বাঁধিব হৃদয়ে তোমায় পর্ব-১৪

0
1163

#বাঁধিব_হৃদয়ে_তোমায়
#পর্ব_১৪
#সুমাইয়া মনি

বাড়িতে ফিরে আবির অস্বাভাবিক আচরণ করে। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে জিনিসপত্র ভাংচুর করছে। আফিন ও তার বন্ধু’রা কেউ আটকাতে পারছে না। সকাইকে ঠেলেঠুলে সরিয়ে দিয়ে চিৎকার করে বলছে বিভাকে এনে দিতে। বিভাকে ছাড়া সে শূন্য! নেই তার কোনো অস্তিত্ব!

আবির প্রায় দশ মিনিট পর ফিরে এসে বিভাকে আর খুঁজে পায় না। হন্ন হয়ে খুঁজে পুরো বাড়িতে। ইতিমধ্যে সকলে বিভাকে খুঁজছে। বিভাকে না পেয়ে সামিম, মারুফকে সঙ্গে নিয়ে এগলি, সেগলি ঘুরে বেড়ায়৷ কোথাও মিলেনা বিভার দেখা। শেষে তারা বাড়িতে ফিরে রাত দুইটার দিকে। এসেই পাগলামি শুরু করেছে আবির। বিভাকে আগলে রাখবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল নিজেকে। এখন তাকেই কি-না হারিয়ে ফেলতে বসেছে।
‘কেন আমাকে ছেড়ে বিভা চলে গেল? এখন আমি কাকে নিয়ে বাঁচবো? বিভাকে এনে দেও ভাইয়া। বিভাকে এনে দেও আমার কাছে। এনে দেও…..’ বলেই চিল্লিয়ে চেয়ার তুলে ডাইনিং টেবিলের ওপর ছুঁড়ে মারল। বিকট আওয়াজ তুলে ভেঙে যায় কাঁচের তৈরি টেবিলটি। কেউ কাছে যেতে পারছে না। আফিন নিজের কথা ভাবছে। আবিরের মতো পাগলামি তার করার দরকার ছিল। কিন্তু…!
দূরে দাঁড়িয়ে মুখে কাপড় গুঁজে আইরিন বেগম কাঁদছে। ছেলের এমন পাগলামি কোনো মা’ই সহ্য করতে পারবে না।
মারুফ, সামিম অসহায় হয়ে বন্ধুর পাগলামি দেখছে। ছুটে এসে আবিরকে জড়িয়ে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করে আফিন।
আবির সরিয়ে দিতে চায় বার বার। শেষে আবিরের মাথা নিজের বুকের কাছে নিয়ে গালে হাত বুলিয়ে বলল,
‘হারিয়ে গেছে দেখে পাগলামি করছিস। যদি ম….’
‘খবরদার! ভাইয়া। ঐ কথা মুখেও আনবে না। আমি শুনতে পারব নাআআ।’ জোরে চিৎকার তুলে আফিনকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে কাঁচের টুকরো তুলে ডান হাতের মধ্যখানে চালিয়ে দেয়। গলগল করে রক্ত বের হতে থাকে। আইরিন বেগম ভয় পেয়ে যায়। সামিম, মারুফ, আফিন আবিরকে ধরে হাত থেকে টুকরোটি ফেলে দেয়। আফিন হাত দিয়ে ক্ষতস্থান চেপে রাখে। কিন্তু তাতেও রক্তক্ষরণ কমে না। অধিক রক্ত বের হবার ফলে আবির ধীরেধীরে দূর্বল হয়ে পড়ছে। তবুও স্ট্রং হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করে। তবে পারে না। জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাওয়ার আগেই ওরা ধরে নেয়। ধরাধরি করে আবিরের কক্ষে এনে শুইয়ে দেওয়া হয়। হাতের চামড়া অনেকখানি সরে গেছে। যার ফলে সেলাইয়ের প্রয়োজন। এত রাতে ডক্টর পাবে না বলে আফিন অস্থির হয়ে উঠে। আইরিন বেগম কেঁদেই যাচ্ছে। সামিম বার বার শান্ত হতে বলছে তাকে।

