বেখেয়ালি মনে পর্ব-২

0
1673

#বেখেয়ালি_মনে
#লেখনীতে- Ifra Chowdhury
পর্ব-০২

রাত দশটা নাগাদ খান বাড়ির সবাই ডিনার করতে বসেছেন। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে তনয়া তার দুই ছেলে তিসান আর নিশানের সাথে কাল একটু বেরোনোর প্ল্যান করছেন।

তনয়া তিসানের দিকে আড়চোখে তাকাতেই তিসান ঢোক গিলে বলে,
– সরি আম্মু, কাল আমার একটা ফ্রেন্ডের বার্থডে পার্টিতে যেতে হবে। আমি তোমার সাথে বেরোতে পারবোনা।
তনয়া বলে,
– সে তুই কবেই বা আমার সাথে বের হোস। তুই তো এই শহরের সব থেকে ব্যস্ত মানুষ।

তিসান মায়ের কথা শুনে আরো জোরেশোরে ঢোক গিলে চুপ করে থাকে। এমনিতেই তনয়া এখন চটে আছে ওর উপর, তাই বেশী কথা বলে মায়ের হাতে কান মলা খাওয়ার ইচ্ছে আপাতত তিসানের নেই৷

তনয়া তিসানের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিশানের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে আদুরে গলায় বলে,
– আমার মানিক! তুমি নিশ্চয়ই ভাইয়ের মতো বলবেনা তোমারও কাল অনেক কাজ আছে, তাই না?
নিশান খাবার প্লেট থেকে মুখ সরিয়ে নিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলে,
– সে তুমি যেখানে যেতে চাও আমি তোমাকে সেখানে নিয়ে যেতেই পারি৷ তবে একটা শর্ত আছে।
তনয়া বলে,
– আবার কিসের শর্ত?
– আমি তোমাকে সেখানে ড্রপ করে দিয়েই চলে আসবো। তোমার সাথে বসে থাকতে পারবো না।
তনয়া হাসি মুখ করে বলে,
– এই তো আমার সোনার চাঁদ! ঠিক আছে আব্বু তোমাকে বসে থাকতে হবেনা। তুমি আমাকে তোমার মামার বাসা পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে আসলেই হবে।
নিশান মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।

মা আর ছেলেদের কথা শুনে ত্রয়ী আর আলফাজ সাহেব মিটমিটিয়ে হাসছে। তা দেখে তনয়া সরু চোখে আলফাজ সাহেবের দিকে তাকায়। স্ত্রীর এমন চাহনিতে আলফাজ সাহেব একদম ভিজে বিড়ালের মতো হয়ে যায়। তারপর গলা খ্যাঁক করে পরিষ্কার করে নিয়ে এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে পান করে নেয়।

ত্রয়ীর খাওয়ার মধ্যখানে বিকেলের সেই অচেনা ছেলেটির কথা মনে পড়ে। ও মুখের ভাত তাড়াতাড়ি শেষ করে আলফাজ সাহেবকে জিজ্ঞেস করে,
– বাবা, আজ নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে।
আলফাজ সাহেব বলেন,
– হ্যাঁ! জানি। আর তোর কাছ থেকে চাবি নিয়ে গেছে এটাও আমি জানি।
ত্রয়ী ভারী অবাক কন্ঠে বলে,
– তুমি জানো কীভাবে?
– যে চাবি নিয়েছে সে নিজেই আমাকে বলেছে।
– ওহ আচ্ছা! এবার কি ব্যাচেলর ভাড়া দিয়েছো বাবা?
আলফাজ সাহেব উনার চশমা ঠিক করে বলেন,
– না ফ্যামিলি।
ত্রয়ীর ছোট্টো মস্তিষ্কে ফ্যামিলি শুনে একটা কথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ফ্যামিলি মানে তো হাজবেন্ড ওয়াইফ। তাহলে ছেলেটা কি বিবাহিত? বিবাহিত কথাটা মনে হতেই ত্রয়ীর বড় বড় চোখ দুটো আরো বড় হয়ে যায়। কেমন যেন একটা হিংসে হিংসে ভাব জাগে। হৃদ-কিনারে শূন্যতা অনুভব হয়। কিন্তু কেনো এমন হয়, সে তা জানেনা।

