মন মুনিয়া পর্ব-১৬

0
1834

#মন_মুনিয়া
তন্বী ইসলাম -১৬

মনি যখন রিতার দেওয়া ঠিকানামতো পৌছুলো, তখন প্রায় সন্ধ্যে ঘনিয়ে এসেছে। মনি এখনো বাসায় গিয়ে পৌছে নি। শুধু জায়গাটায় গিয়ে নেমেছে। চারপাশটা একদম অপরিচিত, বিভিন্ন ধরনের মানুষের যাতায়াত চারপাশে। মনি এবার কিছুটা ভয় পেতে শুরু করলো। চারপাশে বার বার ভয়ে ভয়ে তাকালো সে।

একটা সময় একটা ফ্লেক্সির দোকান দেখতে পেলো মনি। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো সেখানে। একটা অল্পবয়সী ছেলে দোকানে বসা। মনিকে কাচুমাচু করতে দেখে ছেলেটি বললো
-আপু কিছু বলবেন?
ছেলেটির কথায় মনি একটু স্বস্তি পেলো। সে মুখে জোরপূর্বক হাসি টেনে বললো
-একটা ফোন করতাম।

ছেলেটি মনিকে একবার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলো। এরপর বললো
-নতুন আসলেন ঢাকায়?
-হুম।
-একাই?
-হুম।
-নাম্বার দেন, কল দিয়ে দিচ্ছি।

মনি চটজলদি নাম্বারটা বের করে ছেলেটির হাতে দিলো। ছেলেটি ডায়াল করে ফোনটা মনির হাতে ধরিয়ে দিলে মনি তারাতাড়ি কানে ঠেকালো সেটা। ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ হলে মনি বললো
-রিতা?
-না আমি আশা। রিতার রুমমেট।
-রিতা নাই?
-আছে, এই নাও।

রিতা ফোন ধরার পর মনির কাছ থেকে ওর অবস্থান জানতে চায়। মনি ফ্লেক্সির ছেলেটির কাছ থেকে ওর বর্তমান অবস্থান টা জেনে রিতাকে বলে। রিতা ওকে একটু সময় অপেক্ষা করার কথা বলে ফোন রেখে দেয়।

মনি ফ্লেক্সির ছেলেটিকে বিল দিতে চাইলে ছেলেটি হেসে বলে
-এইটা আমার পেশা না আপু। আমি ফ্লেক্সি করি, ফোনের যন্ত্রাংশ বেচি এই। আমার পার্সোনাল ফোন থেকে আপনাকে কথা বলতে দিয়েছি, নেহাত আপনি বিপদে পরেছেন তাই। বিল কিভাবে নেই বলুন তো?

মনি অবাক হয়ে। সে বিস্মিত নয়নে ছেলেটিকে দেখতে থাকে। এই অপরিচিত শহরে এতো ভালো মনের মানুষ আছে মনির জানা ছিলোনা। সে জন্মের পর থেকেই শুনে এসেছে শহরের মানুষের মন বলতে কিছু নেই। তবে আজ মনির খুব বলতে ইচ্ছে করছে, মন শহরের মানুষদেরও আছে, শুধু কিছু পশুদের মন থাকেনা।

মনিকে দোকানের সামনে পায়চারি করতে দেখে ছেলেটি মনিকে ডেকে একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বলে
-আপনি এখানে বসুন। আপনার বান্ধবী নিশ্চয় চলে আসবে এখানে। হয়তো এ দোকান তার পরিচিত, তাই একবার বলতেই চিনে গিয়েছে। আপনার ভয়ের কিছু নেই।

ছেলেটির কথায় মনি নির্ভয়ে বসলো।
অপেক্ষার প্রহর গুণে যাচ্ছে মনি। রিতার আসার কোনো নামগন্ধ নেই। প্রায় আধঘন্টা হতে চললো, এখনো আসছেনা মেয়েটা। মনি অসহায় মুখ করে ছেলেটির দিকে তাকালো। ছেলেটি ওর চোখের চাহনি বুঝতে পেরে নিজ দায়িত্বে সেই নাম্বারে আবার কল করলো।

কল বাজছে, কিন্তু রিসিভ হচ্ছেনা। আরো কিছুক্ষণ সময় পার হয়ে যাবার পর মনি একটু বাইরে উঁকি দিলো। সে দেখলো, একটা মেয়ে হন্তদন্ত করে ছুটছে, কাউকে খুজে চলেছে সে। শহরের জমকালো আলোতে মেয়েটিকে চিনতে ওর একটুও অসুবিধা হলোনা।

