বেখেয়ালি মনে পর্ব-১০

0
805

#বেখেয়ালি_মনে
#লেখনীতে- Ifra Chowdhury
পর্ব-১০
.
.
হক বাড়ির সবাই ড্রইং রুমে বসে আছে। ত্রয়ী নিজের রুমে ছিলো। রাবেয়া হক ত্রয়ীকে ডেকে পাঠান। ত্রয়ী নিচে যেতেই তিনি বললেন,
– তোমার বাবা ফোন করেছিলেন। তুমি কবে ঢাকায় ফিরবে সেটা জানার জন্য।
ঢাকায় ফেরার কথা শুনে ত্রয়ীর মনের আকাশের মেঘেরা গর্জে উঠে। সে বলল,
– কবে ফিরবো?
রাবেয়া মৃদু হেসে বললেন,
– আরো সপ্তাখানেক পর।
ত্রয়ী অবাক হয়। বিস্মিত কন্ঠে বলে,
– বাবা এতোদিন থাকার পারমিশন দিয়ে দিলো?
ত্রয়ীর কথা শুনে উপস্থিত সবাই হেসে দিলো। রাবেয়া বললেন,
– পারমিশন না দিয়ে যাবে কোথায়?

ত্রয়ী কিছু বললো না। ঠোঁট টিপে হাসলো। মনের আকাশের মেঘদের সরিয়ে ঝলমল রোদ উঁকি দিলো।
ইনান মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত। ত্রয়ী খুটিয়ে খুটিয়ে তাকে দেখছে।

ইফতিহা পাশ থেকে বলল,
– ত্রয়ী আপু, তুমি তো এই প্রথম সিলেট এসেছো তাই না?
ত্রয়ী মাথা নাড়িয়ে বলল,
– হুম।
ইফতিহা উল্লাসী কন্ঠে বলল,
– সিলেটে অনেক সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে ঘুরে দেখার জন্য। তুমি ঘুরতে যাবে?
– কে নিয়ে যাবে আমায়?
– কেন ভাইয়া নিয়ে যাবে।
পিছন থেকে ইয়াদ বলল কথাটা।

মুহুর্তেই ত্রয়ীর মন ফড়িংয়ের ন্যায় নেচে উঠলো। ইয়াদের কথা শুনে ইনান চোখ তুলে তাকালো। মোবাইল পকেটে পুরে সে বলল,
– অতো সময় কোথায়? সপ্তাখানেক তো আমরা এদিকটা সামলাতেই হিমশিম খেয়ে যাবো। ঘুরার মতো টাইম নাই।
নিমিষেই ত্রয়ীর মনের দুয়ারে তালা পড়ে যায়। ত্রয়ী উঠে দাঁড়ায় ড্রইংরুম ত্যাগ করার জন্য।

রাবেয়া হক বলল,
– বাবুসোনা, এদিকটা আমরা সবাই সামলে নিবো। আর একটা দিনেরই তো ব্যাপার তুই বরং ওকে ঘুরিয়ে নিয়ে আয়।
মায়ের কথা ইনান কখনোই ফেলতে পারেনা। রাজি হয় সে। তবে বলে,
-কিন্তু মা বাড়ির এমন পরিস্থিতিতে কীভাবে এখন ওকে নিয়ে ঘুরতে যাই?

-আরে তোকে এখনি কে বলছে নিয়ে যেতে? এমন সময় তো আমিও যেতে বলবো না। কয়টা দিন পরে নাহয় মেয়েটাকে নিয়ে একটু ঘুরে আসিস।

মায়ের সাথে সম্মতি জানায় ইনান। ত্রয়ীকে পিছন থেকে ডেকে বলে,
– আচ্ছা আমি তোমাকে দু’দিন পর জানিয়ে দেবো। ঠিক আছে?

ত্রয়ী কিছু বলেনা। শুধু মাত কাত করে সম্মতি জানায়। তারপর ধীরে ধীরে হালকা নজর লুকিয়ে ইনানের দিকে তাকাতে চায়। কিন্তু ব্যর্থ হয় সে। ইনানও দেখে ফেলেছে ওকে৷ দুজনের দৃষ্টি মিলতেই অপ্রস্তুত ভাবে চোখের পালক ফেলে অন্যদিকে সরিয়ে নেয়।

__________________________________________________________

ছাদের এক কোণে চিলেকোঠার ঘর। সেই ঘরে রয়েছে নানা রকমের পেইন্টিং। ইনান রঙ তুলি নিয়ে সাদা ক্যানভাস গুলো বিভিন্ন রঙে রাঙিয়ে তুলছে। ত্রয়ী দু’কাপ চা নিয়ে সেই ঘরে যায়। ইনান ব্যস্ত। ত্রয়ী বিরক্ত না করে পিছনে দাঁড়িয়ে থাকে। বেশ কিছুক্ষন পর ইনান পিছন ফিরে দেখে ত্রয়ী দাঁড়িয়ে আছে। হাতে চায়ের কাপ।

