#বেখেয়ালি_মনে
#লেখনীতে- Ifra Chowdhury
পর্ব-৩৫
.
.
অতীত!
তিশানের বিয়ের পর ইনানকে সিলেট যেতে হয় কিছুদিনের জন্য। সম্পত্তি নিয়ে কিছু একটা সমস্যা চলছে। ইনান আর মোস্তফা হক দু’জনের চোখে মুখে চিন্তার স্পষ্ট ছাপ!
ইনান ব্যাগ গোছাচ্ছে। ত্রয়ী তার সামনে মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছে। ইনান আড়চোখে তাকিয়ে ত্রয়ীর বাচ্চামি দেখে মুচকি মুচকি হাসছে।
তার ব্যাগ গোছানো শেষ হলে ত্রয়ীর কাঁধে হাত রেখে ইনান বলল,
– খুব বেশিদিন থাকবো না তো। ঝামেলাটা মিটিয়েই চলে আসবো।
ত্রয়ী ছোটো করে জবাব দিলো,
– ওহ!
– বোকাপাখি প্লিজ, তুমি এভাবে মন খারাপ করে থেকো না। আমার ভালো লাগে না তোমাকে এভাবে দেখতে।
কথাটা বলে ইনান ত্রয়ীর ডান হাত তার বুকের বা’পাশে নিয়ে রাখে। তারপর আবার বলল,
– দেখো তুমি, তোমার ঐ মেঘে ঢাকা কালো মুখপানের দিকে চেয়ে আমার বুক কেমন আনচান আনচান করছে।
ইনানের কাব্যিক কথা শুনে ত্রয়ী মুহুর্তেই লজ্জা পেয়ে যায়। মুখে তার মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠে। ইনানের বুক থেকে তাড়াতাড়ি করে হাত সরিয়ে এনে দু’কদম পিছিয়ে যায় সে।
ইনান অপলকে তা দেখছে। তবে সে দেখা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। ইনানকে তার কিছুক্ষণ পরেই বেরিয়ে যেতে হয় সিলেটের উদ্দেশ্যে।
ইনানকে ছাড়া ত্রয়ীর এক মুহুর্ত কাটতেই বেশ কষ্ট হচ্ছে। প্রিয়জন কাছে না থাকার যন্ত্রণা বুঝি এতোটা তীব্র হয়?
রাতে বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতেই ত্রয়ীর রাত কাটে। রাত-দুপুরে ইনানের জন্য বিছানা ছেড়ে উঠে ব্যালকনিতে গিয়ে অপেক্ষা করে। এই বুঝি ইনান এক্ষুনি গেইট দিয়ে ঢুকবে আর ব্যালকনির দিকে তাকিয়ে ইশারায় বলবে,
‘আমি এসে গেছি বোকাপাখি!’
এমন আশাতেই ত্রয়ী রাত দিন পার করছে।
রাত তিনটা নাগাদ ত্রয়ীর ফোনটা বেজে উঠে। ত্রয়ী হুড়মুড় করে শোয়া থেকে উঠে বসে। ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে একটা প্রসন্ন হাসি দেয়। রিসিভ করে নিঃশব্দে কাটিয়ে দেয় কয়েক মিনিট। ওপাশ থেকে কেউ একজনের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনে ত্রয়ী হৃদপিন্ড তরঙ্গের ন্যায় স্পন্দিত হতে থাকে।
ক্ষণকাল বাদে ওপাশ থেকে সেই মধুর পুরুষালী কন্ঠ থেকে ভেসে আসে একটি নাম,
– বোকাপাখি!
রাতের নিঃস্তব্ধতার সাথে সাথে ইনানের কন্ঠে ‘বোকাপাখি’ ডাকটা শুনে ত্রয়ীর পুরো শরীরে শিহরণ দিয়ে উঠে। শীতল কোনো কিছু রক্ত মিশে যায়।
ত্রয়ী কাঁপা কন্ঠে জবাব দেয়,
– বলুন!
– ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি!
এই তিন ভালোবাসি।
ভালোবাসি শব্দটা শুনে ত্রয়ী মিইয়ে যায়। কি ভয়ংকর শোনা যায় কথাটা ইনানের মুখে।
ত্রয়ী প্রত্যুত্তরে শুধু ‘হু’ জবাব দেয়। ত্রয়ীর সাধ্যি নেই এই ভয়ংকর শব্দটা উচ্চারণ করার।
ইনান তখন হেসে বলে,
– লজ্জাবতী লাজুকলতাটা আমার। ভালোবেসে সারা জনম আগলে রাখবো তোমায়।
ইনানের কথায় ত্রয়ীও হাসে।
_______________________________________________________
ইফতিহা স্কুল থেকে ফিরে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। আজ নিশান তাকে এখানে দাঁড়াতে বলেছে। ইফতিহা ঘামছে। কেন ঘামছে সে নিজেও জানে না। সে কি ভয় পাচ্ছে? এমন প্রশ্ন মাথায় আসতেই ইফতিহা ঢোক গিলে।
ততক্ষনে নিশান সাঁই করে উড়ে চলে এসেছে তার সামনে। মোটরসাইকেল সাইডে রেখে ইফতিহার পাশে এসে দাঁড়ায় সে। কড়া গলায় বলল,
– এই মেয়ে, এতো ঘামছো কেন?