ত্রয়ীর ভাবনার মাঝখানে তনয়া জিজ্ঞেস করেন,
– ফ্যামিলি তে কয়জন আছে?
আলফাজ সাহেব স্ত্রীর প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে বলেন,
– তিনটা বাচ্চা আর হাজবেন্ড ওয়াইফ।
তিনটা বাচ্চার কথা শুনে ত্রয়ী বিষম খায়। ছেলেটার চেহারা কল্পনায় এনে বিড়বিড় করে বলে,
– এই বয়সেই তিন বাচ্চার বাপ? আর কয় বছর পর না জানি কতো বাচ্চার বাপ হয়ে যাবেন, আল্লাহ মালুম!
ত্রয়ীর বিড়বিড় করা শুনে তিসান ওর মাথায় একটা চাটি মেরে বলে,
– কি রে কার কথা মনে করে বিষম খেলি?
– রিসা ভাবির কথা মনে পড়ে গেলো হঠাৎ।
কথাটা আস্তে করেই বলে ত্রয়ী। যাতে বাবা-মায়ের কান অবধি সেটা না পৌঁছায়।
রিসার নাম শুনেই তিসান গটগট পায়ে ডাইনিং রুম ত্যাগ করে। রিসার সাথে গত একবছর যাবৎ প্রেম করছে তিসান। ব্যাপারটা তনয়া আর আলফাজ সাহেবের চোখ এড়িয়ে গেলেও ত্রয়ী আর নিশানের চোখ এড়িয়ে যায়নি। এই জন্যই তিসান কোনো কাজে ত্রয়ী আর নিশানকে ফাঁসাতে চাইলে উল্টো ওরা দুজন মিলেই তিসানকে ফাঁসিয়ে দেয়।

তিসান চলে যাওয়ার পর নিশান আর ত্রয়ী খিলখিল করে হেসে উঠে। আলফাজ সাহেব আর তনয়া তাদের তিন ছেলে মেয়ের কান্ড কিছু বুঝতে না পেরে একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে থাকেন।

_______________________________________________________

সকালে ত্রয়ী ব্রেকফাস্ট সেরে স্কুলে চলে যায়। আলফাজ সাহেব বেরিয়ে পড়েন তার অফিসের উদ্দেশ্যে। তিসান গার্লফ্রেন্ডের সাথে দেখা করার জন্য সকাল আটটায় বাসা ত্যাগ করেছে।

বাসায় এখন আছে তনয়া, নিশান আর তাদের কাজের মেয়ে টুকি। নিশান রেডি হয়ে বসে আছে মাকে মামার বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্য। তনয়া রেডি হয়ে এলে নিশান আর উনি বেরিয়ে পড়েন।

টুকি ছাড়া পুরো বাসায় আর কেউ নেই। ত্রয়ী এগারোটা নাগাদ বাসায় ফিরে আসে। তা দেখে টুকি ভীষণ অবাক হয়। ত্রয়ী তো বিকেল চারটার আগে বাসায় ফিরেনা। তবে কি আজ ওর শরীর খারাপ হলো নাকি?

টুকি তাড়াহুড়ো করে ত্রয়ীর জন্য এক গ্লাস পানি নিয়ে আসে। ও সেই পানি এক নিশ্বাসে পান করে নেয়।
টুকি বলে,
– আপামনি, আপনের কি শরীর খারাপ?
সে টুকির দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে,
– না রে টুকি।
– তাইলে আপনে এহন বাসায় কেন?
– আজ ক্লাস বাঙ্ক করতে ইচ্ছে হলো তাই চলে এলাম।
মা বাসায় থাকলে তো স্কুল বাঙ্ক করা যায় না।
ত্রয়ীর ইংরেজি কথাটুকু টুকি বুঝলো না। ও ত্রয়ীর দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো।

