আমি কাউকে বলিনি সে নাম তামান্না জেনিফার পর্ব ২১+২২

আমি কাউকে বলিনি সে নাম
তামান্না জেনিফার
পর্ব ২১+২২
__________________________

২১.

শীতকালে সচরাচর বৃষ্টি তেমন হয় না ৷ তবে হঠাৎ হঠাৎ আকাশের মর্জি হলে বিনা নোটিশে একটু দেখা দিয়ে যায় ৷ আজ সকাল থেকে একটু থেমে থেমে বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে ৷ বৃষ্টির সাথে পাল্লা দিয়ে নামছে শীত ৷ প্রচণ্ড শীতে সবার কঠিন অবস্থা ৷ বারান্দায় একটুখানি খড় পাতা দিয়ে আগুন জ্বালানো হয়েছে একটুখানি উষ্ণতার আশায় ৷ তবে উত্তর দক্ষিণে বওয়া এলোমেলো হাওয়ায় আগুন নিভে যাচ্ছে বারবার ! ধোঁয়ায় ঘরের ভেতরে থাকা নয়ন বিরক্ত হয়ে বারান্দায় চলে এলো ৷ এসে বকা দেবার আগেই তার মা বললো “ঘরের ভিত্রে বইয়া বইয়া কী করিস ? আগুনের কাছে বস ৷ ” নয়নের বলতে ইচ্ছে করে “আগুন কই ! ধোঁয়ার কাছে বসতে বলো তার চেয়ে ৷ ” কিন্তু নয়ন কিছু বলে না ৷ বারান্দায় রাখা চৌকিতে বসে আনমনেই ৷ কিছুই ভালো লাগছে না তার ৷ মাথার মধ্যে সারাক্ষণ রূপা ঘুরছে … ও কেন এসেছিল অত রাতে ? এই প্রশ্নটা মাথায় নিয়ে ঘুরতে খুব কষ্ট হচ্ছে তার , একটা প্রশ্নের ভার অনেক বেশি ! কিন্তু জিজ্ঞেস করার উপায় নেই ৷ সারাদিন পালিয়ে বেড়াচ্ছে রূপা , সামনাসামনি হলেও চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে ৷ ওর ফিরিয়ে নেওয়া দৃষ্টিটা যে নয়নের বুকে শেলের মতো বিঁধছে , তা কী ও বোঝে না ! মায়ের পাশেই বসে আছে রূপা ৷ গাঢ় সবুজ আর নিয়ন সবুজে মেশানো সালোয়ার কামিজে কী অপূর্বই না লাগছে তাকে ৷ মাথায় ওড়না দিয়ে ঘোমটা দিয়ে রেখেছে , মনে হচ্ছে যেন সদ্য জন্মানো কচি সবুজ পাতা সে নিজে ! আচ্ছা মেয়েটার কী সবুজ রঙ বেশি পছন্দ ? সবুজে কী আর কাউকে এতটা মানায় !

“এইবার বুড়া মরণ শীত নামছে … গাঁয়ের বুড়াবুড়িগুলা এই শীতে টিকবো না মন কয় ! ”

মায়ের কথায় ভাবনার জাল কেটে যায় ৷ কিন্তু পর মুহূর্তেই আবার ভাবনাটা আসে … রূপার ভাবনা , রূপাকে নিয়ে ভাবতেও কী যে ভালো লাগছে ! এই অনুভূতিটার নাম কী তাহলে প্রেম ? মনে মনে ফন্দি আঁটে নয়ন ৷ রূপাকে একটু একলা পাবার ফন্দি …

—চাউল আর ডাল ভাজা খাইতে মন চাইতেছে মা ৷ লবন মরিচ দিয়া ঝাল ঝাল কইরা মাখা … এমন দিনে এইসব না খাইলে জমে না

—রূপা যা তো , চুলা ধরা ৷ কয়ডা চালে ডালে ভাইজা ফেল ৷ আমি পরে মাইখা দিমুনে

—অয় পারবো ! চাউলের ভিত্রে ফুটবো না ৷ থাক বাদ দেও , আরেকদিন খামুনে ৷

অগত্যা ছেলের আবদার মেটাতে গায়ের চাদরটা ভালো মতো জড়িয়ে রান্নাঘরে যান আলেয়া বেগম ৷ উঠানটা পিচ্ছিল হয়ে আছে , আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে রান্নাঘরে চলে যান তিনি ৷ রূপাও চাচীর পিছু পিছু যাচ্ছিলো , ওর হাতটা খপ করে ধরে তাকে আটকে দেয় নয়ন ৷

—কই যাস ? এইখানে বস , তোর লগে কথা আছে

—চাচীরে একটু সাহায্য কইরা আসি , আপনের কথা পরে শুনুমনে নয়ন ভাই …

—না , মায়ের সাহায্য লাগবো না ৷ তুই বস ৷

রূপার ভেতরে ঝড় বয়ে যাচ্ছে ৷ হৃদপিন্ডটা এত জোরে ধ্বকধ্বক করছে যেন পুরো গ্রাম তা শুনে ফেলবে এখনই …. সকাল থেকেই পালিয়ে বেড়াচ্ছিল সে , শেষ রক্ষা হলো না আর ৷

—রাইতে আমার জানালায় ক্যান আইছিলি রূপা ?

