আঁধারে ঢাকা ভোর পর্ব-১৭

0
1660

#আঁধারে_ঢাকা_ভোর
#অধ্যায়_সতেরো
প্রজ্ঞা জামান দৃঢ়তা

ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে বসে আছে আভা, তুষার। ফারহা আজ আসেনি। কাল ভাইয়ের কাছে সবটা শুনে খুব খুশি সে। তাই সদ্য প্রেমে পড়া দুজন মানব মানবীকে একা ছেড়ে দিয়েছে।

দুজনের জীবনের প্রথম প্রেম তাই ভালো লাগা গুলো স্পষ্ট বলতে পারছে না। কিন্তু বুঝতে পারছে দুজন-দুজনের চোখের ভাষা। গতকাল সি বিচ থেকে ফিরে সারারাত দুজন কথা বলেছে, যদিও বেশির ভাগ কথাই তুষার বলেছে, আভা শুধু হু, হ্যাঁ করে গেছে। তাই বলে তার অনুভূতি গুলো কম হয়ে যায়নি। বরং মন্ত্রমুগ্ধের মতো তুষারের প্রতিটি কথা শুনেছে। এমনভাবে ভালোবাসার মানুষটিকে পেয়ে যাবে দুজনের কেউই ভাবেনি। দুই প্রান্তে বসে দুজন সকাল হওয়ার অপেক্ষা করে গেছে। সকাল হতেই তড়িঘড়ি করে ভার্সিটিতে চলে এসেছে।

একজন অন্যজনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করবে। তখন ঘড়ির কাঁটাকে বড্ড অসহ্য লাগবে। মনে হবে যেন ইচ্ছে করেই এগুচ্ছে না কাঁটাগুলো। ইশ! কী এলোমেলো ভাবনা। এটাকেই হয়তো প্রেম বলে! ভালোবাসা বলে!

“আচ্ছা প্রেম আর ভালোবাসার মাঝে তফাৎ কী বলোতো?” তুষার আভার দিকে পূর্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল।

“প্রেম হচ্ছে একটা মোহ যা হয়তো কিছুদিন পর কেটে যায়। কিন্তু ভালবাসা কখনো শেষ হয় না। ধরুন, কথাটা শেষ কররা আগেই তুষার বলল,

“কাল রাতে কতবার বলেছি আপনি করে বলা যাবে না। তুমি করে বলবে।”

আভা হেসে বলল, “আচ্ছা বলছি। ধরো আমাদের কোনো কারণে যদি বিচ্ছেদ হয়ে যায়। তারপরও পৃথিবীর যেই প্রান্তেই থাকি না কেন তোমাকে ভুলতে না পেরে প্রতিদিন তোমার কথা মনে পড়া ভালোবাসা। দুজনের একসাথে কাটানো সুন্দর মুহূর্তগুলো মনে করে অকারণে হাসা।

ভালোবাসা মানে ত্যাগ, যা আজীবন স্থায়ী। কিন্তু প্রেম মানে চোখের আড়াল হলেই ভুলে যাওয়া। প্রেমে আত্মশুদ্ধি নেই। ভালোবাসায় আছে। যা কখনো বিলীন হয় না, মনের অগোচরে রয়ে যায় কারণে-অকারণে অনন্তকাল।”

তুষার বুদ্ধিভ্রষ্টের মতো তাকিয়ে রইল তার আকাঙ্ক্ষিত নারীর দিকে। মেয়েটা কী দারুণ করে কথা বলে। কথা বলার সময় তার ঠোঁট দুটোতে ছন্দ নামে। যখন দীর্ঘ পল্লবযুক্ত আঁখি মেলে তার দিকে তাকায় মনে হয় এইমাত্র স্বর্গের দরজা খুলে গেছে। যারা তার গায়ের রঙ নিয়ে নানা কথা বলে তারা কী কখনো মনের চোখ দিয়ে দেখেছে তাকে! কখনো খেয়াল করেছে কতটা সুশ্রী সুদর্শনা সে। এই যে তার পুরো মুখের আদলে নিবিড় মায়ায় ভরা তারা কী কখনো অনুভব করতে পেরেছে? করেনি, করলে নিশ্চয়ই এমন করে উপহাস করতে পারত না।

“তোমার পরীক্ষা শেষ তবুও ক্যাম্পাসে এসেছো কেন?”