নিশানের মুখে মেয়ে শব্দটা শুনে ইফতিহা চটে যায়। আশ্চর্যজনক ভাবে, যে মেয়ে এতোক্ষণ ঘামছিলো সে চোখ পাকিয়ে বলল,
– আমার একটা নাম আছে। আশা করছি, এর পরেরবার থেকে আপনি আমায় ‘মেয়ে’ বলে সম্বোধন না করে নাম বলবেন।
ইফতিহার রাগী রাগী মুখ দেখে নিশান খিলখিল করে হাসতে থাকে। তা দেখে ইফতিহা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে।
হাসি থামিয়ে নিশান বলল,
– শুনো, আমি সরাসরি কথা বলতে পছন্দ করি। তাই তোমাকে সরাসরিই কথাটা বলছি, তোমার প্রতি আমার দূর্বলতা তৈরি হচ্ছে ধীরে ধীরে। আর আমি যতটুকু ধারনা, তোমারও আমার প্রতি দূর্বলতা আছে।
নিশানের কথাগুলো শুনে ইফতিহা হা হয়ে যায়। পুরুষ জাতটাই কি নির্লজ্জ আর বেহায়া হয়? যদি, তা না হয় তাহলে এই লোকটা অকপটে এমন একটা কথা বলে দিতে পারলো কীভাবে? সামান্য গলা পর্যন্ত কাঁপলো না তার?
এমন প্রশ্নই মনে মনে আওড়ায় ইফতিহা।
নিশান হাতের দু’আঙ্গুল দিয়ে তুরি মেরে ইফতিহার ভাবনার ছেদ ঘটায়। ইফতিহা আমতা আমতা করে বলল,
– আ-আ-আমার কিসের দূর্বলতা? আমার ওসব কিছু নেই।
এ কথা বলেই ইফতিহা দৌড়ে পালায় সেখান থেকে। নিশান পিছু ডাকে তবুও ইফতিহা থামে না। নিশান কিছু না বুঝেই বেকুবের সেখানে ঠায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে।
______________________________________________________
রাবেয়া হক চিন্তায় চিন্তায় কেমন মিইয়ে গেছেন। ইনান আর মোস্তফা হক সিলেট গিয়েছেন আজ প্রায় পনেরো দিন। অথচ, সেখানের ঝামেলা এখনও শেষ হচ্ছেনা। বরং থানায় কেস হয়েছে। এসব চিন্তায় রাবেয়া হক অস্থির হয়ে উঠেছেন। ইয়াদের ভার্সিটিতে সেমিস্টার ফাইনাল এক্সাম চলছে তাই তিনি এই মুহুর্তে ইয়াদ আর ইফতিহাকে একা ফেলে সিলেট যেতে পারছেন না।
মাকে এতো চিন্তিত দেখে ইয়াদ বলেই ফেললো,
– আম্মু, তুমি না হয় সিলেট চলে যাও। আমি আর ইফতিহা এদিকটা সামলে নিবো।
রাবেয়া হক উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,
– নারে বাপজান তোর পরীক্ষা শেষ না হওয়া অবধি আমি সিলেট যাবো না। আর কিছুদিন পর ইফতিহারও পরীক্ষা শুরু হয়ে যাবে। এমন সময় আমি তোদের ছেড়ে সেখানে গেলেও নিশ্চিন্ত থাকতে পারবো না। তোর আব্বু আর ইনান সেদিকটা ঠিক সামলে নিবে। এই ভরসা আছে আমার ওদের উপর।
ইয়াদ মায়ের কথার পিঠে আর কোনো কথা বলতে পারেনা। চুপচাপ মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। এমন সময় ইফতিহা দৌড়ে বাসায় আসে।
তাকে দেখে রাবেয়া হক বলল,
– কী ব্যাপার আজ তোমার বাসায় ফিরতে এতো দেরি হলো কেন?
মায়ের প্রশ্ন শুনে ইফতিহা থতমত খেয়ে যায়। টেবিলের উপর রাখা পানির গ্লাস হাত নিয়ে ঢকঢক করে এক নিঃশ্বাসে তা শেষ করে নেয়। রাবেয়া হক এখনও ইফতিহার দিকে তাকিয়ে আছেন। মায়ের চোখে চোখ পড়তেই ইফতিহা গোপনে ঢোক গিলে।
শীতল কন্ঠে বলল,
– একটা ফ্রেন্ডের সাথে আজ একটু লাইব্রেরিতে গিয়েছিলাম আম্মু। তাই দেরি হয়ে গেলো।
– তাহলে তুমি এতো হাঁপাচ্ছো কেন?
