নেশাক্ত প্রণয়োণী পর্ব_২৫

0
874

#নেশাক্ত_প্রণয়োণী
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_২৩(লুকায়িত সত্য)

আশফিকে বুকের মাঝারে চেপে ভয়ে চুপছে আছে আনজুমা। মায়ের ভীতি চেহারা দেখে রীতিমত বিরক্ত আশফি। এতো কেউ ভয় পায় নাকি! তার মনমতে, বাবাইয়ের মত সুপারম্যান থাকলে ভয়ের কিছু থাকতেই পারে না। আনজুমা বারংবার জাফর সাহেব কে আজ্ঞা করছে ছেড়ে দিতে। কর্ণগোচরে নেইনি তিনি। বরঞ্চ নিউ ডিলার্সের কাছে মা-ছেলের ছবি তুলে শেয়ার করছে এবং দামধরে তৎপর হয়েছে। ঢোক গিলে আনজুমা করুণ চোখে রাজিবের দিকে তাকায়। সে শক্তমনে হাতমুঠো করে দাঁড়িয়ে আছে। পারলে এখনি সে জাফরের মুন্ড ঘা’ড় থেকে আলাদা করে দিতো! তবে এই মূল্যবান কাজ আরভীক এর। বিধেয় নিশ্চুপে সহে গেল। আনজুমার করুণ চাহনী তাকে দূর্বল করছে। কেননা সে মেয়েটাকে বোনের নজরে আদুরীয় মনে স্থান দিয়েছে। কেমনে সহ্য করবে বোনের করুণমাখা নজরখানি! আশফি থরথরে কাঁপতে থাকা তার মাম্মাকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে। কানের নিকটস্থ হয়ে ফিসফাস আদু কণ্ঠে শুধায়।

‘মাম্মা বাবাইয়ে বলতে আসতে, তুতি কেতোঁ না প্লিত !’

চমকিত নয়নে ছেলের দিকে তাকায় আনজুমা। সেই পুরুষ এসেছে তাদের জন্য! অথচ সে আঘাত করে সেই পুরুষের শরীর ক্ষয় করেছে। জাফর সাহেব ফোনের মধ্যে মেসেজের জোয়ার দেখে খুশিতে আপ্লুত হলো। রাজিবকে আগলে ধরে খুশির চটে বলে,

‘ঐ দেখ মেয়েটারে সবাই পছন্দ করছে। এরে ভিন্ন ভিন্ন লোকের কাছে বহু বার পাঠাব। ব্ল্যাকমানি জমা হবে প্রচুর। উফ! মেয়েটাকে কেন যে চার বছর আগে ছাড় দিলাম। আফসোস লাগছে! না ছাড়লে এতদিনে ব্ল্যাকমানির কোটিপতি হয়ে যেতাম। তবে মামুনি মাফ করিও তোমার জামাইকে খু’ন করার দায়ে।’

