বেখেয়ালি মনে পর্ব-৩৬

0
460

#বেখেয়ালি_মনে
#লেখনীতে- Ifra Chowdhury
পর্ব-৩৬
.
.
মেয়েকে হুট করে হাউমাউ কাঁদতে দেখে তনয়া বড্ড বিচলিত হয়ে পড়েন। উনি ত্রয়ীকে কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে রেখে ক্রমাগত জিজ্ঞেস করতে থাকেন যে কী হয়েছে। ওর এভাবে কাঁদার কারণ কী?
কিন্তু ত্রয়ী কোনো জবাব দেয় না। ও শুধু কেঁদেই চলেছে। ইনানকে নিয়ে চিন্তায় চিন্তায় ওর মন এমনিতেই ভেতর থেকে কেঁদে কেঁদে উঠছিলো। আর এখন মায়ের একটু মমতা মাখা কথা শুনতেই ওর লুকোনো সব কান্না কেমন যেন অজান্তেই বেরিয়ে এলো। ও নিজেও ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারে নি।

ত্রয়ী একটু পর ধীরে ধীরে কান্না থামায়। মুখ তুলে মায়ের দিকে তাকায়৷ কিন্তু পরক্ষণেই ওর মনে একটু ভয় ঢুকে পড়ে। এখন ও মাকে কী বলবে? কেন কেঁদে দিলো এভাবে? আসল কথা তো বলতে পারবে না। তবে কী বলে ও পার পাবে?
হঠাৎ করেই ত্রয়ীর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায়। নিশানের কথা মনে আসে ওর। ভাইয়াকে ফাঁসিয়ে দেওয়া যায়! ও অন্তত বুঝবে কোনো না কোনো দরকারেই ত্রয়ী একটা মিথ্যে বাহানা দিয়েছে।

মিসেস তনয়ার প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে একটু দম নেয় ত্রয়ী। তারপর আটকে আটকে যাওয়া কান্নাকন্ঠে বলে,
-নি-নিশান ভাইয়া.. আ-আমায় খু-উ-ব বকেছে মা।
-কথাটা বলে আবারো একটু কাঁদে ত্রয়ী। তনয়া এটা শুনেই চোখ রাঙিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-কী বলিস? নিশান বকেছে তোকে? কেন?

ত্রয়ী কোনো জবাব দেয় না। ও বলার জন্য মনে মনে উত্তর খুজছে। এদিকে চোখ দিয়ে অশ্রুও ঝরছে। তনয়া এবার একটু নরম চাহনিতে ত্রয়ীর দিকে তাকিয়ে ওর মাথায় একটু হাত বুলায়,
-কী হয়েছে মা? বল্ আমায়? দেখিস নিশানকে খুব বকে দেবো আমি। তার আগে বল্ তুই কী করেছিস এমন? যে ও তোকে এমন বকুনি দিয়েছে?
-আমি ভুলে ভুলে ভাইয়ার পিসির একটা প্রোগ্রাম আনইনস্টল করে দিয়েছিলাম মা। ওটা নাকি ভাইয়ার খুব দরকারি প্রোগ্রাম ছিলো। কিসব ফাইলও সেইভ ছিলো নাকি। তো আমি কীভাবে ডিলিট করলাম? এতো কেয়ারলেস কেমনে হলাম? এই নিয়ে ভাইয়া আমায় খুব বকা দিয়েছে মা। খুব বকা দিয়েছে।

কথাটা শেষ করেই ত্রয়ী আবারো ফুপিয়ে কেঁদে উঠে। তনয়া মেয়ের এহেন কান্না দেখে বুকে টেনে নেয়। আর তখনি এক চিৎকারে নিশানকে ডাকে। কিছুক্ষণের মধ্যে নিশানও দ্রুত এসে মায়ের সামনে উপস্থিত হয়। ও এসে দেখে ত্রয়ী কাঁদছে ওভাবে। কী হয়েছে বুঝে উঠতে না পেরে নিশান ওর মাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে, ঠিক তখনি মিসেস তনয়াই ওকে উলটো প্রশ্ন করে,
-কী রে, তুই নাকি ত্রয়ীকে বকেছিস খুব? তোর কোন প্রোগ্রাম না ফাইল নাকি ডিলিট করে দিয়েছে? সেজন্য ওর উপর এতো চেচামেচি করবি?

