলো৷ ছোট বাসা হলেও যথেষ্ট গোছানো। রান্না ঘরটাও গোছানো।মাহাপারা সিড়ি বেয়ে উপরের দিকে উঠতে নিলো। সিড়ি থেকে হাতের বাঁ পাশে বিশাল একটা বেলকনি। ডান দিকে তাকাতেই দুটো দরজা৷ প্রথমটা বেডরুম সেটা কিছুক্ষণ ঘুরে পাশের বেডরুমে নক করলো মাহাপারা৷ উত্তর না পেয়ে চলে যেতে নিচ্ছিলো কি মনে করে আবার দরজার নব ঘুরালো ভিতরে ঢুকে বুঝতে পারলো এতটাও গোছানো নয়। মায়ের রক্ত আছে তো সেতো বাঙালিই। একই গোয়ালের গরু।বিশাল এক নিশ্বাস ছাড়লো মাহাপারা। ভিতরে ঢুকলো। মাহাপারার সুচিবায় ব্যাওয়ারটা রয়েছে অগোছালো নোংরা জিনিস দেখতে পারেনা।আঁচল্টা কোমড়ে গুজলো। চট করে বুট গুলো সামনের শু রেকে তুলে দিলো। বালিশ গুলো টিক করলো বিছানার সাদা চাদরটা টেনে ব্ল্যাংকেটটা ঠিক করলো। কাউচের উপর রাখা সব কাপড় গুলো সরিয়ে ফেললো। বিন ব্যাগটা জায়গা মতো রাখলো ড্রেসিং টেবিলের সব কিছু গুছিয়ে রাখলো। যাক কিছুটা গোছানো দেখাচ্ছে।

নিচে গিয়ে ডিনারে কি করা যায় তার জন্যও ফ্রিজ খুললো কত দিনের পঁচা খাবার আছে কে জানে? সবটাই ডাস্টবিনে ফেললো। এ বাবা! বাবুমশাই উপরে ফিটফাট ভেতরে সদরঘাট অবস্থা৷

“তুমি বেশ গুছিয়ে দিয়েছো ঘর। ধন্যবাদ। তবে আমাকে নোংরা ভাবার কারণ নেই। আমি এখানে খুব কমই থাকি। তাই এরকম থাকে আর আজকেই প্রথম এলাম তাই এজেন্সিতে কল করে মেইড ডাকতে পারিনি। নাহলে এরকম থাকে না ঘর।”

বোকা বোকা হাসিটা দেখে মাহাপারার হাসি পেলো।বহু কষ্টে হাসি চেপে বললো “আমরা ডিনার কি করবো?”

“আমি অর্ডার করেছি৷ কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবে।”

মাহাপারা ডিনার শেষ করলো একটা পিৎজ্জা খেয়ে। কান্না করার কারণে মাহাপারার এখন বেশ ঘুম পাচ্ছে। সে চিন্তা করছে বলবে কিনা?

“তুমি চাইলে উপরের রুমের যেকোনোটাতে ঘুমাতে পারো। কোনো সমস্যা নেই।”
“গুড নাইট” বলেই মাহাপারা উপরের দিকে গেলো৷ মাস্টার বেডরুমের পাশের বেডরুমটাতে গিয়ে দরজা ভেতর থেকে লক করে দিলো বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। বিছানায় শুতেই ঘুম তাকে কাবু করে নিলো। তার আশেপাশে এখন কি হচ্ছে তা নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে সে। আহা ঘুমই একমাত্র সমাধান সকল সমস্যার।

