মন মুনিয়া পর্ব-৩৭

0
1500

#মন_মুনিয়া
তন্বী ইসলাম -৩৭

সরু একটা নদী বেয়ে চলেছে জঙ্গলের পাশ দিয়ে। চাঁদের আলোয় নদীর স্বচ্ছ পানিটা ঝলমলে দেখাচ্ছে। অপুর্ব লাগছে দেখতে। নদীর পাড় ধরে হাটতে হাটতে বেশ কিছুটা দূরে চলে গেছে নীল আর মনি।

ভালোলাগার আমেজে তারা মত্ত। কারো মুখে কোনো কথা নেই। বেশ কিছুটা দূরে গিয়ে মনি খেয়াল করলো ঘাটে একটা ছোট্ট নৌকা বাধা। মনির বেশ ইচ্ছে হলো নৌকাটায় গিয়ে উঠতে। সে নীলের কাছে বায়না করে বললো
-আমি নৌকায় উঠবো।
-ইচ্ছে করছে?
-খুব।
-কিন্তু মাঝি নেই তো। নৌকা চালাবে কে?
-চালানো লাগবেনা। নৌকায় কিছুক্ষণ বসে থেকে চলে আসবো।
-আমিও আসবো?

মনি কিছুক্ষণ কি যেনো ভেবে বললো
-আসুন।
মনি খুশিমনে নৌকায় গিয়ে উঠলো। পেছন পিছন নীলও এসে উঠলো নৌকায়। নৌকায় বসে পা পানিতে চুবিয়ে মনি চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে। আহ, কি পরম আনন্দ।

নীল মুচকি হেসে তাকালো মনির দিকে। কিছুক্ষণ একভাবে তাকিয়ে থেকে বললো
-ভালো লাগছে?
-হুম।
-আর আমাকে?
মনি হেসে হেসে বললো
-কি আপনাকে?
-আমাকে ভালো লাগছেনা?
-আপনাকেও ভালো লাগছে, ভীষণ ভালো লাগছে।
নীল হাসলো। বললো
-সত্যিই?
মনি হটাৎ চমকে উঠলো। খুশির চোটে বলে দিয়েছে সে ভালো লেগেছে উনাকেও, নিজের মধ্যে থাকলে কি কখনো বলতো?

মনি দেখলো নীল অবাক চাহনীতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। সে ভ্রু বাকিয়ে বললো
-কি দেখেন?
-তোমায়।
-কেন? এক মেয়ের মাকে দেখার কি আছে।

নীল হাসলো। চাঁদের দিকে তাকিয়ে স্থির গলায় বললো,
“এক ভুবন ভোলানো মোহিনী আমায় করেছে দিশেহারা, আমি তাহাতে মুগ্ধ হয়ে নিজেকে করেছি আত্মহারা।

সে নারীতে কি এমন আছে, প্রশ্ন করিয়াও খুজিয়া পাইনা তাহার ধার,
সে আমায় আঁকড়ে ধরিবে, এ সামান্যই আমার আবদার” (তন্বী ইসলাম)

মনি চাঁদের পানে তাকিয়ে বললো
-আপনি চাইলে কিন্তু কবি হতে পারতেন।
-কবি হয়ে কি করবো, যদি কবিতা আমার ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে।
-কে কবিতা?
-আমি কবি হলে তুমিতো আমার কবিতাই হতে।
-আপনার সাথে কথায় পেরে উঠা দায়।

আরো কয়েক মুহূর্ত কেটে যাবার পর মনির খেয়াল হলো, অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। এবার উঠা উচিৎ। সে নীলের দিকে তাকিয়ে বললো
-গাড়ি হয়তো ঠিক হয়ে গেছে। চলুন এবার উঠা যাক।
নীল একটা উত্তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে বললো
-চলো।

মনি যখন নৌকা থেকে উঠে দাড়ালো নামার জন্য, তখন পাশের ঝোপকঝাড়ের আড়ালে কারো কথার শব্দ শুনতে পেলো। সে সামান্য ভয়ে নীলের দিকে তাকিয়ে বললো
-কেউ বোধহয় আসছে এদিকে।
-সেটা আমিও ভাবছি। তারাতাড়ি নেমে পরো, এতোরাতে আমাদের দুজনকে এভাবে একা দেখলে হয়তো মাইন্ডে নিবে।।

মনি ভয়ে ভয়ে ধীরে ধীরে নৌকা থেকে নামলো, নীল এখনো নামেনি, নামার জন্য পা বাড়িয়েছে মাত্র। এমন সময় কেউ কড়া গলায় চিৎকার করে বলতে লাগলো
-কেডা, আমার নৌকায় কেডা?
মনির ভয়ে গলা শুকিয়ে গেলো। সে কাঁপাকাঁপা গলায় নীলকে বললো
-এখন কি হবে? উনারা আমাদের দেখে নিয়েছে।
-ভয় পেয়োনা মনি, আমি আছিতো।

