#বেখেয়ালি_মনে
#লেখনীতে- Ifra Chowdhury
পর্ব-৪৫
.
.
ইনানেরা ত্রয়ীর বাসার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। এমন সময়, মোস্তফা হকের ফোন বেজে উঠে। উনি ফোন রিসিভ করতেই উনার মুখের চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে যায়। আতঙ্কিত কন্ঠে কারোর সাথে ফোনে কথা বলছেন। ইনান সহ বাকিরাও এক রাশ কৌতুহল নিয়ে মোস্তফা হকের দিকে তাকিয়ে আছেন।
রাবেয়া হক উনার কথার মাঝখানেই জিজ্ঞেস করেন,
-কি গো, কী হয়েছে?
মোস্তফা হক ফোন রেখে বলেন,
-মায়ের শরীরটা ভালো না, রাবেয়া। আমাদের এখনি ফিরতে হবে। চলো শিগগির। যাওয়া যাক।
তখনি ইনান ওর বাবার হাত চেপে ধরে,
-বাবা, আমরা ত্রয়ীদের বাসায় যাবো না? আর কিছুক্ষণ মাত্র। ওর সাথে দেখা করতে এসেছি। এতো কাছে এসেও কীভাবে ফিরে যাই?
ইনানের বুকটা কাঁপছে। ওর কাজে কি তাহলে বাঁধা পড়ছে? একদিকে দাদীজান, আরেকদিকে ত্রয়ী। ও কী করবে? ওর দুজনের জন্যই বুক পুড়ছে। তবে আল্লাহ কি চাচ্ছেন না, ইনান ত্রয়ীর কাছে যাক? ও কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। ইনান ওর বাবার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
মোস্তফা হক ছেলের চেহারার দিকে অপলকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবলেন। তারপর ইনানের কাঁধে হাত রেখে বলেন,
-আচ্ছা, এতো আশা নিয়ে এসেছিস, যা তুই দেখা করে আয় ত্রয়ীর সাথে। কিন্তু আমরা এখনি ফিরে যাবো। যাওয়াটা দরকার সত্যিই। আর তুইও ত্রয়ীর সাথে দেখা হলে আজকের রাতের ট্রেনেই চলে আসবি। ঠিক আছে?
ইনানের খুশিতে চোখমুখ ঝলমল করে উঠে। ও বাবাকে জড়িয়ে ধরে জবাব দেয়,
-থ্যাংক ইউ বাবা! থ্যাংক ইউ সো মাচ! আমি ত্রয়ীর সাথে দেখা করেই চলে আসবো, পাক্কা!
মোস্তফা হক ইনানের হালকা পিঠে চাপড়ে বলেন,
-হুম! সাবধানে যাবি। সবসময় কেয়ারফুল থাকবি।
-আচ্ছা বাবা।
মোস্তফা হক আর দেরি করেন না। উনারা তখনি নিজেদের গন্তব্যে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। ইনান উনাদের বিদায় দিয়ে ত্রয়ীর সাথে দেখা করার জন্য একাকীই রওনা হয়।
_______________________________________________________
খান বাড়ির সদর দরজায় এসে ইনান হকচকিয়ে যায়। কতসুন্দর পুরো বাড়ি ডেকোরেশন করা হয়েছে। রকমারি ফুল আর আলোকসজ্জায় ঝলমল করছে চারদিক। ঠিক যেন বিয়ে বাড়ি! ইনানের ভেতরটা কামড়ে উঠে। ত্রয়ীর বিয়ে নয়তো?