স্তদ্ধ,শিহরিত হলো আনজুমা। বিস্ফোরিত নেত্রপল্লবে জাফর সাহেবের দিকে পরখ করে। মেয়ের চাহনী বুঝতে পেরে আয়েশে তার পাশ ঘেঁষে বসে তিনি। দৃষ্টিকোণে লোলুপ,বিশ্রী নজরপাত আঁকড়ে তার মাথায় অস্পর্শিত হাত রাখে। ভীষণ চটে উঠে আনজুমা। প্রচন্ড ক্ষেপে ‘থুথু’ দেয় জাফর সাহেবের মুখে। চোয়াল শক্ত করে আনজুমার গালে চ’ড় লাগাতে নিলে রাজিব এসে থামিয়ে দেয়। চোখ দিয়ে কাঠিন্যতা প্রকাশ করে রুখে দেয়। জাফর সাহেব ভাবল, ডিলার্সের সামনে ক্ষতমুক্ত শরীরে হাজির করালে লাভবান বেশি হবে। অথচ চ’ড় যদি লাগাতো তবে রাজিব চুপ থাকতো না। তথাপি পাল্টা আ’ক্রম’ণে বুঝিয়ে দিতো মেয়েদের চ’ড়া’নোর শাস্তি কিরুপ! জাফর সাহেব রুমাল বের করে মুখ মুছে পুনরায় আনজুমার কোমরে হাত রেখে ঠেসে বসল। আশফি জাফর সাহেবের গালে আ’চ’ড় কেটে ‘ধুর ধুর’ করতে চাইছে। অতিষ্ঠ হয়ে তিনি আনজুমার পরিবর্তে আশফির গালে কপাট ক্ষেপে চ’ড় লাগায়। যন্ত্রণায় তার চোখ অশ্রুতে ভরে যায়। মায়ের বুকে মুখ গুজে গুঞ্জনময় কান্না শুরু করে। বন্দি রুমকে তার কান্নার সুর কাঁপিয়ে দিচ্ছে। সেও তিক্ষ্ণ ক্ষেপে ঠোঁট চেপে রাগী নয়নজুড়ে তাকায় জাফরের দিকে। তার রাগী চেহারাটা দেখে আনজুমা ও রাজিব অবাক! আনজুমা রাগের লক্ষণে ফুটে উঠা আশফির চেহারায় হুবুহু আরভীককে দেখতে পাচ্ছে অদ্ভুত মিলিত ক্রোধদ্বয়! রাজিবের মনেও এক ধারণা। পরক্ষণে মুচকি হেসে মনে মনে আওড়ায়, ‘আসলেই আরভীকের খু’ন তুমি।’
জাফর সাহেব কচি ছেলের ক্রোধ দেখে হাসি দেয়। কিন্তু বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না সেই হাসি। আশফি কান্নারত মুখ নিয়ে তার মাম্মায়ের পাশে অমার্জিত, বিশ্রী স্পর্শ দিয়ে বসে থাকা জাফর সাহেবের ফাঁক হয়ে থাকা দু’পায়ের মাঝে জোরসরো লা’থ দেয়। যেন কেউ ফুটবল মেরে মাঝখানে গোল করে দিল। জাফর সাহেব গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে পাশ ঘুরে ব্যথা কমানোর জন্য দুপায়ের মাঝে হাত চেপে ধরে। রাজিবের দমফাটা হাসি পাচ্ছে। আনজুমার মুখ ভীতু নয়নে হতচেতন হয়ে গেল। সরল হাসি দাম্ভিকতার ন্যায় দমিয়ে রাখেনি। জাফর সাহেব মা-ছেলের হাসি দেখে তিক্ত কণ্ঠে শুধায়।

‘কিছুক্ষণ পরে এ হাসি কান্নায় পরিণত হবে দেখে নিস তোরা!’

আনজুমা তাচ্ছিল্যের ন্যায় মুখ ভেটকায়। জাফর সাহেব তেঁতে উঠল। তিনি এসে আনজুমার গাল শক্ত করে চেপে ধরে বলে,

‘তোর কি ডরভয় নেই! আমাকে দেখে এতক্ষণ ভয়ে কাঁদছিলি এখন কেন হাসি পাচ্ছে। সার্কাস চলছে বুঝি।’

গালে যন্ত্রণা হলেও বাঁকা হেসে জিভে থাকা ঘামাক্ত কফ জাফর সাহেবের মুখে ছু’ড়ে দিয়ে বলে,

‘ডরভয় এখন তোর লাগবে। কারণ কান্না কে করবে সেটা দেখতেই পাচ্ছি!’

ক্ষোভিত দৃষ্টিতে জাফর সাহেব মদের কাঁচের বোতল নিয়ে মেঝের মধ্যে ছু’ড়ে দেয়। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান) বোতলের কাঁচ আনজুমার পাশ্ববর্তী স্থানজুড়ে ভাঙ্গায়, ছোট কাঁচের টুকরো স্পর্শ করে আ’চ’ড় কেটে দেয় তার কোমরে। আড়ালে রইল সেটি। জাফর সাহেব তেঁতো কণ্ঠে সাপের মত ফোঁস ফোঁসিয়ে বলে,

