#নেশাক্ত_প্রণয়োণী
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_২৪
জাফর সাহেবকে বেধড়ক পি’ঠি’য়ে যাচ্ছে আরভীক। তার পিঠে প্লাস্টিকের বেল্টের সঙ্গে বেঁধে আছে ছোট আশফি। আয়েশে পচাঁ লোকের মা’ই’র খাওয়া দেখছে আর খিলখিলিয়ে হাসছে। তখনো রক্তাক্ত হয়নি সে। শুধু লাল আভা ভেসে উঠেছে তার শরীরে। জাফরের চোয়ালে কোনো দাঁত অবশিষ্ট নেই। তার গালের মাংস পুরুপুরি ছন্নছাড়া করে দিয়েছে আরভীক। আশফি ভয়কে প্রশয় দেয়নি। নিশ্চুপে তার বাবাইয়ের কাঁধ শক্ত করে চেপে রেখেছে।
আনজুমা অঞ্জয়কে ঠুকা মেরে দৃষ্টি আকর্ষণ করে তার। সে মুখ ঘুরিয়ে তার ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে খানিক ঝুঁকে! আনজুমা অসহায় গলায় শুধায়।
‘দেবরজী আমাকে তোমার খচ্চর বস কেন বেঁধে রাখল!’
‘কারণ আপনি ছাড় পেলেই স্যারের কাজে নাক গলাবেন।’
থতমত খেল আনজুমা। মনমতে বুদ্ধিমতীর কাজ করতে চেয়ে ছিল আরভীককে থামিয়ে। তবুও যে সরল পুরুষকে চারবছর পূর্বে বিনা অপরাধে মা’রা হয়ে ছিল! তার অন্তরালে বসবাসরত হিংস্র পশুকে নাড়িয়ে দিয়েছে জাফর ও তার সাথী লিয়াকত। আজ কোনোরকম উপপ্রয়োগ বা সরঞ্জাম ব্যবহার করেনি আরভীক। বরঞ্চ জাফর ও লিয়াকত যেরুপে তার ম’র’ণ নিধারণ করে ছিল, সেও তাদের অতীব পূর্বকথিতে ম’র’ণ দেবে। তফাৎ হবে আরভীক অথাৎ সুয়াইবকে নদীর মধ্যে ফেলা হয়ে ছিল। কিন্তু তাদেরকে ফেলা হবে কিং অফ কোবরার মুখে! এই কোবরা প্রাণীর হিংস্রতা পূর্ব পরিচিত। ক্ষুধার্ত কোবরা আপনজনও মানে না। সে তদারককে মান্য করে শুধু খাবার পাওয়ার লোভে। বিধেয় কোবরা প্রাণীকে পরিকল্পনায় এনেছিল সায়াজ! আরভীক যুদ্ধের ময়দানে যাওয়ার পূর্বে সায়াজকে আজ্ঞা করে।
‘ডুড ভয়ানক প্রাণী লাগবে! যে মাংস,হাড্ডি চাবিয়ে খেয়ে হজম করতে পারে।’
সায়াজ তখন এক প্রাণীর নাম মুখে নেয়।
‘কিং অফ কোবরা !’
