বিন্নি ধানের খই পর্ব-৪৫

0
2348

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_৪৫
#মিদহাদ_আহমদ

আসিফকে এবার ধরে বসলাম আমি। আসিফ বললো,

‘আরে কী হয়েছে? ওসব কিছু না। তুমি এতো হাইপার হয়ো না।’

আমি আসিফের কথা শোনার পরিস্থিতিতে আর রইলাম না৷ সেই রাতেই ডাক্তারের এপোয়েনমেন্ট নিলাম। একবার চিন্তা করলাম শাশুড়িকে জানাবো। পরক্ষণেই ভাবলাম শাশুড়িকে জানানো যাবে না এখন। তিনি এমনিতেই দুঃশ্চিতার মাঝে আছেন।

ডাক্তার বিকালে বসেন আল হারামাইন হসপিটালে। আসিফের অফিসে যাচ্ছি বলে বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম আমি৷ অফিসে গিয়ে দেখি আসিফ যেইসেই পেইন্ট আর তুলি হাতে নিয়ে কাজে বসা আছে। আমাকে দেখেই একটা হাসি দিয়ে বললো,

‘কী? আবার ইনভেস্টিগেশন করতে চলে এসেছো বুঝি?’

আসিফের এই মায়ামাখা মুখ দেখলে আমার ভীষণ ভালোলাগে। আজও ঠিক তেমন ভালোলাগা কাজ করছে। আমি ভাবনায় পড়ে গেলাম। আসিফ আঙুল দিয়ে চুটকি বাজিয়ে বলল,

‘কী মিসেস? কীসের চিন্তা? জামাই মারা গেছে বুঝি?’

আমার চোখ দিয়ে পানি চলে এলো। আসিফ উঠে এসে বললো,

‘আরে আরে আরে! বোকা নাকি তুমি? কান্না করছো কেন? আমি কিছু বললাম আর এমনি…’

‘কেন এসব বলবে? কেন?’

আমি জড়িয়ে ধরলাম আসিফকে। আসিফ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।

কিছুক্ষণের মাথায় তাকে নিয়ে ডাক্তারের চেম্বারে গেলাম। ডাক্তার দেখালাম। ডাক্তার জানতে চাইলেন সমস্যা কী। আসিফ বললো যে কাশির সাথে রক্ত আসে এই যা। ডাক্তার আসিফকে জিজ্ঞেস করলেন,

‘স্মোকের সাথে বাজে অভ্যাস আছে কি?’

আসিফ কোনকিছু বললো না। আমি বললাম,

‘হ্যাঁ ডাক্তার।’

ডাক্তার কিছুক্ষণ মলিন মুখে প্রেসক্রিপশনের দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন,

‘এভাবেই কত পরিবার যে ধ্বংস হয়ে যায়, একেবারে শেষ হয়ে যায়…’

আমার বুকটা হুট করে কেঁপে উঠলো। ডাক্তার এসব কী বলছেন! ডাক্তার তারপর আমাকে বললেন,

‘আপাতত এই টেস্টগুলা দিচ্ছি। সবগুলো করাবেন। তারপর আসবেন। দেখছি কী করা যায়।’

‘ডাক্তার টেনশনের কোন…’

‘টেনশন কিনা জানা নেই। আপনি টেস্ট করিয়ে আসুন।’

তারপর আসিফের দিকে চেয়ে বললেন,

‘মিস্টার, বাজে অভ্যাস আপনাকে যেনো না খেয়ে বসে এর আগে অভ্যাসকেই আপনাকে খেতে হবে।’

টেস্ট করালাম সবকিছু। ফিরে আসার সময় ড্রাইভ করতে করতে আসিফ বললো,

‘কী এক ডাক্তার বাপু! সতেরো হাজার টাকার টেস্ট করাতে দিয়ে দিল! টাকা চাইলে টাকা দিয়ে দিতাম। কিন্তু না। সে কী করলো? এতগুলা টেস্ট আর মাথা ভর্তি টেনশন ঢুকিয়ে দিলো মনের মাঝে। এখন আবার আগামীকাল সকালে খালি পেটে এসে আরেকটা টেস্ট করাও। আমি এসব পারবো না।’

আসিফের কথাগুলো শুধু যেনো নীরবে আমি শুনছিলাম। কোন কথা ফিরতি বলার শক্তি আমার নাই।

বাসায় এসে আমার কোন কাজেই মন বসছিলো না। আসিফ সিগারেট টানতে টানতে বললো

‘পড়তে বসবে না? নাকি এভাবেই? ‘

আমি আসিফের কাছে গিয়ে সিগারেট ফেলে দিলাম টান মেরে। আসিফকে জড়িয়ে ধরে বললাম,

‘আর সিগারেট খাবে না। এসব আর না। হুইস্কিও না। সবকিছু না।’

আসিফ এবার যেনো নীরবে বসে থাকলো। আমি আসিফকে বললাম,

‘আমার কে আছে বলো? কে আমাকে স্বপ্ন দেখাবে বলো? আমার শুধু তোমাকে চাই আসিফ। এই টাকা পয়সা ধন বিত্ত সম্পূর্ণকিছুর বিনিময়ে শুধু তোমাকে চাই। আর কিছু না। আর কিচ্ছু না।’

