প্রেমের_ভেলা পর্ব ৫

0
3885

প্রেমের_ভেলা
পর্ব ৫
লেখায়- #Anjum_tuli
.
.
আমি কতটা নির্বোধ ঠিক কতটা তা আমি চিন্তা করলাম। যেই কিশোরী বয়সে শুদ্ধ ভাইয়ের প্রেমে পরেছিলাম ঠিক সেই সময়টাতেই আন্টি মুগ্ধ ভাইয়ের জন্য বিয়ের প্রপোজাল নিয়ে এসেছিলো। কথাটা আমার মাথায় ঠিক কি কারণে স্থান পায়নি ভাবতেই অবাক লাগে।

আন্টির বলা কথাটা শুনার পর আর স্থির থাকতে পারছিলাম না। অসুস্থতার বাহানায় কেটে পরেছিলাম। কিন্তু রেহাই পাই নি। আন্টি চলে যাওয়ার পর বাবা মা আমাকে এ নিয়ে আর কিছু বলেনি। আমি জানতাম বাবা অপেক্ষায় আছে আমি কিছু বলার।

পরেরদিন বাবাকে শুধু এইটুক বললাম যে, ‘বাবা তুমি কিন্তু আমায় কথা দিয়েছিলে’

বাবা আমতা আমতা করে বললেন, ‘ইয়ে মানে আমিও তো ভাবীকে কথা দিয়ে ফেলেছিলাম রে। তোর মা আর আমি অনেক বুঝালাম কিন্তু উনি মানতে নারাজ। উনার এক কথা উনি তোকে নিজের মেয়ে করে রাখবে। আর পড়াশুনার ব্যাপারে…’

বাবাকে আর বলতে না দিয়েই শুধু করুন মুখে বললাম, ‘বাবা..’

এতেই কাজ হলো আমার বাবার মুখেও চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটলো। মা এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
‘এত কিসের চিন্তা মা। তোর আন্টিকে তো তুই চিনিসই মা। তোকে নিজের মেয়ের মত করে রাখবে’

আমি তো সবই জানি। আর আমিত আন্টির কাছেই যেতে চাই। কিন্তু মুগ্ধ না শুদ্ধর বউ হয়ে। একথাটা মা কিভাবে বুঝবে! উপরে তাকিয়ে দেখলাম ফ্যান ঘুরতেছে। এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলাম।ফ্যানের মতই আমার মাথাটাও ঘুরতে লাগলো। প্রবল বেগে ঘুরতে লাগলো। চোখে ঝাপসা দেখতে লাগলাম। হাতরে মা’কে ছুয়ে বললাম, ‘মা আমার মাথাটা ঘুরতেছে মা, আমি মনে হয় বেশিদিন বাচবো মা।’

আমার বলতে দেরী হয়নি বাবা দৌড়ে আমার মাথায় হাত রেখে বলতে দেরী হয় নি, ‘থাক থাক এখন বিয়ে দিবো না আমার মেয়েকে। তোর মাথা আর ঘুরবে না’

অনেক কষ্টে সেদিন হাসিটা আটকে রেখেছিলাম। যা মনে হলেই দম ফাটানো হাসি আসে। আমার কিন্তু সেদিন সত্যিই মাথা ঘুরছিলো তবে তা সহনীয়। ইস! আমার মা বাবাটা এত ভালো কেনো!
আচ্ছা আমি যখন শুদ্ধ ভাইয়াকে এই কাহিনী গুলো বলবো তখন উনার রিয়েকশন কেমন হবে!

রাতে বেশ ভালো ঘুম হলো। এই বিয়ের ঝামেলা থেকে মুক্ত। কিন্তু কিভাবে শুদ্ধ ভাইয়ের সাথে দেখা করবো তা ভাবতে লাগলাম। এক দিকে গতি করার চিন্তা অন্য দিকে বিরাট আকারের এক দুশচিন্তার উকি দিলো। ‘আচ্চা বাবা যদি আন্টিকে বিয়ের জন্য মানা করে তাহলে… তাহলে কি আন্টি আর শুদ্ধ ভাইয়ের সাথে আমাকে মেনে নেবেন?’
বিরাট আকারের এক চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগলো। না না কিছুতেই বসে থাকার উপায় নেই। ভাবতে হবে…

আমার মোটা মাথায় চিকন সুতোর এক বুদ্ধি সেদিন উকি দিয়েই দিয়েছিলো। এক মিনিট সময় ব্যয় না করেই বাবাকে ফোন দিয়ে বলেফেলেছিলাম, ‘বাবা আমি এই বিয়েতে রাজি। তুমি আন্টিকে এই নিয়ে আর কিছু বলো না।’

বাবা আমার কথা শুনে বেশ অবাক হলেও খুশি হয়েছিলেন। সারাদিন গুণগুণ করে গান গাইলাম। আহহা শুদ্ধ ভাই আর কত অপেক্ষা করাবেন আমাকে! হু? মে আরাহাহু।