তার কথা শুনে অবাক চোখে তাকায় আরভীক। আশ্চর্যের বিষয় কোবরাকে দেশের মধ্যে আনা দুষ্কর! কেননা সুবিশাল দেহের অধিকারী কোবরাকে ধরে বেঁধে সামলানো কোনো একার মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। দশ-বারো ফিট লম্বা সাপ যে, যার দ্রুতপথ প্রায় আঠারো ফিট, যার বাইট পুরু চারশ-পাঁচশ মিলিগ্রাম ভেনোম। সে সাপের পরিধির পরিপক্কতা সামলানো দায়। তখন সায়াজ বুদ্ধি দেয় যে, ‘আমরা শত্রুদের এখানে নয় হংকং এ কোবরার কাছে নিয়ে মা’র’ব। কোনো কেসও হবে না, ফাইল করা তো দূরের কথা।’
সায়াজের কথা ভীষণ পছন্দের ঠেকে আরভীক এর কাছে। উদগ্রীবহীন মনে সরল হাসি দিয়ে চোখের ইশারায় সায় দেয়। বন্ধুর অনুমতি পেয়ে খোশমনে সেও তার হংকং পরিচিত এক সোশাল মিডিয়ার ফ্রেন্ডের কাছ থেকে সহায়তা নেয়। যেন সে তাদেরকে কোবরার নিকট নিয়ে যায়। এতে অপরপাশ্বের হংকং পরিচিত বন্ধু ইতস্ততঃ, ভীতিগ্রস্থ হয়। কারণ কোবরা কোনো স্বাভাবিক প্রাণী নয়। হংকং এর ভয়ানক প্রাণী। বলাবাহুল্য হংকং এর প্রতিটা ম্যাগাজিনে কোবরার বিলুপ্তের কথা ছড়িয়ে আছে। অথচ জঙ্গলে গেলে কোবার চিহ্ন,লেজের সার ঠিক বালি,ঘাসের মধ্যে পাওয়া যায়। বিনিময়ে জঙ্গলে খুব কমই ঘুরাঘুরি করে ট্যুরিস্টগণ। সায়াজ আশ্বস্ত করে কোবরার জন্য তারা উপহার এনেছে। ভক্ষক থেকে শান্ত প্রাণী বানিয়ে দেবে কোবরাকে। কথার আপেক্ষে রাজি না হয়ে পারেনি হংকং বন্ধু। সায়াজকে বলে, যখন সে আসবে তখন যেন তাকে ফোন করে জানায়। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
সানন্দে ধারণামাফিক রাজির বিষয়টি আরভীকদের জানায় সায়াজ।
৪৫.
আশফিকে বুকে জড়িয়ে ধরে বিলাপ করে চলছে আরভীক। যেন সে কোনো ঘোরে আছে। তার শরীর থরথর করে কাঁপছে। আনজুমা তার নিকটস্থ হয়ে আড়চোখে অঞ্জয়দের দিকে তাকায়। ইতিপূর্বে সে জেনেছে, তার স্বামী মা’রা যায়নি। বরং আরভীক রুপে যে পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে। সেই কিনা তার সুয়াইব। ফাহাদ জাফরদের বেহাল দশা হওয়ায় তাদের নিয়ে রাতের মধ্যে হংকং যাওয়ার ফায়সালা করে। লিয়াকতকে পরপর ছু’ড়ি দিয়ে বুকের মধ্যে মে’রে খন্ড খন্ড করেছে আরভীক। যার কারণে বিবর্ষ অবস্থা হয়েছে তার। অঞ্জয় আনজুমার কাছে এসে শুধু বলেছে,
‘ম্যাম স্যারই আপনার সব। চারবছর আগে সুয়াইব ভাইয়ের মৃত্যু হয়নি। এই যে আমাদের আরভীক স্যারই সুয়াইব ভাইয়া।’
কথাটি শুনে স্তদ্ধ হয়ে গেল আনজুমা। কিরুপ আচরণ করবে সেটাই যেন ভুলে গেল। কোনো ধরনের সত্যতা তার সামনে আছেনি! লুকায়িত সত্য জেনেও কিন্তু…..রয়ে গেল!
আনজুমার অভিমান জড়ো হলো। সুয়াইব রুপে আরভীক তার পাশ্বে ক্ষণে ক্ষণে থাকার পরও লুকায়িত সত্যের কথা বলেনি। যার ফলে মন থেকে তার ভীষণ কষ্টের অভিমান একত্রিত হলো। শাস্তি কি আজও সে দিতে পারবে! আজ আনজুমা যতটা সত্যের মুখোমুখি হলো তা হজমে সে নিজেই মরমরা প্রায়!
