#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_৪৯
#মিদহাদ_আহমদ
এর মাঝে মাস দুই কেটে গেলো। ননাস সুইসাইড করার দুইদিন পরেই আমার এইচ এস সি’র রেজাল্ট বের হয়। আমি সব বিষয়েই প্লাস পাই। আসিফ সেদিন খুব খুশি হয়েছিলো। আবার একসাথে পুরো মহল স্থবির হয়ে উঠেছিলো ননাসের সুইসাইডে। আমার রেজাল্টের পর মা কল করে বলেছেন, আমি যেনো মন দিয়ে পড়ি। আমি যেনো সত্যি সত্যি মেডিকেলে চান্স পাই৷ আমার মায়ের কাছ থেকে এই সায় পাওয়া আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সফলতা হয়ে উঠেছিলো সেদিন। আমার যে মা কোনদিন আমাকে পড়তে বলেন নি, সেই মা আমাকে বলছেন আমি যেনো ডাক্তার হই! আমি যেনো অর্ধেক সাহস সেদিন পেয়ে গিয়েছিলাম আমার মায়ের কথায়। এদিকে বাসার সবাই কেমন জানি একটা মুষড়ে গিয়েছে৷ শাশুড়ি আর আগের মতো সিরিয়াল দেখেন না। নানা পদের খাবার রান্না করেন না। শ্বশুর ইজি চেয়ারে বসে পত্রিকা পড়েন না। আমাকে চা এনে দেয়ার কথাও বলেন না। আমিই মাঝেমধ্যে চা নিয়ে যাই। শ্বশুর তখন বলে উঠেন,
‘মা গো, পড়াশোনা করছো তো গো মা? তুমি ডাক্তার হও এই স্বপ্নটা আমি যে কয়েকদিনে নিজের মধ্যে বুনন করতে শুরু করেছি।’
আমি শ্বশুরের দোয়া নেই। বাবার জায়গাটা যেনো ধীরে ধীরে আমার শ্বশুর পূরণ করতে চলেছেন। আসিফ তার কাজে ব্যস্ত। এদিকে আমার ননাস পড়ে আছেন কোমায়। আমি সেই চিঠিটা যেদিন পেয়েছিলাম ননাসের রুমে, সেদিন চিঠিটা ধরে খুব কান্না করেছিলাম। একজন মানুষ আমাকে আপন করে নিতে চাচ্ছেন। কাছে টানতে চাচ্ছেন। বুঝতে পারছেন নিজের ভুলগুলা। এরচেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে! সেদিন রাতে খুব কান্না করেছিলাম আর বলছিলাম, যদি আমার ননাসকে আমি একবার ফিরে পেতাম, জড়িয়ে ধরে খুব কান্না করে তার কাছে আমার বড় বোনের জায়গা চেয়ে নিতাম। আমার আফসোসের জায়গা থাকতো না যে আমার কোন বড় বোন নেই। বিধাতা আমাকে সেই আফসোস আজন্মের জন্য রেখে দিলেন হয়তো।
আসিফ অফিস থেকে আসতে আসতে রাত নয়টা। আসিফকে ভাত টেবিলে দিয়ে শ্বশুরকে ডাকতে গেলাম৷ শ্বশুর না করে দিলেন তিনি খাবেন না। ইদানীং শ্বশুর এমন করেন৷ খান না নিয়মিত। মাকে ডেকে আনলাম। ছেলের সাথে এসে তিনি টেবিলে বসেন শুধু৷ ইচ্ছা হলে খান, না হলে খান না। আসিফ মাকে বললো,
‘বসো না। কী হলো? খেয়ে নাও।’
‘তুই খা বাবা। আমি বসি। তানিয়ার অবস্থার কিছু জেনেছিস আর?’
‘আজ আর কল করা হয়নি মা। আমি খেয়ে কল দিবো হসপিটালে। আর নুপুর পর্শুদিন তোমার পরীক্ষা। এখন এখানে আমাকে ভাত বেড়ে দেয়ার সময়? সবাই শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি নিচ্ছে এখন।’
শাশুড়ি আমার দিকে চেয়ে বললেন,
‘যাও বউমা। এখন গিয়ে একটু পড়তে বসো৷ আমি আসিফকে খাইয়ে দিবো কেমন? আর শুনো যাওয়ার আগে দুধ গরম করে এক গ্লাস নিয়ে যেও সাথে৷ রাতে পড়তে পড়তে খাবা৷ আমি শেষ রাতে কর্ণফ্লাক্স নিয়ে যাবো৷ দরজা খুলা রেখো কেমন?’