ও দ্রুত গেইট দিয়ে ভেতরে ঢুকতে যায়। তখনি দেখে গেইটের উপর ইংরেজীতে বড় বড় করে লেখা, “ওয়েডিং অফ ত্রয়ী” । ইনানের এবার পুরো দম বন্ধ লাগছে। মনে হচ্ছে এখনি ও নিঃশ্বাস আটকে মারা যাবে। ওর বুঝতে আর বাকি থাকে না, আজকে ত্রয়ীর বিয়ে। না! এটা হতে পারে না। ত্রয়ী শুধু ইনানের। এ বিয়ে কখনোই হতে পারে না। এখনি আটকাতে হবে।
নিজেকে কোনোভাবে সামলে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে ইনান। বিয়ে বাড়ি হওয়া স্বত্তেও বাড়িতে শুনশান নীরবতা। ইনানের বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। তবে কি ত্রয়ী শ্বশুর বাড়ি চলে গেছে? আমি কি খুব বেশি দেরি করলে ফেললাম? মস্তিষ্কজুড়ে এমন সব প্রশ্ন। ইনান থমকে থমকে এক পা, এক পা করে এগিয়ে যাচ্ছে বাড়ির ভেতরে। ড্রইংরুমে চোখ পড়তেই ইনানের নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসে। কিছু সংখ্যক লোক সেখানে দলা পাকিয়ে দাড়িয়ে আছে। ইনান ধীরপায়ে সেদিকে এগিয়ে যায়। ভীড় ঠেলে সামনে অগ্রসর হয়। কিছু মুহুর্ত সেখানে মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে থেকে ধপাস করে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। ইনানকে দেখে সেখানে উপস্থিত সবাই চমকে উঠে। মিসেস তনয়া, তিশান, রিসা সবাই। কিন্তু আলফাজ সাহেব আর নিশান স্বাভাবিক-ই রয়েছেন। আফতাহির মধ্যেও তেমন কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি।
ত্রয়ী অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পড়ে আছে। গায়ে তার বিয়ের বেনারসি। বউ সেজে একটা মেয়ে মেঝেতে পড়ে আছে, এই দৃশ্য সচারাচর দেখা যায় না। ইনান অজ্ঞান ত্রয়ীর মাথাটা ওর কোলের মধ্যে নিয়ে নেয়। মিসেস তনয়া চোখ পাকিয়ে তাকায় তার দিকে। কিন্তু ইনানের সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। ইতোমধ্যে, ডক্টর এসে উপস্থিত হয়েছেন সেখানে। ইনান পাগলের মতো ত্রয়ীকে ডেকে চলেছে কিন্তু ত্রয়ীর জ্ঞান ফিরছে না।
ডক্টর এসে ব্লাড প্রেশার চেক করে বললেন,
– খাওয়া-দাওয়া তো একেবারেই ছেড়ে দিয়েছে। তারমধ্যে, দুশ্চিন্তা করে খুব। তাই এমন হয়েছে। আমি একটা ইনজেকশন দিচ্ছি। আধঘন্টার মধ্যে জ্ঞান ফিরে আসবে, ইনশাআল্লাহ। আপনারা কেউ এক গ্লাস গরম দুধ নিয়ে আসবেন ওর জন্য? জ্ঞান ফিরার সাথে সাথে ওকে দুধটা খাইয়ে দিবেন।
ডক্টরের কথানুযায়ী রিসা ত্রয়ীর জন্য দুধ আনতে চলে যায়। মিসেস তনয়া আড়ালে আফজাল সাহেবকে ডেকে নিয়ে যান। আফজাল সাহেব বুঝতে পারছেন তনয়া কেন ডাকছে তাকে। আর তিনি তনয়ার সব প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েই আছেন।
আলফাজ সাহেব তনয়ার কাছে আসতেই তনয়া প্রশ্ন ছুড়ে দেন তার দিকে,
– ঐ পাগল ছেলেটা আমাদের বাসায় কি করছে? তুমি তাকে দেখেও এতোটা শান্ত থাকছো কীভাবে?
আলফাজ গলা পরিষ্কার করে বললো,
– ইনান এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। গতকাল রাতেই ওর স্মৃতি ফিরে এসেছে। ও যে, এখানে আসবে তা মোস্তফা হক আমাকে ফোন করে জানিয়েছেন আজ সকালে।
তনয়া ভ্রু কুঁচকে বলল,
– এসব কথার মানে কী? ও আসবে এটা জেনেও তুমি ওকে বাসায় ঢুকতে দিলে কেন? আর কিছুক্ষণ পর ত্রয়ীর জ্ঞান ফিরলেই আফতাহির সাথে ওর বিয়ে। ইনান যদি গন্ডগোল পাকায়, তখন কী হবে?