নিশান মায়ের কথা শুনে কিছুক্ষণের জন্য থ মেরে যায়। ও এসবের আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছে। কিসের প্রোগ্রাম, কিসের ফাইল! আর কিসের ডিলিট! আর ত্রয়ীকে ও বকলোই বা কখন? বেচারার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। ও বেকুবের মতো একবার মায়ের দিকে, তারপর ত্রয়ীর দিকে তাকায়।
ত্রয়ীর চোখে চোখ পড়তেই দেখে ও নিশানকে কিছু একটা ইশারা করতে চাইছে। ওর চোখে স্পষ্ট একটা অনুনয়ের ছাপ দেখতে পায় নিশান। হয়তো ত্রয়ী চাইছে, নিশান এই কথার সাথে তাল মেলাক। হ্যাঁ সম্ভবত ইশারা ইঙ্গিতে এটাই বুঝাতে চাচ্ছে ত্রয়ী।

নিশান আর কোনো কথা না বাড়িয়ে মাথা নিচু করে মাফ চায় মায়ের কাছে। আর বলে,
-আসলে আম্মু, ওটা আমার খুব দরকারি জিনিস ছিলো। আর তখন মাথাটাও একটু গরম ছিলো। তাই ও ডিলিট করে ফেলেছে শুনেই মেজাজটা আর আটকাতে পারি নি।
-হ্যাঁ বুঝেছি তো। খুব লায়েক হয়ে গেছো না তোমরা? সামান্য বিষয় নিয়েও ছোট বোনের উপর বা অন্য কারোর উপর চেচামেচি করবা। ভালোই তো!
-দুঃখিত আম্মু! ভুল হয়ে গেছে সত্যিই। আর হবে না।
-ঠিক আছে যা এখন।

নিশান মাথা নাড়িয়ে চলে যায় ওখান থেকে। তবে যাবার আগে একটাবার ত্রয়ীর দিকে তাকায়, ত্রয়ী নিরবে ওর দিকে তাকিয়ে একটা স্বস্তির পলক ফেলে শুকরিয়া জানায়। আর একটা দীর্ঘশ্বাসও ছাড়ে।
__________________________________________________________
আজ বিকেলে কাউকে কিছু না জানিয়েই মোস্তফা হক আর ইনান সিলেট থেকে ঢাকায় ফিরে আসেন। তবে ওদের জায়গা নিয়ে ঝামেলাটা এখনো শেষ হয়নি। আপাতত ভেজালটা একটু স্থিতিশীলই আছে। তো ওটার কিছু দরকারেই মূলত বাপ-ছেলের আবার বাসায় ফিরতি আসা।

ছাদে একা একা দাঁড়িয়েছিলো ত্রয়ী। বেখেয়ালি মনে ইনানের কথাই ভাবছিলো। আচমকাই পেছন থেকে ইনান ওর দুহাত দিয়ে ত্রয়ীর চোখ ঢেকে নেয়। মুহুর্তেই ত্রয়ীর সমস্ত শরীরে কাটা দিয়ে উঠে। ওর এতক্ষণের শান্ত মনটা সাথে সাথেই চঞ্চল হয়ে যায়। নেচে উঠে ফুরুৎ করে। ও খুব দ্রুত ওর চোখ ঢেকে দেওয়া হাত দুটো সরিয়ে পেছন ঘুরে তাকায়।

ইনানকে দেখেই ওর চোখেমুখে খুশির ঝিলিক ছড়িয়ে পড়ে। ওর যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না, ইনান যে ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এভাবে হুট করে ওকে কিছু না বলেই চলে এসেছে? কেন? চমকে দেওয়ার জন্য? কে জানে!

কিন্তু খুশি হলেও ত্রয়ীর মুখটা চট করেই আবার ফ্যাকাশে হয়ে যায়। খুব গম্ভীর ছাপ চেহারায়। ইনানকে নিয়ে কতো চিন্তায় ছিলো মেয়েটা! অথচ ইনানের কি সেদিকে কোনো খেয়ালই নেই? আশ্চর্য ব্যাপার!

