#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_৩৪
#মিদহাদ_আহমদ
সকালে ঘুম ভাঙ্গলো আসিফের ডাকে। মাথার কাছে এসে ডাক দিয়ে তুললো। বললো,
‘রেডি হও। আমার সাথে যাবা।’
আমি উঠে বসলাম। কেমন জানি করলো নিজের মনের মধ্যে। কয়েক মিনিট বিছানায় বসা রইলাম। এর মাঝে আসিফ বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে চলে এসেছে৷ এসে বিছানায় বসা দেখে বললো,
‘অদ্ভুত! এখনও বসে আছো? রেডি হও। আমার সাথে যাবা।’
আমি কোন উত্তর দিলাম না। চেয়ে চেয়ে দেখলাম শুধু৷ ননাস এসে ডাক দিয়ে ভাইকে নাস্তা খাওয়ার জন্য নিচে নামতে বললেন। অথচ এর আগে কোনদিনও এমন হয়নি। আসিফকে রোজ সকালে আমি আর নাহয় শাশুড়ি মা নাস্তা খাইয়ে দেন। আমার হাতের চা তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে যেনো! আসিফ আমাকে কথাগুলো বলেই সে নিচে নেমে গেলো। আমি পিছুপিছু গিয়ে দুতলার সিঁড়ি থেকে দেখলাম, ডাইনিং টেবিলে নানান পদের খাবার সাজিয়ে ননাস বসে আছেন ভাইকে খাওয়াবেন বলে। আমি রুমে চলে এলাম। কেন জানি না শাড়ি পরতে ইচ্ছে হলো। এদিকে আসিফ আমার উপর রেগে আছে। রাগবেই না কেন! আমি হয়তো মিছেমিছি তাকে সন্দেহ করছিলাম! নিজের উপর নিজের কেমন রাগ হলো। নিজেই নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম, এমন কেউ করে নাকি নিজের মানুষের সাথে! আর এসব তো আমার আন্দাজ। সত্য তো নাও হতে পারে। মাথায় এসব প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে আর আমি আলমারি খুলছি। আলমারির প্রথম তাকে রাখা ফিরোজা রঙের জামদানি শাড়ির দিকে আমার নজর গেলো। ইচ্ছা হলো শাড়িটা পরে নেই। হয়তো আসিফের রাগ কমে যাবে!
এদিকে নিচে আসিফ খাবার খেতে গেলে পাশে বসে থাকা বোন আসিফকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললো,
‘জানিস কী হয়েছে? আমার ছোট ননাস আর স্বামীর কথা বলছি। ওইযে ছোটটা যে? চিনেছিস? মুনা না।’
‘হুম’
‘তার ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে।’
আসিফ কোন ইন্টারেস্ট দেখালো না বোনের কথায়। তানিয়া আবার নিজ থেকে আসিফের প্লেইটে বিন্নি চালের পোলাও তুলে দিতে দিতে বললো,
‘কেন হয়েছে ভাই জানিস?’
‘তুমি না জানালে জানবো কীভাবে আপু?’
‘এইযে সন্দেহ। তার স্বামীর উপর তার সন্দেহ হচ্ছিলো৷ যদিও কোনকিছু ক্লিয়ার হয়নি। তার পরও সন্দেহ থেকে সে আর সংসার করবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয়৷ সন্দেহে কবার ঢুকে গেলে ডিভোর্স না দেয়ার আগ পর্যন্ত কোনভাবেই শান্তি পাওয়া যায় না রে ভাই।’
তামান্না এসে বললো,
‘ভাইয়া শুনো, আমাকে আরেকটা জিনিস দিতে হবে তোমার।’
‘কী?’
‘আগে বলো দিবা?’
‘হ্যাঁ দিবো।’
‘আমাকে এন্টলিক পেইজ থেকে মেইকআপ কিট পুরো সেট দিতে হবে। দাম কিন্তু পনেরো হাজার টাকা।’
‘আচ্ছা বিকালে দিবো। অর্ডার দিয়ে দিস।’
আমি রেডি হয়ে নিচে নেমে এলাম। নিচে নামতে নামতে শুনলাম আসিফ তার বোনকে বলছে বিকালে পনেরো হাজার দিয়ে দিবে। এদিকে ননাস আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
‘আরে আরে আরে! এত সকাল সেজেগুজে? কোথাও যাচ্ছো নাকি নুপুর?’
আসিফ বললো,
‘হ্যাঁ আমার সাথে সে যাবে আপা।’
‘কেন? তোর সাথে কেন?’