আভার কথায় ধ্যান ভাঙে তুষারের।

“তুমি বুঝি জানো না?”

“সে আমি জানি, কিন্তু অন্যরা দেখলে কী ভাববে? তুমি তো ক্যাম্পাসের পরিচিত মুখ।”

“কে কী ভাবছে তা নিয়ে ভাবার এত সময় আমার নেই।”

“তা আপনার কাছে কিসের সময় আছে শুনি?”

তুষার রহস্যময় হাসি দিয়ে বলল, “প্রেম এবং বিয়ে দুটোর জন্যই আমার কাছে অফুরন্ত সময় আছে।”

আভার মুখ আরক্ত হলো। তার মায়াবী মুখখানা নিচের দিকে নামিয়ে বলল, “আমার ক্লাস শুরু হবে এখন, আমাকে যেতে হবে।”

“পালাতে চাইছো?”

“উঁহু! আপনি এভাবে চেয়ে থাকলে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। বুকের ভেতরটা ধুকপুক করে। অস্বস্তি হয়।”

তুষার হেসে বলল, “তুমি কী জানো পৃথিবীর সব সুখের মুহূর্তগুলো মানুষকে এই একই অনুভূতি দেয়? মানুষ চাইলেও কোনোমতেই স্বস্তিতে সুখগুলো অনুভব করতে পারে না। সুখের ক্ষণে তোমার ভেতরটা ছটফট করবে। নাহলে যে সুখটুকু তুমি প্রাণ দিয়ে অনুভবই করতে পারবে না।”

আভা চিন্তা করে দেখল সত্যিই তো এমনটাই তো হয়! এক রাশ মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে দেখল সামনে থাকা মানুষটাকে সাথে সাথেই চারপাশে ফুলের সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ল, অবিচ্ছিন্ন শান্তিতে চেয়ে গেল বুকের ভেতরটায়। মনে হলো এই মানুষটিকে সে ভালোবাসে, ভালোবাসে বহুকাল ধরে! কোনো পুরুষকে এই প্রথম এতটা নিবিড়ভাবে ভালোবাসতে পেরেছে সে। এতটা প্রবলভাবে তাকে কেউ কোনোদিন টানতে পারেনি। মনে হয় এই ছেলেটা জাদু জানে নয়তো কী করে তাকে নিজের করে নিল।

যে মেয়ে ভেবেছে কাউকে নিজের জীবনের সাথে জড়াবে না। সে মেয়েই এখন তুষার নামক মানুষটায় আসক্ত হয়ে পড়েছে! ভালোবাসা যখন হয়ে যায়, তখন নিজেকে সামলানো দায় হয়ে পড়ে। নয়তো সারাক্ষণ এই ছেলেটাকে কেন তার মনে পড়ে! কেন মনে হয় সাত সমুদ্র তেরো নদী পার করে আসতে পারবে শুধু তাকে এক নজর দেখার জন্য। আভা এমন এলোমেলো ভেবে নিজেই আনমনে হাসে।

তুষার সে হাসির দিকে তাকিয়ে জ্ঞানী ভঙ্গিতে বলে, “আমি জানি তুমি কী ভাবছো।”

“বাহ! সাহেব দেখি মনও পড়তে পারে! তা কী ভাবছি আমি?”

“ভাবছো এই ছেলেটাকে আমি এত ভালোবাসি কেন? ভাবছো এই ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আমি জনম জনম পার করে দিতে পারব।”

তুষার দার্শনিকের ভঙ্গিতে কথা গুলো বলল।
আভা তার ভাব দেখে জোরে হেসে ফেলল। তুষারের ফোলা ফোলা গাল টেনে বলল, “ইশ! উনি যেন সব জেনে বসে আছেন। আমার ক্লাস আছে আসছি এখন।”

কথা শেষ করেই সে চলে গেল। তুষার চেয়েও কিছু বলার সুযোগ পেল না, হাসি মুখে পেছন থেকে তাকিয়ে রইলো তার যাওয়ার দিকে।

★★★

সময় চলছে নিজের গতিতে। তারসাথে চলছে আভা তুষারের ভালোবাসাও। নিয়ম করে তুষার শাটল ট্রেনে করে আভার সাথে ভার্সিটি পর্যন্ত আসে। ভার্সিটিতে কোনো কাজ নেই এখন তাও কিছুক্ষণ দুজনে সময় কাটায়। আভা ক্লাস শেষ করে আসলে আবার দুজনে একসাথে শাটল ট্রেনে চড়ে বাসায় ফিরে। ট্রেনে উঠে আভা যখন জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে দেয় তুষার সেই হাতের উপর হাত রাখে। আভা যদি বলে, “আহ! কী করছো বাকিরা কী ভাববে?”