ইনান হেসে বলে,
– আরে তুমি যে! কখন এলে?
– অনেকক্ষন।
– ডাকলে না কেন?
-ব্যস্ত ছিলেন। বিরক্ত করতে মন চায়নি।
-তেমন ব্যস্ত ও ছিলাম না যে ডাকলে বিরক্ত হতাম।
ত্রয়ী তার ডান হাতের কাপ টা এগিয়ে দিয়ে বলে,
-আপনার গ্রীন টি।
ইনান রঙ তুলি রেখে এগিয়ে দেওয়া কাপ টা হাতে নিয়ে বলে,
– থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ।
ত্রয়ী সানন্দে তা গ্রহন করে বলে,
– ওয়েলকাম।

দেয়াল ঘেষে রাখা টেবিলের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ায় ত্রয়ী। চোখ যায় কাপড়ে মোড়ানো ক্যানভাস গুলোর দিকে। উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
– ক্যানভাস গুলো আড়াল করা কেন? কী আঁকা তাতে?

ইনান নিঃশ্বাস ছাড়ে। বলে,
– আমার জীবনে ফেলে আসা দিনগুলো থেকে পুরোনো কিছু লাল, হলুদ, নীল রঙ মাখা তুলির আলতো করে ছুঁয়ে দেওয়া আঁচড় রয়েছে তাতে।

-তাহলে কাপড় দিয়ে মোড়ানো কেন এগুলো?
ইনান কিছু বলেনা। চুপ করে থাকে। কথা পাল্টিয়ে বলে,
– বাবা-মা কে ছেড়ে আগে কখনো থেকেছো?
ত্রয়ী মৃদু গলায় বলে,
– না, এই প্রথম।
-কেমন লাগছে থাকতে?
-খারাপ লাগছে তা বলবো না। তবে অস্বস্তি হয়। অভ্যেস
নেই তো, সে জন্য।

ত্রয়ীর কথা শুনে ইনান রহস্যময় হাসি দেয়। এমন কেন ছেলেটা? তা বুঝতে পারেনা ত্রয়ী।

জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখতে থাকে ত্রয়ী। আজকের আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার। রোদ নেই আবার মেঘও নেই। আকাশের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে সে তার মনের ক্যানভাসে ইনানের প্রতিচ্ছবি আঁকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

________________________________________________________

-মা ত্রয়ী আপুকে তোমার কেমন লাগে?
উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে ইফতিহা জিজ্ঞেস করে রাবেয়া হককে।
রাবেয়া মেয়ের মাথায় বিলি কেটে দিতে দিতে বলে,
– ভালোই তো। বেশ ঠান্ডা স্বভাবের মেয়ে। শহরে বড় হয়েও তেমন চঞ্চল হয়নি।
– ঠিক তাই মা। কি মিশুক মেয়েটা। কয়দিনের মধ্যেই কেমন আপন করে নিছে আমাদের।
মা মেয়ের কথার মাঝে ইনান ও ইয়াদ এসে উপস্থিত হয়।

ইয়াদ বলে,
– কি নিয়ে কথা হচ্ছে?
রাবেয়া হেসে বলেন,
– ত্রয়ীকে নিয়ে।
ইয়াদ আবার বলে,
– তা কী কথা হচ্ছে?
ইফতিহা বিরক্ত হয়ে বলে,
– সব কথা তোর শুনা লাগবে না।
ইয়াদ ইফতিহার মাথার বেনীটা হালকা টান মেরে বলে,
– কেন আমি শুনলে তোর সমস্যা কোথায়?

ইফতিহা আরো কিছু বলতে নিলে ইনান তাদের থামিয়ে দিয়ে বলে,
– আবার শুরু হয়ে গেলো তোদের তাই না? এর জন্যই দু’টো কে এতোদিন দূরে রেখেছি।
ইয়াদ আর ইফতিহা কানে হাত দিয়ে একসাথে বলে,
– সরি ভাইয়া। আর হবেনা এমন।

ছেলে মেয়েদের কান্ড দেখে রাবেয়ে হক হেসে দেন। ইনান দুহাতে দুজনের কান ধরে কাছে টেনে বলে,
– হয়েছে হয়েছে, আর কান ধরতে হবেনা। পাজি দুইটা।