চোখ বুজে দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে আরভীক এর নিকটস্থ হয় সে। অঞ্জয়রা তাদের স্পেস দিয়ে মৃতলাশ নিয়ে প্রস্থান করে। আরভীক আশফিকে চেপে রেখে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। যে কান্নার সুর নেই,শব্দ নেই। নিশ্চুপে মেয়েদের ন্যায় কাঁদছে। হয়তো চারবছরের জমানো ক্ষোপ পানি হয়ে ঝরছে! আনজুমার শরীর মৃদু কাঁপছে। আরভীক নামে পরিচিত পুরুষটি তার চিরপরিচিত সুয়াইব হবে কল্পনাও করেনি কখনো। শুধু আহাট অনুভব করেছে সুয়াইবের অনুভূতিতার! যখন আরভীক তার ঘনিষ্ঠে এসে ছুঁয়ে দিতো মনে হতো স্বয়ং সুয়াইব ছুঁয়ে দিচ্ছে! তখনো ঘাঁটেনি বিষয়ের প্রেক্ষিতে। অথচ না ঘাঁটা বিষয়টিই যেন পরিণয়ে সত্য হলো!
কাঁপান্বিত হাতটি আরভীক এর কাঁধে গভীরভাবে ছুঁয়ে দেয়। প্রশ্নাতীত আশফির সঙ্গে আনজুমার কোমর জুড়ে জম্মানো যন্ত্রণার জোয়ারভাটা বয়ে গেল তার চোখজোড়া হতে! আনজুমা নিজেও শুদ্ধভাবে নিজেকে সামলাতে পারছে না! সুয়াইবের করুণ চাহনী যেন আনজুমার হৃদয় বিক্ষত করে তুলছে। শরীরের প্রতিটা রুন্ধ-নিন্দ্র যেন দ্রুতবেগে গমন করছে তার। মন না চাইতেও আরভীক এর মাথায় হাত দিয়ে কোমরে গুজে থাকা পুরুষটিকে গোপনে আকঁড়ে ধরে। ঢোক গিলে কাঁপান্বিত গলায় বলে,
‘ছাড়েন বাসায় যেতে হবে!’
ছলছল দৃষ্টিতে আরভীক কোমর থেকে থুতনি উঠিয়ে আনজুমার দিকে তাকায়। বাস্তবে আনজুমা দেখতে পেল মায়াবী চেহারার ক্রন্দন দৃষ্টিকোণ! তৎক্ষণাৎ দৃষ্টি সরিয়ে সরল কণ্ঠে শুধায়।
‘আশফির, আপনার খিদে পেয়েছে নিশ্চয় বাসায় চলেন।’
আনজুমা ছটপটিয়ে হাত সরিয়ে দেয় আরভীক এর। আহত হৃদয় নিয়ে সে আশফিকে আগলে রেখেই বলে,
‘আমাকে কি ক্ষমা করা যায় না প্রণয়োণী!’