আমার পাগলামুপনা গুলো যেনো হুট করেই আবার সেই কিশোরী বয়সে ফিরে গিয়েছিলো। কারণতো সেই একটাই শুদ্ধ ভাই। আমি তখনও জানতাম না আমার জন্য শুদ্ধ ভাইয়ের মনে কোনো অনুভূতি আছে কিনা! অথবা কখনো কোনো অনুভূতির সৃষ্টি হবে কিনা। আমি কেবল নিজের ভালোবাসা পাওয়ার আকাঙ্খায় পাগল ছিলাম।

একদিন আন্টির ফোন এলো মুগ্ধ ভাই আসছেন। আমি যদি উনাকে রিসিভ করতে যাই তাহলে অবাকের সাথে খুশি হবেন। সাথে বাবা মাকেও ইনভাইট করলেন। এই সুযোগটা আমি কিছুতেই হাতছাড়া করলাম না। উপলক্ষ্য মুগ্ধ হলেও উদ্দেশ্য শুদ্ধ ছিলো আমার। তাই তো সেজেগুজে তৈরী হয়ে নিলাম। কিন্তু মাথামোটা আমি জানতামই না শুদ্ধ ভাইয়ের ঠিক কোন রঙটা পছন্দের। আন্দাজে ঢিল ছুড়ে নীল রঙটাকেই বাছাই করলাম। আচ্ছা সেদিন কি শুদ্ধ ভাই হিমু হয়ে হলুদ পাঞ্জাবীতে নিজেকে রাঙ্গিয়েছিল? উওরটা সত্যিই আমার জানা নেই।

সেদিন শুদ্ধ ভাই এয়ারপোর্টে নিজের ভাইকে পিকআপ করতে আসলেও আমরা পৌছুনোর আগেই অপারেশনের ছুটোয় কেটে পরে। ঠিক কেটে পরেন নাকি সত্যিই ইমার্জেন্সি ছিলো! জিনিসটা নিয়ে এখনো আমার ছোট মস্তিষ্কে বল প্রয়োগ করতে হয়।

সেদিন উনি নিজের অজান্তেই আমার সমস্ত প্লেনে পানি ঢেলে হাওয়া হয়ে গিয়েছিলেন। আমিও হাল ছাড়ি নি। মুগ্ধ ভাইয়ের হবু বউ হয়ে যখন উনার পাশে দাঁড়িয়ে থাকবো ঠিক তখনি শুদ্ধ ভাইয়ের রিয়েকশনটা কেমন হবে তা দেখার জন্য মন আকুপাকু করতেছিলো। এয়ার্পোট থেকে সোজা আন্টিদের বাসায় গেলাম। তাদের নতুন বাড়িতে। বেশ সুন্দর বাড়িটা। মুগ্ধ ভাই কিনেছেন। আন্টি বেশ গৌরবের সাথে মুগ্ধ ভাইয়ের প্রশংসা করতে লাগলেন। একবারের জন্য আমি উনার মুখে সেদিন শুদ্ধ ভাইয়ের নাম শুনি নি। আচ্ছা এই যে উনার বড় ছেলের এত বড় একটা দিনে ছোট ছেলেটার অনুপস্থিতি কি উনাকে একটুও কষ্ট দিচ্ছে না! নাকি এত দিন পর বড় ছেলে আশায় ছোট ছেলে না থাকলেও তার ঘাটতি পূরণ হয়ে যাচ্ছে।

আমার ভাবনার অবসান ঘটালো মা। যখন হুট করেই আন্টিকে বললো, ‘আমরা আজকেই যদি এদের এংগেইজমেন্টটা করে ফেলি ভাবী কেমন হবে? ‘

মায়ের কথায় আমি আশাহত হলেও মুগ্ধ ভাইয়ের কথা শুনে মনে শান্তি পেয়েছিলাম। যখন উনি বলেছিলেন, ‘এত তাড়াহুড়োর কিছু নেই আন্টি। আর শুদ্ধকে ছাড়া আমার লাইফের এত বড় ডিসিশন আমি নিব না।’

‘শুদ্ধ তো আছেই, এখান থেকে এখানে। একটা ফোন দিয়ে আসতে বলো।’ মা বললেন নির্দিধায়।

আন্টি এসব বাদ দিয়ে খাবারের জন্য সবাইকে নিয়ে গেলে আমি এক পলক মুগ্ধ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। এতক্ষন যাবত এই যে আমি একটা মানুষ আছি তা হয়তো বা উনার মনে হচ্ছে না। নিজেকে টিকটিকির চেয়েও অধম মনে হচ্ছিলো। আচ্ছা ওরা দুই ভাই তালগাছ বলে কি আমাকে চোখেই পরে না? আমার ভাবনার সমাপ্তি ঘটালো মুগ্ধ ভাই যখন বলেছিলেন,
‘আরে পিচ্চি তুমিও খেতে যাও। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি’