—ভুল হইছে , আর যামু না

—একশ বার আইবি , কিন্তু আগে ক ক্যান আইছিলি ?

—এমনেই ঘুম ধরতেছিল না তাই বাইর হইছিলাম ৷ আপনের জানলা খোলা দেইখা উঁকি দিছি ৷

—আর কিছু না !

—আর কিছু না …

রূপার হাত ছেড়ে দেয় নয়ন ৷ তার প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে ৷ রূপা এমনিতেই এসেছিল , তার মনে তার মানে কিছুই নেই ! না কী সে মিথ্যা বলছে ? মিথ্যা বললেও কেন বলছে ! চাদর ফেলে বৃষ্টির ফোঁটা মাথায় নিয়ে হনহনিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায় সে ….

আলেয়া বেগম চাল ডাল ভাজা মাখা এনে দেখেন তার ছেলে বাড়িতে নেই ৷ রূপাকে প্রশ্ন করলেও উত্তর মেলে না ৷ চৌকির উপর চালডাল ভাজা পড়ে পড়ে নেতিয়ে যায় , নয়ন তবু ফেরে না !

সন্ধ্যে নেমে গেছে ৷ নয়ন বসে আছে তার বড় চাচীর কবরের পাশে ৷ কবরের পাশে একটা পাগল ধরনের শিউলি গাছ আছে ৷ শীতের মধ্যেও যে ফুল ফুঁটিয়ে যায় ৷ খুব অল্প ধরলেও একটা কথা ছিল , গাছ ভর্তি হয়ে গেছে ফুলে ৷ প্রকৃতির একটা অংশের মনে হয় নিয়ম ভাঙাতেই সুখ ৷ কিছু কোকিল থাকে যারা বসন্ত ছাড়াও অন্য ঋতুতে কুউউ কুউউ ডাকে , কিছু ফুল নিয়ম ভেঙে অন্য ঋতুতে ফুঁটে যায় ৷ নিয়ম ভেঙে তারা যেন দেখাতে চায় তাদের পাগলামি , দেখাতে চায় মুক্তির সুখ , ইচ্ছা পূরণের আদিখ্যেতা ….

নিচে পড়ে থাকা শিউলিগুলো হাতের মুঠোয় জমিয়ে নয়ন বাড়ির দিকে রওনা হয় ৷ তার রাগটা পড়ে গেছে , রাখতে চাইলেও রাখা যাচ্ছে না ৷ অবশ্য সে এতক্ষন বসে বসে অপেক্ষা করছিল রূপা বোধহয় আসবে ৷ কিন্তু সে পাষাণী এলো না ! মেয়েদের মনের মতোন শক্ত বোধহয় আর কিছু নাই ৷ নয়নের ভিতরে হওয়া তুফান কী সে আঁচ করতে পারছে না ? ঠিকই পারছে , কিন্তু কিছু বলছে না … নয়নকে জ্বলতে দেখেই হয়তো ওর সুখ হচ্ছে ! হোক , তাতেও রাগ নেই নয়নের ৷ এই মেয়েটার উপর অভিমান রাখা যাচ্ছে না ৷ মেয়েটা অভিমানকেও তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিচ্ছে… ওকে শুধু ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে, বুকের মধ্যে শক্ত করে জড়িয়ে রাখতে ইচ্ছে করছে ! একটা শক্ত করে যেন পাজরের হাড় ভেঙ্গে হৃদপিন্ডে গিয়ে মেশে ওর শরীরটা …. মেয়েটাকে ভালোবাসতে বাসতে নিঃস্ব হতে ইচ্ছে করছে ! একবার ওকে মনে ভরে আদর করতে ইচ্ছে হচ্ছে … এরপর যদি মৃত্যুও আসে , সেও বোধহয় সুখেরই হবে !

দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল রূপা ৷ ওর হাতের মুঠোয় শিউলিগুলো ভরে দিয়ে সোজা নিজের ঘরে চলে যায় নয়ন ৷ ওর মুখের দিকেও তাঁকায় না ৷ ওর মুখের দিকে তাঁকালে নিজেকে যে আঁটকে রাখতে পারবে না সে , এ সত্য এখন নয়নের জানা হয়ে গেছে ৷

২২.

বিছানায় শুয়ে ছটফট করছে রূপা ৷ একবার মনে হলো লেপে কভার লাগানো হয়নি তাই বোধহয় আরাম লাগছে না ৷ সেই রাত্রে উঠে সে বসে বসে লেপের কভার লাগালো ৷ তারপরও মনে হচ্ছে কেমন একটা অস্বস্তি ! ভাবলো বিছানা হয়তো ঠিকমতো ঝাড়ু দেওয়া হয়নি ৷ আবার নেমে বিছানাটা ঝেড়ে ঝুড়ে টানটান করে চাদর পেতে শুয়ে পড়লো ! লাভের লাভ কিছু হলো না ৷ কিছুই যেন আরামদায়ক লাগছে না ৷ রূপা আবার উঠে বিছানা থেকে ৷ নিজেই নিজেকে বোঝায় “ঘরের বাইরে যাবো না কিছুতেই ” …. কিন্তু একটা কিশোরী হৃদয় যা প্রতিনিয়ত প্রেমের জলে ডুবে মরে যাচ্ছে তাকে কী বশে আনা এতই সহজ !

নিজের মনের শাসন বারণ না শুনে রূপা দরজা খুলে ফেলে শব্দ না করে ৷ রূপার ঘর আর নয়নের ঘর সামনাসামনি ৷ মাঝখানে উঠান ৷ এই ঘরের সামনেও একটা বারান্দা ঐ ঘরের সামনেও বারান্দা ৷ উঠানের মাঝখানে একটা লিচু গাছ , গাছের গোড়াটা শান বাঁধানো ৷ বারান্দায় দাঁড়াতেই রূপা দেখলো সেই গাছের গোড়ায় বসে আছে নয়ন ৷ হাতে সিগারেট , গায়ে শীত নিবারনের মতো কোন বস্ত্র নেই ৷ নয়ন যে সিগারেট খায় সেটা রূপা জানতো না , কখনোই দেখেনি ৷ আজকে এই দৃশ্য দেখে ভীষণ রাগ হয় তার ৷ তার সামনে যাবে না এটা যে সে ভেবে রেখেছিলো , নিমেষেই তা ভুলে যায় …. গটগট করে তার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে

—সিগারেট খাইতাছেন ক্যান ? সিগারেট খাইলে ক্যান্সার হয় জানেন না ! এত লেখাপড়া শিইখা তাইলে লাভ কী হলো !

—আমার ক্যান্সার হইলে তোর কী ! হোক ক্যান্সার , মইরা যাই আমি ৷

নয়ন সিগারেটে আরেকটা লম্বা টান দেয় ৷ রূপা নয়নের ঠোঁট থেকে সিগারেটটা ছুড়তে ছুড়তে বলে

—কইছি না খাওয়া যাইবো না !

—তুই কইলেই শুনতে হইবো !

—হ , শুনবেন ৷ আমার সব কথাই শুনবেন ৷

—ক্যান ?

—কারণ …. কারণ কিছু না ৷ আমি বলছি তাই ..

নয়ন হঠাৎ দাঁড়িয়ে রূপাকে জড়িয়ে ধরে চুমু দেয় ওর ঠোঁটে …. তিড়তিড় করে কেঁপে উঠে রূপা ৷ ওর মনে হয় ভূমিকম্প হচ্ছে , পূরো পৃথিবীটা দুলছে ! পুরো শরীরের লোমকূপে চলছে বিদ্রোহ ! নোনতা স্বাদে দুলে উঠছে অন্দরমহল , সিগারেটের গন্ধটাও যেন শিউলির সুবাস মনে হচ্ছে … আবেশে ওর চোখ বন্ধ হয়ে আসে মুহূর্তেই !

রূপার ঠোঁট ছেড়ে ওর মুখটা হাত দিয়ে তুলে সে বলে

—এবার বল আমি মরে গেলে তোর কী !

—আপনি মরে গেলে আমিও বাঁচবো না …

—ক্যান ? ক্যান বাঁচবি না বল … বলতেই হবে তোকে ! ছাড়বো না আমি … আমি যে ভেতরে ভেতরে মরে যাচ্ছি তা কী তুই দেখিস না ? বল .. বলতেই হবে !