তারপর আবার ননাস বললো,
‘অহ ও! স্বামীর উপর নজরদারি করা হচ্ছে বুঝি? ঘর সংসারে মন দাও নুপুর। এসব নজরদারি করে করে জীবন সংসারে আগুন ধরাবা।’
বুঝতে পারলাম না আমার ননাস এসব আমাকে কেন বলছেন। আসিফ তো এসব কোনকিছু তার বোনকে বলবে বলে মনে হচ্ছে না। আর যদি আসিফ এসব তার বোনকে বলে, তাহলে আসিফের উপর আমার এত দিনের জমে উঠা অনুরাগ, স্নেহ সব একেবারে নষ্ট হয়ে যাবে৷ সব।
আমি কোন কথারই জবাব দিলাম না৷ আসিফ খাওয়া শেষ করলো। গাড়ি বের করে রাখা ছিলো বাসার সামনেই। আমি গাড়িতে উঠে বসলাম। মিনিট দুয়েক হয়ে গেলেও আসিফ কোন কথা বললো না আমার সাথে। আমিও নীরব ছিলাম। অপেক্ষায় ছিলাম আসিফ কিছু বলে কিনা না৷ লুকিং গ্লাসে নজর যেতেই দেখলাম আসিফ তার চোখ সরিয়ে নিলো। সে লুকিং গ্লাসে আমাকেই দেখছিলো। আমিই এবার বললাম,
‘কেমন লাগছে আমাকে? কপালে কালো টিপ দিয়েছি!’
কয়েক সেকেন্ড নীরব থাকার পর আসিফ বললো,
‘হুম ভালো।’
‘জানো আসিফ কোক স্টুডিওর নতুন গান কাল রিলিজ হয়েছে। আমি অনেকবার শুনেছি। তুমি শুনেছো কি? তাদের এবারের কম্পোজিশন দারুণ হয়েছে। তাইনা?’
আসিফ এবারও জবাব দিলো না আমার কথার৷ আসিফ আর কোনকিছু বললোও না পুরো সময় জুড়ে সকাল সকাল স্কুলের জ্যাম। মিরাবাজার পয়েন্ট থেকে জ্যাম শুরু হয়েছে। মিরবাজার ক্রস করে বন্দর পর্যন্ত যেতে যেতেই আমাদের ত্রিশ মিনিটের মতো লেগে গেলো৷ অথচ পথ মাত্র পাঁচ/সাত মিনিটের। আসিফ গাড়ি সাইড করে আমাকে নামতে বললো। আশেপাশে সব দোকানপাট, লোকজন, হাট বাজার। লালদিঘির পারের একদম এক কোণার দিকের পাঁচতলা পুরানো বিল্ডিং এর পাশে গাড়ি পার্কিং করলো আসিফ৷ আমি নেমে দাঁড়ালাম। গাড়ি থেকে নামতেই কেউ একজন আমাকে সালাম দিলো। আসিফ আসতে আসিফকেও সালাম দিলো। আসিফ আমাকে বললো,
‘দেখবে বলেছিলে না? সব দেখবে৷ চলো৷ আমার সাথে চলো উপরে। আজ সবকিছু ক্লিয়ার হয়ে যাবে৷ কোন রাখঢাক থাকবে না আর।’
আমি ফ্যালফ্যাল চোখ আসিফের দিকে চেয়ে রইলাম। আসিফের এমন ব্যবহার আমি এর আগে কখনো দেখিনি। বিল্ডিংটা প্রকান্ড হলেও একদম সরু এর সিঁড়িগুলো। কেমন যেনো ভয় ভয় করছে আমার। চারদিকে কাগজ ছড়ানো ছিটানো। সোজা তিন তলায় উঠলাম। গিয়ে দেখি কয়েকটা ভাগে মানুষ এক ত্রিশ জন হবে কম্পিউটারের সামনে বসে আছে। আসিফ তাদেরকে ক্রস করে যাচ্ছে আর এক এক করে সবাই তাকে সালাম দিচ্ছে৷ আমাকেও দিচ্ছে। আমি কোনকিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না যেনো!
একটা রুমে গিয়ে ঢুকলো আসিফ। মাঝারি সাইজের রুম৷ দেয়ালে তিন রঙের তিন কালার। এক পাশে সাদা। এসি লাগানো। একটা টেবিল আর টেবিলের পাশে চেয়ার। অন্যদিকে সোফার মতো করে পাঁচটা চেয়ার সাজানো। টেবিলের এক দিকে ল্যাপটপ, অন্যদিকে হুইস্কির বোতল। অর্ধেক বোতল ভরা খেয়াল করলাম। দেখলাম নিচের দিকেও কয়েকটা খালি বোতল রাখা। টেবিলের আরেকপাশে একটা ফটোফ্রেম। আমার আর আসিফের শিল্পী হাসেম খানের আঁকা ছবিটার নকল ছোট করে বসানো। আসিফ আমাকে চেয়ারে বসালো। তারপর সে সামনের চেয়ারে বসলো। বসে আমাকে বললো,
‘এখন বলো কী জানতে চাও?
(চলবে)