ভর দুপুরে কাঠ ফাটা রোদের মধ্যে ত্রয়ী ছাদে বসে আছে। এর মধ্যে রিসা দৌড়ে আসে ছাদে। রিসাকে দৌড়ে আসতে দেখে ত্রয়ী কপাল কুঁচকে রিসার দিকে তাকায়।
– বাবা তোকে এক্ষুনি রুমে যেতে বলেছে ত্রয়ী।
রিসার কন্ঠে অস্থিরতা।
ত্রয়ী উদাস কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
-কেন?
– তা আমি কী করে বলবো? বাবা জাস্ট আমাকে বলেছে তোকে যেন রুমে যেতে বলি।
– আচ্ছা তুমি যাও। আমি আসছি।
রিসা আর কিছু না বলে ছাদ থেকে চলে যায়। ত্রয়ী রিসা যাওয়ার কিছুক্ষন পর রুমে যায়। কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে ওর। সে নিজের ওড়না দিয়ে কপালের ঘাম মুছে বাবার ঘরে যায়।
ত্রয়ীর বাবা জনাব আলফাজ খান। ঢাকা শহরের নামি-দামি একজন ব্যবসায়ী। খুব কঠোর মানুষ আলফাজ সাহেব। তার মুখের উপর কথা বলার সাহস এই খান বাড়ির কারোর নেই।
ত্রয়ী ধীর পায়ে আলফাজ সাহেব এর সামনে এসে দাঁড়ায়। ওকে দেখে আলফাজ সাহেব উনার কালো গ্লাসের গোল চশমাটা ঠিক করে কঠোর কন্ঠে বলেন,
– আজ আফতাহি আসবে তুমি তৈরি থেকো।
বাবার কথা শুনে ত্রয়ী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়।
মেয়ের প্রশ্ন আলফাজ সাহেব বুঝতে পেরে ঠান্ডা গলায় বলেন,
– আমার বন্ধু শাহীন এর একমাত্র ছেলে আফতাহি। লন্ডন থেকে ফিরেছে সপ্তাহ খানেক আগে। শাহীন চাচ্ছে তোর সাথে আফতাহির বিয়েটা হোক। আর আমারও একই ইচ্ছে। তাই আফতাহি আর শাহীন আজ আসবে তোকে দেখে যেতে।
বাবার কথা শুনে ত্রয়ীর সারা শরীরে কাঁপুনি দিয়ে উঠে।
সে ভয়ার্ত কন্ঠে বলে,
– কিন্তু বাবা আমি..
ত্রয়ীর কথা পুরো শেষ করতে না আলফাজ সাহেব হুংকার দিয়ে উঠে।
বাবার হুংকার শুনে সে কেঁপে উঠে। আর কোনো কথা না বলে আলফাজ সাহেবের সামনে থেকে সরে যায় ও। গটগট পায়ে নিজের রুমে এসে রুমের দরজা লাগিয়ে দেয়। ত্রয়ী ঘামছে, খুব ঘামছে। ফুল স্পীডে ফ্যান চালিয়ে দিয়ে সিলিং ফ্যানের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
_______________________________________________________
অতীত!
