মন মুনিয়া পর্ব-৩৮

0
1476

#মন_মুনিয়া
তন্বী ইসলাম -৩৮

অবশেষে বৃদ্ধ লোকটির বাড়িতে নিয়ে গিয়ে গ্রামের এক হুজুরকে ডেকে নীল আর মনির বিয়ের কাজ সম্পন্ন হলো। মনির চোখে স্পষ্ট পানি দেখতে পাচ্ছে নীল। ওকে মার খাওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে মেয়েটার আজ এই অবস্থা হলো। নিজের কাছে নিজেকে কেমন যেনো দোষী অনুভব হচ্ছে তার।

ওখান থেকে যখন ওরা বেরিয়ে এলো তখন রাত বাজে প্রায় এগারোটা। এতো রাত হয়ে গেছে, তার উপর সাথে মনি আছে, গাড়িও পাবেনা এতো রাতে। যাও দু একটা পেয়েছে, তারা এতো দূরে যেতে রাজি হচ্ছেনা।
সব মিলিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় ভোগছে নীল। মনি নিরবে হাটছে নীলের পিছন পিছন। নীল বুঝতে পারছে ওর নিরবতার কারণ। সে মনির দিকে তাকিয়ে দাড়ালো। মনিও দাঁড়িয়ে পরলো তখন।

নীল কিছু বলার আগে মনি বললো
-আমি রাজি না হলে ওরা হয়তো আপনাকে মারধোর করতো, তাই বিয়েটায় রাজি হয়েছি আমি। তবে এই বিয়ে নিয়ে আপনি বেশি ভাববেন না, এ বিয়ের না আছে কোনো দলিল আর না আছে কোনো সাক্ষী। আপনার বাড়ির কেউই জানবে না, এ বিয়ে সম্পর্কে।

নীল অদ্ভুতভাবে তাকালো মনির দিকে। শান্ত গলায় বললো
-এইসব নিয়ে এখন নাইবা ভাবলে মনি, বাড়ি কিভাবে যাবো, সেই চিন্তায় আছি এখন। তোমার বোধহয় খিদে পেয়েছে খুব।
-নাহ।
নীল আক্ষেপে বললো
-লোকগুলো কেমন দেখেছো, ধরেবেধে বিয়ে করিয়ে দিলো, অথচ দুইজনকে কিছু খাবার পর্যন্ত দিলোনা। নতুন বিয়ে উপলক্ষেও তো কিছু খাওয়াতে পারতো, মিষ্টিমুখ করানোটা তো বাধ্যতামূলক ছিলো। সবগুলাই কৃপনের হাড্ডি।

মনি অবাক হলো বেশ। সামান্য রাগ দেখিয়ে বললো
-এ কেমন মানুষ রে বাবা, মিষ্টি খাওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে।

নীল হাসলো। এমন সময় নীলের ফোনে কল এলো। বড় ভাই নিলয় ফোন করেছে। আর আগেও কয়েকবার করে কল এসেছে বাড়ি থেকে। ঝামেলার মধ্যে থাকার কারণে কল রিসিভ করতে পারেনি তখন। মনিকে আঙ্গুলের ইশারায় চুপ থাকতে বলে নীল কলটা রিসিভ করলো।
-হ্যালো, ভাইয়া।
-কোথায় তোরা, এতো রাত হয়ে গেছে এখনো আসছিস না। আজ কি ওখানে গিয়ে থাকার নিয়ত করেছিস?

-একটা ঝামেলা হয়ে গেছে ভাইয়া। তুই কি একটা গাড়ি নিয়ে আমাদেরকে নিতে আসতে পারবি?
নিলয় উৎকন্ঠা নিয়ে বললো
-কি হয়েছে? বিপদে পরেছিস কোনো?
-পরে বলবো ভাইয়া। আগে তুই এসে আমাদের নিয়ে যা প্লিজ, তা নাহলে রাস্তাতেই আমাদের রাত কাটাতে হবে।
-কোথায় আছিস তোরা?

নীল লোকেশনটা নিলয়কে বললে নিলয় ওদেরকে সেখানে অপেক্ষা করতে বলে ফোনটা কেটে দিলো। নীল আর মনি ধীরে ধীরে হাটতে লাগলো সামনে দিকে। আশাপাশে কোনো কোলাহল কলরব নেই। চারিদিকে ধূ ধূ নিস্তব্ধতা, ঝিঁঝিঁপোকার ডাক ছাড়া আর কিছুই কানে আসছেনা। গ্রাম এলাকা হওয়ায় নিস্তব্ধতাটা যেনো কয়কে গুন বেশি।

নীল হাঁটতে হাঁটতে মনিকে বললো
-খারাপ লাগছে?
মনি কোনো উত্তর দিলোনা। নীল আবারও প্রশ্ন করলো
-হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে?
মনি দাঁতে দাঁত খিঁচিয়ে বললো
-কেন, কষ্ট হলে কি কোলে করে নিয়ে যাবেন?
নীল হেসে বললো
-তুমি চাইলে কেনো নয়?
মনি রাগে অন্যদিকে তাকালো। কোনো কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছেনা এইমুহূর্তে।

