মন মুনিয়া পর্ব-১১

0
1832

#মন_মুনিয়া
তন্বী ইসলাম-১১

নিয়ান নিজের মধ্যে নেই। কি ভালো কি মন্দ সে বুঝতে পারছেনা। পাছে কোনো অঘটন ঘটে যাক সেটা সে চায়না। মনির হাতটা এখনো নিয়ানের হাতের মুঠোয়। মদ খাওয়ায় শক্তি বেড়ে গেছে কিনা কে জানে, কিছুতেই সে হাতটা ছাড়াতে পারছেনা।

নিয়ান মনির ঠোঁটের দিকে কিছুক্ষণ লোভনীয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ব্যাপারটা বেশ অস্বস্তিকর মনির কাছে। একটা সময় নিয়ান এগিয়ে আসতে লাগলো মনির একদম কাছে। মনির আত্মারাম যেনো একবার খাচা ছাড়া। সে ছটফট করতে লাগলো বারবার।

অনেক ধস্তাধস্তির পর হটাৎ নিজেকে নিয়ানের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিলো মনি। বড় বড় নিশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে এক দৌড়ে দরজার কাছে চলে এলো সে। নিয়ান ধীরপায়ে এগিয়ে আসছে মনির দিকে। হাবভাব একদমই ভালো না।

মনি এক মুহুর্ত দেরি না করে বাইরে বেরিয়ে আসবে ঠিক সেই মুহূর্তে খপ করে ধরে ফেললো নিয়ান। মনি অসহায় মুখ করে তাকালো নিয়ানের দিকে। এই বুঝি সব শেষ। মনির মুখটার দিকে তাকিয়ে হাসলো নিয়ান। গভীর সেই হাসি।

আচমকাই বাজ পরলো। বাজের সেই বিস্ফোরিত শব্দে কেঁপে উঠলো চারপাশটা। নিয়ান একটানে নিজের কাছে নিয়ে গেলো মনিকে। মনি কিছু করবে তার আগেই ওকে শক্ত করে নিজের সাথে চেপে ধরলো সে।

সারারাত প্রচন্ড মাথাব্যথা থাকার কারণে বিন্দুমাত্র ঘুম হয়নি মনির। এতো পরিমাণে মাথা ব্যাথা এর আগে হয়নি তার। সকালের দিকে ঘুমটা এসেছিলো চোখে। তবে অনেকটা বেলা হয়ে যাওয়ায় বার বার মায়ের ডাকাডাকিতে এক পর্যায়ে ঘুম থেকে উঠতে বাধ্য হলো সে।

মনি ধীরপায়ে বিছানা থেকে নেমে বাইরে উঠোনের এক কোনে রোদে গিয়ে বসলো। মাথাটা এখনো ঝিম মেরে আছে তার। কিছুই ভালো লাগছেনা।

মনির শরীর ভালোনা, সেটা গতকাল প্রাইভেট থেকে ফিরে আসার পরই কিছুটা আন্দাজ করেছিলো মনির মা। তবে মনির উপর বিশেষ রাগ থাকায় তিনি সেটা নিয়ে আর মাথা ঘামান নি। তবে এখন আর মেয়ের মুখের দিকে তাকাতে পারছেন না উনি। যত রাগ থাকুন, মা তো মা ই হয়। মেয়ের উপর আর এতোক্ষণই বা আর রেগে থাকতে পারেন।

তিনি হাতের কাজকর্ম শেষ করে মেয়ের পাশে গিয়ে বসলেন। এতে মনির কোনো ভাবাবেগ হলোনা, পাশে কেউ এসে বসেছে সেটাও বুঝতে পারলোনা।
মনির মা আলতো হাতে মেয়ের পিঠে হাত রাখলেন, তাতেও কোনো হেলদোল হলনা মনির।

মনির মা নরম গলায় বললো
-তোর কি শরীর খারাপ মা? কাইল থেইকা কোনো কথা কস না, খাসও নাই রাইতে কিছু। অহনো তোরে ঠিক লাগতাছেনা।
মনি কিছু বললোনা, মায়ের দিকে তাকালোও না। তবে ওর চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরলো। মায়ের বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো তখন, মেয়ের চোখে পানি, সেটা কিছুতেই মানতে পারছেন না। মেয়েকে কখনো এই অবস্থায় দেখেন নি উনি।

তিনি আবার বললেন
-কানতাছোস কেন মা? আমারে বল তোর কি হইছে? অসুখ করছে নাকি কেউ কিছু কইছে?