বিকেল চারটা। ত্রয়ী মাত্রই স্কুল থেকে ফিরেছে। ক্ষুধায় যেনো ওর পেটে ইঁদুর দৌঁড়াচ্ছে। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে এসে ভাত খেতে বসে যায় সে। ত্রয়ীর ভীষণ বাজে অভ্যাস হচ্ছে সোফায় পা তুলে বসে, দুই পায়ের মাঝখানে ভাতের প্লেট রেখে, টিভি দেখতে দেখতে ভাত খাওয়া। এই অভ্যাসের জন্য মায়ের হাতে কতো পিটুনি খায় সে, তবুও অভ্যাস চেইঞ্জ করে না।
অভ্যাস চেইঞ্জ না করার পিছনে অবশ্য আরেকটা বিশাল কারণ রয়েছে তা হচ্ছে আলফাজ সাহেবের আহ্লাদ ।
যখনি ত্রয়ীর মা তনয়া মেয়েকে কিছু বলতে যাবেন, তখনি আলফাজ সাহেব মেয়ের পক্ষ নিয়ে বলবেন,
– আহা তনয়া! তুমি কেন শুধু শুধু আমার মেয়েকে কথা শুনাচ্ছো? তোমার তো একটাই চিন্তা- সোফা নষ্ট হয়ে যাবে তাই তো? কিন্তু তুমি কি জানো না? এরকম এক সেট সোফা নষ্ট হলে, আমি আরো দশ সেট কিনে নিয়ে আসবো তৎক্ষনাৎ।
তবুও তুমি আমার একমাত্র মেয়েকে এসব ঠুনকো বিষয়ের জন্য বকা দিবে না বলে দিলাম।
ত্রয়ী তখন আহ্লাদে আধখানা হয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
– তুমি আমার বেস্ট বাবা।
তারপর শুরু হয়ে যায় মেয়ে আর বাবার আহ্লাদীপনা। তা দেখে তনয়া মুখ ভেংচি কেটে আলফাজ সাহেব কে বলেন,
– দাও দাও মেয়েকে আরো আশকারা দাও। যখন মাথায় চড়ে বসবে তখন বুঝবে।
তনয়ার কথা বাবা-মেয়ে কেউ কানে তুলেনা।
সেদিন স্কুল থেকে এসে ত্রয়ী রোজকারের মতো একই ভাবে ভাত নিয়ে বসে সোফায়। এক লোকমা মুখে দিতেই বাসার কলিং বেল বেজে উঠে। ত্রয়ী তাদের বাসার কাজের মেয়ে টুকিকে ডাক দেয় দরজা খুলে দেওয়ার জন্য, কিন্তু টুকির কোনো পাত্তাই পাচ্ছেনা। এদিকে কলিং বেলটাও বারবার বেজে উঠছে। ত্রয়ী বিরক্ত হয়ে নিজেই দরজা খোলার জন্য ভাত রেখে দিয়ে পা বাড়ায়।
দরজা খুলেই ত্রয়ী হা হয়ে যায়। একটা অচেনা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। ত্রয়ী ছেলেটার পা থেকে মাথা অবধি পর্যবেক্ষণ করতে থাকে।
সাদা ধবধবে বিশাল লম্বা দেহের ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখের মণিটা ব্রাউন কালারের। চুলগুলো কপাল অবধি আঁচড়ে পড়েছে। হাত দিয়ে সে বার বার চুলগুলো ঠিক করছে। নাকটা সরু লম্বাটে। খুব বেশি মোটাও না, আবার চিকনও না।
ত্রয়ী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব কিছু দেখছে। ওর এমন কান্ড দেখে ছেলেটা ফিক করে হেসে দেয়।
ত্রয়ী মুগ্ধ নয়নে সে হাসি উপভোগ করছে আর ভাবছে,
– ছেলেদের হাসি এতো সুন্দরও হয়?
ত্রয়ীর ভাবনার ছেঁদ করে ছেলেটা বলে,
– আংকেল বাসায় আছেন?
কন্ঠ শুনে ত্রয়ীর যায় যায় অবস্থা। ওর মনে একটা গান বাজা শুরু করে তৎক্ষনাৎ,
“পাগল হয়ে যাবো, আমি পাগল হয়ে যাবো।”
– জ্বি কোন আংকেল?
– আলফাজ সাহেব।
– না, বাবা একটু বাহিরে গেছেন। কেনো?
-আসলে আমরা আজ উপরের তলায় ভাড়া উঠেছি। বাসার চাবিটা লাগতো।
ছেলেটার কথা শুনে ত্রয়ী যেনো খুব খুশি হলো। ও দৌড়ে গিয়ে উপরের চাবিটা নিয়ে এসে ওর হাতে দেয়।
থ্যাংকস বলেই অচেনা ছেলেটা পা বাড়ায় তার গন্তব্যে।
ত্রয়ী উদাস মনে তা দেখতে থাকে।
.
.
চলবে।
.
.
#বেখেয়ালি_মনে
#লেখনীতেঃ Ifra Chowdhury