শাশুড়ির দিকে চেয়ে একটা হাসি দিয়ে আমি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসলাম নিজের রুমে। টেবিলে বই খুলে বসতে যাবো এমন সময় তামান্নার নাম্বার থেকে কল এলো। একবার ভেবেছিলাম কল রিসিভ করবো না এখন। পরে কী ভেবে কল রিসিভ করলা। তামান্না ফোনের ওপাশ থেকে বললো,
‘ভাবি ভাবি ভাবি! আমি মা হতে চলেছি৷ আমি মা হতে চলেছি।’
আমি চোখ বন্ধ করে আলহামদুলিল্লাহ বলে আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করলাম। আজ কতদিন পর একটা খুশির খবর শুনলাম! আমি কল রেখে নিচে নেমে গেলাম৷ শাশুড়ি আর আসিফ টেবিলে বসা। শুরুতেই বাবার রুমে গিয়ে বাবাকে ডেকে আনলাম টেবিলে। তারপর বললাম,
‘একটা গুড নিউজ গুড নিউজ গুড নিউজ। এটেনশন প্লিজ।’
আসিফ খেতে খেতে বললো
‘কী হয়েছে বলবে তো?’
‘আমি মামি হতে চলেছি আর তুমি মামা।’
তারপর শ্বশুরের হাতে ধরে বললাম,
‘বাবা এখন আপনি আপনার নাতি বা নাতিনকে এই আঙুল দিয়ে ধরে লেকের পারে হাঁটবেন। কেমন? আপনি আর জওয়ান না, এখন নানা হতে যাচ্ছেন।’
আমি খেয়াল করলাম শ্বশুর শাশুড়ি দুজনের মুখে যেনো হাসি ফুটে উঠলো৷ শাশুড়ি উপরে হাত উঠিয়ে বললেন,
‘আল্লাহ গো! আমারে অতোদিনে এখান খুশির খবর হুনাইলায়।’
আসিফ খাবার না খেয়ে উঠেই মোবাইল হাতে নিয়ে কল দিলো তামান্নাকে। ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে বললো,
‘আমি আগামীকাল ই আসছি৷ সাবধানে থাকিস তুই কেমন?’
সবাইকে খুশি দেখতে পেয়ে আমার মন ভরে উঠলো। রুমে এসে পড়তে লাগলাম। আজ এতদিন পর যেনো এক প্রশান্তি অনুভব হতে লাগলো আমার। পরিবারের একটা খুশির খবর যে মানুষকে এতটা আন্দোলিত করে তা এই খারাপ সময়ে না পড়লে হয়তো বুঝতেই পারতাম না!
পরেরদিন আসিফ অফিস থেকে এসে মায়ের রুমে গেলো৷ আমাকেও ডাক দিলো৷ আমি পড়া ছেড়ে উঠে গেলাম। আসিফ বললো,
‘ডাক্তার বলেছে আপা এখন কিছুটা সাড়া দিচ্ছে।’
শাশুড়ি মা আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠলেন। আসিফ বললো,
‘না মা। তোমাকে শক্ত হতে হবে৷ ডাক্তার জানিয়েছেন এই ট্রমা থেকে বের হয়ে আসা পসিবল না। তার পরও এমন পজেটিভ সাইন দেখে তারা আশ্চর্য হচ্ছেন। আমাকে কল করেছিলেন ডাক্তার জাবেদ ইমতিয়াজ স্যার। আমাকে বসিয়ে বলেছেন যে এর কোন সুরাহা নাই। এখন যা হবে সব উপর ওয়ালার ইচ্ছাতে আর হুকুমে হবে। হয়তো আপা রিকভার করবে আর না হলে আমাদের সবাইকে স্ট্রং থাকতে বলেছেন যে আপা চিরতরে আমাদের ছেড়ে চলে যাবে। আজ গিয়েছিলাম তামান্নাকে দেখতে৷ সে সুস্থ আছে।’
মহলটা এই ভালো এই খারাপ এমন আমেজে চলে গেলো। আসিফ রুমে এসে আমাকে অভয় দিলো, আমি পড়ছি না কেন মনোযোগ দিয়ে৷ আসিফকে হেসে হেসে বললাম,
‘পর্শুদিন যদি ভাগ্য আমার সহায় থাকে তাহলে ভালো কিছু হবে। নচেৎ…’
‘না৷ নচেৎ না। সবকিছু ভালো হবে। এবং তুমি চান্স ও পাবা। ‘