নীল নামার সাথে সাথেই দেখতে পেলো তিন চারজন লোক ওদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে। নীল স্বাভাবিকভাবেই বললো
-কিছু বলবেন?
লোকগুলো অগ্নী কন্ঠে বললো
-এইহানে অতো রাইতে আপনেরা কি করেন?
-আমাদের বাস নষ্ট হয়ে গেছে, সাড়তে সময় লাগবে। তাই সময় কাটানোর জন্য হাঁটতে হাঁটতে এখানে চলে এসেছি।

লোকগুলোর মধ্যে দুই একজন বলে উঠলো
-আমাগোরে আবুল মনে হয়? কিচ্ছু বুঝিনা আমরা? বাস নষ্ট হইলে বাসের আশেপাশে মানুষ ঘুরাঘুরি করে, এমন ফাঁকা যায়গায় আইয়া দুই পুলা মাইয়া নৌকার ভিতরে ঢুকে না।

লোকগুলোর কথায় মনি প্রচন্ডরকম লজ্জা অনুভব করতে লাগলো। অস্বস্তিতে সে নীলের পিছনে গিয়ে দাড়ালো সে। তখন লোকগুলোর মধ্যে একজন বললো
-এই মাইয়া, সামনে আহো৷ পেছনে লুকাও কেন।
মনি ভয় পেয়ে গেলো বেশ। এই লোকগুলো ওকে কেন ডাকছে?

নীল দৃঢ়তা নিয়ে বললো
-ওকে ডাকছেন কেন, যা বলার আমাকে বলুন।
-কেন, ওরে ডাকলে তোমার সমস্যা কি পুলা?
-দেখুন, ও ভয় পাচ্ছে। যা বলার আমাকে নির্দ্বিধায় বলতে পারেন।
-আকাম করনের বেলা ভয় লাগেনা, অহন ধরা খাইয়া ভয় লাগে কেন, এইদিকে আহো মাইয়া। ধমকিয়ে বললো একটা লোক। মনির এবার লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। নীল অস্বস্তিতে পরলেও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো।

এক পর্যায়ে সকলের জোরাজুরিতে মনি পেছন থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হলো। সে লোকগুলোর সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। লোকগুলো তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললো
-এই পুলা কি লাগে তোমার?
মনি নির্বাক। সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। লোকগুলো আবারও তিরিক্ষি মেজাজে বললো
-এই মাইয়া কি জিগাইতাছি। কথা কও না কেন? কি হয় এই পুলা তোমার?
মনি ভয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো
-আ আমার আশা আপুর বড় ভাই।

তখনই লেকগুলোর মধ্যে একটা গুঞ্জন শোনা গেলো। কেউ বলছে, “যা ভাবছিলাম তাই, অবৈধ সম্পর্কে জড়াইতে এই খালি যায়গাই আইছে।” আবার কেউ বলছে, “পুলাডারে ধইরা পিডা দে, তাইলেই সব রশ বাইর হইয়া যাইবো।

মন কাঁপছে। নীল অদ্ভুদ ভাবে লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। মানুষ কতোটা লো মেন্টালিটির হলে কিছু না জেনে কাউকে এভাবে অপবাদ দিতে পারে।

এতোক্ষনে চিল্লাচিল্লিতে আরো মানুষজন এসে হাজির এলো সেখানটায়।
নীল বললো
-দেখুন, আপনারা যা ভাবছেন তা একদমই সত্য নয়। আমাদের গাড়িটা সত্যিই নষ্ট হয়ে গেছে, তাই হাঁটতেই এসেছি আমরা এখানে।
একজন মাঝবয়সী লোক বললো
-গাড়ি নষ্ট হইছে? তা এতো রাইতে একটা মাইয়া মানুষ নিয়া গাড়ি দিয়া কই যাইতাছিলা শুনি?
-আমাদের বাড়ি যাচ্ছিলাম।
-কই থেইক্কা আইছো?
-ওদের বাড়ি থেকে। মনিকে ইশারা করে বললো লোকটি।
-কেন, ও কি তোমার বিয়া করা বউ?

