#পূর্ণময়ীর_বিসর্জন
#মৌমি_দত্ত
#পর্ব_৫
– ওকে সন্দেহ করলে লাভ হবে না ভাইয়া। দোষ বা ভুলটা আমাদেরই। বিদেশের মাটিতেই বাংলার বংশোদ্ভূত এক বিদেশিনী ও। আমরা একটু খেয়াল করলেই হয়তো বুঝতাম। একটু লক্ষ্য করে দেখো ওর চুল আর পাঁচটা বাঙ্গালী মেয়েদের মতো কালো না। কেমন বাদামী ভাব আছে ওর চুলে। শুধু তাই নয়, আমরা ভেবেছি ও গুছিয়ে কথা বলতে পারে না। হয়তো তা সত্যিও। কিন্তু ভালো করে শুনলে বুঝা যাবে ওর বাংলা টা কেমন যেন ভাঙ্গা ভাঙ্গা। হয়তো ও প্রতিবন্ধী না। অন্য কোনো ভাবে মানসিক সমস্যায় আছে।
রায়ান অনুবিকার কথা মন দিয়ে শুনলো।নার্সের দেখিয়ে দেওয়া ঔষধ ভাইয়ের হাতে তুলে দিয়ে অনুবিকা আলতো হাসলো।
– ও আমাদের পরিবারের অংশ ভাইয়া। আমার বোনের মতো।
রায়ানের যেন পছন্দ হয়নি বোন শব্দটা। রায়ান মৃদু হাসলো। সে পাগল হয়েছে নির্ঘাত। অনুবিকা বললো,
– ইশশ! মেয়েটা কিছু না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। তোমার হাত ছাড়া তো ও খায় না। এখন কি যে হবে!
অনুবিকা এগিয়ে যাচ্ছিলো পূর্ণর দিকে। রায়ান হাত ধরে আটকে দিলো।
– থাক! একটু ঘুমাক। মুখ শুকিয়ে গেছে ওর।
রায়ানের কথা শুনে অনুবিকা মাথা নাড়লো।
– তুই খেয়ে আয় ক্যান্টিন থেকে। যা!
অনুবিকা ভ্রু কুঁচকে মানা করতে যাবে। তখনই রায়ান রেগেমেগে তাকালো। ভাইকে উত্তেজিত হতে দিতে চায় না সে। তাই মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে চলে গেলো। রায়ান নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো সামনে শুয়ে থাকা মেয়েটির দিকে। সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। সুস্থ হলেই পূর্ণকে ভালো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। নিজের অজান্তেই রায়ান বিড়বিড়িয়ে বললো,
– এতোদিন ছিলে মায়াবিনী এখন জানি বিদেশিনী। আর কতো রুপ তোমার?
পরক্ষনেই নিজের কথায় নিজেকে ধিক্কার জানুয়ে চোখ বুজলো রায়ান। এই মেয়ে সাংঘাতিক কোনো কুহকী।বেশি সময় তাকিয়ে থাকলে মোহ জালে ফাঁস খেতে হবে। ঔষধের কার্যক্ষমতার জন্য ঘুমিয়ে পড়লো রায়ান।
.
.
দেখতে দেখতে কেটে গেলো আরো এক সপ্তাহ। পূর্ণ নিজ হাতে খাওয়া শিখে নিয়েছে কষ্ট করে। কিন্তু রায়ান ছাড়া অন্য কারোর হাতে খাবে না প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেনি। রায়ান এই ৭ দিনে পূর্ণর সাথে ইংলিশেই কথা চালিয়েছে। আর যা বুঝেছে তা হলো পূর্ণ সত্যিই এখানকার না। সে লন্ডনেই বড় হয়েছে। কথাবার্তায় আরো বুঝেছে বায়োলজিকাল মেয়ে ছিলো না সে যাদের বাবা ও মা ভাবতো। তাই তারা ফেলে চলে গেছে। যদিও এতে পূর্ণর কষ্ট নেই। কারণ অতোটুকু বিকাশ ঐ মস্তিষ্কের হয়নি এখনো। এই ৭ দিনে রায়ান এই হাসপাতালেই একজন ডাক্তারকে দেখিয়েছে পূর্ণকে। অনেক বড় সাইকোলজিস্ট। পূর্ণ ভালো করে পর্যবেক্ষনের পর তিনি জানিয়েছেন পূর্ণ অটিস্টিক নয় মানসিক ভাবে হালকা অপরিপক্ক রয়ে গেছে। তার জন্য কাউন্সেলিং, পরিবারের সহযোগিতা আর কিছু ঔষধ পত্র যথেষ্ট। সময় সীমা বেঁধে দিয়েছে ডাক্তার ৬ মাসের। এই ৬ মাস পর আশা করা যায় পূর্ণ স্বাভাবিক হয়ে উঠবে অনেকটাই। যদিও আর দশটা মানুষের মতো চালাক চতুর হবে তা বলা যাচ্ছে না। রায়ান ইতোমধ্যেই পূর্ণর চিকিৎসা শুরু করে দিয়েছে। তাই পূর্ণর সময় রায়ানের কেবিন, ডাক্তারের কেবিন, রেহানা, আয়ান আর অনুবিকার সাথে হাসপাতালেই আড্ডা দিয়ে কেটে যায়। এখানের থেকে সে এই একসপ্তাহে এক পাও নড়েনি। তার জামা এখানেই এনে দেওয়া হয়েছে। সে রায়ানের কেবিনটাকেই নিজের রুম বানিয়ে নিয়েছে। পূর্ণ লন্ডনে স্কুল লাইফে সবে উঠেছিলো যখন তার বাবা মা বাংলাদেশে নিয়ে আসে তাকে আর ফেলে চলে যায়। তাই রায়ান সিদ্ধান্ত নিয়েছে পূর্ণর বাবা মাকে সে খুঁজবে। পূর্ণকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যে নয়। তার সকল কাগজপত্র নিয়ে আসার জন্যে। এই দেশেই রেখে দেবে পূর্ণকে।
.
