#বেখেয়ালি_মনে
#লেখনীতে- Ifra Chowdhury
পর্ব-৪১
.
.
ত্রয়ী কিছুক্ষণ আগেই বাসায় ফিরেছে। বাসায় সম্ভবত ওর রিসা ভাবী ছাড়া আর কেউ নেই৷ বাকিরা এক দাওয়াতে গিয়েছে। কিছু দরকারে রিসার কয়েকজন বান্ধবী এসেছিলো, সেজন্যই আর রিসার যাওয়া হয় নি। আর ত্রয়ী ইচ্ছে করেই যায় নি। বাসার ডুপ্লিকেট চাবি ওর কাছে থাকায় এখন নিঃশব্দেই প্রবেশ করতে পেরেছে। বাসায় ঢুকেই ও তিশান আর রিসার রুমের দিকে যায়। দরজাটা ভেজানো আছে। ত্রয়ী ধীরে ধীরে দরজাটা ঠেলে ভেতরে তাকায়। যা ভেবেছিলো, তা-ই। রিসা ঘুমোচ্ছে।
যাক! ত্রয়ীর ভাবনা তাহলে সার্থক হয়েছে। রিসা এই সময় ঘুমে থাকতে পারে ভেবেই ত্রয়ী আর কলিং বেল না বাজিয়ে নিজে নিজেই ঢুকে নিয়েছে। ত্রয়ী কিছু একটা ভেবে মৃদু হাসে। তারপর দরজাটা নিঃশব্দে লাগিয়ে রেখে ও ওর রুমের দিকে পা বাড়ায়। হঠাৎ ও যেতে যেতে একটা পুরুষালি কন্ঠ শুনে ও থমকে দাঁড়ায়। কিছুটা ফিসফিস করে কেউ চাপাগলায় কথা বলছে মনে হচ্ছে। কিন্তু কে? ওদের বাসায় তো এখন ত্রয়ী আর রিসা ছাড়া কেউই নেই। তবে? কার কন্ঠ শুনলো ত্রয়ী?
বেশ কৌতুহল আর সাহসের সাথে ত্রয়ী ধীরে কন্ঠটা অনুসরণ করতে করতে এগিয়ে যায়। কিচেন থেকে আসছে স্বরটা। ত্রয়ী পা টিপে টিপে সেখানেই উপস্থিত হয়। যেতেই দেখে নিশান কারোর সাথে ওভাবে ফোনে কথা বলছে। নিশানকে দেখেই ত্রয়ী একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। আবার সেই সাথে কিছুটা ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেসও করে,
-ওহ তুমি! কিন্তু তুমি এখন বাসায় কীভাবে? তুমিও না দাওয়াতে গিয়েছিলে?
নিশান চমকে তাকায় ত্রয়ীর দিকে।
নিশান কোনো উত্তর দেওয়ার আগেই ত্রয়ী আবার জিজ্ঞেস করে,
-কখন ফিরলে? তোমাদের না সন্ধ্যার দিকে আসার কথা ছিলো। বাকিরা কোথায়?
-আমি একটু আগেই এলাম। আম্মুরা পরেই আসবে।
-তো তুমি চলে এলে কেন?
-আমি তো..
নিশান কথাটা সম্পূর্ণ করার পূর্বেই ত্রয়ীর ফোন বেজে উঠে। ত্রয়ী স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখে ওর মা কল করেছে।
ও রিসিভ করতেই উনি ওপাশ থেকে বলেন,
-ত্রয়ী, বাসায় আছিস তো তুই?
ত্রয়ী স্বাভাবিকভাবেই জবাব দেয়,
-হ্যাঁ এখন বাসায়ই আছি।
-আচ্ছা, নিশান খেয়েছে দেয়েছে তো? ও তো ঘন্টা তিনেক আগেই বাসায় চলে গেলো, ওর নাকি শরীর ভালো লাগছিলো না।
কথাটা শুনেই ত্রয়ীর খটকা লাগে। ঘন্টা তিনেক আগেই চলে এসেছে? তাহলে নিশান যে বললো একটু আগেই ফিরেছে। ও কি তাহলে মিথ্যা বললো? কিন্তু কেন?
ত্রয়ী ওর ভাবনাতে মগ্ন। ওদিক থেকে মিসেস তনয়া কোনো উত্তর না পেয়ে আবারও ডাকে ত্রয়ীকে,
-কি রে? ত্রয়ী? কী হলো? খেয়েছিস তোরা?