আলফাজ সাহেব কিছুক্ষণ চুপ থেকে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
– আফতাহির সাথে ত্রয়ীর বিয়েটা হচ্ছে না। আজ যদি ত্রয়ীর বিয়ে হয়, সেটা ইনানের সাথেই হবে।
– মানে?
– মানেটা আমি তোমাকে বুঝিয়ে বলছি। সকালবেলা আফতাহি ত্রয়ীর হাতের বালা দিতে যখন এসেছিলো, ঠিক তখনই মোস্তফা হকের ফোন কলটা আসে। আমি আফতাহিকে লক্ষ্য করিনি, কিন্তু সে আমার পিছনে দাঁড়িয়ে সবটা শুনে নেয়। আমি ফোন রেখে যখন পিছন ঘুরি চমকে যায় ওকে দেখে। কপালে আমার তখন বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। মনে ভয় আফাতাহি তো সবটা শুনে ফেললো, এখন কী হবে? এমন প্রশ্ন আমার ভেতরটায় কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিলো। আমার এমন অবস্থা দেখে আফতাহি একটু মুচকি হেসে আমাকে আশ্বস্ত করে বললো,
– আঙ্কেল আপনার এতো অস্থির হওয়ার মতো কিছু হয়নি। ত্রয়ী আর ইনানের সম্পর্কের ব্যাপারে আমি সবটা জানি। কিন্তু ইনান অসুস্থ থাকায় আমি ত্রয়ীকে বিয়ে করতে চাই। এই একটা মাস আমি ত্রয়ীর মনে জায়গা পাওয়ার জন্য বহু চেষ্টা করি, তবুও আমি ব্যর্থ হই। আসলে, ভালোবাসা এমন একটা জিনিস, যা কখনো টাকা, পয়সার মাধ্যমে পাওয়া যায় না। আমিও পাইনি ত্রয়ীর ভালোবাসা। ত্রয়ীর সব ভালোবাসা ইনানের কাছেই আটকে আছে। তবুও ওকে আমি বিয়ে করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম। কারণ একটাই- ইনান যদি কখনও সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে না আসে, তাহলে ত্রয়ীর ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে থাকবে। তাই ত্রয়ীকে বিয়ে করে ওর ভালোবাসা না পেলেও, আমার ভালোবাসা দিয়ে ওকে বাকি জীবন আলোতে রাখতে চেয়েছিলাম।
এটুকু বলে আফতাহি কিছুক্ষন সময় চুপ করে থাকে। কয়েক মিনিট পর আবার বললো,
– আজ যখন শুনলাম ইনান সুস্থ হয়ে গেছে। বিশ্বাস করুন আঙ্কেল আমার নিজের অজান্তেই ভেতর থেকে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস বের হয়ে এসেছিলো। ইনান সুস্থ। এর মানে ত্রয়ী ওর ভালোবাসা ফিরে পাবে। আমি শুধু ত্রয়ীকে সুখে দেখতে চাই, ওর মুখে হাসি দেখতে চাই। ব্যস, এটুকুতেই আমার একতরফা ভালোবাসা সার্থকতা পাবে।
আফতাহির কথাগুলো শুনে আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। খুব অপরাধী বোধ কাজ করছিলো আমার ভেতরে। বাইরের একটা ছেলে একমাস আমার মেয়ের সাথে মিশে বুঝে গেলো, আমার মেয়ে কিসে সুখে থাকবে। অথচ, আমি তার বাবা হয়ে এটা বুঝিনি। বছরের পর বছর মেয়েটাকে শুধু আঘাত দিয়ে গেছি। আমি তখন অসহায় দৃষ্টিতে আফতাহির দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ছেলেটা আমার অসহায়ত্ব বুঝতে পেরে আমার হাত দু’টো ওর মুঠোয় নিয়ে বললো,
– এই মুহুর্তে বাসার কাউকে কিছু বলার দরকার নেই। যা হবে ইনান আসলেই হবে। আর আমার বাবাকেও আমি সবটা বুঝিয়ে বলবো। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না আঙ্কেল। আপনি শুধু ইনান আর ত্রয়ীর বিয়ের ব্যবস্থা করুন।
