আমি কাউকে বলিনি সে নাম
তামান্না জেনিফার
পর্ব ১৯
__________________________
আজ রূপার রেজাল্ট দিবে ৷ নয়নের অস্থির লাগছে , কেমন যেন ভয়ও লাগছে ৷ যদি রেজাল্ট খারাপ হয় আর রূপা উল্টাপাল্টা কিছু করে বসে ! আজকালকার দিনে রেজাল্ট খারাপ হলে ছেলেমেয়েরা নানান উল্টাপাল্টা কাজ করে ৷ তবে রূপাকে দেখে মনে হচ্ছে না তার কোন চিন্তা হচ্ছে ৷ সে দিব্বি একটা শাড়ি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে ৷ কচুপাতা রঙের শাড়ির সাথে লাল ব্লাউজ পরেছে রূপা ৷ লম্বা চুলের বেনী পিঠের উপর ৷ মেয়েটা অতি রূপবতীদের একজন নিঃসন্দেহে ৷ কিন্তু বুদ্ধিসুদ্ধি এত কম কেন কে জানে ! এই যে আজকে তার রেজাল্ট দিবে , একটু তো ভয় করা দরকার !
নয়ন ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি খেয়ে ফেলে ৷ টেনশনে আর তৃষ্ণা বাড়ে ৷ পানি খেতে খেতে পেটের মধ্যে কুয়া হয়ে যাচ্ছে অথচ তার পিপাসা মিটছে না , এ এক অদ্ভুত সমস্যা ৷
—ভাইজান দেখেন তো , আমার চোখে কি জানি পড়ছে ৷ চোখের মধ্যে খচখচ করতেছে …
—এদিকে আয়
রূপা নয়নের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ৷ নয়ন জলচৌকিতে বসা ৷ ওর চোখের দিকে তাঁকিয়ে নয়নের হঠাৎ মনে হয় পুরো পৃথিবীটা স্থবির হয়ে গেছে ৷ একটা সদ্য ফোঁটা পদ্ম যেন বসে আছে নয়নের পায়ের কাছে ৷ এমন অনুভূতি কখনই হয়নি ওর ৷ রূপার কাজল দেওয়া চোখ দুটোতে চুমু দিতে ইচ্ছে হচ্ছে খুব ! ভেতরটা যেন তিড়তিড় করে কাঁপছে ….. চোখে কিছুই ছিল না , তবুও খুঁজে ফেরে নয়ন ৷ তারপর ফুঁ দিয়ে দেয় …. হঠাৎ রূপার যেন খুব লজ্জা লাগে … এক দৌড়ে পালায় সে নয়নের সামনে থেকে ! আর নয়নের পায়ে যেন কোন শক্তিই নেই ৷ পা দুটো যেন পাথর হয়ে গেছে ! ওর খুব ইচ্ছে করছে দৌড়ে গিয়ে রূপাকে ধরে ফেলে , তারপর চুমুতে চুমুতে ভরে দেয় ওর চোখ দুটো… হয়তো তাতেই ওর তৃষ্ণা মিটবে … মাথায় দু’হাত চেপে শুয়ে পড়ে নয়ন ঐ জলচৌকিতেই ৷ মাথার ভেতরে হওনা অনুভূতিটা বড্ড অচেনা ! আবেশ কেটে যেতেই লজ্জা হতে থাকে নয়নের ! এসব কী ভেবেছে সে , রূপা যদি বুঝে ফেলে ব্যাপারটা ভীষণ লজ্জার হবে ৷
রান্নাঘরে ঢুকে হাফাচ্ছে রূপা ৷ আলেয়া বেগম পিঠা বানাচ্ছিলেন ৷ আজ নাদের মিয়ার নিপার বাড়ি যাবার কথা ৷ তার জন্যই পিঠা বানাতে বসেছেন তিনি অসময়ে ৷ তিন বছর হয়ে গেছে মেয়েটাকে দেখেননি ৷ এর মধ্যে তার স্বামী , নাদের , বেশ কয়েকবার ও বাড়ি গিয়েছে কিন্তু তার যাওয়া হয়নি ৷ এবার বোধহয় যেতে হবে ৷ মেয়েটার প্রসবের দিন ঘনিয়ে আসছে ৷ আজ নাদের মিয়াকে পাঠাচ্ছেন তিনি অনুমতি প্রার্থনা করতে , তারা যেন নিপাকে এ বাড়িতে পাঠায় ৷ প্রথম সন্তান মায়ের বাড়িতে হবে এটাই রীতি ৷ মা না থাক , তিনি তো আছেন , লাকী আছে ৷ আর যদি তারা রাজী না হয় একদম শেষ সময়ে তিনি নিজেই যাবেন ৷ পিঠা বানাতে বানাতে দুনিয়ার কথা মনে আসছে তার ৷ তার বিয়ের পর কোন পিঠাই তিনি বানাতে পারতেন না ৷ সব শিখেছেন বড় জায়ের কাছে ৷ এত পিঠা বানাতে যিনি জানতেন , তার মেয়েকে পিঠা বানিয়ে খাওয়াতে পারলেন না ৷
