#মন_মুনিয়া
তন্বী ইসলাম -৪৬
দেখতে দেখতে নীলের যাওয়ার দিন চলে এলো। রাতের ফ্লাইটে সে যাবে। বাড়ি থেকে রওনা করবে বেলা ১০ টা নাগাদ। সকলেই যাবে ওকে ছাড়তে। রাবেয়া আর হিমা সেই সকাল থেকে রান্নাবান্নার কাজে ব্যস্ত। ছেলেকে খাইয়ে কিছু খাবার সাথেও দিয়ে দিবে। আশা নীলের জন্য গোছগাছ করতে ব্যস্ত।
তবে যে চলে যাবে, সেই নীলই কিছু করছেনা। বার বার হতাশ দৃষ্টিতে বাইরে তাকাচ্ছে। ওর মন খারাপের কারণ আশার বোধগম্য হলো। সে ভাইয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে ওর মাথায় হাত রেখে বললো
-মন খারাপ করিস না ভাই। সবে তো মাত্র দুইটা বছর। দেখতে দেখতে কেটে যাবে দেখবি। আর ফোন তো আছেই। যখনই মন খারাপ হবে, কথা বলবি।
নীল অসহায় দৃষ্টিতে বোনের দিকে তাকালো। আজ আশা দুষ্টুমি করছেন, সিরিয়াস সে। বোনটা বড্ড বড় হয়ে গেছে। নীলের চোখের কোনে পানি দেখা গেলো। আপন মানুষদের চোখের পানি একদমই সহ্য করতে পারেনা আশা। এবারেও তার ব্যাতিক্রম হলোনা। তার চোখ বেয়েও অঝোর ধারায় পানি ঝরছে। আকস্মিক সে নীলকে জরিয়ে ধরলো। হু হু করে কেঁদে ফেলল সে। নীল কিছুই করতে পারলোনা। আজ শান্তনা দেবার মতো ভাষাও তার মুখে আসছেনা।। আশা ভেজা গলায় বললো
-ভালো থাকিস ভাইয়া, নিজের খেয়াল রাখিস। ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করিস আর সারাক্ষণ হাসিখুশি থাকিস।
নীল একহাতে বোনকে জরিয়ে ধরলো। ভেজা গলায় বললো
-লেখাপড়াটা চালিয়ে নিস বোন। আর মনিকে দেখে রাখিস। মেয়েটা সত্যিই অনেক অসহায়।
আশা মাথা তুকে তাকালো ভাইয়ের দিকে। বেশি কিছু বুঝোক আর নাই বুঝোক, এতোটুকু সে ঠিকই বুঝতে পারছে মনির জন্য ওর মনটা ভেতর থেকে ভেংগে যাচ্ছে। আশা শান্ত গলায় নীলকে বললো
-এতো ভালোবাসিস, তাহলে সবার থেকে কেন এখনো গোপন রেখেছিস। বাবা মাকে জানাতি, পুর্ণতা পেয়ে যেতো তোর ভালোবাসাটা।
নীল জোরপূর্বক হাসলো। চোখের কোনে জমে থাকা বিন্দু পানিটা এক হাতে মুছে বললো
-সবসময় পূর্ণতায় সুখ আসেনা আশা। আমি ওকে কিছুদিনের জন্য কাছে পেয়ে আবারও দূরে সরিয়ে দিতে পারতাম না। এই কয়টা দিন হয়তো ওকে নিয়ে সুখী দাম্পত্য জীবন কাটাতে পারতাম। কারণ, আমার বিশ্বাস বাবা মা কখনো আমার বিরুদ্ধে যেতো না। কিন্তু একটা কথা ভেবে দেখ, মেয়েটা এমনিতেই অনেক বড় রকমের একটা শক পেয়েছে। তার উপর আমাদের বিয়েটাও হয়েছে অন্যরকম একটা পরিস্থিতিতে। যেটা আমাদের কারোরই কাম্য ছিলোনা। সেই বিয়েটাকে ভিত্তি করে আমি কিভাবে ওর উপর অধিকার খাটাতে পারতাম?