“মানুষ কী ভাবছে তাতে যেন আমার বয়েই গেল।” তুষারের এমন বেপরোয়া কথা শুনে সে হাসে। মাঝে মাঝে মানুষটাকে তার নিজের থেকেও ছোট মনে হয়। কেমন ছেলেমানুষি করে। তবে তার কাছে যে মন্দ লাগে তেমনটাও নয়। বরং খুব ভালো লাগে।

“এই অরনী কী ভাবছো বলতো?” তুষারের ডাকে সম্বিৎ ফেরে তার।

“আচ্ছা তুমি আমায় আভা না ডেকে অরনী কেন ডাকো?”

“সবাই তোমার কাছে যা আমি কী তাই?”

“না! তুমি অন্য সবার থেকে আলাদা।”

“হু! তুমিও আমার কাছে সবার থেকে ভিন্ন তাই আমি তোমাকে ভিন্ন নামেই ডাকব। যে নামে আমি ছাড়া আর কেউ তোমায় ডাকতে পারবে না।”

“বাব্বাহ! কত হিংসুটে তুমি! দেখে তো মনে হয়নি কখনো।”

“যেভাবে বলছো যেন আমি সবার সাথে প্রেমিকার মতো ব্যবহার করব!”

“করো না! তাতে আমার কী?”

“তোমার কিচ্ছু না?”

“উহু! কিচ্ছু না।”

“তাহলে ওই দেখো মেয়েটা কীভাবে তাকিয়ে আছে, তাকে এখনই গিয়ে প্রেমের প্রস্তাব দেব। কথাটা বলেই তুষার হাত তুলে তাকে ডাকল, ” এই যে শুনছেন?”

আভা তুষারের হাতটা খপ করে ধরে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলল, “হাত কেটে ফেলব যদি আর কাউকে এই হাত দিয়ে ডাকো। চোখ তুলে ফেলব যদি ওই চোখে অন্যকাউকে দেখো, হৃদপিণ্ডটা খুলে নেব যদি সেখানে আমি ছাড়া অন্য কাউকে জায়গা দাও।”

তুষার অবাক নয়নে আভার দিকে তাকিয়ে বলল, “ওয়াও! কিলার লাভার!”

ও-দিকের মেয়েটার আওয়াজ পাওয়া গেল, ” এক্সকিউজ মি আমকে কেন ডেকেছেন?”

তুষার ইতস্ততভাবে বলল, “পানি হবে আপনার কাছে?”

মেয়েটা ভ্রু কুচকে বলল, “আপনার গার্লফ্রেন্ডের হাতেই তো পানির বোতল আছে।”

সে হেসে কাচুমাচু হয়ে বলল, “সরি খেয়াল করিনি।”

আভা এদিকে হাসতে হাসতে অবচেতন মনে তুষারের কাঁধে মাথা রাখল। তুষার সে হাসি দেখে তৃপ্তি পেল। সে আভার হাতটা বুকের সাথে লেপ্টে ধরে সুখে চোখ বুজল।

★★★

এভাবেই হাসি খুশিতে মাস পেরিয়ে দুই বছর চলে গেল। তাদের ভালোবাসা গভীর থেকে গভীরতর হয়ে গেল। আজকাল দুজন দুজনকে জিজ্ঞেস না করে কিছুই করে না। প্রতিদিন নিয়ম করে দেখা করে। তুষার আগ্রাবাদ জনতা ব্যাংকে চাকরি পেয়েছে। সকাল থেকে রাত অবধি অফিস করেও কখনো দুজনের দেখা করায় বা কথা বলায় খামতি থাকে না। রাত জেগে কথা বলে। প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে নিজেদের অনুভূতিকে নতুনভাবে আবিষ্কার করে। দুজনের কথার কমতি না হয়ে বরং বেড়ে যায়।