‘সুয়াইবের মত তার ছেলের স্বভাব হয়েছে। হাহ্ তাকে বড় করেছি নিজ হাতে। পুলিশ লাইনে এনে সম্মানের উচ্চস্থানে বসিয়েছি যে, তাকে যারা দেখতো চোখ নিচু করে দেখতো! ভয় নামক প্রশয়প্রাপ্ত মানবিকতা জম্মে ছিল মানুষের মধ্যে সুয়াইবকে নিয়ে। নামীদামী শহরের নামকরা পুলিশ অফিসার আহা! আমি যে তাকে সিংহাসনে বসিয়েছি কই এর মূল্য তো সে দেয়নি। বরং আমার কাজে ঠেং লাগিয়ে রুক্ষে দাড়িয়ে ছিল। ইশ! ফলাফল কি হলো মৃত্যু! চোখ বড় করে কি দেখস,এখনো বুঝিস নাই, হাহাহা। তোর জামাইকে এ নিজ হাতে মে’রে মাউন্টেন ব্রিজ থেকে খুদে ফেলেছি। দেখ, দেখ তোর জামাইয়ের খুনী দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু কপাল তোর! বর্তমান জামাইকেও হারিয়ে বসবি। ছাড় পেতি তোরা, কিন্তু সুদ হিসেবে টাকা দিল না তোর আরভীক জামাই! ঠিক সুয়াইবের মত পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুয়াইবকে কেমনে, কে কে মারছে জানস! দাঁড়া বলি!’

জাফর সাহেব উম্মাদের মত রুমের বাহির চলে যায়। রাজিব বাঁকা হেসে তার কলারের দিকে তাকায়। কলারে ক্ষুদ্র সিসিক্যামেরা ফিট করা। লাইভ টেলিকাস্ট হচ্ছে প্রতিটা কথা ও দৃশ্য! আনজুমার নেত্রপল্লবে অশ্রু জমে আঠা ভাব হয়ে গেল। অনুভূতিহীন মানবী। চারবছর আগে তার জ্ঞানমতে স্বামীর দূর্ঘটনার পথপার্শ্বে যে কত বড় রহস্য লুকিয়ে ছিল! আজ জানতে পারল সে! রহস্যের খোঁজ না লাগিয়ে বিধবা ভেবে জীবনযুদ্ধে নিজেকে কাঁদিয়েছে,রুক্ষে দাঁড়িয়েছে,সংগ্রাম করে গিয়েছে প্রতিমুহূর্ত। তৎক্ষণাৎ রুমের প্রবেশ করে জাফর সাহেবের সঙ্গে তার পরম বন্ধু লিয়াকত সাহেব। তিনি তাকে চোখের ইশারায় দেখিয়ে বলে,

‘এই তোর স্বামীর অজানা রক্তের চাচা লাগে। মানে সুয়াইব এতিম! তার বাবা-মা নেই। ছোট থেকে নিজেকে এতিমখানায় দেখে এসেছে। অথচ সে অবগত নয় তার সুদীর্ঘ রঙিন অতীত সম্পর্কে। তুই তো সুয়াইবের জীবনে নতুন প্রবেশ করলি। কিন্তু আমরা পূর্ব থেকেই ছিলাম। তফাৎ সে আমাদের সম্পর্কে জানতো না। সুয়াইব নেই,তাই অতীত তোকে শুনায়। এ হলো লিয়াকত মোবাশশের সুয়াইবের আপন চাচা। তার ভাই,ভাইয়ের বউকে এ নিজে দুনিয়া থেকে বিদায় করে ছিল। ছোট সুয়াইবকে দয়া দেখিয়ে এতিমখানায় ভর্তি করিয়ে দেয়। আমিও ভাবলাম সুয়াইব বড় হলে তাকে হাত করে নেবো। ঠিক জায়গায় নিশানা বানিয়েছি। একদিন গাড়ি নিয়ে তার সম্মুখে অসহায় নিথর দেহ নিয়ে পড়ে ছিলাম। সে এসে সহায়তার হাত বাড়ালে সেই হাত আমি লম্বা করে দেয়। পুলিশ লাইনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছাত্রকে ডিপুটি কমিশনার অফ পুলিশ বানিয়ে দিলাম। ভেবে ছিলাম লম্বা প্রতিদান দিলাম কিছু তো উপকৃত হবো। না তা হলো না! ঝাবাশ পুলিশ অফিসারের মত রুক্ষে দাঁড়িয়ে ছিল আমার পথে। ব্যস বুঝতে পারলাম তার হায়াত এটুকু! মৃত্যু অবধারিত। যে রাতে মাউন্টেন ব্রিজ থেকে আমার ব্ল্যাকমানি আসার কথা ছিল। ঐ রাতে সুয়াইবকে আমার এক লোক কথাটা ফাঁস করে দেয়। ফলে লোকটা মরণের দুয়ারে ঠেকে। ভেবেছিলাম চুপ থাকবে। কিন্তু না পরিকল্পনায় পরিপূর্ণ জল ঢেলে সে পুলিশ ফোর্সের নিকট খবর পাঠানোর জন্য উদ্যোগী হয়ে উঠল। আমার প্রাণ যায় যায় অবস্থা! তখন লিয়াকত ভাগ্যবশত তার নজরে পড়েনি। সে অন্ধকারে লুকিয়ে ছিল। ফলে পিছ থেকে এসে সজোরে লা’ঠি’চার্জ করে উঠে। আমিও সঙ্গ দেয়। এতদিনের মূল্যায়নের পর বেইমানি করার শাস্তি! তার পুরু শরীর জখমে ভরে ছিল। ম’রে গেছে ভাবছি তাও হলো না! কৈ মাছের মত ছটপটিয়ে উঠছিল। যার কারণে মেজাজ বিগড়ে গেল। ভয়াবহ মাছ,সাপ ভর্তি নদীর মধ্যে ধাক্কা দেয় সুয়াইবকে। ইশ! কি মায়া ছিল তার চোখে। এ এই হাত দিয়ে….।’