আলফাজ সাহেব কথাগুলো বলে তনয়ার দিকে তাকাতেই দেখেন, তনয়া অঝোর ধারায় কাঁদছেন। তিনি কিছুটা এগিয়ে যেতেই তনয়া তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বললো,
– আমিও এই পাঁচটা বছর মেয়েটার সাথে অনেক অন্যায় করেছি। ওকে বুঝতে পারিনি। আজ ইনানের সাথে ওর বিয়ে দিয়ে কিছুটা প্রায়শ্চিত্ত করবো।
উনাদের কথার মাঝেই নিশান দৌড়ে এসে বললো,
– আম্মু ত্রয়ীর জ্ঞান ফিরে এসেছে।
মেয়ের জ্ঞান ফিরে এসেছে শুনে আলফাজ সাহেব আর তনয়ার মুখে খুশির ঝিলিক দেখা যায়। দু’জনেই আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করেন। তারপর দ্রুত পায়ে হেঁটে যান মেয়ের কাছে।
ত্রয়ী জ্ঞান আসলে ওর মাথার কাছে ইনানকে দেখতে পেয়ে পাগলের মতো কেঁদে উঠে। লাজ-লজ্জা ভুলে ঘরভর্তি লোকের সামনেই ইনানকে জাপটে ধরে। ইনান ও কাঁদছে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। শুধু কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। দু’জনে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়েছে। উপস্থিত সবাই ড্যাবড্যাব চোখে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। ত্রয়ীর পরিবারের সবার মুখে প্রশান্তির হাসি। নিশান আগে থেকেই সবটা জানে ইনানের ব্যাপারে। ইফতিহা জানিয়েছিলো ওকে। আর রিসা, তিশান ও ইতোমধ্যে সবটা জেনে গেছে। অনেকক্ষন কান্নাকাটির পর রিসা ত্রয়ীকে ইনানের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যায় ওর রুমে। তারপর নতুন করে আবার সাজিয়ে দেয়। সাজানোর মধ্যেই রিসা ত্রয়ীকে জানায় যে, ওর বিয়ে ইনানের সাথেই হচ্ছে। তাই এবার যেনো, কান্নাকাটি করে বিয়ের সাজ নষ্ট না করে। রিসার কথায় হঠাৎ করে ত্রয়ী খুব লজ্জা পেয়ে যায়। কিছুক্ষন আগের মুহুর্তের কথা ভেবেই ত্রয়ীর গায়ে কাটা দিয়ে উঠে। বাদ আসরে আফতাহির সাথে ওর বিয়ের কথা ঠিক হয়েছিলো, সেই মতেই ত্রয়ীকে আসরের পর বিয়ের মণ্ডপে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু ত্রয়ী মণ্ডপে পৌঁছা মাত্রই জ্ঞান হারায়। যার ফলে, এখন সে ইনানের হতে পারছে। নাহলে, হয়তো এতোক্ষণে আফতাহির সাথে ওর বিয়েটা হয়ে যেতো। এমনটা ভেবেই ত্রয়ী আৎকে উঠে। কিন্তু ত্রয়ীর এই ভাবনা গুলো যে ভুল, তা সে বুঝতে পারছে না। ত্রয়ী জ্ঞান না হারালেও আজ তার বিয়ে ইনানের সাথেই হতো, এটা এখনও অজানা তার কাছে। কতোগুলো বছর পর আজ এই দিনটি এসেছে। ত্রয়ীর অপেক্ষা অবসান ঘটেছে। এসব ভেবেই ত্রয়ী দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
ইনানের পরিবারের কেউ দাদীজানের অসুস্থতার জন্য এই মুহুর্তে বিয়েতে উপস্থিত হতে পারবেন না। তবে আলহামদুলিল্লাহ, ইনানের দাদীজান পুরোপুরি ঠিক আছেন এবং তিনি তার নাতির বিয়ের জন্যও অতীব আগ্রহী হয়ে আছেন। তারা কাল নিজেদের বাড়িতে ধুমধাম করে ইনানের বিয়ের অনুষ্ঠান করবে জানিয়েছেন। আলফাজ সাহেব এতে সম্মতি দিয়েছেন। আজ শুধু ত্রয়ীর আকদ হয়ে যাবে ঠিক করেছেন সবাই।
