মন মুনিয়া পর্ব-১৫

0
1833

#মন_মুনিয়া
তন্বী ইসলাম -১৫

নিয়ান চারপাশটায় একবার তাকালো। এরপর আস্তে আস্তে বললো
-সহজ বাংলায় যাকে বলে নষ্ট করা। তোমার পেটে যে বাচ্চাটা আছে সেটা নষ্ট করতে হবে। আমরা সেজন্যই এসেছি।।

মনির মাথায় বাজ পরলো, সে তৎক্ষনাৎ দুই পা পিছিয়ে গেলো। আমতাআমতা করে বললো
-ম মম মানে?
-আহ মনি, এটাও তুমি বুঝো না?

মনি অবাক হলো, সামান্য রেগে বললো,
-বুঝতে পারছি। তাইলে আপনে আমারে বিয়া করার জন্য আনেন নাই। বাচ্চা নষ্ট করতে আনছেন?

-আমার এখনো বিয়ের সময় হয়নি মনি। আমাকে এস্টাবলিশ হতে হবে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। পায়ের নিচে শক্ত একটা মাটি তৈরি করতে হবে । এরপর বিয়ের চিন্তা।

-আপনে আমারে আগে কন নাই কেন এইরকম একটা আকাম করতে আমারে নিয়া আসছেন?
-এতো কথা বলোনা তো। উনি যেভাবে করতে বলেছে সেভাবেই করো। তারাতাড়ি যাও। পরে আবার রেগে যাবেন উনি।

-আমি বাচ্চা নষ্ট করমুনা।
-পাগলামো করোনা মনি। যাও তারাতাড়ি। অনেক বুঝিয়ে রাজি করিয়েছি। এটাও করতাম না, আমি নেহাত প্রতিজ্ঞা করেছিলাম তাই।।

মনি ভ্রু বাকালো। প্রশ্নবিদ্ধ কন্ঠে বললো
-কি প্রতিজ্ঞা?
-তোমার সাথে এমন একটা ঘটনা ঘটেছে জানার পর আমি আন্দাজ করেছিলাম এমন কিছু হতে পারে। তোমার বাবা যেহেতু বদরাগী তাই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যেটা করতে গেলে সবদিক থেকে বাধার সম্মুখীন হতে হবে, আমি সেটাই করবো। আর এই বাচ্চা এবর্শনই হলো সেই কাজ।

-আপনে এতোদুর পর্যন্ত ভাইবা নিলেন। একবার আমার কথা ভাবলেন না?
মনির চোখদুটো থেকে অনর্গল পানি ঝরতে লাগলো। নিয়ান ওকে বুঝিয়ে বলতে লাগলো
-ওহ মনি, এখানে সিনক্রিয়েট করোনা প্লিজ। লোকেরা কি ভাববে বলোতো?

-যা ভাবার ভাবুক। আমি বাচ্চা নষ্ট করমু না।
-পাগলামি করোনা। তোমার কথা ভেবেই আমি এতোটা রিস্ক নিয়েছি, এখন তুমি এমন করলে কিভাবে হবে বলো?
মনে রেগে তাকালো নিয়ানের দিকে। খানিক তেজ দেখিয়ে কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বললো
-কি এমন ভাবছেন আমার কথা? আমার কথা ভাবলে এমন একটা বাজে কাজ করার কথা মাথাতেও আনতেন না।

-তুমি নেহাত বাচ্চা একটা মেয়ে, তাই বুঝতে পারছোনা। এটা করলে তোমারই ভালো হবে। কেউ জানবে না এটার ব্যাপারে, সমাজের ডরভয় কিচ্ছু থাকবেনা মনে।
-আমারে আপনে বিয়া করবেন, আর এক্ষনই।
-মাথা খারাপ মনি। কি বলছো তুমি?
-কেন, আমারে বিয়া করতে সমস্যা কি আপনের?
-সম্ভব না এটা।
-কেন সম্ভব না?
-বলেছি তো আমার বিয়ের সময় হয় নি এখনো। আর তাছাড়া..
-তাছাড়া কি?

নিয়ান একটা উত্তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে বললো
-কষ্ট পেয়ো না মনি। তোমাকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব না। তোমার আর মাঝে বয়সের বিরাট একটা ফারাক, তবে সেটা তেমন কোনো ব্যপার ছিলোনা। সমাজে আমাদের একটা নামডাক আছে, আমার বাবার সামাজিক মর্যাদা আছে। তিনি চান তার লেভেলের কারো সাথেই আমাদের আত্মীয়তা হোক।

– বয়সের ফারাক, সামাজিক মর্যাদার কথা এতোই যখন চিন্তা করেন, তাইলে তখন আমার এতো বড় সর্বনাশ টা কেন করলেন?
-ওখানে আমার কোনো দোষ নেই। ওটা একটা এক্সিডেন্ট ছিলো, আর কিছুই নাহ।