নিশ্চুপ উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করেনি আনজুমা। সচল পায়ে কদম পেড়িয়ে প্রস্থান করে। আশফি ঘুমন্ত নয়নে তার মাম্মার যাওয়ার দিকে একপলক তাকিয়ে তার বাবাইয়ের দিকে তাকায়। তার বাবাইয়ের চোখে অশ্রুপাতের খেলা দেখে। সে নিজ হাতে মুছে দেয়। আবেগে আপ্লুত দৃষ্টিতে আরভীক আশফির মুখপানে চুমুতে ভরিয়ে দেয়। তার গালে হাত রেখে স্নেহপরশী গলায় শুধায়।
‘ইউ আর রিয়েলি মাই চ্যাম্প আশফি! আইম ইউর ড্যাড! ইউর বাবাইয়ি।’
পিটপিট করে আশফি আদু গলায় ‘বাবাইয়িই’ বলে আকঁড়ে ধরে। আরভীক মনে মনে আওড়ায়।
‘তুমিও এভাবে আমার বুকে আছড়ে পড়বে প্রণয়োণী। অভিমান হয়েছে, তবুও এর প্রতিহার করার উপায়ন্তর আছে।’
দুষ্টু হাসি চওড়া হলো আরভীক এর মুখশ্রীতে। আশফিকে নিয়ে গাড়ির কাছে এসে দেখে তার প্রণয়োণী ঘুমিয়ে পড়েছে। সেও বিনা শব্দে বসে পড়ে ড্রাইভিং করতে। ইশ! পাশে বউ,কোলে ছেলে বাবু তিনজনে মিলে লংড্রাইভে হানিমুন করতে যাওয়ার মজাই আলাদা! ভেবেই ফিক করে হেসে দেয় আরভীক। ঘুমন্ত আনজুমা চোখ খুলতে গিয়েও খুলল না। প্রচন্ড ক্লান্ত সে। এক এক ঝড়ঝঞ্ঝার কারণে তার শরীর দূর্বল হয়ে পড়েছে। আরভীক গাড়ি চালু করে মোড় ঘুরিয়ে নেয়।
৪৬.
ফাহাদ জাফর সাহেবের ডকুমেন্ট তৈরি করছে গাড়িতে বসে! যেহেতু তিনি পুলিশ ডিপার্টমেন্টের এসি পদে সম্মানিত সেহেতু তার উপর লিগ্যাল এক্যাশন তৈরি বিহীন এনকাউন্টারের কোনো পথ নেই। অঞ্জয় গাড়ি এয়ারপোর্টের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। একরাতের মধ্যে বুকিং করা হয়েছে হংকং এর টিকেট! যেমনে ঝড়,বাদলের মিলান্তরে বৃষ্টি,বন্যার পরিক্রমণে সূর্য উকিঁ দেয় তেমনে তারাও পরিকল্পনামাফিক একরাতের মধ্যে কাম খাতাম করার উদ্যোগে রওনা হয়েছে। সায়াজ আনমনে বলে,
‘রাজিব কে কোথাও দেখলাম না সে কই গেছিল!’
সায়াজের প্রশ্নে অবাক সহিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ফাহাদরা। তাদেরও যেন মনের কোণায় রাজিবের ডেটা সম্পর্কে ঝড় তুলল। অঞ্জয় ভাবান্তর হলো কিঞ্চিৎ পূর্বের ঘটনায়।
পূর্বের ঘটনা….💥
আনজুমাকে লাল জরজেট স্লিভলেস শাড়ি পরিয়ে দাঁড় করানো হয়েছে ডিলার্সের সামনে। কিন্তু সে কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করে জাফরের কাঁধ থেকে ছুঁ মেরে চাদরটি নিয়ে নিজেকে চাদরে ঢেকে নেই। বে’য়াদ’বির কায়দা হওয়ায় গুটাকয়েক ডিলার্স নারাজ মনভাব পোষণ করে। আনজুমা পুতুলের ন্যায় ঢোক গিলে স্বাভাবিক দৃষ্টিকোণে ডিলার্সের দিকে নজর বুলায়। কিন্তু সরু কোণারে তার চোখ আটকে যায়। গোল চোখে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে কোণারে বসা পুরুষটার দিকে গভীর চাহনী নিক্ষেপ করে। তবে তার চাহনীকে পরিপূর্ণ লাজুকতায় ফেলে দেয় সেই পুরুষটি চোখ টিপুনি দিয়ে।
অঞ্জয় বসের ক্রিয়াকলাপ দেখে হামি দেয়। যা দৃষ্টিগোচর হলো। আরভীক চোখ রাঙিয়ে তাকায়। ফলে হামির বদলে কাশি চলে আসে অঞ্জয়ের। আরভীক বাঁকা হেসে আনজুমার দিকে তাকিয়ে উচ্চস্বরে আওড়ায়।
‘সি ইজ অনলি মাই গার্ল!’