আসিফের চোখেমুখে আমি আমার জন্য স্বপ্ন ভাসছে দেখতে পেলাম। এতকিছু না ভেবে সানি স্যারের নোট পড়া শুরু করলাম। বায়োলজি বইয়ের শেষে থাকা কুয়েশ্চন রিভাইজ দিলাম। কেমিস্ট্রির কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলায় চোখ বুলালাম। জোবায়ের জিকে আমার বরাবর পছন্দের। মেডিকেলের জিকের জন্য এতকিছু পড়ার দরকার হয় না৷ তবুও মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর এগুলায় চোখ বুলিয়ে নিলাম একবার।
আজ দেখতে দেখতে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ চলে এলো৷ আমার বাবার স্বপ্ন, আমার আসিফের স্বপ্ন, আমার মায়ের দোয়া আর আমার নিজের জন্য কিছু করার ইচ্ছা চোখে ভেসে উঠছে যেনো মুহুর্মুহু করে। আসিফ ভোরেই আমাকে কর্ণফ্লাক্স এনে দিয়ে পাশে বসে রইলো। শাশুড়ি মা একবার রুমে এসে জিজ্ঞেস করে গেলেন কিছুর দরকার আছে কিনা। আটটা চল্লিশে বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম আমি আর আসিফ। দশটায় পরীক্ষা শুরু হলো। এক ঘন্টার পরীক্ষা দিয়ে বাসায় এসে এক প্রশান্তির ঘুম দিলাম। আসিফ আমার হাতে হাত ধরে বললো,
‘উপরওয়ালা যাই করবেন তাই যেনো মঙ্গলের হয়।’
আমি আর চিন্তা করলাম না বেশিকিছু। যা হবার হবে।
দুইদিন চলে গেলো। কাল রাতে দেখলাম আজ সকাল বারোটার পর মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট পাবলিশড হবে। সকাল থেকেই মোবাইল হাতে নিয়ে বসে আছি আমি। বারোটা বাজলো। দুপুর গড়ালো। সন্ধ্যা হলো। রেজাল্ট এখনও দিলো না। প্রতিটা মুহূর্ত যেনো এক বছর সমান লম্বা লাগছে আমার। যেকোনো মুহূর্তে রেজাল্ট দিয়ে দিতে পারে।
বিকালের দিকে নিউজ দেখালো যে রেজাল্ট প্রধানমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে৷ কিছুক্ষণ পর দেখলাম দেশের প্রথম হয়েছে অতসী সুনন্দা, জয়পুরহাট গার্লস ক্যাডেট কলেজ থেকে৷ তার এবারের প্রাপ্ত মার্কস ৮৯.৮৫। আমার ভেতরের কম্পন আরও বেড়ে যেতে লাগলো। এদিকে আসিফ বাসায় চলে এলো। আসিফ এসেই শাশুড়িকে জানালো, তানিয়া আপার সেন্স ফিরে এসেছে এবং ডাক্তার বলেছেন তার পজেটিভ রিকভারি হচ্ছে। আশাকরা যায় সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। শাশুড়ি খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলেন৷ উপরে দুই হাত তুলে বললেন,
‘আল্লাহ আমার পরিবারে যেনো সব সুখ দিয়ে দেন। আল্লাহ তুমি আমার সব সুখ আবার ফিরিয়ে দেও।মালিক আর সহ্য হচ্ছে না এসব।’
আসিফ আমার দিকে তাকালো। আমার চিন্তাযুক্ত মন দেখে বললো,
‘কোন চিন্তা করো না নুপুর। দেখবা সব যখন ঠিক হচ্ছে তখন তোমারও রেজাল্ট ভালো আসবে।’
আমার অজানা শঙ্কা মনে দেখা দিলো। আমি কি চান্স পাবো মেডিকেলে? নাকি স্রস্টা সবকিছু দিয়েও নিয়ে নিবেন আমার থেকে? সব সুখ কি মানুষের কপালে একসাথে চলে আসে?
মুহূর্তের মাঝে মোবাইলে রেজাল্টের একটা মেসেজ এসে ঢুকলো। আমি কাঁপা কাঁপা হাতে মেসেজ দেখতে গেলাম। মেসেজে লেখা…
(চলবে)