বেখেয়ালি মনে পর্ব-১৩

0
801

#বেখেয়ালি_মনে
#লেখনীতে- Ifra Chowdhury
পর্ব-১৩
.
.
-ওর নাম প্রিয়া।
-প্রিয়া?
-হুম প্রিয়া। পুরো নাম মেহেরিশ চৌধুরী প্রিয়া।
ত্রয়ী নিঃশ্বাস ছাড়লো। বলল,
-আপনাদের সম্পর্ক?
ইনান ত্রয়ীর মুখের দিকে তাকালো। স্পষ্ট কন্ঠে বলল,
– নাম দেওয়ার মতো কোন সম্পর্ক আমাদের মধ্যে তৈরি হয়নি।
ত্রয়ী ইনানের কথা কিছুই বুঝলো না। শুধু নীরব শ্রোতা হয়ে রইলো।

ইনান আবার বলল,
– বছর তিনেক আগের কথা। আমার তখনও পড়া শেষ হয়নি। তারপরেও আম্মুর মাথায় আমার বিয়ের ভূত চেপে বসেছিলো তখন। আমি বাধা দেওয়া সত্ত্বেও আম্মু মেয়ে দেখছিলো। হঠাৎ করেই আম্মুর এক বান্ধবী প্রিয়ার সন্ধান দেয়।

ইনান কিছুটা থামলো। দোলনা থেকে উঠে ছাদের কর্ণারে গেলো। ত্রয়ী তখনও দোলনায় বসা। মনে তার বিষন্নতা।

ইনান আবার বলা শুরু করলো,
– প্রিয়ার বাবা সিলেটের নামি-দামি ব্যবসায়ী। আমাদের ফ্যামিলির সাথে ওদের ফ্যামিলির খাপ খেয়ে গেলো। প্রিয়াকে দেখার জন্য আমাদের বাড়ির সবাই গেলো। আমি তখন ঢাকা ছিলাম তাই যেতে পারিনি। তবে ইয়াদ প্রিয়ার একটা ছবি আমাকে পাঠিয়েছিলো। ছবি দেখে আমি মুগ্ধ হই। একরাশ মায়া কাজ করে ওর প্রতি আমার। বুকে চিনচিন ব্যথা অনুভব করি।

ইনান কথা বলছে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে। এদিকে ত্রয়ীর মনে কালো মেঘেরা গলে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। মনের বৃষ্টি চোখে এসে জমাট বাঁধে। চোখের কোণ বেয়ে বিন্দু বিন্দু পানি গড়িয়ে পড়ে। ইনান তা দেখতে পায় না।

ইনান বলে,
– মা-বাবা বিয়ের পাকা কথা বলার আগে আমাকে ফোন করে। এদিকে প্রিয়াকে দেখেই আমার ভালোলাগা কাজ করে, মনে মিশ্র অনুভূতির সৃষ্টি হয়। তাই আমি হ্যাঁ বলে দেই। ব্যস! বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়ে যায়। আমার সেমিস্টার এক্সাম শুরু হয় তাই আসতে পারিনি সিলেট। তবে রোজ মুঠোফোনে প্রিয়ার সাথে আলাপ হয়। খুব কাছাকাছি চলে আসি দু’জনে। প্রথম প্রেমে পড়ি তখন, তবে তা গোপন রাখি প্রিয়ার কাছে। শুধু প্রিয়ার কাছেই, বাসার সবার কাছে না।

হুট করে প্রিয়াকে দেখার তীব্র লোভ জাগে আমার মনে। তাই দ্রুত সিলেট আসি। মা আমাকে দেখে খুব অবাক হয়। আগের দিন সিলেট আসি। পরেরদিনই প্রিয়াকে দেখতে ওদের বাসায় যাই। প্রিয়াকে জানাইনি ব্যাপারটা। সারপ্রাইজ দিবো ভেবেছিলাম। আমার সাথে ইয়াদও যায়। কতো স্বপ্ন বুকে। কতো প্রেম ওকে নিয়ে। বুঝোই তো আবেগী হৃদয়ের কতো আকুলতা।

ত্রয়ী নিঃশব্দে কাঁদছে। ইনানের কথার প্রত্যুত্তর দেয় কাঁপা গলায়,
– হুম, তারপর?
– প্রিয়ার বাসার দরজায় যাওয়া মাত্রই ওর বাবা তোফাজ্জল চৌধুরী আমাদের অকথ্য ভাষায় অপমান করেন।
ত্রয়ী চোখের পানি মুছে অবাক কন্ঠে বলল,
– অপমান?