কণ্ঠনালী শুনতে পেয়ে পরম নিশ্চিত হলো আনজুমা। এই তার আরভীক! কিন্তু ঘাবড়ে গেল তার বেশভূষা দেখে। আজও সে মাফিয়ার দৃষ্টপাতে এসেছে। হাতের হাতা ফোল্ড করা, শার্টের কলার তিন বোতাম অব্দি উম্মুক্ত, ফিটিং প্যান্ট, চুলগুলো একসাইডে এলোথেরাপি করে আচড়ানো, মুখের পানে লেগে আছে বাঁকা তিক্ষ্ণ হাসি, চোখজোড়ায় জ্বলছে যাওয়া আগুন থেকে তৈরিকৃত লাভার রক্তিম বর্ণ ফুটে উঠেছে! আনজুমা কিছু একটা মনে পড়তেই আনমনে বলে,
‘তার মানে যুদ্ধ হলো…।’
অসম্পূর্ণ কথার মাঝে জাফর সাহেবের শোরগোল শুনে থুতনী তুলে তাকায়। ডিলার্স যারা ছিল তাদের ছিঁটেফুটোও নেই। বরং রুমে শুধু তারাই আবদ্ধ। নজর বুলিয়ে দেখে ফাহাদ ডিলার্সদের এরেস্ট করে পুলিশ ফোর্সের গাড়িতে উঠিয়ে দিচ্ছে। অন্যত্রে রাজিবের কোলে ছোট আশফি খিলখিলিয়ে হেসে ‘বাবাইয়ে আততে,আততে’ বলে হাত তালি দেয়। আরভীক জাফরের সামনে গিয়ে বাঁহাত পকেটে গুজে,ডান হাতে পি’স্ত’ল নিয়ে সে নিজের কপালে ঠেকায়! গাম্ভীর্য ভরা গলায় শুধায়।
‘ওহ তুই না এককোটি টাকা চেয়েছিলি!’
জাফর আমতা আমতা করে পা পিছিয়ে নিতে থাকে। তার কদম যত পিছাচ্ছে আরভীক এর কদম তত এগোচ্ছে! আরভীক জবাব না পেয়ে একটানা বাক্যধারা বয়ান করে।
‘তুই কি ভেবেছিস খেলা শুধু তুই খেলতে পারিস! চারবছর আগে আমাকে মে’রে শান্তি পাস নাই দেখে আবারো পিছু লেগেছিস।’
হতভম্ব হয়ে যায় জাফর। বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে।
‘তু তুম তুমি কি স সসুয়াইব!’
‘মৃত মানুষকে তাহলে চিনতেই পেরেছেন আব্বাজান!’
‘আব্বাজান’ শব্দটি শুনে ধুক করে উঠে জাফরের হৃদপিন্ড! পরিশেষে তার যম সামনে এলোই। চোরাচুপে নিজেকে আড়াল করতে গিয়েও পারল না। কেননা ঘুরেফিরে মৃত্যুর মুখে চলে এসেছে! আমতা আমতা করে আরভীক এর দিকে করুণ চাহনী নিয়ে বলে,
‘বাবা মাফ করে দে আমাকে! আমি জানি যা কিছু হয়ছে খারাপ হয়ছে। কিন্তু দেখ তুই বেঁচে গেলি। আমার মূল্যায়ন অসফল হয়নি। তোকে ধাক্কা মারার পরও বেঁচে ফিরে…।’
তার কণ্ঠনালী থেকে বের হওয়া বাক্যগুলো আরভীক এর কাছে দহনকৃত অগ্নিকুণ্ড মনে হচ্ছিল। ফলে সে এক ঘু’ষি আ’চ’ড়ে দেয় জাফরের গন্ডদেশ বরাবর! র’ক্ত কফের সঙ্গে দল পাঁকিয়ে তার মুখ থেকে বের হলো। চারবছরের দীর্ঘ কোমার থেকে রেহাই পেয়েও স্মৃতিহীন বেঁচে ছিল মূর্তির মত! তার আরাজ নামক মহৎ মানবকে ড্যাডের নামে আখ্যায়িত করে সে গর্বিত! তার আফসোস নেই এই