জাফর সাহেব আনজুমার নিকটস্থ হয়ে তার বৃদ্ধ হাতের রগরগা দেখিয়ে বলে,

‘যে হাতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত থেকে পুলিশ লাইনের কমিশন বানিয়েছি,ভালোবাসা দেখিয়েছি সেই হাত দিয়েই তাকে উচু স্থান নিচে ফেলে দিলাম। তার স্থানই ছিল আজম্ম নিচে। এই আমার পায়ের নিচে! তাকে আমি বাঁচিয়ে ফেলতাম। যদি আমার কাজে ঠেং না লাগতো। সে লাগিয়েছে ব্যস ম’র’তে হলো! ওহ সুয়াইবের আসল বাপ কে জানস! শুনলে শকড খাবি।’

শয়তানি চোখে সে লিয়াকতের দিকে তাকায়। রাজিবও প্রশ্নবিদ নয়নে চেয়ে আছে। লিয়াকত সাহেব মুচকি হাসছে। তিনি জাফরের কাঁধে হাত রেখে মুখোমুখি হলো আনজুমার। তার গাল চেপে ঠাট্টার সুরে বলে,

‘তার বাপ ছিল ইয়াসির মোক্তার। তিন ভাই ছিলাম আমরা। এক ইয়াসির, দুই আমি আর তিন…হুমম। তিন না হয় অজানা থাক! সব জেনে গেলেও বিপদ হতে পারে। আপাত জেনে রাখ যাদের চৌপাশে তুই আর তোর ছেলে ছিলি। তাদের মধ্যে কেউ একজন সুয়াইবের আপন চাচা লাগে। শুধু আমি আপন চাচা হয়েও যেন নয়। ভাতিজার কদর ততক্ষণ ছিল যতক্ষণ সে আমাদের মূল্যায়ন,সম্মান বুঝতো। কদর শেষ,মূল্যায়নও শেষ।’

আনজুমা কাঁপান্বিত সুরে জিজ্ঞেস করে।

‘আপ আপনাদের আরাজ আব্বু আর আরভীকের সঙ্গে কিসের শত্রুতামি! সব ঘিরে সুয়াইবের সঙ্গে শত্রুতামির রহস্য বোঝা আসলেও ফাওয়াজ পরিবারের সঙ্গে কি!’

কথাটি শুনে লিয়াকত সাহেবের চেহারায় টগবগে উত্তপ্ত রাগের ফুলকা ভেসে উঠল। জাফর সাহেব আড়চোখে বিষয়টি খেয়াল করে। তিনি ধমকে আনজুমার চুলের মুঠি চেপে ধরে।

‘বেশি কথা পছন্দ করি না। যতটুকু স্বেচ্ছায় বলার ছিল বললাম। বাকি মুখ বন্ধ। ঐ কইরে তোরা এদিক আয়। এ মেয়েরে সাজা। ডিলার্সের সামনে সুন্দর লাগতে হবে তো নাকি!’