– হ্যাঁ অপমান! তার এমন ব্যবহারের কারণ বুঝতে পারলাম না তখন। তবে উনার কথায় এটা স্পষ্ট ছিলো, তিনি তার মেয়ের বিয়ে আমার সাথে দিবেন না।
আমি তার কারন জানতে চাইলে সে আমাকে বলেন, প্রিয়ার এই বিয়েতে মত নেই। আমি প্রিয়ার সাথে দেখা কর‍তে চাইলাম। উনি বললেন, প্রিয়া বাসায় নেই। অথচ প্রিয়া সেদিন বাসায়ই ছিলো। আমি স্পষ্ট ওর গলার আওয়াজ শুনতে পেয়েছিলাম ভেতর থেকে। তারপর তোফাজ্জল চৌধুরীর কাছে হাতজোড় করে শুধু একটা বার প্রিয়াকে সামনে আনার অনুরোধ করলাম।

কিন্তু উনি প্রিয়াকে সামনে আনেন নি। আমি প্রিয়ার নাম ধরে চিৎকার করলাম। তবুও প্রিয়া আসেনি। অবশেষে ওর বাবার পায়ে পড়লাম তবুও বিশেষ কোনো লাভ হলোনা।

ইয়াদ ততক্ষণে বাসায় ফোন করে সব জানায়। সব শুনে বাবা, চাচ্চু প্রিয়াদের বাসায় যান। এসবের কারণ জানতে চাইলে তোফাজ্জল সাহেব বলেন, আমার অতীতের জন্য তিনি তার মেয়েকে আমার হাতে তুলে দিবেন না।

ইনানের অতীতের কথা শুনে ত্রয়ী আঁৎকে উঠে। ভয়ার্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
-অতীত?
ইনান হাসে। খুব জোরে হাসে। তারপর বলে,
– হুম অতীত। এই অতীতটাই আমার জীবনের কাল।
– অতীতটা কী?

ইনান পিছু ঘুরে ত্রয়ীর দিকে তাকিয়ে বলে,
– সেটার গল্প না হয় অন্যদিন হবে। আজ এটুকুই থাক।
– তারপর প্রিয়া আপুর সাথে আপনার আর যোগাযোগ হয়নি?

– নাহ, এমন ঘটনার পর আমি কিছুদিন ডিপ্রেশনে ছিলাম। সেটা থেকে বের হতে অনেক দিন লেগে যায়। মা খুব ভয় পেয়ে যায়। আমাকে আবার ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়। ঢাকামুখী হয়ে ধীরে ধীরে ডিপ্রেশন কাটিয়ে উঠি। প্রিয়ার জন্য আমার মনে যে ভালোবাসা টুকু তৈরি হয়েছিলো তা ঘৃনায় পরিনত হয়।

– ভালোবাসলে কী তাকে ঘৃনা করা যায়?
ত্রয়ীর প্রশ্নে ইনান চুপ হয়ে যায়। আপন মনে ভাবে, হয়তো প্রিয়ার প্রতি তার ভালোবাসা ছিলোনা। যা ছিলো, তা শুধু ক্ষনিকের মোহ।
প্রশ্নের জবাব না পেয়ে ত্রয়ী বলে,
– বললেন না তো?
– সময় আর বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে সব কিছুই করা যায়। ভালোবাসলে তাকে ঘৃনা করা যায়। কিন্তু কাউকে ঘৃনা করলে তাকে কোনোদিন ভালোবাসা যায় না। ঘৃনা মূলত ভালোবাসার পরের ধাপ।

হঠাৎ করে দু’জনেই নীরব হয়ে যায়। চারদিকের নীরবতাকে সাক্ষী রেখে গোপনে দু’জনেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।

___________________________________________________________

রাত যত গভীর হচ্ছে ত্রয়ীর মনের প্রশ্নগুলো ততই আঘাত হানছে। কী ঘটেছিলো ইনানের জীবনে? কী এমন অতীত?

