মন মুনিয়া পর্ব-৩৬

0
1545

#মন_মুনিয়া
তন্বী ইসলাম -৩৬

নীল হাসলো। ফুরফুরে কন্ঠে বললো
-আমি এ গ্রামের জামাই।

মনি ভ্রু বাকিয়ে তাকালো নীলের দিকে। বিষাদ গলায় বললো
-চলুন এখান থেকে।
কথাটা বলে হনহন করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলো মনি। পেছন থেকে ডাক এলো
-বিয়ে করেছো কবে, জানালে না তো।

মনি থমকে দাড়ালো। এরপর ফিরে আক্রোশে নীলের দিকে তাকিয়ে বললো
-রাস্তাঘাটে যার তার সাথে কথা বলার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। আপনি আসবেন নাকি থাকবেন?
নীল অবাক হলো। মনে মনে ভাবলো, “হটাৎ ওর আবার কি হলো?”

ইতি তাচ্ছিল্যের সাথে বললো
-বেশ দেমাগ হয়েছে দেখছি তোর। মাটিতে পা ই পড়ছেনা।
-পা টা সত্যিই তুলে রেখেছি ইতি। সঠিক সময় হলে একদিন ঠিকই নামাবো।
ইতি রেগে নিয়ানকে বললো
-বাজে কথা শুনার জন্য কেন এখানে দাঁড়িয়ে আছো। চলো এখান থেকে।

নিয়ান হাসলো। সে মনির দিকে এগিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বললো
-সত্যিই বিয়ে করেছো নাকি ফাঁদে ফেলেছো?
মনি শক্ত গলায় বললো
-সবাইকে নিজের মতো ক্যারেক্টালেস নাই ভাবলেন মিস্টার নিয়ান।
-সেতো দেখতেই পাচ্ছি।
-চোখের দেখা সবসময়ই ঠিক হয় না। যেমন, আমিও আপনাকে দেখে খুব ভালো মনে করতাম। তেমনি গ্রামের সকলেই আপনাকে সাধু মনে করে। কিন্তু এটা যে কতো বড় ভুল সেটাতো আপনিও জানেন।

নিয়ান ভ্রু বাকালো। ওর ভ্রু বাকানো দেখে মনি হেসে বললো
-আমিও না বড্ড বোকা, ফালতু মানুষের সাথে কথা বলে সময়টা ফালতুভাবেই নষ্ট করছি।

নিয়ান দু পা পিছিয়ে ইতির কাছে গেলো এবার। ওর চোখেমুখে বেজায় আক্ষেপ। নীল সন্দিহান চোখে নিয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু একটা গবেষণা করছে বোধহয়। মনি এবার চাপা গলায় বললো
-আপনি আসবেন প্লিজ, মুনিয়া বোধহয় কাঁদছে। আমাকে তারাতাড়ি ফিরতে হবে।।

নীল হাসিমুখে বললো
-আসছি মহারাণী।
নিয়ান হটাৎ মুখ বাকালো, কপাল কুচকে বললো
-মুনিয়া কে?
-আমার মেয়ে। এবার আনিনি, খুব ছোট তো। বড় হবার পর কোনো একদিন এখানে এলে আপনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিবো, মামা বলে ডাকবে আপনাকে। ভাগ্নীকে আদর করতে কৃপণতা করবেন না কিন্তু।

নিয়ান অবাক হলো। বললো
-এরমধ্যে বাচ্চাও নিয়ে নিলে!
মনির রাগ হলো এবার বেশ। তবে সেটা চোখেমুখেই প্রকাশ করলো, মুখে আনলো না। নীল হয়তো এখন বেশ অলস হয়ে গেছে। সামনে হাটার নামই নিচ্ছেনা।

মনি সামান্য রাগীচোখে নীলের দিকে তাকালো। শক্ত গলায় বললো
-আপনাকে কি কোলে করে নিতে হবে?
-পারবেনা আমাকে নিতে, তবে তোমার দায়িত্ব টা আমাকে দিলে আমি সানন্দে তোমায় কোলে করে নিয়ে যেতে রাজি। দিবে কি সেই দায়িত্বটা?
-চলুন তো।

নিয়ানের দিকে এক পলক তাকালো মনি। নিয়ান অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। মনি নিয়ানের দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি হেসে নীলের হাতের পাঁচ আঙ্গুলের মাঝে ওর হাতের আঙ্গুল ঢুকিয়ে মুষ্টিবদ্ধ ভাবে ধরলো। নীল অবাক হলো বেশ, অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে রইলো সে মনির দিকে। মনি হাসলো। মিষ্টি কন্ঠে বললো
-সামনে চলুন, এখানে চারপাশে তেতো তেতো স্মেল আসছে, সহ্য করতে পারছিনা।
-চলো।

নিয়ানের চোখের সামনে দিয়ে হেটে চলে গেলো নীল আর মনি। নিয়ান প্রচন্ড অবাক হলো। কিছুদিন আগেও মেয়েটা অসহায়ের মতো তার কাছে এসেছিলো, সেই মেয়েটাকে আজ এতো হাসিখুশি কিভাবে?