যদিও ও এখন আমায় অনেক ভালোবাসে, কিন্তু তখন পরিস্থিতিটাই অন্যরকম ছিলো। আমার কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু তাও আমি সবটা সহ্য করছি কারণ আমি চাই একটা সুষ্ঠু সুন্দর সম্পর্ক। যে সম্পর্কে কোনো কালি থাকবেনা। দুইবছর পর যখন ফিরে আসবো, তখনই আমি যোগ্য সম্মান দিয়ে নিজের করে নিবো। যদি আমি এখনই ওকে নিজের কাছাকাছি নিয়ে আসতাম, তাহলে বিশ্বাস কর, আমরা কেউই একে অন্যের থেকে দূরে থাকতে পারতাম না। সারাজীবন ওকে কাছে পাবার জন্য এই কয়টা দিন নাহয় ত্যাগ স্বীকার করলাম।
নীলের কথায় আশার মুখের আদলে পরিবর্তন এলো। ভাইটা এতোটা ভালোবাসে মনিকে, তা হয়তো মনিও জানেনা।
আশা এবার মুখে শুকনো হাসি টেনে বললো
-আমি বাইরে যাচ্ছি একটু।
নীল কিছু বললোনা। সে হতাশ দৃষ্টিতে বাইরের দিকেই তাকিয়ে রইলো।
দরজার মুখোমুখি গিয়ে আশা ঘুরে দাড়ালো। বললো
-আমি মনিকে পাঠিয়ে দিচ্ছি ভাইয়া, যা যা কথা বলার ঝটপট বলে নিস।
বোনের দিকে ফিরে তাকালো নীল। এক চিলতে সুখের হাসি তার মুখে দেখা মিললো।
বারান্দার গ্রিলে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে আছে মনি। চোখমুখ ফুলে আছে তার। মুনিয়া বিছানায় শুয়ে কেঁদে চলেছে সেই কখন থেকে। এই কান্না মনির কান পর্যন্ত যাচ্ছে কিনা সন্দেহ।। সে যেনো আজ বধির হয়ে গেছে।
হুশ এলো আশার ডাকে। চমকে সে তাকালো কন্ঠস্বর অনুসরণ করে। আশা সামান্য ক্ষোভ নিয়ে বললো
-মেয়েটা এভাবে কাঁদছে, আর তুই এখানে দাঁড়িয়ে আছিস?
মনি নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আশার দিকে। যেনো আশার বলা কথাগুলো তার কাছে বোধগম্য হয়নি।।আশা আবারও বললো
-মেয়েটাকে এভাবে ফেলে রেখেছিস কেন? কাঁদতে কাঁদতে কি হাল হয়েছে দেখ!
মনির অসহায় দৃষ্টি মুনিয়ার দিকে যায়। মেয়েটা সত্যিই কাঁদছে। সে একটু নড়েচড়ে উঠলো। আশার দিকে হাত বাড়িয়ে বললো
-একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছিলাম আশাপু। দাও মুনিয়াকে আমার কোলে।
আশা মনির দিকে তাকালো, শান্ত গলায় বললো
-ওকে আমি দেখছি। তুই একবার ভাইয়ার রুমে যা মনি।। অপেক্ষা করছে তোর জন্য।
মনি হতাশ গলায় বললো
-এখন তো দিনের বেলা আশাপু। আমি কি করে যাই উনার রুমে। আন্টি, আংকেল, বড় ভাইয়া সবাই বাড়িতে আজ।।কখন কে দেখে ফেলে, কি থেকে কি মনে করে। তার থেকে না যাওয়াই ভালো।
মনি যখন কথাগুলো বলছিলো, তখন স্পষ্ট কান্নার কম্পন আশার কানে আসছিলো। হয়তো অনেক কষ্টে কান্নাটাকে সে কন্ট্রোল করেছে, যার কারণে কথা বলার সময় কম্পিত হয়েছে।
আশা মনির মনের অবস্থাটা বুঝতে পারলো। সে মনিকে আবারও বললো
-আব্বু আর ভাইয়া বাইরে আছে। আম্মু রান্নায় ব্যস্ত। আর ভাবী তো সবটা জানেই। কোনো সমস্যা নেই। তুই যা তো। বেচারা কখন থেকে অপেক্ষা করছে তোর জন্য ।