রহিম মিয়া বাড়ি ছিলেন না এতোক্ষণ। সকাল সকাল চা খাওয়ার জন্য পাড়ার দোকানে চলে গেছিলেন। রোজকার সকালের অভ্যাস তার। এইমাত্রই বাড়ি ফিরলেন তিনি। দেউরি দিয়ে বাড়িয়ে ঢোকার মুখেই মনির মায়ের বলা শেষ কথাটা উনার কানে গেলো। উনি হাসতে হাসতে এগিয়ে আসলেন আর বললেন

-আহ মনির মা, মাইয়াডারে বিরক্ত কইরোনা তো। কয়দিন পর মাইয়াডার বিয়া, নিজের বাড়ি পর কইরা পরের ঘরে যাইবো গা। তাই মন খারাপ। তুমি ওরে আর জ্বালাতন না কইরা আমারে ভাত দেও।

মনির মা একটা লম্বা শ্বাস টানলো। মনে মনে ভাবলো, “এটাই হবে হয়তো”

তিনি উঠে চলে আসার পর মনির কান্নার বেগ আরো বেড়ে গেলো। তবে সে কোনো শব্দ করলোনা, নিশ্বব্দে কাঁদলো

কিছুটা বেলা হলে মনি উঠে গিয়ে আবার শুয়ে পরলো। মা চলে গেছে পরের বাড়ির কাজে। রহিমও ঘরে নেই, হয়তো কোনো জুয়া খেলার আড্ডায় গিয়ে মজেছে।।

খালি ঘরে একা মনি নিজেকে আর সামলাতে পারছেনা, হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার। এ কি হয়ে গেলো তার সাথে?

এর মাঝে ঘরের পিছন দিকের বেড়ায় কারো টুকার শব্দে মনির ভাবনার বিচ্ছেদ ঘটলো। প্রথমে মনি সেটাকে এড়িয়ে গেলেও পরবর্তীতে যখন বার বার বেড়ায় কেউ অনবরত টুকা দিতে লাগলো তখন বিরক্ত হলো মনি। সামান্য রাগ দেখিয়ে বললো
-বেড়ায় কে টুক্কি দেয়?
-বান্ধবী আমি, একটু এদিকে আসবে?

নিয়ানের গলার স্বরে মনি যতোটা না অবাক হলো, তার চেয়ে বেশি রাগ হলো। সে উঠে দাঁড়িয়ে চোখের পানিটা ভালোকরে মুছে নিয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে।

মনিকে দেখে মুচকি হাসলো নিয়ান। তাতে পুরো গায়ে জ্বালা ধরে গেছে মনির। সে তিক্ত গলায় বললো
-আপনে কেন আইছেন এইখানে?
নিয়ান হাসলো। হাতে থাকা বইখাতা গুলো মনির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো
-আজ সকালে পড়ার রুমে গিয়ে দেখলাম বইগুলো রাখা। বইয়ে তোমার নাম লেখা তাই চিনতে অসুবিধা হলোনা, তাই নিয়ে আসলাম। সামনে এক্সাম, পড়তে হবেতো।

মনি একভাবে তাকিয়ে রইলো নিয়ানের দিকে। নিয়ান হাতে থাকা বইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো
-আচ্ছা বান্ধবী, তুমিতো কাল আমাদের বাড়ি যাওনি, আমি যতোদুর জানি বাবা কাল বাড়ি ছিলোনা তাই পড়ায় নি। তাহলে তোমার বইগুলো ওখানে গেলো কিভাবে?

এখনো মনির কোনো উত্তর নেই। মনির কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে এবার ওর দিকে তাকালো নিয়ান। মনি কাদছে, চোখদুটো লাল হয়ে আছে তার। নিয়ান বিস্ময়ে বললো
-কাঁদছো কেন বান্ধবী? কি হয়েছে তোমার?
-আমার সবকিছু শেষ কইরা দিয়া আমারে জিগান আমি কান্দি কেন? তীব্র কন্ঠে বললো মনি।

নিয়ান অবাক হয়ে বললো
-কি বলছো বান্ধবী? তোমার সবকিছু শেষ করেছি মানে?
-হ্যাঁ শেষ করছেন। আমারে শেষ করছেন, আমার জীবন শেষ করছেন, আমার সতীত্ব নষ্ট করছেন। আমি নিজেরে আপনের কাছ থেইকা বাঁচাইতে পারি নাই, অনেক চেষ্টা করছি তাও পারি নাই। কেন এমন করলেন আপনে? আপনে তো আমারে বান্ধবী বানাইছিলেন তাইনা? তাইলে এইটাই কি তার পরিণাম?