তিনি আনজুমাকে ছেড়ে চোখ টিপ মেরে প্রস্থান নেয়। লিয়াকত সাহেবও বিনিময়ে কুৎসিত হাসি দিয়ে দরজা আঁটকে চলে যায়। পাহারা দেওয়ার জন্য রাজিবকে দরজার বাহিরে রেখে গেল। আশফি তাদের বলা প্রতিটা কথা না বুঝলেও তার পাপ্পার মৃত্যু যে খু’নে হয়েছে তা বুঝতে সক্ষম হয়েছে। মায়ের পেটে মুখ গুজে কান্নামাখা গলায় জিজ্ঞেস করে।

‘মাম্মা পাপ্পাকে তারা মে’লেছে!’

আনজুমা আশফিকে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে দেয়। বছরখানেক জমানো জলের স্রোত বয়ে দিতে থাকে। সে বিশ্বস্ত, আস্থা রেখে ছিল তার স্বামী অজানা কারণে দূর্ঘটনায় পড়েনী। নিশ্চয় কোন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল! হলো তেমনি চার বছরের লুকায়িত সত্যের স্বীকারোক্তি দিয়েছে জাফর সাহেব। সে তাদের মাফ করবে না! এই দুঃখী,অসহায় নারীর মন থেকে বদ’দোয়া বের হলো তাদের উপর। চোখ বুজে ক্ষোভিত শ্বাস নেয় আনজুমা। কখনো সে কারো ক্ষতি চাইনি। বরং ভালো চেয়েছে। আজ মন থেকে চাই এ পাপী’দের সাজা হোক! খুব কঠিন সাজা। আশফির মাথায় হাত বুলিয়ে অনুভব করে। ঘুমিয়ে পড়েছে সে। শুদ্ধভাবে বুকে টেনে ঘুমানোর স্থান করে দেয় আনজুমা। কান্নার কারণে ক্লান্ত প্রায় বাচ্চাটি। কখন না জানে কাজরত মেয়েরা এসে তাকে সাজায়! তখন ছেলের নিকটস্থ হওয়ার সুযোগ পাবে না। ভেবেই আগলে নেয় আশফিকে। মন বিশ্বাস করে আরভীক এসে হানা দিবে এ আস্তানায়! ছাড়িয়ে নেবে তাদের। পরন্তু এক কথা তার মাথায় ঘুরপাক খেল। জাফরের শেষাক্ত উক্তি দ্বারা কি বোঝায়! সুয়াইবের আপন চাচা তার চারপাশ জুড়েই আছে। কে হতে পারে!
তিনি এও বলেনি কিসের শত্রুতা ফাওয়াজ পরিবারের সঙ্গে! লিয়াকতের চোখে একরাশ হিংস্রতা,ক্রোধ দেখেছে আনজুমা। সাফ জাহির হয়, বড় কোনো ঘটনা নিশ্চয় লুকিয়ে আছে!
আকস্মিক বাহির থেকে শোরগোল শুনতে পেয়ে ঘাবড়ে গেল সে। আশফিকে নরম তুলতুলে জায়গায় শুয়ে জানালা অব্দি আসে। সরু জানালা দিয়ে আপসা দৃশ্য লক্ষগোচর হলো। কিছু বিদেশী,বাঙালি গুটাকয়েক লোক ময়দানে বস রইল। সবার হাতে একেকটা সুটকেস! অর্থ বুঝে নেয় আনজুমা। ভাবনার ফোড়ন কাটে রাজিবের আগমনে। ইতিপূর্বে পরিচিত হয়েছে বটে। কি’ড’নাপের সময় খুব ক্ষতপূর্ণ করেনি মানুষটি। বরং সাবেকে বলেছিল,
‘গাড়িতে উঠো! কিছু অজানা সত্য সন্ধানে তোমাকে বিপদের মুখোমুখি হতে হবে।’

ফলে বিপদ হলেও সত্য জানার তাগিদে বিপদের দুয়ারে প্রবেশ করে ফেলে সে।

‘নাও কথা বলো।’