মনি আর কথা বাড়ালো না। সে পা বাড়ালো নীলের ঘরের দিকে।
ধীর পায়ে নীলের ঘরে প্রবেশ করলো মনি। ওর উপস্থিত টের পেয়ে নীল চমকে তাকালো তার দিকে। ওর হৃদস্পন্দন হটাৎ বেড়ে গেলো। ঝড়ের বেগে সে এগিয়ে এলো মনির দিকে। মনি নিশ্চুপ। মাথা নিচু করে সে দাঁড়িয়ে আছে নীলের সামনে। চোখ বেয়ে টুপটুপ করে পানি পড়ছে। নীল সইতে পারলোনা সে চোখের পানি। ঝড়ের বেগে মনিকে টেনে নিলো নিজের দিকে। নীলের বাহুডোরে আটকা পরলো মনি।
একটা সময় পর মনি নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো নীলের কাছ থেকে। খুবই সন্তর্পণে বললো
-আমাকে আপনার মনের কোন থেকে কখনো মুছে ফেলবেন না দয়া করে। আমি নিঃশেষ হয়ে যাব।
নীল নিজেকে কন্ট্রোল করে বললো
-এমন কথা এখন কেন বলছো মনি। নিজেকে সামলাও। তা নাহলে আমাকে হাসিমুখে বিদেয় দিবে কি করে?
-এ বিদায় আমার জন্য সুখকর নয়। আমি কি করে আপনাকে হাসিমুখে বিদায় দেই? মনি কাদছে। নীল মুখে জোরপূর্বক হাসি টেনে বললো
-আমি ফিরে আসবো তোমার কাছে, সারাজীবনের জন্য নিজেকে তোমার নামে দলিল করে দেবো। শুধু এই কয়টা দিন অপেক্ষা করো।
-আমি অপেক্ষায় থাকবো।
-শুধু অপেক্ষায় থাকলে চলবেনা পুঁচকে। ভালো করে পড়ালেখা করতে হবে। আমি ফিরে এসে যেনো তোমাকে বিজয়ীর বেশে দেখতে চাই।
মনি মাথা নাড়ালো। নীল আবারও জড়িয়ে ধরলো মনিকে। চোখ বন্ধ করে বললো
-রাতে কেন আসোনি তুমি? অপেক্ষায় ছিলাম। ভেবেছিলাম শেষ রাতে তোমার দেখা পাবো, মনভরে তোমায় দেখবো, সারারাত ভালোবাসার গল্প করবো। কিন্তু তুমি এলে না।
নীলের কন্ঠে কিঞ্চিৎ অভিমান। মনি অপরাধীর কন্ঠে বললো
-আমি আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পারিনি। মুনিয়া জেগেছিলো সারারাত। খুব কান্নাও করছিলো। ওকে এই অবস্থায় ফেলে আসতে পারিনি। সত্যিই পারিনি।
নীল মনির চোখের কোনে জমা থাকা পানিগুলো আলতো হাতে মুছে দিয়ে মুচকি হাসলো। আবেশে বললো
-আমার ভালোবাসার একটা বড় অংশ হচ্ছে মুনিয়া। মুনিয়ার যত্ন নিও, আমার কারণেও কখনো ওকে হেলা করোনা।
মনি কিছু বললোনা এবার। নীল আবারও বললো
-এই দুইটা বছর হয়তো আমার কাছে দুই যুগ মনে হবে। কিংবা বেশি। তোমাকেও অনেক বাধা বিপত্তি পেরিয়ে সামনে এগুতে হবে। কখনো ভয় পেয়োনা। ভয় পেলে সফলতা আসে না। ভয়কে দূর করে এগিয়ে চলবে সামনে। নিজেকে এমনভাবে গড়ে তুলবে, যেনো কেউ তোমাকে দেখে আফসোস করে, যে কিনা পুর্বে তোমাকে মূল্যায়ন করেনি।
মনি মাথা নাড়ালো। নীল আবারও মনিকে বাহুডোরে জরিয়ে নিলো।
____
নিলয় আর ওর বাবা রেডি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। হিমা আর আশাও রেডি হলো নীলের সঙ্গে যাবার জন্য। রাবেয়া নিজেকে বোরকাবৃত করে নিচ্ছে। এমন সময় হিমা বললো
-মনি যাবেনা আমাদের সাথে?