বাস স্ট্যান্ডের কাছাকাছি আসতেই নীলের হাতের মুষ্টি থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিলো মনি। নীল অবাক হয়ে বললো
-হাতটা ছাড়িয়ে নিলে কেন?
-হাতটা আমার, তাই ছাড়িয়ে নিয়েছি। কেন, আপনার কাছ থেকে অনুমতি নেওয়া লাগতো?
-হটাৎ কি হলো তোমার, এতোক্ষন তো খুব ফুরফুরে মেজাজে ছিলে দেখছিলাম।
-ফুরফুরে মেজাজে ছিলাম না, তবে একজনের বুকে জ্বালা ধরাচ্ছিলাম। ওকে বুঝাচ্ছিলাম, ও যেমন আমাকে তীব্র যন্ত্রণা দিয়ে সুখে আছে, আমিও সেই যন্ত্রণা পেয়েও তার চেয়ে হাজারগুণ সুখে আছি।

নীল হটাৎ গম্ভীরমুখে বললো
-কাকে?
-নিয়ানকে।
নীল উৎকন্ঠা নিয়ে বললো
-এটাই কি নিয়ান?
মনি জোরপূর্বক মুখে একটু হাসি টেনে বললো
-হুম।

নীল থমথমে মুখে বললো
-আমাকে আগে কেন বললে না?
-বললে কি হতো? কপাল কুচকে বললো মনি।
নীল চোখেমুখে থমথমে ভাবটা আরো কিছুক্ষণ বজায় রেখে হটাৎ বলে উঠল
-উনাকে সালাম করতাম, এরপর বড় ভাইজান বলে কোলাকুলি করে আসতাম। বড়গিরীর সম্মানটা দিয়ে আসতাম।
মনি রেগে বললো
-খুব শখ তাইনা?
নীল হু হু করে বলে উঠলো
-সত্যিই খুব শখ।

বাস ছেড়েছে কিছুক্ষণ আগে। নীল আর মনি পাশাপাশি সিটে বসা। সিটে হেলান দিয়ে বাইরের দিকে বিমর্ষ চোখে তাকিয়ে আছে মনি। যতোই সে ভালো থাকার অভিনয় করুক, কিন্তু সে কি সত্যিই ভালো আছে? নীল একভাবে তাকিয়ে আছে মনির দিকে। মেয়েটা সত্যিই দারুণ। পরিস্থিতি মানিয়ে নিতে পারে চটপট।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আঁধার ঘনিয়ে এসেছে আরো অনেক্ষন আগেই। গাড়িও অনেকটা দূরে চলে এসেছে। তবে রাস্তায় অনেক জ্যাম থাকার কারণে গাড়ি সামনে এগুতেই পারছেনা আর। এক যায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে রাত হয়ে যাচ্ছে অনেক। মুনিয়ার জন্য অনেক চিন্তায় আছে মনি। বেশ উদ্বিগ্ন সে। মনির চোখেমুখে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ পাচ্ছে। নীল সে খেয়াল করে বললো
-কোনো প্রব্লেম হয়েছে মনি?
-মুনিয়ার জন্য চিন্তা হচ্ছে।
-ও ঠিক আছে।
-কিভাবে জানলেন?
-আশাকে ফোন করেছিলাম।।
-কখন? আমাকে দিলেন না কেন?
-তুমি তখন তোমার বাবা মায়ের সাথে ছিলে।
-ওহ।

জ্যাম ছাড়তে ছাড়তে রাত প্রায় ৮টার বেশি হয়ে গেছে। গাড়ি হনহন করে ছুটতে শুরু করেছে সামনের দিকে। কোলাহল পেরিয়ে এক জঙ্গলের ভেতরের রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে গাড়িটা। মনির চোখ বুজে এলো এবার। ঘুমে নেতিয়ে পরলো সে। গাড়ির ঝাকিতে বার বার মাথা এদিক সেদিক করছে। নীল হাসলো। কিছুক্ষণ ঘুমন্ত মনির মুখপানে তাকিয়ে থেকে এক পর্যায়ে ওর মাথাটা আলতোহাতে ধরে নিজের কাধে শুইয়ে দিলো সে। এবার আরামে ঘুমাচ্ছে মনি।

আরো কিছুটা রাস্তা পেরিয়ে যেতেই হটাৎ গাড়িটা থেমে গেলো। কোনো বাস স্টপেজ ছাড়া এভাবে রাস্তার মাঝখানে গাড়ি থেমে যাওয়ায় যাত্রীদের মধ্যে শোরগোলের সৃষ্টি হলো। এরমধ্যে ঘুম ভেংগে গেলো মনির। গাড়ি থেমে আছে দেখে নীলের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললো
-আমরা এসে গেছি?
-না।
-তবে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে কেন?
-বুঝতে পারছিনা। বসো, আমি গিয়ে দেখে আসছি।