কন্ঠে উৎকন্ঠা নিয়ে রাবেয়া হক প্রশ্নটা ছুড়ে দিলেন ইফতিহার দিকে।
– রাস্তায় একটা কুকুর তাড়া করছিলো আম্মু। এ জন্যই দৌড়ে বাসায় এসেছে। আর তাই…
মেয়ের কথা শেষ করতে না দিয়েই রাবেয়া হক বলল,
– ঠিক আছে যাও। ফ্রেশ হয়ে খেতে এসো।
ইফতিহা আর কথা না বাড়িয়ে বাধ্য মেয়ের মতো নিজের রুমের দিকে পা বাঁড়ায়। রাবেয়া হক ইফতিহার চলে যাওয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন।
ইফতিহার কথাগুলো শুনে তিনি সন্তুষ্ট হতে পারছেন না। কিছুদিন ধরেই ইফতিহা কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা করছে তার কাছ থেকে। কিন্তু সেটা কী? এমন প্রশ্ন খুড়ে খুড়ে খাচ্ছে রাবেয়া হকের ভেতরটা।
মেয়েদের পনেরো থেকে কুড়ি বছর বয়সটা প্রচুর খারাপ। এ সময় তারা আবেগে ভেসে চলে। আর খুব বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে ভুল ভুল কাজ করে বসে। নিজের অজান্তেই রাবেয়ার হকের বুক চিড়ে সুদীর্ঘ এক নিঃশ্বাস বেরিয়ে যায়।
_______________________________________________________
ত্রয়ী ব্যস্ত পায়ে হিমার কাছে ছুটে আসে। এই একটা মানুষ যার কাছে অকপটে ত্রয়ী ইনানের কথা শেয়ার করতে পারে। হিমা প্রথমে যখন ত্রয়ী আর ইনানের সম্পর্ক জেনেছিলো, ত্রয়ী তখন খুব ভয়ে ভয়ে থাকতো। যদি, হিমা তার বাবার কাছে ওদের সম্পর্কের কথা বলে দেয়! এই ভয়টা পেতো ত্রয়ী। কিন্তু দিন যত যায় ত্রয়ী বুঝতে হিমা সত্যিই কাউকে কিছু বলবে না। তাই সে এখন নির্দ্বিধায় হিমাকে ইনানের কথা বলতে পারে।
ত্রয়ীকে এমন অস্থির দেখে হিমা জিজ্ঞেস করে,
– কিরে বনু কী হয়েছে?
ত্রয়ী কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
– হিমাপ্পা, তিনদিন থেকে উনার সাথে কোনোরকম যোগাযোগ করতে পারছি না। তোমার সাথে উনার কি কোনো কথা হয়েছে?
হিমা ভ্রু কুঁচকে বলল,
– উনি কে? ইনান?
ত্রয়ী মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দেয়। হিমা কিছুটা হেসে বলল,
– না তো, এর মধ্যে কোনো যোগাযোগ হয়নি ইনানের সাথে আমার। ও সিলেট যাওয়ার পর শুধু একদিন ওর সাথে আমার কথা হয়েছিলো।
ত্রয়ী চিন্তিত গলায় বলল,
– ওহ।
– কিন্তু তুই যোগাযোগ করতে পারছিস না কেন? ফোন কর্ তাহলেই তো হয়।
– তুমি কি ভাবছো আমি ফোন দেই নি? উনার ফোন তিনদিন থেকে সুইচড অফ। কোনো কিছুতে একটিভ নেই উনি। আমার এখন চিন্তায় চিন্তায় নিজেকে পাগল পাগল মনে হচ্ছে।
হিমা ত্রয়ীকে নিজের কাছে টেনে এনে বলল,
– এতো চিন্তা করিস না। ইনান হয়তো কোনো কাজে আটকে গেছে, তাই ফোন বন্ধ রেখেছে। তুই শান্ত হ। দেখবি ফ্রি হয়ে ইনান নিজেই ফোন করবে।
ত্রয়ীর আজ স্বান্ত্বনার বাণী শুনতে একদম ভালো লাগছে না। তাই হিমার কাছ থেকে উঠে গটগট পায়ে বেরিয়ে যায় ছাদের উদ্দেশ্যে। পিছন থেকে তনয়া ডাক দেয় তাকে। মায়ের ডাকে ছাদে না গিয়ে সোজা মায়ের কাছে চলে যায় সে।
ত্রয়ীকে দেখেই তনয়া বলল,
– কী হয়েছে তোর?
মায়ের কথাশুনে ত্রয়ী নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে তাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। আকস্মিক মেয়ের কান্না দেখে তনয়ার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠে।
.
.
(চলবে…)