মনির মুখের কথাগুলো শুনে নিয়ান অবাক হলোনা। তবে তার মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেলো।

মূলত, গতকাল নিজের পুরোপুরি সেন্স আসার পর নিজেকে পড়ার রুমে দেখে আর নিজের শরীরের অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিলো নিয়ান। সে বুঝতে পারছিলোনা এমনটা কি করে হলো। পরবর্তীতে মদের বোতল আর বেঞ্চে থাকা মনির বইগুলো দেখে কিছুটা আঁতকে উঠেছিলো সে। নেশার ঘোরে মনির কোনো ক্ষতি করে ফেলেছে কিনা ভেবেই একটা অপরাধবোধ কাজ করছিলো তার মনে।

তবে সে নিশ্চিত ছিলোনা বিষয়টা সম্পর্কে। তাই বই নিয়ে আসার বাহানায় সেটা জানার জন্য এসেছিলো সে। সত্যটা জানার পর নিয়ানের মুখটা একদম ছোট হয়ে গিয়েছিলো তার। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলো সে মনির সামনে।

মনি হটাৎ চেচিয়ে বললো
-এখন চুপ কইরা রইছেন কেন? কাইল তো চুপ ছিলেন না?

মনি আবার কিছুক্ষণ চুপ থাকলো। এরপর আবারও তীব্র কন্ঠে বললো
-আমার এখন কি হইবো একবার ভাবছেন? যদি এইটা জানাজানি হইয়া যায়, আমি কি করমু? আমার গলায় ফাঁস দেওয়া লাগবো। তা না করলেও আমার বাপে আমারে জবাই দিবো, মাইনষের সামনে মুখ দেখাইতে পারমুনা। সামনে আমার বিয়া, আমি অহন কি করমু একটু বলে দেন আমারে। বলতে বলতে কেঁদে ফেললো মনি।

নিয়ান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো
-তোমার কোনো ক্ষতি হোক আমি চাইনি মনি। এটা আমার মনের অজান্তে হয়ে গেছে। নেশার ঘোরে ছিলাম আমি, কি করে কি হয়ে গেলো বুঝতে পারিনি। আমাকে মাফ করে দাও প্লিজ।

-আপনেরে মাফ কইরা দিলেই কি সব শেষ? আমার দিকটা একবারো ভাবলেন না?

-আমার উপর আস্থা রাখো মনি, যদি এমন কোনো পরিস্থিতির তৈরি হয়, তখন আমাকে তোমার পাশে পাবে। আমি সর্বদায় তোমাকে সাহায্য করবো।

মনি হাসলো। তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। সে আর কোনো কথা না বলে ফিরে এলো ঘরে। নিয়ান কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে এরপর হাটা শুরু করলো নিজের বাড়ির পথে। মনির জন্য খুব খারাপ লাগছে তার।

নিয়ান মনে মনে ভাবলো, “এখানে তো আমার কোনো দোষ নেই, সবটাই আমার মনের অজান্তে হয়েছে। তবুও যতোটা সম্ভব আমি মনিকে হেল্প করবো। যদি কোনো গুরুতর কিছু ঘটে যায় তাহলে প্রয়োজন হলে আমি সেটাই করবো, যেটা করতে গেলে সবদিক থেকে আমাকে বাধার সম্মুখীন হতে হবে।”

_____
মানসিক ভাবে ভেংগে পরায় পড়াতেও মন বসাতে পারছেনা মনি। পরীক্ষাও ঘনিয়ে এসেছে, আর মাত্র এক সপ্তাহ। এই কয়দিনে নিয়ানের সাথে আর কোনো কথা কিংবা দেখা হয়নি তার। যদিও সে শুনেছে নিয়ান বাড়ি নেই, ঢাকা চলে গেছে। তবে মনি এতে অবাক হয়নি। এটাই তো হবার ছিলো, ওর মতো এক বড়ঘরের ছেলে কিভাবে ওকে সাহায্য করতে পারে। সবই সময়ের খেলা।

মনি ভুলে যেতে চায় সেই অপয়া দিনটার কথা, নতুন করে আবার চলতে চায় আগের মতো। আর সেটা করতে গেলে মন থেকে সবকিছু বাদ দিতে হবে। যদি সে বাড়াবাড়ি করে এটা নিয়ে, তবে তারই বদনাম হবে, লোক জানাজানি হবে। মনি এর আগেও একবার কলংকিত হয়েছে, বিয়ের দিন বিয়ে ভেঙ্গেছে। সে আর কলংকের বোঝা মাথায় নিতে চায়না।

কিন্তু মনের বোঝা? সেটা কি খুব সহজেই মন থেকে মুছে ফেলা যাবে? সারাজীবন এই বুঝা তাকে বয়ে বেড়াতে হবে।

মনি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো, সে দীর্ঘশ্বাস যেদিক দিয়ে গেলো, সেদিক দিয়েই পুড়ে ছারখার হয়ে গেলো সবকিছু।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here