রাবেয়া মনিল গলায় বললো
-ও গিয়ে কি করবে। শুধু শুধু ধকল সহ্য করতে হবে। মুনিয়ারও কষ্ট হবে। তার চেয়ে ও বাড়িতেই থাকুক। আর তাছাড়া আমরা তো বেড়াতে যাচ্ছিনা কোথাও।
আশা বললো
-ও যাক মা আমাদের সাথে। একা একা সারাটাদিন বেচারি কিভাবে বাড়িতে কাটাবে বলো। মন খারাপ হবে খুব।
হিমাও সায় জানালো তাতে। শেষে রাজি হলেন উনি। হিমা আশার দিকে তাকিয়ে এক চোখে টিপ দিয়ে বলল
-মনিকে রেডি করে নিয়ে আয় তারাতাড়ি।
আশা দৌড়ে চলে গেলো মনির কাছে।
একটা বড় গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে এসেছে নিলয়। সবাই একসাথে যাবার জন্য। হিমা আর নিলয় বসেছে পাশাপাশি। আরেক পাশে বসেছে রাবেয়া আর ওর হাজবেন্ড। ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটটা রাখা হয়েছে নীলের জন্য। মনি আর আশা একসাথে বসার যায়গা পেয়েছে। কিন্তু বিপত্তি হয়েছে অন্য যায়গায়। নীল ইচ্ছে করেই গাড়িতে উঠছেনা। মনির সাথে বসার অফুরন্ত বাসনা তার মনে কাজ করছে। এই যাত্রাটা সে মনির পাশে বসেই করতে চায়। তবে সবাই সামনে থাকায় মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারছেনা বেচারা। আশা সবটাই এতোক্ষণ অবলোকন করছিলো। সে বুঝে গেছে ব্যাপারটা আগেই। ভাইয়ের ইচ্ছেটা অপূর্ণ থাক সেটা চায় না। তাই সে কৌশলে বললো
-এই ভাইয়া, তুই আমার যায়গাটায় বস না, আমি ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে বসি প্লিজ। সামনে বসতে আমার বেশ লাগে।
বোনের চালাকি সে ধরতে পেরেছে। নিলয় বললো
-তোর সামনে বসে কাজ নেই। তুই ওখানেই থাক।সামনে নীল বসবে।
নীল হেসে বললো
-বসুক না সামনে।। আমার ছোট বোনটা আবদার করেছে, আমি মানা করি কিভাবে।
আশা হেসে বললো
-এটাই ভাইয়ের মতো কথা।
আশা যখন নীলের পাশ কেটে সামনে যাচ্ছিলো তখন নীলের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো
-আমার দয়া মনে রাখিস রে ভাই।
নীল হেসে আশার মাথায় টুকা দিলো। আশা এক গাল হেসে বললো
-অকৃতজ্ঞ কোথাকার।
অবশেষে মনির পাশের সিটে গিয়ে বসলো নীল। এতোক্ষণে গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। সকলের অগোচরে নীল মনির হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নিলো। মনি হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার সামান্য চেষ্টা করলো। বিনিময়ে নীল আরো শক্ত করে ধরলো ওর হাতটা। এ পর্যায়ে মনি মলিন চোখে তাকালো নীলের দিকে। নীল সেই মলিনতা উপেক্ষা করে চট করে মনির গালে একটা কিস করে বসলো।
যেহেতু ওরা সকলের পিছনের সিটে বসেছে তাই, ব্যাপারটা কারো নজরে আসেনি। কিন্তু নীলের এহেন কান্ডে বিস্মিত চোখে ওর দিকে তাকালো মনি। নীল অদ্ভুতভাবে হেসে ফিসফিসিয়ে বললো
-এভাবে তাকিও না পুঁচকে, কলিজায় লাগে। এমন করে তাকালে নির্ঘাত আমার যাওয়াটা ক্যান্সেল করা লাগবে। এ মায়া ছেড়ে যাওয়ার সাধ্য আমার হবেনা প্রিয়।
চলবে…..