হঠাৎ আফিনের মনে পড়ে তার বন্ধু এনামুলকে কথা। তিনি একজন ডক্টর। কল দিয়ে জরুরী ভিত্তিতে বাড়িতে ডাকে। এনামুল আধা ঘণ্টা বাদেই বাইক নিয়ে চলে আসে। প্রথমে তাকে ঘুমের ইঞ্জেকশন পুশ করতে বলে আফিন। তারপর ক্ষত স্থানের রক্ত পরিষ্কার করে সেলাই করেন। বিভার কথাটি এনামুল’কে জানায়। এনামুল দুঃখ প্রকাশ করে বলল,
‘মেয়েটিকে দ্রুত খুঁজে বের করার চেষ্টা কর আফিন। আবিরের পাগলামি যা তোর মুখে শুনলাম, উল্টাপাল্টা না কিছু করে বসে।
‘একে তো ববির খুনিকে এখনো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তার ওপর বিভা নিঁখোজ! এখন আবার আবিরের… বুঝতে পারছি না কি করব আমি।’ উত্তেজিত হয়ে পড়ে আফিন।
‘স্থির হ দোস্ত! পুলিশকে বলেছিস?’
‘হ্যাঁ! জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারা খুঁজছে।’
‘আচ্ছা আমি এখন উঠি। আবিরের কন্ডিশন আমাকে জানাস।’
‘হুম।’
তিনি চলে যায়। আফিন সামিম, মারুফকে যেতে দেয় না। থেকে যেতে বলে।
‘আম্মু, তুমি ঘুমাও। আমি মারুফ, সামিম আবিরের কাছে আছি।’
‘কি হচ্ছে আমার সংসারে জানি না। একটা না একটা ভয়ংকর ঘটনার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। কীভাবে ঘুমাবো বল? তোর বাবাকে আমি কি বলব? এখন পর্যন্ত তাকে কিছুই জানানো হয়নি।’
‘চিন্তা কোরো না মা। ঠিক হয়ে যাবে এক সময়। আর এই মুহূর্তে বাবাকে এসব জানানোর প্রয়োজন নেই।’
আইরিন বেগম কিছু বলে না। আফিন তাকে জোর করে রুমে দিয়ে আসে। ঘুমানোর নির্দেশ দেয়। মায়ের মন কি সন্তানের বিপদেআপদে শান্ত থাকতে পারে। কিন্তু আফিনের কঁড়া আদেশে তাকে ঘুমাতে হয়। আবিরের রুমে তিনজন রাত কাঁটিয়ে দেয়। সারারাত আবিরকে পাহাড়া দেয় তারা।
সকাল হতেই আফিন ওদের দু’জনকে রেখে থানায় আসে। ওসি’কে বিভার সম্পর্কে আরো ইনফরমেশন দেওয়ার জন্য।
ওসির সঙ্গে খুঁজতে অনেক স্থানে যায় আফিন।

এদিকে আবির ঘুম থেকে উঠে আবারও পাগলামি আরম্ভ করেছে। না কিছু খাচ্ছে, না কারো কথা শুনছে। সামিম, মারুফ জোর করে কিছুতেই আটকে রাখতে পারছে না। শেষে আফিনকে জানানো হয়। আফিন দ্রুত এনামুল’কে ফোন দিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দেয়। এনামুলের আসতে বেশিক্ষণ লাগে না।
এসে আবির’কে পুনোরায় ঘুমের ইঞ্জেকশন দিতে হয়।
আবির প্রথমে দিতে চায় নি। চিল্লা পালা করে। এক প্রকার জোর করে দেয় ইঞ্জেকশন। আস্তেধীরে নিস্তেজ হয়ে আসে আবির। তলিয়ে যায় গভীর ঘুমে।

আইরিন বেগম ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করলেন।
এনামুল সান্ত্বনা দেয়। তিনি কান্নারত কণ্ঠে বললেন,
‘ছেলেটা আমার কি হয়ে গেছে এক দিনে। আল্লাহ কেন এমন নিষ্ঠুর পরিস্থিতিতে ফেলেছে আমাদের।’ কান্নার গতিবেগ আরো বেড়ে যায় তার।
মুখ বুঁজে শোনা ছাড়া আর কেউ বা কি বলবে! যা হচ্ছে সব চোখের সামনে দৃশ্যমান।

