মন মুনিয়া পর্ব-১৪

0
1853

#মন_মুনিয়া
তন্বী ইসলাম -১৪

রহিমের কথা উক্ত লোকটির কান পর্যন্ত পৌঁছে, কিন্তু তৎক্ষনাৎ সে কিছু না বলে এগিয়ে আসতে থাকে।
রহিমের কিছুটা কাছাকাছি এসে সে বললো
-চাচা আমি।

জয়নালকে দেখে খুশি হয় রহিম। সে হাসিমুখে বলে
-আরে বাবাজি তুমি। তা এই অসময়ে কেন আইলা?
-ঘরে ঢুকেন চাচা, কথা আছে।
রহিমের সাথে ঘরে এসে ঢুকে জয়নাল। জয়নালকে দেখে মনির মা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে থাকে। জয়নাল কপাল বাকায়, কিন্তু কিছু বলেনা।

রহিম জয়নালের দিকে তাকিয়ে বলে
-কোনো সমস্যা হইছে বাপ? কি দরকারে আইছো?
-আইছি মনির সাথে আমার বিয়ার ব্যপারে।
-হো, বিয়া তো হইবোই। মনির কি জানি একটা পরীক্ষা বাকি আছে সেইডা হইয়া গেলেই হইব।

-কোনো পরীক্ষা টরীক্ষা নাই, যেইডা আছে সেইডা কোনো পড়নের পরীক্ষা না। যাইবো আর আইবো। এইডা আমার বাড়িতে থাইকাই দেওন যাইবো।
-ওহ আইচ্ছা। আমিতো জানতাম না এইডা। তয় কবে বিয়া করতে চাও?
-কাইল।

-কাইল? বিস্ময়ে বললো রহিম।
-কেন কোনো সমস্যা?
-আরে না না। সমস্যা আবার কিয়ের হইবো। যেমনে কইবা সেইভাবেই হইবো।
-তবে একটা কথা চাচা, আগের মতো গ্রামের মানুষগুলারে শুনাইয়েন না। ঝামেলা করবার পারে।

রহিম চিন্তিত গলায় বললো
-কথা সইত্য। আইচ্ছা, তয় কাইলই সব হইবো। তুমি দেইখো, আবার কারো কান পড়া নিয়া ফান্দে পইরোনা। তোমার লগে তো আর বিশ্বাস নাই। ফের এমন করলে আমি তোমারে আর বাঁচাইতে পারমুনা। গ্রামের মানুষ এমনিতেই চেইতা আছে তোমার উপরে।

-মনি কই?
-রান্দে।
-ভালা কথা, তবে ওর মাথায় ভালা কইরা ঢুকাইয়া দিয়েন কাইল আমার লগে হের বিয়া। আর চাচীরেও কইয়েন কোনো ঝামেলা জানি না করে, আগের বার কিছু কই নাই, তয় এইবার ছাড়মু না।

রহিমের মুখের অবয়ব পালটে যায়। সে শুকনো ঢোক গিলে বলে
-কোনো চিন্তা কইরোনা। আমি আছি তো।

জয়নাল চলে গেলে মনির মা উঠে বসে তরিঘরি করে। তিনি বেশ রাগী চোখে তাকান রহিমের দিকে। রহিম সে দৃষ্টি উপেক্ষা করে রান্নাঘরের দিকে তাকায়। সুরেলা গলায় মেয়েকে ডাকেন তিনি।
-মনি, মা মনি।

এক ডাকের মাথাতেই মনি এগিয়ে আসে ঘরে। তার পা যেনো এগোতে চাইছেনা। রান্না ঘরে বসে সব শুনেছে সে। আগামীকাল ওর নিয়ানের সাথে কোথায় যেনো যাবার কথা, আবার ওই ভন্ডটা আগামীকালই ওকে বিয়ে করতে চায়। এবার সে কি করবে?

মনিকে এভাবে ধীর গতিতে এগিয়ে আসতে দেখে রহিম কিছুটা নরম গলায় বললো
-কি রে মা। এতো দেরি করতাছোস কেন? তারাতাড়ি আয়।

মনির মা এবার মুখ খুললো। সে বেজায় তেজ দেখিয়ে বললো
-কেউ সাধে সাধে আগুনে ঝাপ দিতে চায়?
আমার মাইয়ারে তো কাইল কবর খুইড়া জ্যন্ত মাটি চাপা দিবেন। ওর চলার গতি আর কিইবা হইবো।। কেউ তো আর ইচ্ছা কইরা জ্যান্ত মাটিচাপা হইতে চায় না।
-তুই থাম মনির মা। অযথা তর্ক করিস না। মনির লগে আমারে কথা কইতে দে।

মনির মা কিছু বলবে তার আগেই মনি এসে তাতে বাধ সাধলো। সে মাকে কিছু বলতে না দিয়ে বললো
-আমি একটা কথা বলতাম আব্বা।
-কি কথা মা?
-আমি তোমার সব কথা শুনমু, বিয়াও করমু। তয় আমারে সকালে একটু স্যারের বাড়ি যাইতে দিও।
-কেন যাবি ওইখানে? আজই তো গেলি, আবার কি দরকার?