রূপাকে হাফাতে দেখে ভাবনার রেশ কেটে যায় আলেয়া বেগমের ৷ বিরক্তি নিয়ে রূপার দিকে তাঁকান ৷ মেয়েটা আজকেও শাড়ি পরেছে , সাজগোজও করেছে ৷ ইদানীং ঘন ঘনই সাজগোজ করছে ৷ এই বয়সে সাজগোজের দিকে মেয়েদের একটা ঝোক আসে , তারপরও সবকিছু নিয়ন্ত্রনে রাখা দরকার ৷
—এইরাম হাফাইতাছিস ক্যান !
—এমনেই , দৌড়াইয়া আসছি তাই ৷
—দৌড় ঝাপ একটু কমা ৷ দুইদিন পর শ্বশুরবাড়ি যাবি ৷ এমন দস্যিপনা ঐখানে করলে মান ইজ্জত আমাগোই যাইবো ৷
—বিয়া করতে আমার বয়েই গেছে
—মুখে মুখে তক্ক করবি না ৷ একখান কথাও মাটিত ফালাইতে দেয় না , খালি তক্ক ! তা এমুন সাজা গোজা শুরু করছিস ক্যান ?
—কই সাজছি ? খালি শাড়িখান পরছি ৷ আপনেই না কিনা দিছিলেন ! পরা হয়নি , ভাবলাম ভাজ ভাঙ্গি ৷ আইজ একখান বিশেষ দিন , আইজই পরি ৷
—বিশেষ দিন ?
—ভুইলা গেছেন না ! আইজ আমার রেজাল্ট দিবো ৷
আলেয়া বেগমের মন খারাপ হয় ৷ তিনি এত বড় কথাটা ভুলে গেছেন ৷ মেয়েটা মেধাবী , স্কুলের সব স্যাররা তার প্রশংসা করে ৷ সেবার রতনের কাণ্ডের পর রূপার পড়ালেখা বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন তিনি ৷ তখন স্কুলের হেডমাস্টার নিজে এসে অনুরোধ করে আবার স্কুলে নিয়ে গেছেন ৷ ও না কী স্কুলের গর্ব ৷ কিন্তু যত ভালো রেজাল্টই করুক , সেই তো চুলাই ঠেলতে হবে ৷ গ্রামে তো কলেজও নাই ভালো যে সেখানে ভর্তি করাবে ৷ যাও একটা নাম কা ওয়াস্তে কলেজ আছে , সারা বছর বন্ধই থাকে ৷ কলেজ আছে শিক্ষক নাই ৷ বেঞ্চ আছে ছাত্র ছাত্রী নাই ৷ যে ভালো রেজাল্ট কোন কাজেই লাগবে না সেই ভালো রেজাল্টের দাম কী ! একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে চুলায় পায়েশ বসান তিনি ৷ যতই হোক , লাভ থাকুক বা না থাকুক , মেয়েটার রেজাল্ট যদি সত্যি সত্যি ভালো হয় তাহলে মিষ্টিমুখ তো করাতে হবে …. মেয়েটা পায়েশ খুব ভালোবাসে , কিসমিস দেওয়া পায়েশ ৷ ঘরে কিসমিস নাই , রূপাকে চুলার কাছে বসিয়ে আলেয়া বেগম লাকীর কাছে যায় , ওর ঘরে থাকলে একটু কিসমিস আনবেন চেয়ে …
রেজাল্ট নেবার জন্য স্কুলে যেতে হয় না রূপাকে ৷ প্রধান শিক্ষক নিজেই মিস্টির হাড়ি সহ বাড়িতে উপস্থিত হন ৷ রূপা এ প্লাস পেয়েছে ৷ পুরো গ্রামের মধ্যে আর কেউ এমন রেজাল্ট করেনি ৷
নয়ন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না ৷ আজ যা কিছু হচ্ছে সব কী সত্যি সত্যি হচ্ছে ! না কী সে স্বপ্ন দেখছে ? একটু পরই ঘুম ভেঙ্গে যাবে না তো !