সারাদিন খোঁজাখুঁজির পরও বিভার কোনো সুরাহা মিলে না। বিধ্বস্ত হয়ে রাতে বাড়ি ফিরে আফিন। কাল আবার খুঁজতে বের হবে। এদিকে তার কলেজ, কোচিংও বন্ধ যাচ্ছে। অবশ্য এতে তার কোনো মাথা ব্যথা নেই। অবসন্ন শরীর নিয়ে আবিরকে দেখতে আসে আফিন। বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে আছে তার প্রিয় ছোট ভাইটি। সামিম, মারুফ নিজেদের জামাকাপড় চেঞ্জ করার জন্য বাড়িতে গিয়েছে একটু আগে। কাল রাতে এসেছে আর বাড়ির মুখো হয়নি তারা। বন্ধুর করুণ অবস্থা দেখে বাড়িতে যায় নি আর। এখন আইরিন বেগমের কথা অনুযায়ী বাড়িতে গিয়েছে। কিছুক্ষণ পরেই আবার ফিরে আসবে। আজ রাতেও আবিরের সঙ্গে থাকবে তারা।

আবিরের মাথায় হাত রেখে আফিন মায়া ভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ রাখে। এক দিনে আবিরের চোখমুখ কতটা শুঁকনো দেখাচ্ছে।
পেট মিশে গেছে পিঠের সঙ্গে। এক দানা খাবারও পড়েছি পাকস্থলীতে। আইরিন বেগম আফিনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘খেতে আয় বাবা আফিন।’
‘নাহ! আম্মু। আমার ভাই না খেয়ে পাগল অবস্থায় শুয়ে রয়েছে। আর ওঁকে ছাড়া আমি খাবার খাব।’
ছেলের কথা শুনে ডুকরে কেঁদে উঠেন তিনি। আফিন ওর আম্মুকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘আম্মু আমি আমার কষ্ট গুলো চাপা দিয়ে রাখতে পারব। কিন্তু আবিরের কষ্ট গুলো দেখতে পারছি না। আমি যে ভাই হয়ে ছোট ভাইয়ের কষ্টকে কাছ থেকে দেখে মানতে পারছি না আম্মু। কি করব আম্মু বলো? বলে দেও। কীভাবে বলব বিভাবে খুঁজতে ব্যর্থ হয়েছি আমি। যে নিজ থেকে হারিয়ে যায়, তাকে খোঁজা কষ্টকর। বুঝাবো কীভাবে বলতে পারো আম্মু?’ বলেই কেঁদে দেয় আফিন। সামিম, মারুফ ততক্ষণে সেখানে উপস্থিত হয়ে সব কথা শুনেছে। এই একটা মাসের মধ্যে মানুষের জীবনে কতটা পরিবর্তন ঘটতে পারে, সেটা এই পরিবার’কে দেখলে বোঝা যায়।
কতোটা দুরধিগম্য পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে দিন। চাক্ষুষ সাক্ষী কেবল তারা।
‘কেন মনে হচ্ছে বিভা নিজ থেকে হারিয়ে গেছে ভাইয়া? আমি তো বিভাকে নিজের থেকে বেশি ভালোবেসেছিলাম!’ আবিরের কাতর কণ্ঠে প্রশ্নটি শুনে ঘুরে তাকায় সকলে। ওর অনিমেষ দৃষ্টি দেখে দ্রুত চোখের পানি মুছে ফেলে আফিন। স্লোন গতিতে পাশে বসে বলল,
‘আমরা জানি তো তুই বিভাকে অনেক ভালোবাসিস। তুই ভাবিস না, আমি খুঁজবো বিভাকে। শুধু তুই পাগলামি করিস না ভাই।’ নির্মল স্বরে বলল আফিন।
আবির অনাড়ম্বর দৃষ্টিতে সকলের দিকে তাকায়। তারপর অমলিন কণ্ঠে বলল,
‘করব না ভাইয়া। শুধু বিভাকে আমার কাছে এনে দেও। এবার পেলে বিভাকে হৃদয়ের মধ্যখানে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখবো। যেন কক্ষণো পালাতে না পারে। আমাকে একা রেখে হারিয়ে না যেতে পারে। এনে দিবে তো ভাইয়া?
ছোট ভাইয়ের এমন বেদনাপূর্ণ আবদার শুনে আফিন দৃষ্টি নত করে ফেলে। চোখে পানি টলমল করে। তবুও সে প্রতিশ্রুতি দেয় এনে দিবে তার প্রেয়সীকে!
.
.
.
#চলবে?

কার্টেসী ছাড়া কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ। কিছু ব্যক্তিগত কারণে, একদিন পর পর গল্প দেওয়া হবে। গল্পের মোড় নতুন রূপে ঘুরবে। সবাই ধৈর্য্য সহকারে পড়বেন। ধন্যবাদ!

Sumaiya Moni

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here