রাজিবের দৃঢ় কণ্ঠে সূক্ষ্ম নয়নে হাতের দিকে দৃষ্টপাত করে। ফোনের স্ক্রিনে ‘শত্রু’ লিখা। কে এ শত্রু! ফোনটি নিয়ে কানে ধরে অপরপাশ্বে মুখ ঘুরিয়ে সরে দাঁড়ায়। রাজিব গিয়ে আশফির পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। তার বেশ পছন্দ হয়েছে আশফির বিহেভর! বাপের মত ঝাবাশ অফিসার বলে কথা। ফিক করে হেসে ফেলে আনমনে। পুনরায় স্বাভাবিক হলো। আড়চোখে আনজুমার কথন দেখে আনদেখা করে ফেলে।

৪৪.
‘বাইশ ক্যারেটের সোনার বউ জামাইয়ের আদর ছাড়া বেঁচে কেমনে আছো হে! একটু আদুরীয় সোহাগী হতে পারো তো নাকি!’

‘এ্যাঁ বাইশ ক্যারেটের সোনার বউ মানে কি!’

ভীষণ হিসকিসানো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে আনজুমা। সে বুঝেছে ফোনের অপরপাশ্বের ব্যক্তি তার পরম অপটু, শ্রীহীন স্বোয়ামী! আরভীক কলার সটান করে দুগালে হাত রেখে বলে,

‘নাউজুবিল্লাহ্ বউ তুমি দেখি সোনার ক্যারেটও বুঝো না! আহা কি সুখ আমার! অন্য জামাইয়ের বউরা ‘সোনা চাই,সোনা চাই’ বলে জামাইয়ের কান জ্বালাপালা করে দেয়। আর আমার বউ সোনার জায়গায় ‘বাসর করতে চাই, বাসর করতে চাই’ বলবে। ইশ! ভাবতেও কাতুকুতু,কাতুকুতু ফিলিং হচ্ছে!’

দুগালে মুখ আবৃত করে লাজুক হাসি দেয় আরভীক। অন্যত্রে আনজুমার শরীরে হিমশিমে বিব্রতকর অনুভূতি হচ্ছে! কান থেকে গরম লাভা বের হচ্ছে যেন। ক্যারেট বুঝে না, তাই বলে বাসরের সঙ্গে তুলনা করে ফেলবে এ বে’হা’য়া পুরুষ! কিঞ্চিৎ পরিমাণে ওষ্ঠদ্বয় কেঁপে উঠে তার। ফোন ডানহাতে শক্ত করে চেপে শরীরে জোড়ানো চাদরটি চেপে ধরে। তার মন-শরীরের মধ্যে উদগ্রীব উত্তেজনা তৈরি হচ্ছে! ইচ্ছে করছে মাটির নিচ ফাঁকা করে সেখানে ঢুকে পড়তে!
তবেই যদি বেশরমী কথাবার্তা থেকে বাঁচে!
আরভীক বউয়ের সাড়া না পেয়ে দুষ্টুমি হেসে বলে,

‘মাটির নিচ ফাঁকা করে লাভ নেই বউ! তোমার পিছু নিয়ে সেখানেও ঢুকে পড়ব।’

‘সিরিয়াস সময়েও আপনার চাষাড়েগিরি কমেনি।’

‘ওয়াট ইজ চাষাড়েগিড়ি!’

‘এতকিছু বুঝেন চাষাড়েগিরি বুঝেন না!’

‘অভিউয়াসলি নট! বউ মুখ থেকে নতুন শব্দ বের করলে জামাইয়ের বদহজম হবেই।’

‘গ্রামান্তরে অসভ্য ছেলেদের চাষাড়ে বলে।’

‘ওহ রিয়েলি আজ থেকেই প্লানিং করে নিলাম প্রতিরাতে শার্ট,প্যান্টের পরিবর্তে গেঞ্জি,লুঙ্গি পরে তোমার জন্য অপেক্ষা করব!’