মনি ভয়ে ভয়ে তাকালো রহিমের দিকে। আমতাআমতা করে বললো
-আমার নোটটা আইজ আনতে পারি নাই। স্যার বাড়ি ছিলোনা। কাইল যাইতে কইছে একবার।
-অন্যদিন আনিস।
-না আব্বা, কাইল যারা যাইবো তাগোরেই দিবো। যারা যাইবোনা তাগোরে আর পরে দিবোনা। আর এই নোট না পাইলে প্র‍্যাক্টিকেলে পাস করতে পারুম না।

রহিম মিয়া চিন্তার স্বরে বললো
-জয়নাল যে কইলো এই পরীক্ষায় পড়া লাগেনা?
-পড়া লাগে। হে কি কোনো দিন ইস্কুলের গন্ডি পার হইছে নাকি যে জানবো।
-কথা সইত্য। যাক গে, তোর যহন বেশি দরকার তবে যাইস সকাল সকাল। তবে যাইবি আর আইবি। দেরি করিস না।

মনি স্বস্তির নিশ্বাস টেনে মনে মনে ভাবলো
-বাঁচলাম। তবে একবার যদি নিয়ান আমার দায়িত্ব নিয়া নেয় তবে আব্বায় আর দ্বিমত করবোনা। বরং খুশিই হইবো। জয়নাল আর নিয়ানের মাঝে আকাশ পাতাল তফাৎ কিনা।

পরেরদিন সকাল সকাল একটা ভালো জামা গায়ে দিয়ে রেডি হয় মনি। যাবার আগে বাবার পরীক্ষার সময় বাবার দেওয়া টাকাগুলো সাথে নিয়ে নেয়। বলা তো যায়না, কখন কি দরকার পরে। আর একটা জিনিস সাথে নেয় সে। রিতার দেওয়া তার খালাতো বোনের নাম্বারটা। নিয়ানের সাথে বিয়ে হয়ে যাবার পরপরই ওকে ফোন করে জানিয়ে দিবে সে। খুশি হবে মেয়েটা।

আর তাছাড়া মা যদি খুব বেশি রেগে যায় তাহলে ওকেই দায়িত্ব নিয়ে মাকে মানাতে হবে, সেটা আগে থেকেই ওকে জানিয়ে রাখা দরকার। এসব ভেবেই ঘর থেকে বেরিয়ে আসে সে।

মনির মা কিছুটা অবাক হয়ে মেয়েকে বলে
-আইজ হটাৎ নতুন জামা পইরা স্যারের বাড়ি যাইতাছোস?
রহিম মিয়া পাশেই ছিলো। তিনি মনির মায়ের কথায় বাধা দিয়ে বললো
-মাইয়াডার আইজ বিয়া, তয় হে নতুন জামা পরবোনা কি ফকিন্নির মতো থাকব?
-কি জানি, এই ভন্ডডার লগে বিয়া হইবো, সেই বিয়ার খুশিতে মাইয়া নতুন জামা পরছে, কেন জানি আমার হজম হইতাছেনা।

মনি শুধু শুনে গেলো ওর বাবা মায়ের কথা। কিন্তু উত্তর দেয়নি কোনো। আজ তারা বলুক, এরপর হয়তো এগুলো বলতে পারবে কিনা তার জানা নেই, সামনেই অনেক বড় ধাক্কা খেতে যাচ্ছে তারা। যখন দেখবে মেয়ে বিয়ে করে জামাই নিয়ে ফিরেছে তখন হয়তো কিছু বলার মতো ভাষা খুজে পাবেনা।

মনি বেরিয়ে গেলো। মনে কিছুটা ভয় কাজ করলেও খুশিটাই বেশি লাগছে তার। আজ তার বিয়ে হবে এক সুদর্শন ছেলের সাথে, বাচ্চাটা পরিচয় পাবে সমাজে। সবচেয়ে বড় কথা, এটার মাধ্যমেই সে জয়নাল নামের আতংকের হাত থেকে চিরতরে মুক্তি পাবে, এতে সবচেয়ে বেশি খুশি হবে মা।

বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে এসে মনির আসার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে নিয়ান। বার বার হাত ঘরিটার দিকে তাকাচ্ছে আর মনির আসার প্রহর গুনছে।

এক পর্যায়ে মনি আসলো। নিয়ানকে এভাবে রাস্তার মাথায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হলো। ধীরগলায় বললো
-এইখানে দাড়াইয়া আছেন যে?
-তোমার অপেক্ষা করছিলাম। এতো দেরি করলে যে?
-দেরি হইয়ে গেছে। আব্বা আম্মারে অনেক মিথ্যা বলে আসতে হইছে তাই।
-ঠিক আছে, এখন তারাতাড়ি চলো। আমার পিছু পিছু আসো তুমি। ওদিকে সব রেডি আছে। আমরা যাওয়া মাত্রই কাজ শুরু করে দিবে ওরা।