____________________________________________________
গভীর রাত।
ইনান ও ত্রয়ী বেলকনিতে বসে আছে। ইনানের বুকে মাথা রেখে ত্রয়ী সেকেন্ডে সেকেন্ডে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। পাঁচ পাঁচটা বছর ত্রয়ী এমন করে নিঃশ্বাস নিতে পারে নি। ত্রয়ী আজ খুব করে চাইছে- পুরোনো দিনগুলোর কথা মনে করবে না, কিন্তু বারংবার যন্ত্রণার সেই মুহুর্ত গুলো ওর চোখের সামনে ভেসে উঠছে। ইনান চোখ বন্ধ করে পাঁচবছর আগের কথাগুলো ভাবছে। বেখেয়ালি মনে কীভাবে সে তার বোকাপাখির প্রেমে পড়েছিলো, সেসব ভাবছে। ইনান মাঝের এই পাঁচ বছরের কথা ভাবছে না। সুখের এই সময়টাকে সে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে দিতে চাচ্ছে না।
ত্রয়ী হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠে বললো,
– আপনাকে একটা জিনিস দেখাতে বেমালুম ভুলে গেছি। চলুন, চলুন এখন দেখাবো।
এ কথা বলেই ইনানের হাত টানতে টানতে নিয়ে যায় তার ড্রেসিং টেবিলের কাছে। তারপর ড্রেসিং টেবিলের গ্লাস খুলে বড় একটা ঝিনুক দেয় সে ইনানের হাতে। ইনান ঝিনুক হাতে নিয়ে অবাক চোখে তাকায় ত্রয়ীর দিকে। ত্রয়ী ইশারায় তাকে ঝিনুক টা খুলতে বলে। ঝিনুক খুলে ইনান মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষন সেটার দিকে।
ত্রয়ীর খিলখিল করে হেসে বললো,
– কি চিনতে পারছেন তো এগুলোকে?
ইনান কিছু বলার মতো খুঁজে পাচ্ছেনা। চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। মানুষ অতিরিক্ত অবাক হলে মাঝে মাঝে বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। ইনানও তাই হয়েছে। ত্রয়ী হাসতে হাসতে আবারও বললো,
– থাক আপনার কিছু বলতে হবে না। আমিই বলে দিচ্ছি। এই বোতম দু’টোর একটা হচ্ছে- ত্রয়ী বোতাম আর একটা ইনান বোতাম। আর বোতম দু’টোর মাঝে যে হার্ট শেইপড পাথরটা দেখছেন, এটাকে চিনতে পারছেন তো?
ঐ যে, আমরা সাদা পাথরের দেশে গিয়ে যে দেখেছিলাম পাথর টা! এটা সেটাই। আমি বোতাম গুলো আর পাথরটা আপনার চোখের আড়ালে নিয়ে এসেছিলাম।
কেমন দিলাম সারপ্রাইজটা, হুম?
ত্রয়ীর বাচ্চাদের মতো পাগলামি গুলো এখনও রয়ে গেছে দেখে ইনান হেসে ফেলে। তারপর ত্রয়ীকে পাঁজাকোলে তুলে নিয়ে বলে সে,
– তোমার এই সারপ্রাইজের কথা আমি কোনোদিন ভুলবো না। আমি সত্যিই সারপ্রাইজড হয়েছি। এই এত্তগুলা বছর তুমি এই বোতাম গুলো আর পাথরটাকে যেভাবে আগলে রেখেছো; এর মানে হচ্ছে তুমি তোমার এই ভালোবাসা দিয়ে আমাকেও সারাজীবন আগলে রাখবে।
ভালোবাসি বোকাপাখি, খুব বেশি ভালোবাসি।
ইনানের এমন আদুরে কন্ঠে শুনে ত্রয়ী ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। ত্রয়ীর কান্না দেখে ইনান চুপসে যায়। বুকের ভেতরটায় তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করে। মৃদু গলায় বলে,
-এই কাঁদে না বোকাপাখি, কাঁদেনা। তোমার কান্না আমার ভেতরটা কতটা পুড়ায়, তুমি জানো?