ত্রয়ীর মনের মধ্যে খুব অভিমান জমে আসে। এতো দিনের চেপে রাখা অপ্রকাশিত রাগ-অভিমান গুলো ধীরে ধীরে ত্রয়ীর কিশোরী মনে জমাট বাধতে থাকে। কেন জানি খুব কষ্ট হচ্ছে ওর! ভালোবাসা এমন কেন? সুখের সময় হউক বা দুঃখের, অজান্তেই চোখ দুটো ভিজে ভিজে হয়ে আসতে চায়।

ইনান ত্রয়ীর এমন কান্ডে কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। এমন করছে কেন ত্রয়ী? রাগ করেছে? নাকি মান করেছে? হ্যাঁ অভিমানই হয়তো! ইনান বুঝতে পারে তার বোকাপাখির মনের অবস্থা। ও ছাদের রেলিংয়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ত্রয়ীর দিকে তাকায়,
-এই বোকাপাখি, এভাবে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছো কেন? খুশি হও নি আমায় দেখে?
ত্রয়ীর রাগটা আরেকটু বেড়ে যায়। কী আজব! যে মানুষটার জন্য এতো প্রতীক্ষা করছিলো, একটা কল মেসেজের রিপ্লাই না পেয়েই অস্থির হয়ে উঠছিলো, যার কন্ঠটা একটু শোনার জন্য, যাকে একপলক দেখার জন্য ওর মনটা এতো আঁকুপাঁকু করছিলো, সেই মানুষটার আগমনেই নাকি ত্রয়ী খুশি হবে না! ভাবা যায় এটা?

ত্রয়ীর কান্না চলে আসছে। চরম অভিমান নিয়েই বলে ফেলে,
-আপনি খুব খারাপ! খুব! খুব বেশি খারাপ। আপনাকে এতো কল করেছি, এত্তো মেসেজ করেছি, কিন্তু আপনি একটারও রিপ্লাই করেন নি! কল রিসিভ তো দূর, পরেও একটাবার ব্যাক করেন নি! কী সমস্যা হ্যাঁ? কী হয়েছিলো? যে আপনি আমার সাথে কথা বলার জন্য দু মিনিট সময়ও বের করতে পারেন নি!
ইনান কিছুক্ষণ নিরবে হা হয়ে তাকিয়ে থাকে। ত্রয়ী যে আজ বড্ড অভিমানী হয়ে আছে, বেশ বুঝতে পারছে সে। আর অবশ্য অভিমান করাটাও অস্বাভাবিক নয়৷ পয়েন্ট আছে!

ইনান ত্রয়ীকে বোঝানোর চেষ্টা করে,
-অলে বোকাপাখি আমার! আমি দুঃখিত, দুঃখিত, দুঃখিত, দুঃখিত, দুঃখিত, খুব বেশি দুঃখিত! কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি ইচ্ছে করে এমন করিনি তো। আমার ফোনে চার্জ ছিলো না পাখি। আর যে জায়গায় থেকেছিলাম, সেখানে নেটওয়ার্কেরও যা বাজে অবস্থা! তবে আমি বাজারের একটা বুথ থেকে তোমায় অনেক বার কল করেছিলাম দেখে নিও, কিন্তু তুমি হয়তো আননোউন নাম্বার বলে রিসিভ করো নি। তোমার মা রিসিভ করেছিলেন পরে, কয়েকবারই উনি রিসিভ করলেন, তাই পরে আর কল দিতে পারি নি। আর যা ঝামেলায় পড়েছি, একটু দম নেওয়ারও সময় পাই নি বিশ্বাস করো।
ত্রয়ী মনে করার চেষ্টা করে, আসলেই তো অচেনা একটা নাম্বার থেকে খুব কল আসছিলো, কিন্তু ও নিজে রিসিভ করে নি। ওর মাকে দেয় রিসিভ করার জন্য। অচেনা নাম্বার থেকে কল আসলে ত্রয়ী এমনই করে। কারণ এর আগেও অনেকবার অচেনা নাম্বার থেকে ত্রয়ীকে কিছু বদমাশ ছেলে খুব ডিস্টার্ব করেছে। তাই এরপর থেকে ওর মাকে দিয়ে আগে কথা বলায়, তখন চেনা কেউ হলে ওর মা নিজেই ত্রয়ীকে দিয়ে দেয়।