ফাহাদ,সায়াজ ও অঞ্জয় থতমত খেয়ে তাকায় বন্ধুর মুখের দিকে। আরভীক পাত্তাহীন জানালার দিক তাকিয়ে বউয়ের মুখ স্মরণে নিয়ে কথাগুলো বলে। আনজুমা তেঁতে গেল। তিক্ষ্ণ সূচাঁলো কণ্ঠে শুধায়।

‘আপনাকে এক কথা বললে রেহাই পায় না কেন হে! একটা শব্দের সঙ্গেই বাসরের তুলনা করা ছাড়া আপনার আর কাম নেই।’

‘কাম আছে না তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ময়দানে এসে হাজির হবো।’

‘মানে!’

‘তোমার ওত মানে টানে জানতে হবে না। খালি আরভীক ভালোবাসি,ভালোবাসি বলবে। ব্যস তোমার জামাইয়ের শরীরে এভেঞ্জার আইরনম্যানের পাওয়ার চলে আসবে।’

নিশ্চুপে কর্ণপাত করে যায় আনজুমা। বিনিময়ে মনপ্রাণে চেয়ে রইল আরভীক এর আগমনের পথধারা। আনজুমার মনপরিস্থিতি বুঝতে সক্ষম সে। ফলস্বরুপ মজার ছলে হলেও শান্ত রাখতে চাইছে তাকে! অথচ দূর্বল শরীর আরভীক এর। কিন্তু দূর্বল মন-শরীরকেও সচল করে দেয় তার বউ ও ছোট আশফি!
সে দৃঢ় ফাজিল মিশ্রিত গলায় বলে,

‘উফ সোনা বউ আমার! পিছে পিছে এত কু’ত্তা’র লেজ ঘুরে যে তোমার সাথে শান্তিমত সময়ও কাটাতে পারি না। খালি ‘ঘেউ ঘেউ’ শুনে কান পেঁকে ক্ষয় হয়ে গেছে। আজ কসম খেয়ে আসছি, এক্করে গোল মেরে ময়দান খালি করব। তবেই তোমাকে গোলকিপারে নেবো। নাহলে চিপাগলির মধ্যে বস্তি বুক করে নেবো,সেখানেই সংসার পাতবো।’

জটিল কথা শুনার ইচ্ছে পোষণ করেনি আনজুমা। কট করে কলটা রেখে রাজিবের হাতে ফোন ধরিয়ে দেয়। ভেবাচ্যাকা খেয়ে যায় সে। ফোন নিয়ে সূক্ষ্ম নয়নে আনজুমার গুমড়ামুখো চেহারা দেখে বেরিয়ে যায়। রাজিব প্রস্থান নিলে ফিক করে হেসে দেয় আনজুমা। দম আঁটকে হাসি দমে রেখে ছিল। অথচ রাজিবের সামনে এমন ভান করল যেন সে অতিষ্ঠ প্রায়।
রাজিব রুমের বাহির গিয়ে পুনরায় কল দেয় আরভীককে। সেও ফোনের দিক অতীব আগ্রহদীপ্ত হয়ে তাকিয়ে ছিল!
কল পাওয়ায় জটপট ধরে ‘বউপাখি’ বলে ডেকে উঠে। রাজিব ঠোঁট কামড়ে হেসে বলে, ‘আফসোস আমি তোর শা’লা হয়!’

‘কি শা’লা বোনের রোমান্সে ঠেং নাড়ানো বাদে আর কিছু পারিস না!’

‘ভাই বি সিরিয়াসম্যান! গু’ন্ডা’পান্ডার মাঝে আসতে চলেছিস তাও এত মজায় আছিস কেমনে তুই।’

বুকভরা হামি দিয়ে আরভীক শুধায়।

‘তারা যদি গু’ন্ডাপান্ডা হয়, তবে আমি তাদের বাপদাদা লাগি।’

বাঁকা হেসে পায়ের উপর পা তুলে ট্র্যাকিং রোড দেখে নেয়। একঘণ্টার ভেতরে তারা তাদের যুদ্ধের ময়দানে হাজির হতে চলেছে। অঞ্জয় গাড়ির স্টেয়ারিং ধরে সুদীর্ঘ শ্বাস নেয়। দৃঢ়তার পণ নেয় তার বসের কোনো ক্ষতি হতে দেবে না সে! পারলে সে নিজে বিপদের মুখোমুখি হয়ে যাবে। ফাহাদ ও সায়াজের মনমানবিকে একে অপরের প্রতি স্পর্শকাতরতার বাণী আওড়াচ্ছে। অন্যথায় আরভীক চোখ বুজে মনে আওড়ায়।