এসব প্রশ্ন ত্রয়ীকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। ত্রয়ী কিছুক্ষন পায়চারি করে জানালার পাশে দাঁড়ালো। জানালার গ্লাসটা খুলতেই মৃদু হাওয়া এসে ত্রয়ীর চুলগুলোকে ছুঁয়ে গেলো। চাঁদনি রাত
আকাশ ফকফকা। চাঁদের পাশে তারাগুলো মিটিমিটি জ্বলছে। ত্রয়ীর কালো মেঘে ছেয়ে যাওয়া মনে চাঁদের আলোর প্রভাব পড়লো না তেমন।

ইনানের জীবনের পুরোনো স্মৃতি গুলো আজ যেনো মুহুর্তেই সতেজ হয়ে উঠলো। এ স্মৃতি যে খুব বিষাদময়। যা তলোয়ারের চাইতেও বেশি ধারালো। যার আঘাতের চিহ্ন কেউ দেখতে পায়না। হৃদয়ের রক্তক্ষরণ কারো চোখে পড়েনা।

অতীতের রেখে যাওয়া স্মৃতি গুলো ঠিকই থেকে যায়। রেখে যায় পুরোনো কিছু আবেগ। অতীতে হারিয়ে যাওয়া মানুষের রেশ টুকু থেকে যায় আজীবন। যার যন্ত্রনা বয়ে যেতে হয় বছরের পর বছর।

আজকের রাত নির্ঘুমে কাটবে ইনানের তা নিশ্চিত। কিন্তু তার সূত্র ধরে অন্য একটা মানুষেরও আজ নির্ঘুম রাত কাটাতে হবে।
ভালোবাসা বড়ই অদ্ভুত!
ভালোবাসা পারে কাউকে দিনে রাতে অনুভব করে তার কষ্ট গুলোকে ভাগ করে নিতে।

___________________________________________________________

সারারাত জেগে থাকার পর ভোরে দু’চোখ লেগে আসে ত্রয়ীর। ঘুম থেকে উঠে বেলা করে। ফ্রেশ হয়ে নিচে আসে। কফি হাতে নিয়ে সোফায় বসতেই ইনান নিচে আসে। দেখে মনে হচ্ছে মাত্রই উঠেছে। কিছুক্ষন আড্ডা চলে সবার মাঝে।

ইনান কফি হাতে নিয়ে উপরে চলে যায়। যাওয়ার আগে ত্রয়ীকে বলে তার রুমে যেতে।
ত্রয়ী ইনানের পিছু পিছু যায়। রাবেয়া হক এই দৃশ্য দেখে কিছু একটা ভেবে নেয়।

ইয়াদ ও ইফতিহাকে উদ্দেশ্য করে উনি বলেন,
– মেয়েটা খুব বেশি ছোটো, নাহলে ঘরের লক্ষ্মী করতে পারতাম।

রাবেয়ার কথা শুনে মোস্তফা হকের হাত থেকে কফি পড়ে যায়। নিমিষেই হক বাড়ি কেঁপে উঠে। রাবেয়া হকের বুকের ভেতর ধক করে উঠে। তিনি মোস্তফা হকের দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকান।

ইনান ব্যালকনিতে এস দাঁড়ায়। ত্রয়ী তার পিছনে। বিষন্ন গলায় বলে,
– কাল রাতে ঘুম হয়নি?
ইনান পিছু ঘুরে। কপালের চুল গুলো হাত দিয়ে সরিয়ে বলে,
– এমন অনেক রাতই আমার নির্ঘুমে কাটে।

হঠাৎ করেই যেনো ত্রয়ীর বুকে ইনানের জন্য চাপা কষ্ট অনুভব হয়। চোখে জল আসে। তা দেখে ইনান বলে,
– ধুর, বোকা মেয়ে! তুমি কাঁদছো কেন?
– জানিনা।

ইনান ঠোঁট কামড়ে হেসে বলে,
– আচ্ছা বেশ, জানতে হবেনা। আজ বিকেলে রেডি থেকো আমরা বের হবো।
ত্রয়ীর ছলছল করা চোখ দু’টো থেকে জল আলতো ভাবে চিবুক বেয়ে পড়ে। আপন মনে বলে,

“পুরুষদের হয়তো এটাই বিশেষ গুণ, ভেতরে কাঁচের মতো ভেঙে চুরমার হয়ে গেলেও বাইরে তারা কঠিন। খুব কঠিন!”
.

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here