-আমরা কই যাইতেছি? বিয়া করতে তো?
-গেলেই দেখতে পাবে।

ওরা কিছুটা এগিয়ে গিয়ে একটা সিএনজি তে উঠলো। উঠার আগে সিএনজি ওয়ালার সাথে আলাদা করে কিছু কথা বলে নিলো নিয়ান। মনি সেদিকে বিশেষ নজর দিলোনা।

সি এন জি ছাড়ার আগে নিয়ান এসে মনির পাশে বসলো। মনি ঘামছে, নিয়ান সেদিকে অদ্ভুতভাবে তাকালো। বললো
-ঘামছো কেন মনি?
-আমার অনেক ডর করতাছে। বাড়ি গেলে আব্বায় কি করবো? আম্মা যদি রাগ হয় আমার উপর?
নিয়ান মুচকি হেসে বললো
-কিচ্ছু হবেনা। তারা তো জানতেও পারবেনা তোমার প্রব্লেমটার কথা। জানার আগেই সমাধান হয়ে যাবে যে।

-আমরা অহন কই যাইতেছি?
-বলেছি তো, গেলেই দেখতে পাবে।

দীর্ঘ দেড় ঘন্টার জার্নির পর একটা বড়সড় বাজারের মাঝখানে এসে থামলো সিএনজি টা। মনিকে নামতে বলে ভাড়া মেটাতে ব্যস্ত হলো নিয়ান। মনি নেমে চারপাশটায় চোখ বুলাতে লাগলো বার বার। শহর টাইপের এ বাজারটা বেশ অপরিচিত মনির কাছে। এটা কোন জায়গা সে জানেনা।

ভাড়া মিটিয়ে নিয়ান এগিয়ে এলো মনির কাছে। হাসিমুখে বললো
-কি দেখো এইভাবে?
-শহরটারে দেখতাছি। এই জায়গাডার নাম কি?
-এখানকার নাম “রুপনগর” (ছদ্মনাম)
-বাহ, বেশ সুন্দরতো নামটা।
-হুম। এবার এসো আমার সাথে।

মনি নিয়ানের পিছু পিছু হাটতে লাগলো। নিয়ান এগিয়ে যাচ্ছে সামনে। একটা সময় নিয়ান বড় একটা দালানের ভিতর ঢুকলো। মনি ভিতরে যাওয়ার আগে বাইরের লেখাটা খেয়াল করলো। “Digital Diagnostic & Pathology”

নামটা দেখে কিছুটা অবাক হলো মনি। নিয়ানের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো
-আমরা এইখানে কেন আইছি? এইডাতো একটা ডাক্তারখানা।
-ভেতরে আসো, জানতেই পারবে সব।

মনি বিস্ময় নিয়ে ভিতরে ঢুকলো। নিয়ান মনিকে একটা চেয়ারে বসতে বলে ভিতরের চ্যাম্বারে গিয়ে ঢুকলো। কিছুক্ষণ পর একজনকে সাথে করে নিয়ান বেরিয়ে এলো।

লোকটি হাসতে হাসতে মনির সামনে দাড়ালো। এরপর মনিকে আস্বস্ত করে বললো
-তোমার কোনো ভয় নেই বোন। আমাদের স্যার একজন নামকরা পাকা ডাক্তার। উনি নির্বঘ্নে তোমার সমস্যার সমাধান করে দিবে। যদিও নিয়ান আমার পূর্বপরিচিত, তাই ওকে বার বার মানা করেছিলাম এটা করতে। আমাদের স্যার এইসব কাজ সহজে করতে চায়না। তবুও নিয়ানের বিশেষ অনুরোধ আমি ফেলতে পারিনি। তাই স্যারকে অনেক বুঝিয়ে রাজি করিয়েছি।

আমার সাথে এসো, আগে একটা টেস্ট করে কনফার্ম হতে হবে তোমার পেটে বাচ্চা সত্যিই আছে কি না।

লোকটি চলে গেলে মনি বিস্ময়ে তাকালো নিয়ানের দিকে। এরপর ভীতসন্ত্রস্ত কন্ঠে বললো
-লোকটা এইসব কি বইলা গেলো? আমারে টেস্ট করাইবো কেন? আর আমরা এইখানেই কেন আইছি?

নিয়ান নরম গলায় বললো
-শান্ত হও মনি। আমি বুঝিয়ে বলছি তোমায়।
মনি প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো নিয়ানের দিকে। নিয়ান বললো
-আমরা এখানে এসেছি তোমার বাচ্চার Abortion করাতে।
-এইটা আবার কি?

নিয়ান চারপাশটায় একবার তাকালো। এরপর আস্তে আস্তে বললো
-সহজ বাংলায় যাকে বলে নষ্ট করা। তোমার পেটে যে বাচ্চাটা আছে সেটা নষ্ট করতে হবে। আমরা সেজন্যই এসেছি।।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here