***********
আটমাসের বিশাল পেট যথাসম্ভব ঢেকেঢুকে ভাইয়ের সামনে এসে বসলো নিপা ৷ তার পুরো শরীরে পানি এসেছে ৷ আজকাল হাঁটতে তার খুব কষ্ট হয় ৷ সারাদিনে একটা কাজও করতে পারে না ঠিকমতো ৷ এজন্য তার শাশুড়ি খুব রাগ হয় মাঝে মাঝে ৷ নিপার মনে হয় সে এখনও এই বাড়িতে টিকে আছে শুধুমাত্র সুমাইয়ার জন্য ৷ ঢাল হয়ে সামনে না দাঁড়ালে এতদিনে সে ধুলিস্মাৎ হয়ে যেতো ৷
এক কথাতেই সম্মতি দিয়ে দিলেন নিপার শাশুড়ি ৷ সারাদিন বিছানায় পড়ে থাকে , একা একা নিজের কাজটাও করতে পারে না , এমন অকর্মা বউ ঘরে পুষে লাভ নেই ৷ এরচেয়ে ও বাড়িতেই যাক ৷ নাতী হলে একবারে বউ নাতী ফেরত আনবেন ৷
রাহেলা বেগমের দৃঢ় বিশ্বাস ছেলেই হবে ৷ এতদিন পর তার ঘরে প্রদীপ আসছে ৷ বিয়ের তিন বছর পর সন্তান আসছে ৷ সেই সন্তান তিনি ছেলে সন্তানই চান ৷ আকারে ইঙ্গিতে সেই কথা তিনি নিপাকে বারবার বুঝিয়েছেন ৷ ছেলের মায়ের সম্মান আর মেয়ের মায়ের সম্মানের পার্থক্য আছে তা তিনি বেশ গর্ব করেই বোঝান ৷
অবশ্য কী পার্থক্য তা নিপা বোঝে না ৷ ছেলের মা হয়েও এ বয়সে স্বামীর মার তিনি মাঝে মধ্যেই খান ৷ পুত্র সন্তান প্রসব তার লাঞ্চনা কমাতে পারেনি , তবুও তিনি পুত্র সন্তান চান ! অদ্ভুত !
বাবার বাড়ি যেতে পারার আনন্দেই নিপা আত্মহারা ৷ ঐ বাড়ির প্রতি তার একরাশ অভিমান জমে ছিল ৷ কিন্তু গর্ভধারনের পর থেকেই তার মায়ের জন্য মন ছটফট করে … আহারে গর্ভধারণের কষ্ট ! তার মাও তো একই কষ্ট করেছেন ৷ মাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে ৷ মা নাই তার কবরটা তো আছে ! নিপা মনে প্রাণে দোয়া করছিল ও বাড়ি থেকে কেউ আসুক , তাকে একটাবার সেখানে নিয়ে যাক…
মাতৃত্বের দুয়ারে দাঁড়ালেই বোঝা যায় মা মানে কী !
চলবে—