মনি খুশিমনে জোরে ডাক দিলো
-এই রিতা, আমি এইখানে।
মনির ডাক রিতার কানে গেলো। সে মনির ডাকের উৎসের দিকে তাকাতেই মনিকে দেখতে পেলো। এক চিলতে হাসি দেখা গেলো তার মুখে। সে জলদি এগিয়ে এলো মনির কাছে। মনিকে জরিয়ে ধরে প্রায় কান্না করে দিয়ে বললো
-ভালো আছিস মনি? তোরে খুব মনে পরে।
-আমারও খুব মনে পরে তোরে রিতা। আমাগো ফোন নাই তাই তোর সাথে যোগাযোগ করতে পারি না।।
-আচ্ছা এখন বাসায় চল। বাসায় গিয়ে তোর সাথে কথা হবে।
-হুম।

মনি রিতার পিছু পিছু এগিয়ে যেতে গিয়েও থেমে গেলো। রিতা বিস্ময়ে বললো
-দাঁড়ালি কেন?
-উনাকে বলে আসি। মনি কিছুটা দৌড়ের মতো করে ছুটে গেলো সেই দোকানটায়। হাঁপাতে হাপাতে সেই ছেলেটাকে বললো
-আপনারে অনেক ধন্যবাদ ভাই। আপনে আমার অনেক উপকার করছেন আইজ।
ছেলেটি হেসে বললো
-আপনার বয়সী আমার একটা বোন আছে। আপনার জায়গায় আমার বোনটাও তো বিপদে পরতে পারতো।

কিছু বলার মতো ভাষা খুজে পাচ্ছিলো না মনি। পৃথিবীর সব মানুষেরা কেন এমন হয়না?

বাসায় এসে আগে গোসল করে নেয় মনি। এক্সট্রা কোনো জামাকাপড় আনেনি, তাই রিতার জামা থেকেই এক সেট জামা সে পরে নেয়।

সারাদিন অনেক ধকল যাওয়ার কারণে বেশ ক্লান্ত হয়ে যায় সে। যদিও অনেক খিদে পেয়েছে, তবে খেতে ইচ্ছে করছেনা। মন মরা হয়ে শুয়ে আছে। রিতা রান্নাবান্না আগেই সেড়ে রেখেছিলো। মনিকে শুয়ে থাকতে দেখে বললো
-ঘুম পাচ্ছে? ঘুমিয়ে পরবি?
-ঘুম আসে নাই, শরীর ম্যাজম্যাজ করতাছে।
-খেয়ে নে। আমার কাছে শরীর ব্যাথার ট্যাবলেট আছে, খাইলে ম্যাজম্যাজানি কমে যাবে।।

মনি আনমনা হয়ে বললো
-মনের ম্যাজম্যাজানি কেমনে কমামু?
রিতা অবাক হলো মনির কথায়। সে ধীরে ধীরে মনির পাশে এসে বসলো। মনি তখনও নির্বাক। সে মনির পিঠে হাত রেখে বললো
-তোর কি হইছে রে মনি? আগে তো এমন ছিলি না। বল আমার কাছে তোর কি হইছে?

মনি মুচকি হেসে তাকালো রিতার দিকে। ওকে আশ্বস্ত করে বললো
-তোরে সব কমু রিতা। তাইতো তোর কাছে আইছি।

মনি কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে পরক্ষণে সামান্য উৎসাহ নিয়ে বললো
-আইচ্ছা রিতা, বাড়িতে কথা কইছোস আইজ?
-হুম।
-আমাগো বাড়ির ব্যপারে কিছু বলছে তোর মা?
-শুনলাম তোগো বাড়ি নাকি আইজ অনেক ঝামেলা হইছে।
মনির বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো। অনেক ঝামেলা হইছে মানে? মায়েরে কি আব্বায় মারছে? ওই ভন্ড জয়নাল অপমান করছে?

মনি আবার রিতাকে বললো
-কি ঝামেলা হইছে রিতা?
-বেশি কিছু জানি না। তয় তুই বাড়ি ছাইড়া চইলা আইছোস সেইটা নিয়াই নাকি অনেক কান্ড ঘটছে।
মনির চোখ দিয়ে দু ফোঁটা অশ্রু বেরিয়ে এলো। রিতা মনিকে শান্তনা দিয়ে বললো
-কাঁদিস না মনি। আমি বুঝতে পারছি তুই বিপদে পইরাই এইখানে আইছোস। তোর কি হইছে আমারে বল মনি।
-আমি অন্তঃসত্ত্বা।

মনির কথায় চমকে উঠল রিতা। চোখ বড় হয়ে গেলো তার মুহূর্তে। মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো
-বলিস কি মনি? কে করলো এই অনাচার?
-হামিদ স্যারের ছেলে।
রিতা বিস্মিত গলায় বললো
-কাহিনি কি, একটু বিস্তারিত বল তো শুনি?