নীল ইতস্তত বোধ করে বললো
-নাহ।
-কোনো বাপ মা এমন সোমত্তা মাইয়ারে এতো রাইতে কোনো পুলার লগে ছাড়ে না। আমাগো বয়স এমনে এমনে হয় নাই। একটু হইলেও জ্ঞান আমাগো আছে।
নীল কি বলবে এবার, কোনো ভাষা খুজে পাচ্ছেনা সে।

একজন বলে উঠলো
-নিশ্চয়ই ভাইগা আইছে এই মাইয়ারে নিয়া।
নীল বললো
-আমার বাড়িতে ফোন দিচ্ছি, আপনারে কথা বলে সবটা জেনে নিন। অঝতা আমাদের অপদস্ত করবেন না।
-ফোন লাগাইবা? তাইলে লাগাও দেখি মাইয়ার বাপ মায়েরে।
মনি ইতস্ততভাবে বললো
-আমার আব্বা আম্মার কাছে মোবাইল নেই।

লোকগুলো কেমন করে যেনো হাসলো। বললো
-জানতাম এইডাই উত্তর পামু। এই যুগে আবার কারো কাছে মোবাইল না থাকে।
নীল বললো
-আপনারা আমার বাবা মায়ের সাথে কথা বলুন।
-এখনকার পুলা তোমরা, কোন বন্ধু বান্ধবীরে মা বাপ সাজাইয়া কথা কওয়াইবা, তাই আমাগো রে বিশ্বাস করন লাগবো!!

নীল এবার বিপাকে পরলো। কিভাবে বুঝাবে এই লোকেদের?
অবশেষে এদের মধ্যে থাকা এক বৃদ্ধ লোক বলে উঠলো
-ওগোরে যেহেতু হাতেনাতে ধরছোস, তয় মাইরপিট আর ঝামেলা না কইরা সোজা বিয়া করাইয়া দে। ওরাও নিশ্চন্ত হোক, আমরাও নিশ্চিন্ত হই।

মনি আঁতকে উঠলো। এ কি বলছে লোকগুলো। সে অস্পষ্ট ভাবে বলে উঠলো
-বিয়ে করাবেন মানে?
-হো বিয়া করামু, কেন আপত্তি আছে?
-আমি বিয়ে করবো না।
-তুমি রাজি না বিয়াতে? তাইলে তো নিশ্চয়ই কোনো ঘাপলা আছে। এই পুলা নির্ঘাত তোমারে জোর কইরা নিয়া আইছে এইহানে।

নীল তাকালো মনির দিকে। মেয়েটা প্রচন্ড অস্থিরতায় ভোগছে। নীল বললো
-দেখুন, ওকে জোরাজুরি করবেন না। এক্ষুনি বিয়ে করার মতো কিছু এখানে ঘটে নি।
কতোগুলো যুবক এখানে দাঁড়িয়ে ছিলো এতোক্ষণ। এবার এরা তেড়ে এলো নীলের দিকে। দাঁতে দাঁত চেপে বললো
-কয়েকটা কিল গুতা গায়ে পরলেই ভালো মানুষি দূর হইয়া যাইবো। পাব্লিকের মাইর, টের পাইয়া যাইবা মাইয়া নিয়া কারবাবির ফল।

নীল চিন্তিত নিজেকে নিয়ে নয়, মনিকে নিয়ে। মেয়েটার মনের উপর দিয়ে খুব প্রেশার যাচ্ছে। মনি এবার ঘাবড়ে গেলো। ছেলেগুলো ওকে মারার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সত্যি সত্যিই মেরে দিবে না তো? এতোগুলো মানুষ মিলে যদি উনাকে মারে, তাহলে নির্ঘাত উনি মরে যাবে। আমাকে সাহায্য করতে গিয়ে উনি এভাবে বেদম মারের শিকার হোক, আমি সেটা কখনোই মানতে পারবোনা।

ছেলেগুলো যখনই নীলকে মারতে উদ্ধত হলো, তখনই মনি জোরে বলে উঠলো
-থামুন আপনারা, কেন শুধু শুধু উনাকে এভাবে অপদস্ত করছেন? বিয়ে দিতে চান, আমি বিয়েতে রাজি। আপনারা আয়োজন করুন।

নীল চমকে তাকালো মনির দিকে। বিস্মিত গলায় বললো
-পাগল হয়ে গেছো মনি? এভাবে সবার চাপে পরে ডিসিশন নিও না।
-আপনি আমাকে বিয়ে করতে চান না?
নীল কিছুক্ষণ চুপ থেকে শান্ত গলায় বললো
-চাই, তবে এভাবে না।।
-এভাবেই হবে। আর উপায় নেই কোনো।
-আরেকবার ভেবে দেখো মনি।৷ বিয়েটা দুই একদিনের কোনো বিষয় না।
-ভেবেছি। আপনি মুখটা বন্ধ রাখুন, যদি পাব্লিকের হাতে মার খেতে না চান।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here