আভা নিজেকে দিনদিন এক অন্য মানুষ হিসেবে আবিষ্কার করতে লাগল। তার ভেতরে যে এতটা আবেগ ছিল, কাউকে প্রবলভাবে ভালোবাসার শক্তি ছিল এ যেন সে ঘূণাক্ষরেও বুঝতেই পারেনি। দুজনের সময় পেলেই সিআরবি কিংবা পতেঙ্গা সমুদ্র পাড়ে হাত ধরে হাঁটতে যায়। সবকিছু যেন দুটো আত্মাকে এক করে দিচ্ছে।

এইতো সেদিন তুষার বেতন পাওয়ার পর তাকে মার্কেটে নিয়ে গেল কিছু কিনে দিবে বলে। তুষার বলল, “আজ তোমাকে কিছু নিতেই হবে অরনী। সবসময় নিবে না বলে পাশ কাটিয়ে চলে যাও। আজ নিতেই হবে।”

আভা হেসে বলল, “আমাকে যদি কিছু দিতে চাও তবে একটা সংসার দাও, ছোট্ট একটা সংসার যেখানে সবসময় তোমাকে দেখতে পাব, চাইলেই ছুঁয়ে দেখতে পারব। দুজনে একসাথে রাত জেগে মুভি দেখব, প্রচণ্ড শীতে জুবুথুবু হয়ে বারান্দায় গিয়ে বসে থাকব, সাথে থাকবে ধোঁয়া উঠা গরম চা।

তুমি গিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলবে, “চাদর লাগবে?”

আমি বলবো, “উঁহু! এভাবেই জড়িয়ে রাখো আমায় এরচেয়ে বেশি উষ্ণতা আমার লাগবে না। তোমার স্পর্শেই আমার কাছে সবচেয়ে বড় চাদর।”

তুষার মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে রইল তার দিকে। মনে হলো এই মেয়েটি একদম আলাদা, সবথেকে আলাদা!

সেদিন অবশ্য একটা নীল রঙের শাড়ি কিনে দিয়েছিল আভাকে। আভা বলেছিল, “নীল তো বেদনার রঙ তাহলে নীল কেন দিলে?”

তুষার বলেছিল, “নীল শুধু বেদনার রঙ নয়, ভালোবাসার রঙ। তাই আমাদের ভালোবাসায় নীল রঙই থাকবে সারাজীবন।”

আভা উত্তরে শুধু হাসলো।

★★★

আভা তৃতীয় বর্ষে অনেক ভালো ফলাফল করে চতুর্থ বর্ষে ভর্তি হলো। দুজনে হাঁটতে হাঁটতে ভার্সিটির পেছনের দিকে এসে বসে।

তুষার বলল, ” আর কিছুদিন পর তুমি এলএলবি শেষ করে বের হবে। এরপর কী করবে?”

“আমি স্কলারশিপের জন্য আবেদন করতে চাই। আল্লাহর রহমতে যদি টিকে যাই তবে আমেরিকা যেতে চাই উচ্চশিক্ষার জন্য। অবশ্যই যদি তুমি চাও?”

“আমি তোমার কোনোকিছুতেই অমত করব না। আমি জানি পড়াশোনা নিয়ে তোমার কত স্বপ্ন। এ স্বপ্ন শুধু তোমার নয়, এই স্বপ্নটা আমারও। আমিও চাই যারা সবসময় তোমায় ছোট করে কথা বলেছে তুমি যেন তাদের প্রতিটি কটাক্ষের উত্তর দিতে পারো। নিজেকে প্রমাণ করতে পারো। তার জন্য যদি আমাকে তোমার থেকে কিছু দিনের জন্য দূরে থাকতে হয় তাতেও আমি রাজি।”

” তুমি আমাকে নিশ্চিন্ত করলে।”

তুষার ইতস্তত করে বলল,” এলএলবি পরীক্ষা দেয়ার পরপরই আমরা বিয়ে করে নিতে পারি না? আমি জানি তোমার মতো ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রী স্কলারশিপ পেয়ে যাবে। তাই যে কয়টা দিন বাকী থাকবে আমরা একসাথে থাকতে চাই।”

আভা কিছুক্ষণ তুষারের দিকে চেয়ে থেকে বলল, “তুমি আমার মনের কথা কী করে জানলে?”

কথাটা শুনে তুষারের ঠোঁটের কোণে বিশ্বজয়ের হাসি ভেসে ওঠল।

ইনশাআল্লাহ চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here