জাফর নামক খু’নী,অ’প’রাধীকে মেরে ফেললেও। স্মৃতিহীন থেকে যেদিন স্মৃতিশক্তি ফিরে পেলো সেদিন পণ করে ছিল! নির্দিষ্ট সময়ে শত্রুের উপর পাল্টা আক্রমণ করে বিক্ষোভ শোধ নেবে। সঙ্গ হিসেবে ছিল ফাহাদরা। কথাগুলো ভেবেই আরভীক অট্টহাসি দিয়ে উঠে। জাফরের সামনে চেয়ার এনে দেয় অঞ্জয়। আরভীক পায়ের উপর পা তুলে বসে। গালে হাত রেখে ব্যঙ্গ মুখশ্রীর ভাব নিয়ে বলে,
‘বল কু’ত্তে তোর কেমন শাস্তি খেতে মন চাইছে! সেরুপ শাস্তি দেব।’
ছোট আশফি তার বাবাইয়েকে দেখতে পেয়ে ‘বাবাইয়ি’ বলে নিম্ন কণ্ঠে ডাক দেয়। আরভীক ভ্রু কুঁচকে আশফির দিকে তাকায়। আশফি কোনো এক কারণে মুখ লুকিয়ে আছে রাজিবের বুকে। আরভীক সন্দেহের বশে তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে তার কাছে গিয়ে হেঁচকা টেনে আশফিকে কোলে নেয়। তার গাল ধরতে নিলে ‘আহ’ করে কেঁদে দেয় সে। আরভীক এর চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। আশফির ছোট নরম ডান গালে পাঁচ আঙুলের লাল ছাপ! যার ফলে হাতের সূক্ষ্ম ছোঁয়াও ব্যথাতুর লাগছে আশফির। আরভীক আশফির গালে ওষ্ঠ লাগিয়ে অঞ্জয়কে ফুসফুসানো গলায় শুধায়।
‘বরফ আন!’
অঞ্জয় মাথা নেড়ে তৎক্ষণাৎ গাড়ির কাছে গিয়ে ডিক্কি থেকে ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে দৌড়ে ভেতরে যায়। আরভীক এর সামনে ধরে। কথ্যহীন বরফ কাপড়ে পেঁচিয়ে আশফির গালে ধীরস্থির করে লাগায়! মাঝমধ্যে যন্ত্রণার কারণে ‘আহ আহ’ করে শব্দ বের করছে আশফি। ফুঁপিয়ে কাঁদছে! নিশব্দে আরভীক মৃদু হেসে আদুরীয় হাতে বরফ লাগিয়ে মুছে দেয়! ফাস্ট এইড বক্স থেকে অয়েনমেন্ট ক্রিম নিয়ে তার গালে মৃদু চাপে লাগিয়ে দেয়। সে ঢোক গিলে নাকের পানি,চোখের পানি মিলে জমানো সর্দি আরভীক এর শার্টে মুছে। ঠোঁট চেপে হাসি আঁটকে নেয় আরভীক। তার শার্টের উপর অংশ ভেজে জুবুথুবু হলো। তবুও তার মনে উগ্র মানসিকতা ফুটে উঠেনি। বরং ভালো লাগল তার। আশফির কথা বলতে ইচ্ছে করছে না বিধেয় সে তার বাবাইয়েকে জড়িয়ে ধরে। আরভীক জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে রাজিবকে বলে,
‘দেখ তুই আমার শা’লা লাগিস! আনজুমার নামাত্র ভাই। ফলে তোর দ্বারা আশফি উধাও হলো। সেটা জানিয়েছিস কিডনাপ করে তোর তদারকরে বলার পর! কিছু বললাম না। বউটারেও আমার হুঁশ আসার আগে উধাও করে নিলি। বাট নেভার মাইন্ড। সো নাউ আই সেয়ে, হু স্লেপেড মাই সান!’