———————————————————–

নিপার ইদানীং বেশ খারাপ লাগে। মন মেজাজ খিচড়ে থাকে আর ঘন ঘন বমি হয়।সিলেটে পরিবারের কেউ না থাকায় মন আরো খারাপ হয়ে থাকে তার৷
আবরারের সাথে ইদানীং প্রায় কথা কাটাকাটি হয়। মন খারাপ করে বসে থাকে সে। অফিসে ওয়ার্কলোড বেড়ে যাওয়ায় আবরারও বিরক্ত হয়ে থাকে। নিপাকে সময় দিতে না পারাটা তাকেও কষ্ট দেয়। কিন্তু কিছু করার নেই৷রাগ ভাঙাতে গেলে নিপা আরো খিটখিট করে তাই এক প্রকার বিরক্ত হয়েই আবরার রাগ ভাঙাতে যায়না আর।

দুপুরের সময়টায় নিপা ভিডিও কলে বসে বাড়ির সবার সাথে কথা বলে। তার শাশুড়ীর সাথে গল্প করে৷ তার মনে হয় এই মানুষটা কঠোর হলেও তাকে সবচেয়ে বেশি বোঝে৷ তাইতো রোজ নিয়ম করে একবার কথা বলে নেয়। এতে নিপার ভিতর বাহিরে কি চলছে তাও আঁচ করে ফেলেন তিনি৷ ল্যাপটপে কথা বলতে বলতে নিপা শাক বাছতে বসেছিলো হঠাৎ করেই বমি পাওয়ায় সামনের বেসিনেই বমি করলো সে। তার চেহারার কাহিল অবস্থা। শাশুড়ীর যা বোঝার সে বুঝে নিয়েছেন। কল কেটে ছেলেকে কল করলেন। আবরার কল ধরতেই তার উপর দিয়ে ঝড় গেলো একচোট। তারপর বললেন নিপাকে ডাক্তার দেখাতে তার শরীর ভালো নেই। আবরার ভয় পেয়ে গেলো। নিপাতো আগে জানায়নি তার শরীর ভালো নেই সেই কথা। ইদানীং অনেক কথা গোপন করে সে। আবরারের মা একবার ভাবলেন আবরারকে সবটা বলবেন পর মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত বদলে নিলেন।থাকুক টেনশনে গাধাটা।

আবরার সন্ধ্যায় জলদি বাসায় ফিরলো আজ।
“আজ এত জলদি যে?”
” দ্রুত রেডি হয়ে নাও হাসপাতালে যাবো”
” হাসপাতাল? কেনো? কারো কি কিছু হয়েছে?”
” হ্যাঁ। দ্রুত রেডি হও।”
নিপা আর কথা বাড়ালো না সে জানে এখন প্রশ্ন করলেও উত্তর পাবেনা।
তাই রেডি হয়ে নেয়াটাই ভালো।

হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তারের সাথে কথা বললো তারা৷ কয়েকটা টেস্ট দিয়ে গাইনি বিভাগে রেফার করলো ডাক্তার। আবরার অস্থির হচ্ছে। টেস্টের কথা ভেবে।নিপার শরীর বেশ খারাপ বোঝা যাচ্ছে। এতদিন শুধু শুধু কষ্ট দিয়েছে বেচারিকে৷ অথচ নিপা তাকে কিছুই জানায়নি। আল্লাহ জেনো ওকে সুস্থ রাখে৷ টেস্ট করিয়ে বাহিরে এসে নিপা দেখলো আবরার ক্লান্ত চোখে দেয়ালের দিকে চেয়ে আছে।

” চলো বাসায় যাই। রিপোর্ট কাল এসে নিতে বলেছে।”
“তোমার এত শরীর খারাপ আগে বলোনি কেনো?”
“নিশ্চুপ”
আবরার উঠে হাঁটা দিলো বাহিরের দিকে। নিপাও তার পিছু পিছু গেলো৷
গাড়িতে বসে নিপা মুচকি হাসতে লাগলো কালকে কি হবে সেটা ভেবে। নিপা জানে তার কিছু হলে এই মুখচোরা লোকটার দুনিয়াটাই ওলট পালট হয়ে যাবে।

চলবে…!

Shahazadi Mahapara’s Inscription

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here