‘ইয়া আল্লাহ্ সবাইকে রক্ষা করার তাওফিক দিও আমিন।’

_______

জাফর সাহেব তার এক গুপ্ত লোককে আড়ালে গিয়ে ফিসফিসিয়ে ফোনের মধ্যে বলে,

‘শোন আরাজ কে সামনে দেখলে গু’লি করে পালিয়ে যাস।’

লিয়াকত সাহেব শুনে শয়তানি হাসি দিল। সেও আনমনে জাফরের কান্ড দেখে বলে,

‘টাকা মানেই জীবন! ভালোবাসা আর যুদ্ধে যেমন সব জায়েজ। বন্ধুত্ব আর সম্পদের যুদ্ধেও সব জায়েজ। তুই শুধু আমার খেলার গুটিমাত্র জাফর! একবার তোর হাতে সবগুলোর খু’ন করিয়ে ফেলি। তবেই তোকে ফাঁসিয়ে নিজেকে রেহাই দিতে পারব। না হলে কতবছর আর গোলামি করে কাটাব। তুই যে ঋণ শোধ করছিস সেটাই তোকে পরিশেষে ফিরিয়ে দেব। আমি আবার কারো দেনাপাওনা রাখিনা বন্ধু।’

কুবুদ্ধি এঁটে জাফরের আড়াল থেকে কেটে পড়ে লিয়াকত সাহেব। তিনি গিয়ে ডিলার্সের সঙ্গে নিজের কাতির জমায়। কেননা জাফরের মৃত্যুর পর সেই হবে কালো টাকার বাদশা!
ফলে তদারকি শিখা উচিৎ বলে মনে করে সে। তাদের সঙ্গে কথা বলার মাঝে দৃষ্টিগোচর হলো! রাজিব শ্রেয়ার ছবির দিকে একমনে চেয়ে আছে। মন্দ লাগেনি ব্যাপারটা। বরং ভেবেই নিল রাজিবকে তার গোলামির খোরাক বানিয়ে নিবে এবং জাফরের মেয়ে শ্রেয়াকে নিজের চাহিদার খোরাক বানিয়ে নেবে। প্রতিরাতে কচিখুকির শরীর নিয়ে মাখোমাখো পিরিতে লুপে থাকবে! লিয়াকত মনের সানন্দে খিলখিলে উঠে।

‘কি রে বন্ধু কি ভাবছিস!’

জাফরের কণ্ঠে হকচক খেল লিয়াকত। আমতা আমতা করে বলে,

‘না চল ডিলার্স সব হাজির। মাইয়াটারে সামনে আনতে হইবো।’

‘অবশ্যই এর আগে মেয়েগুলো সাজিয়ে দিক তারে।’

লিয়াকত কথায় সায় দিয়ে ডিলার্সের সঙ্গে কুশল আলাপে ব্যস্ত হলো।
অন্যত্রে মেয়েরা এসে আনজুমাকে টেনে শাড়ি পরতে বাধ্য করছে। কিন্তু সে তার সিদ্ধান্তে অনড়! মেয়ে দুজন ভয়ে আছে। যদি তাদের মালিক জানে, যে তারা এক মেয়েকে সাজাতে অক্ষম! তবে চাকরী বাতিল করে দেবে। সে ভয়ে মেয়ে দুটো আনজুমাকে ছেলের ক্ষতি করার ভয় দেখায়। দুজন মিলে আশফির ঘাড়ে ও পেটের উপর দা রাখে। আতঁকে উঠে আনজুমা। ধারালো দা’ এর সূক্ষ্ম অংশে লাগলে আশফির নরম শরীর কেটে চুপছে যাবে। পরিণয়ে রাজি হলো আনজুমা। নাড়ীছেঁড়া ধনের ক্ষতি কোনো মায়েই চাইবে না! সে মায়েই তার নাড়ীছেঁড়া ধনের ক্ষতি চাইবে, যে দীনের আর্দশের পরিবর্তে দিনদুনিয়ার সম্বল পেয়ে অধম হয়েছে!

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here