—কারণ … কারণ … আমি আপনাকে ভালোবাসি নয়ন ভাই …

এবার রূপাকে একটানে বুকের মধ্যেনিয়ে নেয় নয়ন ৷ শক্ত করে ওকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে বলে “ভালোবাসিও বলিস আবার নয়ন ভাইও বলিস তাইলে কেমনে হয় ! ”

রূপা এবার নয়নকে ধাক্কা দিয়ে ওর বাহুডোর থেকে মুক্ত হয়ে এক ছুটে নিজের ঘরে গিয়ে পালায় ৷ আজকে যা কিছু হলো সবটাই বোধহয় স্বপ্ন … নিজের ঠোঁটে আনমনে হাত দেয় রূপা , আবার মনে পড়ে যায় সেই মুহূর্তটা ! এটা কী স্বপ্ন ছিল ! স্বপ্ন হলে এমন মধুর স্বপ্ন সে বারবার দেখতে চায় ….

নয়নের নিজেকে এখন খুব হালকা লাগছে ৷ পাষাণী নিজের মুখেই স্বীকার করেছে সে তাকে ভালোবাসে , এই মুহূর্তে তার মতো সুখী আর কেউ নাই এই পৃথিবীতে ! কিন্তু পরক্ষনেই মনটা খারাপ হয়ে যায় তার ৷ ঢাকায় ফেরার দিন ঘনিয়ে আসছে … রূপাকে রেখে এবার সে ফিরবে কীভাবে !

*************

—চাচী , ও চাচী দরজা খুলেন , ও চাচী দরজা খুলেন !

দরজায় জোরে জোরে ধাক্কানোর শব্দে ঘুম ভেঙে যায় রূপার ৷ চাচীর ঘর আর তার ঘর পাশাপাশি ৷ সে দরজা খুলে দেখে লাকী ভাবি এসে দরজা ধাক্কাচ্ছে , তার চোখে মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট ৷ চারদিকে আজান দিচ্ছে … রূপা কোন কারণ না জেনেই নিজেও চাচীর দরজায় ধাক্কানো শুরু করে ৷

দরজা খুলে লাকী আর রূপাকে দেখে আলেয়া বেগম হকচকিয়ে যান ৷ মনে মনে “লা ইলাহা ইন্না আন্তা সোবহানাকা ইন্নী কুন্তু মিনাজ জোয়ালেমিন ” পড়ে লাকীকে জিজ্ঞেস করেন

—কী হইছে বউ ? এই ভোররাত্রে এইখানে তুমি ?

—চাচী তাত্তাড়ি চলেন , নিপার বেদনা উঠছে ৷ পানি ভাঙছে , রক্ত আইতাছে ! আমার ডর করতাছে চাচী !

—কমলা ধাইয়ানিরে ডাকতে পাঠাইছো ?

—হ , আপনের ভাতিজা গেছে ৷ আপনে চলেন চাচী , আমার ভয় লাগতাছে ! নিপার সতীনে খুব কানতাছে চাচী ..

আলেয়া বেগম দোয়া ইউনূস পড়তে পড়তে তার সাথে রওনা হন … রূপাও পিছু পিছু ছোটে ৷ সোরগোলে নয়নও জেগে গেছে ৷ সে বলে উঠে “ধাইরে না ডাইকা আপারে হাসপাতালে নেওনেরূ ব্যবস্থা করো ৷ আমি যাই ভ্যান জোগার কইরা আনি ৷”

নয়ন ছোটে ভ্যানের খোঁজে ৷

কমলা ধাই চলে আসে কিছুক্ষনের মধ্যেই ৷ হাত দিয়ে পরীক্ষা করে বিরস মুখে আলেয়ার সামনে এসে বলেন ” বাচ্চার পাও নিচে মাথা উপ্রে ভাবীসাব ৷ আমি পারমু না ৷ চেষ্টা করলে ক্ষতি হইতে পারে ৷ এরচেয়ে কমুনিটি কিলিনিকে নিয়া যান ৷ আমার কাছে ওইখানের নার্সের নাম্বার আছে , তয় নাম্বার বাড়িত ৷ ওই নাম্বারে কল দিয়া কইলেই নার্সে চইলা আসবে , কাছেই বাড়ি …”

ভ্যানে করে সেই কমিউনিটি ক্লিনিকে যাবার পর নার্স পরীক্ষা করে দেখে বললেন , “এইখানে সম্ভব না , পেট কাটন লাগবো ৷ তারে শহরে নেবার ব্যবস্থা করেন , রক্ত জোগার করেন …যে হারে রক্ত যাইতাছে ! ”

শহরে যাবার প্রথম বাসটা বেলা আটটায় …নয়নের মনে হয় এতক্ষন তার বোনটা বাঁচবে তো !

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here