তা দেখে ত্রয়ী বলল,
– মানে স্কুল ফাঁকি দিয়েছি আজ। এবার বুঝেছিস?
ওর কথা শুনে টুকি একটা হাসি দিয়ে বলে,
– হয় আপা এহন বুঝছি। ভালোই করছেন আজ স্কুল ফাঁকি দিছেন, আমারও একা একা বাসায় ভাল্লাগতাসিলো না।
ত্রয়ী হাসলো ওর কথায়।

স্কুল থেকে ফিরে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে ত্রয়ী নাচতে নাচতে ছাদের দিকে পা বাড়ায়। কিন্তু থার্ড ফ্লোর পর্যন্ত গিয়ে ত্রয়ীর পা আটকে যায়। বারবার সেই ছেলেটির কথা মনে পড়তে থাকে। পরক্ষণেই মনে হয়ে যায় ছেলেটি বিবাহিত।

কিন্তু ত্রয়ীর মনটা যে বড্ড চঞ্চল ও উশৃঙ্খল হয়ে পড়ছে। কথা শুনছে না যেন। মনের সাথে শরীরটাও বড্ড অবাধ্য হয়ে আছে। ও তাই স্থিরও থাকতে পারেনা। আস্তে আস্তে দরজার সামনে গিয়ে কলিং বেল বাজায়।

একবার বাজালে কেউ সাড়া দেয় না। তাই ও দ্বিতীয়বার কলিং বেল বাজাতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে সেই মধুর কন্ঠস্বর,
– আসছি।
কন্ঠটা শুনেই ত্রয়ীর ভেতরে তোলাপাড় শুরু হয়ে যায়। ষোল বছরের কিশোরীর মন কুঠুরীতে প্রিয় প্রণয় সম্পর্কে একটু একটু আন্দাজ করতে পারছে ত্রয়ী। এ যেনো এক জ্বালাময়ী অনুভূতি।

দরজা খুলেই ছেলেটা বলে,
– আরে বোকাপাখি যে।
ত্রয়ী অন্যদিকে ফিরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে স্বাভাবিক হয়ে নেয়। তারপর ওর চারপাশে দেখতে থাকে।
তারপর বলে,
– হু ইজ বোকাপাখি?
ছেলেটি সেই মন মুগ্ধকর হাসি দিয়ে বলে,
– ইউ।
ত্র‍য়ী মুখ ভেংচি কেটে বলে,
– আই এম নট বোকাপাখি।
ছেলেটার হাসি আরো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতম হয়।
সে বলে,
– যে মেয়ে একটা পরপুরুষকে তার-ই সামনে ওমন তীর্যক দৃষ্টিতে দেখতে থাকে, তাকে বোকাপাখি ছাড়া আর কিছু বলা সম্ভব না আমার পক্ষে।

কথাটা শুনেই ত্র‍য়ী লজ্জায় হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে এখনি কোনো গোপন সুরঙ্গে লুকিয়ে যেতে। লজ্জায় ওর নাকের পাটা লাল হয়ে গেছে। কান গরম হয়ে অদৃশ্য গরম ভাপ বের হচ্ছে যেন। অসহনীয় ব্যাপার!

ত্রয়ীকে আর লজ্জায় না ফেলে ছেলেটা বলে,
– ভেতরে আসুন। তারপর দরজা থেকে সরে দাঁড়ায় সে।
ত্র‍য়ী ভেতরে এসে উঁকিঝুকি দেয় কিন্তু কাউকে দেখতে পায় না।
পিছন থেকে ছেলেটি বলে,
– কাকে খুঁজছেন?
– ভাবীকে।
– ভাবী মানে কোন ভাবী?
ত্রয়ী ছেলেটির মুখোমুখি হয়ে বলে,
– আপনার ওয়াইফকে।
হতাশ কন্ঠে সে বলে,
– ওয়াইফ তো বাপের বাড়ি।

তার নিজের মুখে ওয়াইফের কথাটা ত্রয়ীর মনে প্রবল ঝড়ের মতো আঘাত হানে। মনের ছোট্ট চিলেকোঠাটির দরজা খোলার আগেই তা বন্ধ হয়ে যাবে, সেটা ভেবেই ওর বুক চিড়ে বেরিয়ে আসে হাহাকার মাখা এক দীর্ঘশ্বাস। এক বেদনাময় অনুভূতি।
.
.
চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here