ত্রয়ী কান্নারুদ্ধ কন্ঠে বলে,
– হু।
– তাহলে কাঁদছো কেন? আমাকে পোড়াতে চাও?
ত্রয়ী মাথা নাড়িয়ে না সূচক জবাব দেয়। তারপর কান্না থামিয়ে হালকা হাসার চেষ্টা করে। ইনান ত্রয়ীকে বেডে শুইয়ে দিয়ে নিজেও তারপাশে শুয়ে পড়ে। ত্রয়ী ইনানের বুকে মাথা রাখে। ইনানও ওপাশ থেকে ত্রয়ীকে নিজের আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নেয়।
____________________________________________________
ইনান আর ত্রয়ীর সাথে ত্রয়ীর পুরো পরিবারও সিলেট এসেছে আজ সকালে। সিলেট আসার আগে নিশান সাহস করে তার ইফতিহার সম্পর্কের কথা তনয়াকে জানিয়েছে। তনয়া এতে আপত্তি করেনি। তিনি তো ইফতিহাকে চেনেন, কতোটা ভালো মেয়ে সে। তাই এই সম্পর্কে আপত্তি করার কোনো মানেই হয়নি। আর তার উপর, মেয়েকে এতোদিন যে বিচ্ছেদের যন্ত্রণা দিয়েছেন, সেটা আবার নতুন করে নিজের ছেলেটাকেও দিতে চান না। মাঝের কয়েকটা বছর ইনানের সূত্র ধরে দু’পরিবারে শত্রুতা হলেও কাল সেই শত্রুতা শেষ হয়েছে ইনান ত্রয়ীর বিয়ের মাধ্যমে। আজ তনয়া সিলেট এসেই নিশান আর ইফতিহার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছেন। মাস খানেক পরেই তাদের বিয়ে। দুই বিয়ের আমেজে পুরো বাড়িতে হৈচৈ শুরু হয়েছে। ত্রয়ীকে বধূ রূপে দেখে ইনান আবারও বেখেয়ালি মনে নতুন করে প্রেমে পড়ছে আজ। সন্ধ্যা নামতেই ত্রয়ীকে ইনানের রুমে দিয়ে আসা হয়। রুমে যাওয়ার আগে ইনান ত্রয়ীর হাতে একটা চিরকুট দেয়। ত্রয়ী রুমে গিয়ে সেটা খুলে পড়তে থাকে। চিরকুটে লিখে,
– আলমারি খুলে একটা শাড়ি পাবে, সেটা পড়ে নিও। তারপর ড্রেসিং টেবিলে গিয়ে বাকিসব জিনিস পেয়ে যাবে। রেডি হয়ে থেকো আমি আসছি কিছুক্ষণের মধ্যে।
ত্রয়ী ইনানের কথানুযায়ী আলমারি খুলে। একটা সাদা জামদানী দেখে সেটা হাতে নেয়। কিছুক্ষন বুকের সাথে সেটা চেপে ধরে রাখে। তারপর শাড়ি পড়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে যায়। বেলিফুলের সব গয়না। তাও তাজা বেলি ফুল; যার সুবাস পুরো রুমে ছড়িয়ে পড়েছে। ত্রয়ী ধীরে ধীরে সব গয়না পড়ে নেয়। মাথায় হাত খোপা করে বেলি ফুলের গাজরা গুজে দেয়।
কিছুক্ষণ পর রুমের দরজা খোলার শব্দ পেয়ে ত্রয়ী চোখ বন্ধ করে ফেলে। ইনান আলতো হাতে ত্রয়ীর কাঁধে হাত রাখতেই ত্রয়ী মৃদু কেপে উঠে। ঠোঁট দু’টো কাঁপতে থাকে। ত্রয়ীকে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
– আজ কী হবে?
ত্রয়ী চোখ মেলে জিজ্ঞেস করে,
– কী হবে?
ইনান দুষ্টুমির হাসি দিয়ে ত্রয়ীকে পাঁজাকোলে নিয়ে বললো,
– সেটা দেখতেই পারবে কী হবে!