মনির চোখ বেয়ে শীতল পানির অশ্রুধারা বেরিয়ে এলো। রিতা ওকে দুহাতে আগলে ধরে বললো
-কান্না থামা মনি।
মনি চোখ মুছে নিলো এবার। মুখের অবয়ব পালটে যাচ্ছে। এক পর্যায়ে চোখমুখ শক্ত হয়ে গেলো তার। সে বলতে শুরু করলো পুরো ঘটনা।

______
একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে শোকে কাতর মনির মা। সারাদিন কিচ্ছুটি মুখে দেন নি তিনি। দাওয়ার এক মাথায় বসে সমানে কেঁদে যাচ্ছেন। রহিম মিয়ার তাতে রাগে পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে। তার ধারণা, মেয়ের এই কান্ডের পিছনে ওর মায়েরই হাত আছে। তিনি এবার ধমকে বলে উঠলেন
-অভিনয় করিস না মনির মা। মাইয়ারে উস্কানি দিয়া অহন ভাব ধরস? আমার মান সম্মান রাখলি না তোরা মা মাইয়া মিইলা।

মনির মায়ের খুব ইচ্ছে করছিলো এই কথার মুখ্যম জবাব দিতে। তবে সে এখন এই পরিস্থিতিতে নেই। তিনি অঝোরে কেঁদেই যাচ্ছেন।

রহিম মিয়া এবার কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বললেন
-আল্লাহর দরবারে কি এতো পাপ করছিলাম আমি, যে আল্লাহ আমারে এই রকম বউ মাইয়া দিলো৷ আল্লাহ গো, শত্রুর ঘরেও এমন বউ মাইয়া দিও না।

মনির মা এবার আর নিজেরে শান্ত রাখলে পারলোনা। সে শক্ত গলায় বললো
-আইজ যা হইছে আপনের লাইগা হইছে। মাইয়ারে জবাই দিতে চাইছিলেন, অহন আল্লাহ আপনের কাছ থেইকা মাইয়াডাই কাইরা নিছে। আমি কান্তাছি কেন, আমার তো খুশি হওনের কথা। কারণ মাইয়া যা করছে, উচিত করছে। এইবার ফাক পাইলে আমিও গা ঢাকা দিমু। আপনের মতো অমানুষের লগে থাকনের কোনো ইচ্ছাই আমার নাই।
-মুখ সামলাইয়া কথা বল মনির মা। হুংকারে বলে উঠলেন রহিম মিয়া।

মনির মা দ্বিগুণ তেজে বললেন
-কেন মুখ সামলামু? আমি কইমুই আইজ। কম অত্যাচারে মাইয়াডা আমার বাইর হয় নাই। আমি কি বুঝি না কিছু। আপনে মাইয়াডারে তীলে তীলে মারবার চাইছিলেন, তাই সহ্য করতে না পাইরা মনি আমার গেছে গা।
-তোরা আছোস তোগো ধান্ধায়, ওইদিকে জয়নাল যে শাসাইয়া গেছে, সেই কথা কি মনে আছে?
-সব মনে আছে। আহুক আবার ওই ভন্ডডা, দাও দিয়া যদি না কুপাইছি ওরে।

সব শুনে আঁতকে উঠলো রিতা। ওরও চোখদুটো ভিজে গেছে এবার। সে মনিকে শান্তনা দিয়ে বলতে লাগলো
-মন খারাপ করিস না মনি। মানুষ এতোডা খারাপ কেমনে হয় আমি বুঝিনা। আর স্যারের ছেলে, ওদের তো শিক্ষা দিক্ষা, আচার আচরণ সবদিক থেকা বেশি থাকার কথা, ওরা কেন এমন করে আমার মাথায় ধরে না।।

কথাগুলো বলে মনির দিকে তাকালো রিতা। মনি নিচের দিকে মুখ ফিরিয়ে কাদঁছে। রিতা ওর কাঁধে হাত রেখে বললো
-ওহন কি করবি শুনি? আর পেটের বাচ্চাটাই বা কেমনে রাখবি?
-কেন? এই কথা বসল কেন?
-আমি তোর মনের অবস্থা বুঝি মনি। কোনো মেয়েই চায় না, তার নিজের বাচ্চা নষ্ট করতে। কিন্তু সমাজ বইলা তো একটা কথা আছে। কি পরিচয় দিবি বাচ্চাটার?

মনি শক্ত গলায় বললো
-আমার বাচ্চার পরিচয় আমি নিজেই হমু। আর কাউরেই আমার দরকার নাই। তুই শধু আমারে একটু সাহায্য করিস রিতা।

ওই নিয়ান রে আমি দেখাইয়া দিমু, ওরা জ্বালামু। ওর চোখের সামনে দিয়া আমার বাচ্চা হাটবো, ঘুরবো, কথা বলবো।

সে শুধু দেখবো আর বুক ফাঁটা আর্তনাদ করবো। কিন্তু ছুইতে পারবোনা।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here