মনি ঘৃণার সঙ্গে তাকালো নিয়ানের দিকে। এরপর তাচ্ছিল্যতার সাথে বললো
-এই কথাডা শুনোনের লাইগাই আইজ বিয়া বাদ দিয়া এইখানে আপনের লগে আইছিলাম আমি তাইনা?
-কার বিয়ে আজ?
-আমার বিয়া। আইজ আমার বিয়া। সেই বিয়া ফালাইয়া চইলা আইছি আপনেরে বিশ্বাস কইরা। আর আপনে আমার বিশ্বাসের এই দাম দিলেন।

নিয়ান কিছুটা বিরক্তবোধ করলো এবার। সে সামান্য তিক্ত গলায় বললো
-এখন তুমি কি চাও? এবর্শন করাবে না?
-না, আমি বাচ্চা নষ্ট করমুনা। আমারে বিয়া করবেন আপনে।

নিয়ান মেজাজ দেখিয়ে বললো
-তোমার যখন এতোই বিয়ের শখ তাহলে বিয়ে ছেড়ে চলে এলে কেন? চলে যাও বাড়ি, জয়নালকেই বিয়ে করে নাও। বাচ্চাটা ওর বলেই চালিয়ে দিও, কেউ সন্দেহ করবেনা। এমন অনেক হয়, বিয়ের রাতেই কন্সিভ করে। তুমিও এমন করেই চালিয়ে দিও। কেউ নূন্যতম সন্দেহ করবেনা।

মনি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো নিয়ানের দিকে। এতোটাও আশা করেনি সে। নিয়ান আবার বললো
-কি করবে তারাতাড়ি ডিসাইড করো। আমার তাড়া আছে।
-আপনে চইলা যান।
নিয়ান অদ্ভুত ভাবে তাকালো মনির দিকে। অবাক হয়ে বললো
-তুমি যাবেনা?
-যামু, তয় আপনের লগে না। পাছে আপনের যদি কোনো বদনাম রইটা যায়।
-একা যেতে পারবে তুমি?
-পারমু।

-ওকে, এবর্শন যেহেতু করবেনা, তাহলে একটা সিএনজি নিয়ে চলে যেও। আমি বরং চলেই যায়। এখানকার অনেকেই আমার পরিচিত। তোমার সাথে দেখলে কি না কি ভেবে বসে বলা তো যায়না।
-আমারে নিয়া এতো ভাবতে হইবো না আপনের। আপনে চইলা যান।

নিয়ান চলে যাবার জন্য উদ্ধত হলো। যাবার আগের আরেকবার মনির দিকে ফিরে তাকালো। মুচকি হেসে বললো
-নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা রইলো। বিয়ের পর তোমার বরসমেত দেখা হবে। যাচ্ছি, তুমি সাবধানে যেও। আর হ্যাঁ, আমি ওদের বলে দিচ্ছি কোনো টেস্ট হবেনা, এবর্শনও হবেনা। তুমি জলদি চলে যেও। বেশিক্ষণ থেকোনা এখানে।

মনি তাকিয়ে রইলো নিয়ানের যাবার পথে। ওর চোখে এখন আর পানি নেই, শুকিয়ে গেছে অনেক আগেই। এক পর্যায়ে মনি হাসলো। হাসতে হাসতে উপরের দিকে তাকালো।

একটা সময় ভাবলো সে এখন কি করবে, কোথায় যাবে। যদি বাড়ি যায়, বেশ ঝামেলা হবে, একেতো অনেক দেরি হয়ে গেছে তাই। এর উপর হয়তো জয়নাল এসে ঝামেলা বাধিয়েও দিয়েছে। চারদিকে জানাজানি হয়ে গেছে সে স্যারের বাড়ি যায়নি, হয়তো সবাই ধরেই নিয়েছে সে পালিয়ে গেছে।

সবচেয়ে বড় কথা এখন বাড়ি গেলে সব ঝামেলার মুলেও বিয়েটা হবে। সে এই বিয়েটা করতে চায় না।জয়নালের মতো কারো সাথে বিয়ে হবার চেয়ে সারাজীবন একাই কাটিয়ে দেওয়া ভালো। আর বিয়েটা না করলেও এই বাচ্চার ব্যাপারটাও জানাজানি হয়ে যাবে। সকলে চুনকালি মাখবে তার মুখে। বাবা মা মুখ তুলে তাকাতে পারবেনা সমাজের মানুষের সামনে। সারাজীবন মাথা নত করেই থাকতে হবে। মা বাবার কড়া শাসনে হয়তো বাচ্চাটাকে সে টিকিয়েও রাখতে পারবেনা।

তার চেয়ে ভালো, কে একাকীই দিন যাপন করুক। যদি আল্লাহ সহায় হয়, পেটের বাচ্চাটাই হবে তার একমাত্র সঙ্গী।