রাবেয়া হক তিন ছেলে মেয়ের উদ্দেশ্যে বলেন,
– সারাজীবন এমন হাসি খুশি থাকিস তোরা। এভাবেই একে অপরকে জড়িয়ে রাখিস। তোদের খুশিতেই যে আমার খুশি।

ত্রয়ী দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে মা আর তিন ছেলে মেয়ের খুঁনসুটি দেখতে থাকে। পরক্ষণেই মনে পড়ে যায় তার ভাইদের কথা। দু’দিন হয়েছে তাদের ছেড়ে এসেছে এখানে, অথচ ত্রয়ীর মনে হচ্ছে দুই শতাব্দী হয়ে গেছে সে তার ভাইদের দেখেনা। ভাই-বোনের বন্ধন টাই এমন। কাছে থাকলে সারাক্ষণ খুঁনসুটি লেগেই থাকে, দূরে গেলে আবার তাদের জন্যই মন কাঁদে।

_________________________________________________________

ইফতিহা বই পড়ছে। কিশোরী উপন্যাস। তা দেখে ত্রয়ী বলে,
– তুমি উপন্যাস পড়ো? বাসায় কিছু বলে না?
ইফতিহা মুচকি হেসে বলে,
– কেউ জানলে তো বলবে।
ত্রয়ী ভ্রুদ্বয় কিঞ্চিৎ বাঁকিয়ে বলে,
-মানে?
ইফতিহার হাসির বেগ আরো বেড়ে যায়। সে বলে,
– লুকিয়ে পড়ি।
-ওহ। তো এসব উপন্যাস কার?
-ইনান ভাইয়ার।
– তোমার ভাইয়া বই ও পড়ে?
– হুম পড়ে তো। বই পড়া তো ভাইয়ার নেশা। বলা যায়, ভাইয়ার ছোট খাটো একটা লাইব্রেরীও আছে।

ত্রয়ী কপালে হাত দিয়ে বলে,
– তোমার ভাইয়া আর কী কী করে বলতো?
ইফতিহা হেসে ফেলে ত্রয়ীর কথায়।
ত্রয়ী আবার বলে,
– সিরিয়াসলি, এমন অল রাউন্ডার ছেলে আমি খুব কমই দেখেছি। একসাথে সে কত পেশায় যুক্ত। ইঞ্জিনিয়ার, চিত্র শিল্পী আবার সেই সাথে কবিও। যদিও এখনো তার লেখা কবিতা শোনা হয়নি। তবে, আমার ধারনা চমৎকার লিখেন উনি।

ইফতিহা বলে,
– ভাইয়া সব কিছু পারলেও এখন অবধি প্রেম করতে পারেনি।
– প্রেম করলে তো আস্ত রাখতাম না তোমার ভাইকে। একদম গিলে ফেলতাম।
ত্রয়ীর কথা শুনে ইফতিহার চোখ কপালে উঠে যায়। ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলে,
– এ্যা! কী বললে?

ত্রয়ীর এতোক্ষনে খেয়াল হয় সে মুখ ফসকে মনের কথাটা জোরে বলে ফেলেছে। অন্যদিকে ফিরে জিভ কাটে। ঢোক গিলে বলে,
– না তো কিছু বলিনি তো। কথা পাল্টাতে সে আবার বলে,
– তুমি না বললে তোমার ভাইয়ার লাইব্রেরী আছে? তা কোথায়?
– ভাইয়ার রুমের পাশে ছোটো একটা রুম আছে। সেটাতেই ভাইয়ার বুক শেলফ। অনেক অনেক বই আছে।

মজার কথা কী জানো আপু? ভাইয়ার রুমের ভিতর দিয়েও সেই রুমে যাওয়া যায়। তাই ভাইয়া ওই রুমের মেইন ডোর টায় তালা দিয়ে রাখে। তার পারমিশন ব্যতীত কেউ ওই রুমে যেতে পারেনা। কিন্তু আজ রুমটায় তালা ছিলো না। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আমি এই উপন্যাসটা এনেছি।

– কেন?
– তা জানিনা।
ত্রয়ী কিছু একটা ভেবে বলল,
– চলো।
– কোথায় আপু?
– তোমার ভাইয়ের লাইব্রেরী তে যাবো।
– না আপু, যদি ধরা খাই তাহলে ভাইয়া খুব বকা দিবে।
-ধরা খাবে না। সিওর থাকো।
– সিওর তো আপু?
– আলবাত, হান্ড্রেড পার্সেন্ট সিওর।
ত্রয়ীর ভরসায় ইফতিহাও লাইব্রেরীর উদ্দেশ্যে পা টিপে টিপে হাঁটতে থাকে।

.
.
চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here