.
আজকে হাসপাতালে ৮ম দিন রায়ানের। আজকেই বাসায় ফিরে যাচ্ছে সে। মিস্টার হেনরিক ফেয়োল খোদ নিজে আসছেন আজকে বাংলাদেশে পূর্ণ ও রায়ানকে দেখতে। পূর্ণ রায়ানের ফিরে আসার জন্যে পুরো বাড়ি সুন্দর করে সাজিয়েছে অনুবিকাকে বলে। এই কয়েকদিন রায়ানের ঔষধপত্র, দেখভাল সব নিজের অপরিপক্ক মস্তিষ্ক ও একরাশ ভালোবাসা দিয়ে পূর্ণ নিজেই করে গেছে যা দেখে বাদ বাকি সকলে এমনকি পূর্ণর ডাক্তারও অবাক হয়েছে। পূর্ণর ডাক্তার সাজেস্ট করেছে যেন রায়ান পূর্ণকে একটু বেশি সময় আর প্রায়োরিটি দেয়। এতে করে পূর্ণর সেড়ে উঠার চান্স দ্রুত বাড়বে। রায়ানকে সকালবেলা ঘুম ভাঙ্গার পর ধরে ধরে পূর্ণ ওয়াসরুমের সামনে নিয়ে গেলো আর নিজে ওয়াসরুমের বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো। এরপর রায়ান ফ্রেশ হয়ে নিলে তাকে এনে আবার খাটে বসালো। খালি পেটের দুটো ঔষধ দিয়ে দিলো। ততোক্ষনে অনুবিকাও চলে এসেছে। অনুবিকার থেকে স্যুপের বাটি নিয়ে আর বাদ বাকি দিনগুলোর মতো রায়ানকে খাইয়ে দিলো স্যুপ কেননা রায়ানের ডান হাতের কনুইয়ে আর মাথায় এখনো ব্যান্ডেজ আছে। রায়ানকে খাইয়ে দিয়ে কিছুক্ষন অনুবিকার সাথে বসে গল্পগুজব করলো আর নিজেও খেয়ে নিলো। এরপর রায়ানকে ঔষধ খাইয়ে নিজেও ঔষধ খেয়ে নিলো। রায়ানকে টিশার্ট পড়িয়ে দিলো অনুবিকার সাথে মিলে। প্যান্টটা রায়ান ওয়াশরুমেই পড়ে নিয়েছিলো। এরপর পূর্ণ অনুবিকার সাথে কথা বলতে বলতে এদিক ওদিক ছুটে ছুটে বাচ্চাদের মতো রায়ানের জিনিস গুছিয়ে নিতে লাগলো। রায়ান শুধু দেখছে পূর্ণর কার্যকলাপ। মাঝে মাঝে তার মনে হয় এই মেয়েটার ঠিক হওয়ার কোনো দরকার নেই। একটা রোগ রয়ে গেছে বলেই এতো ভালো লাগে মেয়েটাকে। হয়তো নিঁখুত বানাইনি আল্লাহ তাকে এই একটিমাত্র কারণে, যাতে সবাই তাকে প্রাণ খুলে ভালোবাসে।
বেচারা রায়ান, পূর্ণ এদের জীবনে কি হতে যাচ্ছে তা সম্পর্কে কোনো জ্ঞানই হয়তো এদের নেই।
চলবে,