কিছুটা রাস্তা হেঁটে যাবার পর নীল আবারও বললো
-কিছু বলছোনা যে?
মনি কটমট করে তাকালো নীলের দিকে। নীল হাসলো। বললো
-অতি দুঃখে যদি কাঁদতে ইচ্ছে করে তাহলে এখানে কেঁদে নাও তারাতাড়ি। এখানে আমি ছাড়া তো আর কেউ নেই। বাড়িতে গেলে কাঁদার মতো আর টাইম পাবেনা। আশা, ভাবি আর মায়ের সামনে তো তুমি কাঁদতেও পারবেনা।

মনি প্রচন্ডরকম রেগে গেলো এবার। শক্ত গলায় বললো
-চুপ করবেন নাকি আমাকে কিছু করতে হবে?
নীল ভ্রু বাকিয়ে বললো
-কি করবে তুমি?
-আমি জানিনা কি করবো। তবে কিছু একটা করবো।
-করো, আমি প্রস্তুত। নীল মাথা নিচু করে মনির দিকে এগিয়ে গেলো। অতি দুঃখে মনির এবার কাঁদতে ইচ্ছে করছে না, বরং নীলের এহেন কান্ডে ওর হাসি পাচ্ছে।

কিছুক্ষণ বাদে একটা গাড়ি এসে থামলো ওদের সামনে। দূর থেকে গাড়ির লাইট দেখেই নীল অনুমান করেছিলো এটা তার ভাইয়াই আসছে। গাড়ি থামতেই নিলয় জানলা দিয়ে মাথাটা বের করে দিলো। নীলকে বললো
-তারাতাড়ি গাড়িতে উঠে আয় নীল। তুমিও উঠে এসো মনি।
নীল হেসে মনির দিকে তাকালো। গাড়ির দরজাটা খুলে দিয়ে বললো
-উঠে বসো মনি।

মনি উঠে বসামাত্র নীলও ওদিক দিয়ে গিয়ে বসলো। ড্রাইভিং সিটে বসে নিলয় বললো
-তুইও পেছনে বসলি? আমিতো ভাবলাম তুই সামনে এসে বসবি।
নীল ভ্যাবলামার্কা হাসি হেসে বললো
-অনেক রাত হয়ে গেছে ভাইয়া, ও পিছনে একা ভয় পাবে।
নিলয় আর কথা বাড়ালো না, গাড়ি চালাতে শুরু করলো।

গাড়ি চলছে নিজ গতিতে। রাস্তার পাশে নির্দিষ্ট দুরত্ব পরপর ল্যাম্পপোস্টের আলো দেখা যাচ্ছে। মাঝে মধ্যে ঝোপে ঝাড়ে জোনাকির আলো। নীল আবছা আলোয় বার বার মনির দিকে তাকাচ্ছে। মনি কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে একবার বলেই ফেললো
-আপনি বার বার আমার দিকে তাকাচ্ছেন কেন?
মনির এমন আক্রমনাত্মক কথায় হটাৎ কিছুটা হতচকিত হলো নীল।

কিছুটা সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে বললো
-কক কখন তাকালাম তোমার দিকে?
-আমি স্পষ্টভাবেই লক্ষ্য করেছি, আপনি একটু পর পর আমার দিকে তাকাচ্ছেন। কিন্তু কেন?
নীল কপালে হাত দিয়ে খানিক চাপা গলায় বললো
-আস্তে কথা বলো, ভাইয়া শুনছে তো।
-শুনলে শুনুক, জানোক তার ভাইটা কতোটা ফন্দিবাজ।

নীল ভ্রু বাকালো। বললো
-কি করেছি আমি?
-জানিনা। মনি অন্যদিকে তাকালো। নীল একা একাই মুচকি হাসলো কিছুক্ষণ।

বাড়ি পৌছুতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিলো বিধায় রাবেয়া আর নীলের বাবা ঘুমিয়ে গিয়েছিলো। নিলয় বাইরে গিয়েছিলো ওদের আনার জন্য আর হিমাও জেগে ছিলো। এতোক্ষন সে আশার সাথে আশার রুমে মুনিয়াকে নিয়ে বসে ছিলো। মনি আর নীল বাসায় আসামাত্রই সকলে ওদেরকে প্রশ্ন করে করে ঘিরে ধরলো দেরি করে আসার কারণ জানার জন্য । মনি কোনো উত্তর না দিয়ে আগে মুনিয়ার কাছে গেলো। মুনিয়া ঘুমোচ্ছে। তবে চোখের নিচে পানি শুকিয়ে দাগ হয়ে আছে কিছুটা। বোঝায় যাচ্ছে অনেক কেঁদেছে মেয়েটা।