ত্রয়ী হুশে ফিরে না খেয়েও মিথ্যে উত্তর দেয়,
-হ্যাঁ মা খেয়েছি।
-আচ্ছা শোন্ রাখছি এখন, তোর খালা ডাকছেন।
-হুম।
ত্রয়ী ফোনটা রেখেই নিশানের দিকে আড়চোখে তাকায়। নিশান ত্রয়ীকে ওভাবে তাকাতে দেখে নিজের চোখ সরিয়ে নেয়।
ত্রয়ী নিশানকে জিজ্ঞেস করে,
-ভাইয়া তুমি নাকি অনেক আগেই ওখান থেকে চলে এসেছো? কিন্তু তুমি তো বললে একটু আগে ফিরেছো? আর তোমার শরীর খারাপ? কী হয়েছে ভাইয়া? বলো আমাকে? কোনো সমস্যা?
নিশান ত্রয়ীর প্রশ্ন শুনে কেমন যেন হকচকিয়ে উঠে। আমতা আমতা করে জবাব দেয়,
-না আসলে.. আ-আমার একটা দরকারী কাজ ছিলো, সেজন্যই বাসায় আসতে দেরি হয়ে গেলো।
-কী কাজ?
-তু-তুই বুঝবি না ত্রয়ী। বাদ দে।
কথাটা বলেই নিশান ওখান থেকে ত্রয়ী আর ওর প্রশ্নগুলোকে এড়িয়ে নিজের রুমের দিকে চলে যায়। ত্রয়ী এর কোনো মানে বুঝতে পারে না। ও অবাক হয়ে শুধু ওর ভাইয়ার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। ও ভাবে, সবাই-ই কেমন বদলে যাচ্ছে! মানুষও বদলাচ্ছে, আর সেই সাথে জীবনের মোড়গুলোও!
____________________________________________________
রাবেয়া হক ইনানের সাথে কতো গল্পগুজব করে যাচ্ছেন, সব কথাই ওর ভুলে যাওয়া বছরগুলোর ঘটনাসমূহকে ঘিরে। তিনি ওসব ঘটনাগুলো ওকে বলে বলে ওর স্মৃতিগুলো মনে করানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু উনি সম্ভবত সফল হতে পারছেন না। উনার ছেলে একটা ভিডিও গেইম নিয়েই ব্যস্ত হয়ে বসে আছে। আর কোনোদিকে ওর খেয়াল নেই। অথচ ওর মা সেই কখন থেকেই যে ওর সাথে বকবক করে যাচ্ছে, হিসেব ছাড়া!
ইফতিহা রুমে এসেই ওদের দুজনকে দেখে থমকে দাড়ায়। ইনানের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। এই পাঁচ-ছয় বছরে ওর সুস্থ সবল ভাইটার কী অবস্থা আজ! ওর মাথায় প্রায় ৫ বছর আগেকার পুরনো কথাগুলোর ভাবনা উঁকি দিয়ে উঠে। যখন ইনান বাসায় থেকে থেকেও ওর মানসিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছিলো না, বরং ক্রমাগত তা আরো বৃদ্ধি লাভ করতে থাকে, তখনি ওর সঠিক ট্রিটমেন্টের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয় এসাইলামে!
ঐ দিনগুলোর কথা মনে পড়তেই ইফতিহার শরীরে কাটা দিয়ে উঠে। ইনানকে এসাইলামে পাঠিয়ে দেওয়ার পর ইফতিহা আর ওর মা কতো কান্নাকাটি করেছিলো। ওর পুরোপুরি সুস্থতার জন্য আল্লাহর কাছে কতো যে মানত করে রেখেছে! আল্লাহ হয়তো ওদের ডাক শুনতে পেয়েছিলেন, যার জন্য প্রথম দিকে ইনানের অবস্থা একটু বেগতিক থাকলেও, ধীরে ধীরে সেটা স্বাভাবিক হতে শুরু করে। যদিও ইনানের স্মৃতিশক্তি দুর্বলই আছে, বিগত সেই কয়েক বছরের কথা এখনো সে মনে করতে পারে না। শুধু চোখের সামনে ঝাপসা ঝাপসা প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠে!
ইনানকে এতো শান্তভাবে জয়স্টিক নিয়ে গেইম খেলতে দেখে ইফতিহার মুখে হালকা একটা হাসি স্থান পায়। ওর মনের চোখে ইনানের কয়েক বছর পূর্বের উচ্ছৃঙ্খল কর্মকান্ডগুলো ফুটে উঠে। ইনান যখন শুধু পাগলের মতো চিৎকার চেচামেচি করতো আর বলতো,
“ঐ মেয়েটাকে এনে দাও! ঐ মেয়েটা.. মেয়েটা আমাকে খুব ভালোবাসে। আমিও চাই ওকে। কিন্তু.. কিন্তু ও কোথায়? আর ওর নাম কী? আমার কিচ্ছু মনে পড়ছে না কেন ইশ! ঐ তোরা কে আছিস! ওকে এনে দে না আমার কাছে? আমি মরে যাবো আল্লাহ!”