রাজিব স্বাভাবিক আচরণকৃত আরভীককে দেখে ভীতিগ্রস্থ হলো! তবে তার তারিফ করতে মন চাইছে এ জনাবের প্রতি। একনজরে বুঝে গেল ছেলের কষ্ট। ইশ! বেচারা জাফরের প্রতিও মায়া হচ্ছে তার। আরভীক অধৈর্য কণ্ঠে আওড়ায়।
‘আমি কিছু জিজ্ঞেস কর…।’
রাজিব চোখ বুজে ‘জাফর মার’ছে’ বলে দেয়। আরভীক শুনে ঠোঁট পাঁকিয়ে বাঁহাত দিয়ে কপাল চুলকায়। অঞ্জয়কে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘অঞ্জয় যা তো গাড়ি থেকে প্লাস্টিকের বেল্টটা নিয়ে আয়।’
অঞ্জয় দ্বিরুক্তি করতে নিলে আরভীক এর রাগান্বিত মুখশ্রী দেখে ভয়ে শব্দহীন গাড়ির কাছে যায়। প্লাস্টিকের বেল্ট নিয়ে এলে আরভীক আশফিকে চেয়ারে বসায়। আনজুমা দৃশ্যপট কি থেকে কি হতে চলেছে বোঝার সাপেক্ষে এগোতে নিলে আরভীক আদেশের সুরে ফাহাদকে বলে,
‘ফাহাদ তোর ভাবীকে চেয়ারে বেঁধে দেয়।’
ফাহাদ থতমত খেল। আনজুমাও চটে এগোনোর পূর্বেই ফাহাদ ধরে টেনে চেয়ারে বসিয়ে হাত বেঁধে দেয়। আনজুমা নিরহ চোখের ইশারায় খুলতে বলে! কিন্তু দৃষ্টিনত করে ফাহাদ সামনে তাকায়। আরভীক বেল্ট তার কাঁধে পেঁচিয়ে আশফিকে কাঁধে আঁটকে নেয়। আশফি তার বাবাইয়ের কোলে হাওয়ার মত উড়ছে ভেবে হৈহুল্লোড় করে উঠে।
আরভীক আশফির হাসিমাখা মুখশ্রী দেখে ফিসফিসিয়ে বলে,
‘তোমার বাবাইয়ি আইরনম্যানের মত ডুসুম ডুসুম দেবে তুমি ভয় পেও না চ্যাম্প। চ্যাম্পস ডোন্টস বি স্ক্যারেড!’
আশফি মাথা নেড়ে সায় দিল। ব্যস ধুম চেয়ে শুরু হলো মা’ই’র দেওয়া। আরভীক পরপর মে’রে ক্ষত করে ফেলে জাফর ও লিয়াকতের শরীর। লা’ঠি,বে’ল্ট,গাছের ধারালো ডাল,দা দিয়ে পুরু শরীর র’ক্তা’ক্ত করে ফেলে। আশফি খু’নখারাবী দেখার সুযোগ পায়নি। ততক্ষণে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। কেননা পিঠে নেওয়ার পূর্বে কৌশলে আরভীক ঘুমের ইনঞ্জেকশন পুষ করে দেয় আশফির কাধে। বিধেয় র’ক্তা’ক্ত দেহদ্বয় দেখেনি ! তথাপি হাওয়ার প্রবল বেগে সে ঠান্ডা অনুভব করার সঙ্গে তার বাবাইয়ের উষ্ণতা পেয়ে শান্তির ঘুম ঘুমিয়ে যায়।
বিপরীতে পরিবেশ হাতের নাগাল এলে অঞ্জয় তার ম্যাডামকে আরভীকই সুয়াইব কথাটির স্বীকারোক্তি দেয়। তবে সেটার মধ্যে লুকানো অতীত তার অজানা হওয়ায় বলতে পারেনি! ব্যথিত মনে আনজুমা সকলের অগোচরে আরভীক এর নিকটস্থ হয়।
‘কি রে অঞ্জয় চল!’