মনি ব্যতিব্যস্ত হয়ে আশার দিকে তাকালো। অস্থিরতা নিয়ে বললো
-মুনিয়া বোধহয় খুব কেঁদেছে আশাপু?
-কেঁদেছে তো। তোরা এতো দেরি করলি কেন? ভাইয়াও কিছু বলছেনা। কি হয়েছে বল তো? আমি যতদুর জানি তোরা সন্ধ্যার আগেই বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলি আসার জন্য। তখন তো কোনো সমস্যা ছিলোনা। ভাইয়া বলেছিলো আমায়। রাস্তায় কোনো সমস্যা হয় নি তো?
-নীলের মুখ দেখে তো মনে হচ্ছেনা রাস্তায় কোনো খারাপ কিছু হয়েছে। ওকেতো ফুরফুরেই দেখাচ্ছে। ব্যাপার কি? পাশ থেকে নীলের দিকে তাকিয়ে কথাটা হিমা বললো।

নীল হাসলো। হিমার দিকে তাকিয়ে বললো
-আজ এভারেস্ট জয় করেছি ভাবি জি। ফুরফুরে তো দেখাবেই। হিমা ভ্রু বাকালো। আশা বললো
-কি এমন রাজকার্য করে এসেছিস শুনি, যার জন্য একটা বাচ্চা মেয়েকে ফেলেও এতোটা রাত করে ফিরেছিস।

নীল আবারও হাসলো। কেন জানি ওর খুব হাসি পাচ্ছে আজ। ওর হাসি দেখে মনির পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে।
হটাৎ নীল আশাকে আর হিমাকে টেনে নিয়ে চলে গেলো বারান্দায়। মনি অবাক হলো, এই ছেলের মতলবটা কি? বিয়েটার ব্যাপারে কিচ্ছু বলে দিবে নাতো?

কিছুক্ষণ পর হিমা আর আশাকে নিয়ে ফিরে এলো নীল। ওরা মিটমিট করে হাসছে। মনি কিছুটা সন্দিহান গলায় বললো
-হাসছো কেন আশাপু?
-যেটা শুনেছি, সেটা কি সত্যি মনি?
-কোনটা? ভ্রু বাকিয়ে বললো মনি।
হিমা বললো
-রাস্তায় আজ তোমাদের সাথে যা ঘটেছে তা কি সত্যি?

মনি এবার বিপাকে পরলো। কিছুটা রেগে গেলো মনে মনে। এভাবে হুটহাট করে বলে দিতে হলো কেন? একটু সময় নেওয়া উচিত ছিলো। আশা তাড়া দিয়ে বললো
-কি ব্যপার মনি? কথা বলছিস না যে!
মনি এবার বাধ্য হয়েই বললো
-ব্যাপারটা বেশ ঝামেলাপূর্ণ ছিলো। এটা করা ছাড়া উপায় ছিলোনা আর।
-ওহ আচ্ছা। তাই বলে একদম বিয়ে? আর তুইও মেনে নিলি?
-না নিয়ে কি আর করতাম। ওরাতো ক্ষেপে ছিলো অনেক?
-ওরা মানে? প্রোপোজ তো একজনেই করেছে নাকি?
-মানে? অবাক হলো মনি।

হিমা বললো
-তোমাকে নাকি আজ বাসে কেউ বিয়ের প্রোপোজাল দিয়েছে?
-কিহ? মনি অবাক হয়ে তাকালো নীলের দিকে। নীল হাসছে। মনিকে এমন অবাক হতে দেখে হিমা বললো
-অবাক হচ্ছো কেন মনি, আমরা জেনে গেছি তাই লজ্জা পাচ্ছো?
-নাহ, মানে।
-ছেলেটা অনেক ঝামেলা করেছে রাস্তায়। তাইতো এতো দেরি হয়ে গেলো। মনিকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে রিতীমত ওর হ্যাঁ উত্তর পাবার জন্য উঠে পরে লেগেছিলো সে। ভাগ্যিস আমি তখন মনিকে আমার ওয়াইফ বলে পরিচয় দিয়েছিলাম।।

নীলের দিকে তাকিয়ে চোখ বড় বড় করলো মনি। আবার পরক্ষণে নিশ্চিন্ত হলো এটা ভেবে যে, “যাক একটা কিছু বলে দেরি হওয়ার কারণটা তো কাটিয়ে দিয়েছেন উনি। ”

হিমা বললো
-চল আশা, ওদের খাবারের ব্যবস্থা করি। খিদেয় হয়তো পেটে জ্বালা ধরেছে এতোক্ষণে।
-হুম চলো ভাবি।
আশা আর হিমা বেরিয়ে গেলে নীল ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো মনির কাছে। অস্ফুটে বললো
-ভেবেছিলে বিয়ের কথাটা বলেছি?
-হুম। তবে যেটা বলে কথা কাটিয়েছেন সেটাও কেমন যেনো লজিক ছাড়া। অন্যকিছুও বলতে পারতেন।

নীল হাসলো। শান্ত গলায় আস্তে করে বললো
– “আমি হয়েছি পাগল, নিজেকে করেছি বেসামাল।
তোমার পানে তাকিয়ে আমি ভুলে গেছি সব, সকল কথার যুক্তি ভুলে করছি আমি তাল মাতাল ”

আমি হয়েছি তোমাতে মত্ত, তুমি কি আমায় ভালোবেসে ডুবিয়ে দিবে অনন্ত?

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here