আরো কতো কতো পাগলামি! ওরা ইনানকে কতো বুঝানোর চেষ্টা করতো, কিন্তু কোনো লাভ হতো না। ইনান মেয়েটার জন্য পাগল থাকতো, কিন্তু যখনি ওকে ত্রয়ীর কথা বলা হতো, তখনি সে তেড়ে আসতো।
বলতো, ও ঐ মেয়েটার কথা বলছে না, ওকে চিনেই না ইনান; ও তো ওর পাগলির কথা বলছে। বাচ্চা পাগলি! যে ওকে ভালোবাসে, খুব ভালোবাসে!
কিন্তু ঐ মেয়েটাই যে ত্রয়ী, সেটা ইনানকে কেউই বোঝাতে পারতো না। কেউ না।
ইফতিহা ওসব ভাবতে ভাবতেই ওর চোখের কোণে পানি জমে আসে। ও আঙুল দিয়ে পানির ফোটাটা মুছে নেয়। যাই হউক, যদিও আজও ইনানের স্মৃতিগুলো মনে হয় না, তবুও এখন যে ওর ভাইয়া দিন দিন সুস্থ হচ্ছে, এটাই বড় কথা।
ইনানকে এসাইলাম থেকে ছাড় দিয়েছে বেশ কয়েক মাস হয়ে গেছে, এখন ওকে বাসায় পরিবারের সদস্যদের সাথে থাকতেই সাজেস্ট করা হয়েছে। যাতে তারাই ইনানের স্মৃতি ফেরানোর শতভাগ চেষ্টা করতে পারে।
______________________________________________________
আফতাহি ত্রয়ীর জন্য ওদের বাসার গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে। ত্রয়ীকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাবে। সারাক্ষণ ত্রয়ী বাসার মধ্যেই মনমরা হয়ে বসে থাকে, খাওয়া দাওয়া তো করেই না। শুধু মাঝেমধ্যে দায়ে পড়ে পরিবারের মানুষগুলোর সাথে টুকটাক হঠাৎ কথা বলে।
তাই ত্রয়ীকে একটু বেটার ফিল করানোর জন্য ওর মা-বাবার সাথে কথা বলে আফতাহিই ওকে একটু বাইরে ঘুরিয়ে আসার অনুমতি চায়। আফতাহি ওদের বাড়ির হবু জামাই, এখনি ত্রয়ীর ভালোর জন্য কতো কী ভাবছে! সেসব চিন্তা করে আলফাজ সাহেব আর তনয়াও কোনো আপত্তি করেনি। আর ত্রয়ীকেও জোর করে রাজী করানো হয় আফতাহির সাথে একটু এদিক ওদিক ঘুরে আসার জন্য। দরকার হলে ও যেন ওর বন্ধবান্ধবদের সাথেও দেখা করে আসে, এটাও বলা হয় ওকে।
ত্রয়ীর এসব নিয়ে কোনো হেলদোল নেই। ওর মধ্যে ঘুরাঘুরি নিয়ে কোনো ধরনের উৎসাহ কাজ করছে না, বরং প্রচন্ডরকমের বিরক্তবোধ হচ্ছে। আফতাহির সাথে থাকতে যেন পুরো দম বন্ধ লাগছে ওর। কিন্তু ওর হাত পা বাঁধা! ব্যথা সইতেও পারছে না, আবার প্রতিবাদও করতে পারছে না! শুধু প্রাণহীন পুতুলের মতো গাড়ির সিটে বসে আছে ত্রয়ী।
পাশ থেকে আফতাহি ত্রয়ীকে কতো রকমের প্রশ্ন করছে, আবার নিজ থেকেই টুকটাক কথা তুলছে, অথচ ত্রয়ী ওকে কোনো রকম পাত্তাই দিচ্ছে না। আফতাহি ব্যাপারটা বুঝেও থামছে না। একটু পরপরই কোনো না কোনোভাবে ত্রয়ীর সাথে কথা বলতে চাইছে। ও শুধু চাইছে, ত্রয়ীকে বিভিন্নভাবে ভুলিয়ে ভালিয়ে যদি ইনানের চিন্তা সরানো যায়! তাই আফতাহি ত্রয়ীকে খুশি করার জন্যই কতোরকমের প্ল্যান কষে চলেছে।
.
.
চলবে..