মনি এক পা দুই পা করে সেই প্যাথলজি থেকে বেরিয়ে আসে। বাইরে এসে দাঁড়িয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আকাশের দিকে তাকায়। ঝাঁকে ঝাঁকে দল বেধে পাখিরা উড়ে যাচ্ছে ডানা মেলে। মনি ভাবে, এই পাখিদেরও থাকার জায়গা আছে, বুঝার মতো এক ঝাঁক বন্ধু আছে। হয়তো, বিশ্বাসী একটা সঙ্গীও আছে। তবে তার কি আছে? কিছুই নেই। লাভ লোকসানের খাতায় লোকসানে পরিপূর্ণ হলেও লাভের হিসাব তার শূন্য।

মনি আবারও একটা লম্বা শ্বাস টেনে হাটতে লাগলো। কিছুটা দূরে গিয়ে দেখলো একটা ফ্লেক্সিলোডের দোকান। মনি কোনো চিন্তাভাবনা ছাড়াই সে দোকানে ঢুকে। রিতার নাম্বারটা বের করে দোকানদারের হাতে দিয়ে তাকে অনুরোধ করে একটু এই নাম্বারে কথা বলিয়ে দেবার জন্য।

দোকানদার রাজি হয়, তবে মিনিট হিসেব করে তাকে টাকা দিতে হবে সেই শর্ত দেয়। মনি শর্ত মেনে নেয়।

কয়েকবার রিং হবার পর একটা মেয়ে ফোনটা রিসিভ করে। মনির গলা কাপছে। সে কিভাবে কি বলবে বুঝতে পারছেনা। একটা সময় সকল ভয়কে দূরে ঠেলে সে বলে
-এখানে রিতা আছে?
-আপনি কে?

মনি চিন্তায় পরে। কি বলবে এখন? রিতার বান্ধবী এটা সে বলে দিবে? নাহ, এটা বলা যাবেনা। মনি এনার সসংকোচে বলে
-আমি ওর লগে কাজ করি।
-ওহ, কিন্তু আজ তো ওর ডিউটি বন্ধ।
-জানি তো। তাই তো কল দিছি, একটা দরকার ছিলো। একটু দিতে পারবেন?
-দিতে পারতাম। তবে, ও এখন আর আমার সাথে থাকেনা। আলাদা মেসে উঠেছে। এখন তোমার সাথে কিভাবে কথা বলাই বলোতো?

মনি এবার চিন্তায় পরলো। কিছুক্ষণ কি যেনো ভেবে বললো
-আমার খুব দরকার ছিলো ওরে।
-ওর রুম মেটের নাম্বার আছে আমার কাছে, দিবো? ওই নাম্বারে কল করতে হয়তো পেয়ে যাবে।
মনির মুখে খুশির ঝলক দেখা গেলো। সে উৎসাহে বললো
-দেন।

নাম্বারটা নিয়ে দোকানদারকে দিয়ে আবারও কল করালো মনি। এইবারও একটা মেয়ে ধরলো ফোনটা। হয়তো এটাই ওর রুমমেট। মনি রিতার কথা বলতেই মেয়েটা খুশিমনে ফোনটা রিতাকে দিয়ে দিলো।

রিতা ফোন কানে ঠেকিয়ে বললো
-হ্যালো, হ্যালো কে?
-আমি মনি। কাঁপা কাঁপা গলায় বললো মনি।
রিতা যেনো বিশ্বাসই করতে পারছেনা এতোদিন পর মনি তাকে কল করেছে। সে আনন্দে হতবিহ্বল হয়ে উঠলো। খুশিতে আত্মহারা হয়ে বললো
-তুই সত্যিই মনি?
-হুম।
-আমার বিশ্বাস হইতাছেনা তুই আমারে কল করছোস।
-আমি তোরে খুব দরকারে কল করছি রে রিতা।

মনির কন্ঠস্বর রিতার কাছে স্বাভাবিক লাগলোনা। তার কপালে সুক্ষ্ম চিন্তার ভাজ পরলো। সে কিছুটা অবাক হয়ে বললো
-কি হইছে মনি? কোনো সমস্যা?
-হইছে অনেক কিছু। আগে তোর বাসার ঠিকানাটা দে। আমি আসমু তোর বাসায়।
-কেন কি হইছে?
-বললাম তো, সব বলমু তোরে। আগে ঠিকানা টা দে।

রিতা ওর ঠিকানাটা বলার সাথে সাথে দোকানদারের কাছ থেকে কাগজ আর কলম নিয়ে সেটা লিখে নিলো মনি। এরপর আবারও বললো
-রিতা শোন,
-কি?
-আমি তোর বাসায় যাওয়ার আগে যদি তুই তোগো বাড়িতে কথা বলোস, তাইলে ভুলেও বলিস না, আমি যাইতেছি তোর বাসায়।।

রিতা চিন্তিত গলায় বললো
-আচ্ছা। তুই সাবধানে আসিস। কাছাকাছি এসে কোনো ফ্লেক্সির দোকানে গিয়ে আরেকবার কল দিস। সেখান থেকে আমি তোরে নিয়ে আসমু বাসায়।
-আচ্ছা।

কল কেটে দিলে মনি বিলটা মিটিয়ে দিলো। এরপর এগিয়ে গেলো সামনের দিকে, চলতে শুরু করলো এক নতুন পথে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here