অপমানে আমার মুখ থমথমে হয়ে গেলেও একটা কথা মাথায় আসতেই বত্রিশ পাটি দাত মেলে খিলখিলিয়ে হাসতে মন চাইছিলো। ছোট ভাইয়ের বউ তো ছোট হয়। আর ছোট মানেই পিচ্চি। দারুণ দারুণ। মুগ্ধ ভাইকে মনে মনে হাজার ধন্যবাদ দিয়ে মনের সুখে মুরগির ঠ্যাং চিরিয়ে খেতে লাগলাম। আহ! এত সুস্বাদু খাবার মনে হয়নি আর কখনো খেয়েছিলাম।

বাসায় ফিরে আসার আগ অব্দি আর শুদ্ধ ভাইকে দেখার আশা পূরণ হয় নি। তবে চুপিচুপি শুদ্ধ ভাইয়ের রুমে উকি দিয়েছিলাম। দেয়ালে টাঙ্গানো উনার সেই বিখ্যাত স্মাইলের ছবি দেখে সেখানেই মরে গিয়েছিলাম। ভাজ্ঞিস দম ছিলো আর নাহলে সেদিন অক্কা পেতাম। খুটিয়ে খুটিয়ে পুরো ছবিটাতে নজর বুলালাম। ঠিক কি কারণে আমি এই পাষান নির্দয় লোকের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি তা খুজে বের করার চেষ্টা করলাম। সারা রুমে ছড়ানো ছিড়ানো কেবল বই আর বই। পড়ে একদম উলটে ফেলেছে।

তিনদিন পরেই এংগেইজমেন্টের ডেইট ফিক্সড হলো। তারজন্য শপিংয়ে যেতে হবে। গেলাম। গিয়ে অবাকের সপ্তম আকাশে পদার্পন করলাম। শুদ্ধ ভাইয়ের সাথে একটা মেয়ে হেসে হেসে কথা বলছে। শুদ্ধ ভাই মেয়েটার চুলে হাত দিয়েছে। অহ মাই গড! এমন দিন দেখার আগে মরণ হলো না কেনো আমার। অজান্তেই চোখের কোণে অশ্রুরা এসে ভিড় জমিয়েছে। টুক করে পরেও গেলো।

আন্টি তাড়াহুড়ো করে জিজ্ঞাসা করলেন কি হয়েছে। কোনো মতে চোখের পানি মুছে বললাম, ‘চোখে কি যেনো পরেছে’
কিন্তু সেদিন চোখে না আমার মন হৃধয় ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছিলো।

আন্টিকে ভাঙ্গা গলায় কোনোমতে বলেছিলাম, ‘আন্টি শুদ্ধ ভাইয়ের সাথে এটা কে?’

আন্টি মুখ ভরা হাসি নিয়ে বললেন, ‘আরে ও তো দিশা। শুদ্ধর সাথেই পড়াশুনা করেছে। মেয়েটা ভীষণ ভালো। জানিস আমার তো মনে হয় শুদ্ধর সাথে ওর কিছু চলছে বুঝলি! তোদের বিয়েটা হয়ে যাক তারপর এদের টা দেখছি।’

দশ হাত দূর থেকে শুদ্ধ ভাইকে এক পলক দেখাতেই এ মনে খুশির জোয়ার বয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু এই দৃশ্য আর আন্টির বলা কথা শুনে আমি কোনো ভাবেই আর ঐ জায়গাতে স্থির থাকতে পারছিলাম না। বার বার বলছিলো, ‘কেনো এমনটা হলো শুদ্ধ ভাই! তুমি অন্যকারো কেনো হলে! তুমার মনের দরজায় কি আমায় নিয়ে অনুভূতিরা একটুও টুকা দেয় নি?’

সেদিন মুগ্ধ ভাই আসে নি। শুদ্ধ ভাই আন্টিকে দিয়েই চলে গিয়েছিলো। আন্টির সাথেই ভাঙ্গা মন নিয়ে শপিং করে ক্লান্ত শরীরে বাসায় ফিরলাম। শুদ্ধ ভাই একবার কাছে এসে জিজ্ঞাসাও করলেন না, ‘সিয়া তুমি কি ভালো আছো?’

যদি জিজ্ঞাসা করতেন, ‘চিৎকার করে বলতাম। ভালো নেই শুদ্ধ ভাই আমি ভালো নেই। তুমার প্রেমের দহনে পুড়ে ছাড়খাড় হয়ে যাচ্ছি আমি। আমায় একটু শান্তি দিবে?’

কিন্তু না আমি বলতে পারি নি। আমার মনের ভেতর জমানো হাজারো কথার ঝুলি মনের মধ্যেই আড়াল হয়ে রয়ে গেলো তা শুদ্ধ ভাই অব্দি পৌছোলো না।

আচ্ছা বিয়ের বেনারশি গায় আমি যখন মুগ্ধ ভাইয়ের সাথে দাঁড়ানো থাকবো তখন, ঠিক তখন কি শুদ্ধ ভাইয়ের বুক একবারের জন্যও কেপে উঠবে না?

চলবে….

[গল্পটা কেমন লাগছে জানাতে ভুলবেন না]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here