রাতে ননাসের কাছে গিয়ে বললাম সবকিছু খুলে। এও বললাম যে ডাক্তারে গিয়ে সব টেস্ট করিয়ে এসেছি। ননাসের চোখ বেয়ে পানি নামলো। ননাস বিলাপ করতে করতে বললেন,

‘আমাদের পরিবারের উপর কার নজর লেগেছে। কার নজরে সবকিছু শেষ হয়ে যাচ্ছে। সব যেনো একেবারে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আল্লাহ আমার একমাত্র ভাইটার সাথে কী করবেন আমি জানি না। আমি কিচ্ছু জানি না। আসিফ আমার সাথে ভালোকরে কথাও বলছে না। আমি বোন না, আমি বোন হয়ে তার সাথে কতকিছু করলাম! আল্লাহ আমাকে কখনো ক্ষমা করবেন না।’

আমি ননাসকে বললাম,

‘আপা এমন কেন বলছেন? আপনি রুমে আসেন৷ দেখবেন আসিফের সব রাগ গলে জল হয়ে গিয়েছে। আমি ভেতরে ভেতরে আর চেপে রাখতে পারছিলাম না ডাক্তার দেখানো আর টেস্ট করানো ঘটনাটা। তাই আপনাকে বললাম। আপনি রুমে এসে একবার আসিফের সাথে ভালোমন্দ কথা বলেন৷ দেখবেন সব ঠিক হয়ে গিয়েছে।’

ননাস কোন জবাব দিলেন না আমার কথার। বুঝতে পারলাম ভেতরে থাকা গ্লানি তাকেও শেষ করে দিচ্ছে। মানুষ যখন নিজের ভুলের জন্য অনুতপ্ত হয়, তখন সেই মানুষ নিজেই নিজেকে জগতের সবচেয়ে বড় অপরাধী হিসাবে ভাবতে শুরু করে। অথচ সে জানে না, ভুলের অনুতপ্ত হওয়া মানুষ দুনিয়ার সবচেয়ে প্রফুল্ল চিত্তের মানুষ হয়ে থাকে।

ননাস কিছুক্ষণ পর আমাদের রুমে আসলেন। আসিফ ননাসকে দেখে একটা বই হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলো। তানিয়া আপা স্যুপ বানিয়ে এনেছেন। থাই স্যুপ আসিফের পছন্দের। ননাস স্যুপ এনে আসিফের সামনে ধরলে আসিফ আমাকে ডেকে বললো,

‘ওনাকে বলো স্যুপ নিয়ে চলে যেতে। যে আমার মৃত্যু কামনা করতে পারে, তার হাতের স্যুপ আমার না খেলেও চলবে’

আসিফ মানুষটা এমন! কোনকিছু ধরে বসলে আর ছাড়ে না। সে এখনও ভুলতে পারছে না ননাস তার সাথে কী করেছেন সেইটা। ননাস কান্না ভেজা চোখে চলে গেলেন রুম থেকে। যাবার আগে স্যুপ টেবিলে রেখে আমাকে বললেন,

‘নুপুর আমার ভাইকে খাইয়ে দিও পারলে।’

আমি আসিফের পাশে বসলাম। আসিফ তেড়ে রাগান্বিত গলায় আমাকে বললো,

‘এখন তুমি আমাকে উপদেশ দেয়া শুরু করবে নাকি? কোন উপদেশ না। চুপচাপ থাকো।’

আমি আসিফকে বললাম,

‘দেখো আসিফ, উনি তোমার বোন। মানুষের ভুল থাকতেই পারে। তাই বলে কি এভাবে? দেখো আপা এখন কত বড় মানসিক ট্রমার মধ্যে আছেন! আপাকে এখন আমাদের সঙ্গ প্রয়োজন। আমাদের ভালোবাসার প্রয়োজন। আর নাহলে একটা মানুষ এভাবে আমাদের সামনে শেষ হয়ে যাবে বলো?’

‘আর তিনি যা আমার সাথে করলেন? আমাদের সাথে করলেন?’

‘দেখো আসিফ, দুনিয়ার নিয়ম এমন। আর আপা তো একা করেননি। সঙ্গদোষে লোহা ভাসে। এমন একবার ভেবে দেখেছো? ওই পাষন্ড লোকটা আপার মোবাইলে তার নতুন বিয়ে করা ছবি পাঠাচ্ছে। তার থেকে আর কী আশা করা যায় বলো? তার প্ররোচনায় তো আপা এমন করেছেন৷ জানো, ছোট থাকতে খালা -ফুফুরা তাদের ভাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতো সেই ছড়াটা,

‘ভাইবোন মিলেমিশি তুলি কত ফুল
মিঠে পায়ে ঝরে পড়ে শেফালী বকুল’

মনে আছে তোমার? সেই ভাইবোনে এতো মান, এতো অভিমান কেমন করে হয়? এখানে তো শুধুই ভালোবাসা জায়গা করে নেয়। শত ভুল আর অভিমান এখানে নিমষেই কর্পুরের মতো উবে যায়! আর তুমি কিনা বাচ্চা ছেলের মতো নিজের সহোদরা বোনের উপর রাগ করে আছো আসিফ?’