নীল উঠে যেতে নিতেই লোকমুখে শুনতে পেলো গাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে। কথাটা শুনে মনির চোখেমুখে স্পষ্ট আতংক দেখা গেলো। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। তার উপর এতো রাত। নীল মনিকে শান্তনা দিয়ে বললো
-এতো আতংকিত হয়োনা মনি। আমি দেখে আসছি কি হয়েছে।

যাওয়ার কয়েক মিনিট বাদেই ফিরে এলো নীল। মনি ব্যতিব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলো
-কি, কি হয়েছে?
নীল নিজের আসনে বসতে বসতে বললো
-গাড়িটা সত্যিই নষ্ট হয়ে গেছে মনি। সাড়তে দেড় দুই ঘন্টা লাগবে।
মনি ভীতসন্ত্রস্ত কন্ঠে বললো
-মানে, তাহলে আমরা যাবো কিভাবে?
-আর কোনো উপায় নেই, এটা ঠিক হওয়া অব্দি আমাদের এখানেই অপেক্ষা করতে হবে। রাতে আর বাস নেই।

গাড়িতে কিছুক্ষণ বসে থাকার পর উসখুস করতে লাগলো মনি। একভাবে এভাবে কতোক্ষণ বসে থাকা যায়? মনিকে এমন উসখুস করতে দেখে নীল বললো
-খারাপ লাগছে?
-বসে থাকতে আর ভালো লাগছেনা।
-চলো, নিচে যাই।
মনি এক মুহুর্ত নীলের দিকে তাকালো। ভাবলো, গাড়ি যেহেতু দাঁড়িয়েই আছে, তাহলে একটু নেমে হাটাহাটি করুক, ভালো লাগবে।।

মনি সম্মতি জানালে নীল মনিকে সাথে করে গাড়ি থেকে নামলো। আশেপাশে জনমানবহীন অবস্থা, চারিদকটা নিঝুমতায় ছেয়ে আছে। অসংখ্য গাছগাছালির ভীরে ঝিঝিপোকার তীব্র আর্তনাদ আর রাতের জোনাকিদের ঝাকে ঝাকে উড়ে বেড়ানো, সব মিলিয়ে এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। মনি মনভরে সেসব উপভোগ করতে ব্যস্ত। চারপাশটা অন্ধকারাচ্ছন্ন হলেও চাঁদের আবছা আলোয় ভালোয় দেখা যাচ্ছে।

মনি হাটতে হাটতে একটু সামনে এগিয়ে গেলো। একটা জোনাকি ওর চোখের সামনে দিয়েই ঘুড়ে বেরাচ্ছে। মনি হাত বাড়িয়ে জোনাকিটা ধরার চেষ্টা করলো। কয়েক বারের প্রচেষ্টায় এক সময় জোনাকিটা ওর হাতের মুঠোয় ঠাঁয় পেলো। এক ফালি খুশির হাসি দেখা গেলো মনির ঠোঁটের কোনে।

নীল কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে তার মায়াবতী কে। চাঁদের আলোর ভীরে এ যেনো এক অন্য চাঁদ। খুশির আমেজে তাকে আজ অন্যরকম ভালো লাগছে। এ ভালো লাগার মুহূর্ত থেকে চোখ ফেরানো দায় হয়ে গেছে নীলের।

মনির কাছাকাছি যেয়ে নীল বললো
“এ চাঁদের জোছনার অপরুপ সাজে, তোমাতে মুগ্ধ হয়েছি আমি,
ডুবে যেতে চাইছি বারে বারে, তুমি কি রাজি?
আমারে মুড়িয়ে নিতে তোমারি মাঝে””

মনি অবাক হয়ে তাকালো নীলের দিকে। নীল ভয়ানক নেশাতুর চোখে তাকিয়ে আছে মনির দিকে। এ নেশা প্রেমের নেশা। মনির ভয় হচ্ছে, পাছে এ নেশায় মাতাল হয়ে যদি বলে দেয়, “আমিও ভালাবাসি প্রিয়”

মনি চোখ সরিয়ে নিলো, কিছুটা দুরত্ব নিয়ে দাড়ালো সে। নীল পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বললো
-কাছেই একটা ছোটখাটো নদী আছে, যাবে দেখতে?
মনি উৎসাহ নিয়ে বললো
-কি নদী?
– নাম জানিন, লোকজন বলাবলি করছিলো। অনেক সুন্দর নাকি নদীটা
-বাস ঠিক হয়নি?
-আরো কিছুটা সময় লাগবে, এর আগেই আমরা চলে আসবো।

মনি হেসে বললো
-চলুন তাহলে। নদীর পাড়ে হাটতে আমার ভালোই লাগে।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here