ফাহাদের ডাকে ভাবনার ফোড়ন কাটে অঞ্জয়ের। তারা এয়ারপোর্টে চলে এসেছে। ড্রাইভার ব্যাগপত্র ইমিগ্রেশন অব্দি টেনে এনে দেয়। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে ভিআইপি লাইনের মাধ্যমে নিশ্বাসকৃত দুটি লাশকে প্লেনে উঠিয়ে নেয় তারা।
অঞ্জয়রা নিজ নিজ সিটে বসার পর কল পায় আরভীক এর। ফাহাদ অঞ্জয়ের ফোন রিসিভ করে লাউড স্পিকারে দেয়।
আরভীক এর গাড়ি সবেই বাসার রাস্তায় পৌঁছায়। সে ব্লুটুথের মাধ্যমে জিজ্ঞেস করে।
‘এভরিথিংক ফাইন!’
‘ইয়াহ্ ডুড তুই বল ভাবীর অবস্থা কেমন!’
‘বউপাখি নারাজ!’
‘স্বাভাবিক তোর কারণেই হলো।’
‘ঠেং না মেরে বল কতক্ষণ লাগবে!’
‘জাস্ট ওয়ান ডে!’
‘ওকে তোরা একদিনের কেস খতম করে আয় আর আমি একদিনের হানিমুন করে তোদের সুখবর জানানোর ব্যবস্থা করি।’
‘তুই শোধরাবি না শা’লা!’
‘আমার কি শোধরানোর কথা ছিল যে শোধরে সাধুবাবা সেজে নেবো!’
‘ডুড তোর সাধুগিরি ভালোই জানি আমরা। এসব বাদ দিয়ে বল রাজিব কই।’
‘রাজিব তার বউয়ের সঙ্গে লুতুপুতু করতে গেছে!’
‘আমাদের কেন কেসের মধ্যে ঠেলে দিলি!’
মিছামিছি রেগে বলে সায়াজ! আরভীক শুনে পাত্তাহীন বলে,
‘দেখ সামনের শুক্রবারে বেস্ট রিপোর্টার এওয়ার্ড দেওয়া হবে! সো কেসের মধ্যে ফোকার্স না করলে তোর এওয়ার্ড অন্যজন ছুঁ মেরে নিয়ে উড়াল দেবে।’
‘ছেলে আর কিছু পায় না হাতির পাদা একখান! খালি ইমোশনাল ব্লেকমেইল ধ্যাঁত।’
সায়াজ তার দুঃখী ভাব নিয়ে সিটে মাথা হেলিয়ে দেয়। বাকিরাও রেস্ট করবে বলে কল রেখে দেয়। আরভীক ঠোঁট কামড়ে আড়চোখে তার প্রণয়োণীর দিকে তাকায়। ঘুমন্ত নিষ্পাপ বউয়ের মুখে যুবতী রুপের আভা আহা! দেখেই তো মন চাইছে খেয়ে হজম করে নিতে। আরভীক তার ভেজা ওষ্ঠের ছোঁয়া মেখে দেয় আনজুমার গাল ও ওষ্ঠজোড়ায়। ঘুমন্ত আনজুমা ঘুমে কাঁদা হয়ে আছে। স্পর্শের আকস্মিক অনুভবে কেঁপে উঠে। পুনরায় ঘুমের মধ্যে স্বপ্নের ঘোরে হারিয়ে যায়। অন্যত্রে আরভীক মনে মনে সব সত্য ফাঁস করার দৃঢ় প্রকল্প নেয়।
পরিণয়ে যদি নতুন অধ্যায় শুরু হয় মন্দ কোথায় এতে!
চলবে…..