আসিফ আমার কথাগুলো বুঝলো হয়তো। তবে কোন রেসপন্স করলো না। সকালে ঘুম থেকে তাড়াতাড়ি উঠলো সে। আমাকে জাগিয়ে তুলে বললো,

‘আমার আর আপার জন্য কর্ণফ্লাক্স বানিয়ে নিয়ে আসতে পারবা আপার রুমে? একসাথে খাবো আমরা ভাইবোন মিলে। আর তুমি খেলে তোমার জন্যও একটা বানিয়ে নিয়ে এসো’

‘কিন্তু তোমাকে যে খালিপেটে টেস্ট…’

‘আরে ওসব একটু আধটু খেলে কিছু হয় না। তুমি নিয়ে আসো।’

আমিও আর না করলাম না। নিয়ে এলাম বানিয়ে। ভাই বোনের দূরত্বটা যদি কমে যায়, তাহলে একদিন যেনো শান্তি হয়ে যাবে। কিছুক্ষণ পর আবার আসিফের টেস্ট!

আপার রুমে ঢুকতেই দেখতে পেলাম গিটার বানিয়ে আসিফ গান গাইছে,

‘এক হাজারো মে মেরি এক বেহেন হে
সারে উমর হামে এক সাঙ্গ রেহনা হে
তুলো কাতারো কা, সাবকা কেহনা হে…’

আমার অজান্তেই কেমন জানি গাঁ কেঁপে উঠলো! তারা ভাইবোনেরা আজন্ম একসাথে থাকুক। কেউ কারো থেকে বিচ্ছিন্ন না হোক৷

এদিকে তামান্নার স্বামী রাজিব যেনো বিয়ের পর একেবারে চেইঞ্জ হয়ে গিয়েছে। বুঝতে শিখেছে৷ গতরাতে তামান্না কান্না করলে রাজিব তামান্নাকে বুঝালো, সংসারে একটু কষ্ট সহ্য করে নিতে হয়৷ রাজিব এও বললো, তার বাবা মায়ের সামনে সে কখনো কথা বলে না। তাদের মুখের উপর গিয়ে সে তামান্নার হয়ে কোনকিছু বলতেও পারবে না। বোনেরাই পরিবারের সব এখন৷ তাদের উপর গিয়েও রাজীব কোনকিছু বলতে পারবে না৷ তামান্না কান্না করতে করতে বললো

‘আমার বাবা মা কোনদিন আমার গায়ে হাত তুলেননি৷ কিন্তু আপা কী করলেন? আমার গায়ে হাত তুললেন? আমি ভাত একটু নরম করে ফেললাম বলে আমাকে চড় মারতে পিছু হাটলেন না?’

রাজিব তামান্নার হাত ধরে বললো,

‘আমি বুঝতে পারছি সব। তুমি একটু ধৈর্য্য ধরো৷ আমি আর কয়দিন ই বা আছি? বাবা মায়ের সাথে মনোমালিন্য হলে এই আবার তোমার উপর এসে পড়বে। সবাই বলবে যে বউ বাদ। সামনের মাসেই চলে যাচ্ছি। এরপর সব প্রসেসিং করে তোমাকে আমার কাছে নিয়ে যাবো। এর আগ পর্যন্ত প্লিজ একটু সহ্য করে নাও।’

এসব বলতে বলতে রাজিব তামান্নার চোখ মুছে দেয়। তামান্নাও নীরবে মনে মনে সবকিছু সহ্য করে যায়। নাহলে সে প্রতিবাদ না করার মেয়ে নয়। রান্না করার মেয়ে নয়। বোনের মতো যদি তার অবস্থা হয়, তাহলে তার বাবা মা দুজনের আস্ত থাকবে না। তারা বাঁচতে বাঁচতে মারা যাবেন।

রাত্রে আমি একাই গেলাম টেস্টের রিপোর্ট নিয়ে আসতে। রিপোর্ট আনতে আনতে রাত নয়টা। ডাক্তার এর মাঝে চলে গিয়েছেন। বাসায় রিপোর্ট নিয়ে এসে আমার আর রাত কাটছে না যেনো৷ একদিকে ভয়, অন্যদিকে আল্লাহকে বলছি, আল্লাহ যেনো এমন কোনকিছু না করেন যে আমার জীবন শেষ হয়ে যায়৷

পরেরদিন সন্ধ্যায় ডাক্তারের চেম্বারে গেলাম। ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে রাত আটটা। ডাক্তার টেস্টের রিপোর্ট হাতে নিলেন। আমার দিকে চেয়ে মলিন মুখে বললেন,

‘আমার হাতে আর কোনকিছু নেই। আপনার হাতেও না।’

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here