ইশ! তাহলে এইজন্যই ও ইনানের সাথে কথা বলতে পারেনি! ধ্যাৎ নিজের উপরই নিজের রাগ হচ্ছে ওর। কিন্তু ইনান দম পাবে না কেন? দু সেকেন্ডের জন্য নিজের নাম্বার থেকে কোনোভাবে কল দেওয়া যেতো না? তাহলেই তো হতো! আবার আজকেও না জানিয়েই চলে এসেছে! একটা বার খবর দিলে কী এমন হয়ে যেতো?

ত্রয়ী অভিমানী কন্ঠে ইনানকে বলে,
-আপনি জানেন, আমার কতো টেনশন হচ্ছিলো! কতো চিন্তায় পড়েছিলাম! আপনার সাথে একটু যোগাযোগ করার জন্য কতো অস্থির অস্থির লাগছিলো! আর আপনার তা নিয়ে কোনো হেলদোলই নেই।
ইনান একটু শান্তভাবে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
-আমার কোনো হেলদোল নেই? তাই মনে হয় তোমার? তোমায় নিয়ে আমিও কতো চিন্তায় থাকি, বুঝো না তুমি? তোমার সাথে কথা বলার জন্য আমিও কতো ছটফট করছিলাম, জানো তুমি?
ত্রয়ী কোনো কথা বলছে না। ও চুপচাপ হাত ভাঁজ করে অন্য দিক মুখ করে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। ও জানে, ইনানও ওকে কতো মিস করছিলো। ইনানও যে খুব বেশিই ভাবে ওকে নিয়ে, হয়তো ইনানের মতো করে ত্রয়ী নিজেও এতোটা ভালোবাসতে পারবে না, কিন্তু তাও সে অভিমান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

খুব ভালো লাগছে ত্রয়ীর। এভাবে কোনো কারণ ছাড়াই ভালোবাসার মানুষটার সাথে অভিমান করতে! মানুষটাকে আরো বেশি নিজের মানুষ বলে অনুভব হচ্ছে। যার সাথে যখন ইচ্ছে এভাবে অভিমান করে থাকা যাবে। যা ইচ্ছে, তা-ই করা যাবে! একদম নিজের মতো করেই অনেক অনেক বেশি ভালোবাসা যাবে।

এদিকে ইনান চেষ্টা করেই যাচ্ছে ত্রয়ীর অভিমান ভাঙানোর। কান ধরছে, নাক ধরছে। উঠ বস করছে। কিন্তু তাতেও কাজ হচ্ছে না।
ইনান কপাল কুচকে ত্রয়ীকে বলে,
-এই, আমার সব তো তুমিই বোকাপাখি। আমি তোমার চিন্তা করবো না তো আর কার চিন্তা করবো? হুম? আমি নিজের আগেও তোমার কথা বেশি ভাবি তো। আমার সব ভাবনার শুরু তুমি বোকাপাখি। বুঝো না? আমার শুরু থেকে শেষ জুড়ে এখন শুধু তুমি আছো। খুব ভালোবাসি তো!
এবারও কোনো সাড়া না পেয়ে ইনান ত্রয়ীর একটা দুর্বলতার জিনিসের সহায়তা নিতে চায়। যা শোনা বা গাওয়া মাত্রই ত্রয়ীর মনটা ফুরফুরে হয়ে যায়।
হ্যাঁ গান!
ইনান চোখ বুজে একটা শ্বাস টেনে গান ধরে,

“তুমি জানো না..
তুমি, জানো না রে প্রিয়,
তুমি মোর জীবনের সাধনা।
তোমায় প্রথম যেদিন দেখেছি,
মনে আপন মেনেছি,
তুমি বন্ধু আমার বেদন বোঝো না..”

.
.
চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here