এ কথা বলেই ত্রয়ীকে বেডে শুইয়ে দিয়ে একপাশ থেকে অন্যপাশে সরিয়ে দেয়। তারপর ভয়ংকর কন্ঠে বলে,
– যন্ত্রণায় কাতরানোর মুহুর্তে শেষে, আজ এই মিলনের রাতে, আমি খন্ডে খন্ডে বিভক্ত হয়ে তোমার সর্বাঙ্গে বিচরণ করতে চাই! তারপর..
ত্রয়ী কাঁপা গলায় বলে,
– তারপর কী?
– পরস্পর পরস্পরের অস্তিত্বে মিশে যাবো, শিরা-উপশিরায় বেখেয়ালি মনে ভালোবাসা কুড়াবো।
আজ রাত আমাদের দু’জনের রাত। আজ রাত আমাদের মিলনের রাত!
রাতদুপুরে চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, একজোড়া সুখী দম্পতির রুমের পর্দা গুলো মৃদু হাওয়ায় দুলছে।
_____________________________________________________
বিয়ের দু’মাস চলছে। ইনান অসুস্থ হওয়ার পরে ঢাকার চাকরিটা হারায় সে। তাই এখন সিলেট চাকরি করছে। প্রতিদিনের তুলনায় আজ একটু তাড়াতাড়িই সে বাসায় ফিরেছে। রুমে গিয়ে এদিক ওদিক খুঁজেও ত্রয়ীকে দেখতে না পেয়ে পা বাড়ায় ছাদের দিকে। যা ভেবেছিলো ঠিক তাই; তার বোকাপাখি ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। ইনান পা টিপে টিপে ত্রয়ীর কাছে গিয়ে পিছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে। ত্রয়ী ভয় পেয়ে মুহুর্তেই আবার নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
– আজ আমার নির্লজ্জ স্বামী এতো তাড়াতাড়ি ফিরলো যে?
ত্রয়ীর মুখে নির্লজ্জ স্বামী কথাটা শুনেই ইনান হেসে ফেলে। তারপর বললো,
– যার ঘরে একটা এতো সুন্দরী লজ্জাবতী বউ আছে, তার কি আর অফিসে মন বসে?
ত্রয়ী খানিকটা লজ্জা পেয়ে যায়। এর মাঝেই হঠাৎ করে ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ইনান ত্রয়ীকে টেনেও ছাদ থেকে নামাতে পারছে না।
তাই বাধ্য হয়ে নিজেও ভিজছে বৃষ্টিতে। বৃষ্টিস্নাত রাতে প্রিয়তার সাথে একান্তে এভাবে ভেজার অনুভূতিই অন্যরকম।
ইনান ত্রয়ীর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,
– একটা গান শোনাও না বউ?
ইনানের আবদার ত্রয়ী ফেলতে পারে না। ইনান ত্রয়ীর পেট জড়িয়ে ধরে পিছন দিক থেকে। ত্রয়ী মৃদু কেঁপে উঠে গান ধরে,
“বেখেয়ালী মনে, ভেবেছি গোপনে,
বেখেয়ালী মনে, ভিজেছি দুজনে।
আদরে চাদরে, নেবো তোকে মুড়ে,
বৃষ্টি চাস, বারো মাস,
ভিজি আয়.. ও ওও..
বেখেয়ালী মনে, ভেবেছি গোপনে,
বেখেয়ালী মনে, ভিজেছি দুজনে।
আলোর ওই দেশে, সাত রং মেশে,
সেই রঙে তোকে রাঙাবো।
রাত্রি গড়িয়ে, বুকে জড়িয়ে,
তোর ভোরের-ই ঘুম ভাঙ্গাবো।
আদরে চাদরে, নেবো তোকে মুড়ে,
বৃষ্টি চাস, বারো মাস,
ভিজি আয়.. ও ওও..
প্রেমের অন্তরা, লিখেছি মনগড়া,
তোকে সুরে সুরে ভেবে যাই।
মনের ছবিটায়, শেষের কবিতায়,
তোকে বারেবারে খুঁজে পাই।
আদরে চাদরে, নেবো তোকে মুড়ে,
বৃষ্টি চাস, বারো মাস,
ভিজি আয়.. ও ওও..”
(সমাপ্ত)
______________
আল্লাহ হাফেজ!