নিরবতা পর্ব-৬

0
4736

#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_৬

বাবার বাড়ি ছেড়ে স্বামীর বাড়িতে পদার্পণের দিন দশেকের মতো হয়ে এসেছে উল্লাসীর। এর মাঝে না বাবার বাড়ি থেকে কেউ দেখতে এসেছে তাকে আর না সে নিজে গিয়েছে সেখানে। ছোট্ট বোনটির জন্য মন সবসময় আকুপাকু করলেও কাউকে কিচ্ছুটি বলার সাহস করে উঠতে পারেনি সে। তবে আজ তো ঈদ। মিলনের দিন। সকল কষ্ট ভুলে আনন্দে মেতে উঠার দিন। ঈদের মত একটি দিনেও কী তাহলে সে দেখা পাবে না সুহার? সকালে ঘুম থেকে উঠার পর থেকেই বাড়িতে কাটানো ঈদের সকালগুলো খুব করে মনে পড়ছে। সকল বাঁধা অতিক্রম করে একটিবার দৌড়ে নিজের সেই কুটিরে যেতে মন টানছে৷ সে না হয় এবাড়ির মানুষজনকে সাহস করে কিছু বলে না উঠার ফলে যেতে পারছে না বাড়িতে। কিন্তু বাবা? সে কেনো এখানে আসেনা একটিবার তাকে দেখতে? তার বুঝি মনে পড়ে না তার এই মেয়েকে! একটিবার বুকে আঁগলে নিতে ইচ্ছে করেনা? তাছাড়া খুব বেশি ভুল না হলে কালই তাকে স্বামীর সঙ্গে শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হতে হবে। তাহলে কী শহরে যাবার আগে সুহা, বাবা.. এদের সঙ্গে দেখা হবে না তার? উত্তরে বুকচিরে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল উল্লাসীর। খিচুড়ির চুলোর আঁচ কমিয়ে রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে সে পা বাড়ালো উঠোনের দিকে। উঠোনের দক্ষিণ দিকে গরুর মাংস নিয়ে বসেছেন মোরশেদা বেগম সহ কিছু মহিলা। মোরশেদা বেগম তদারকি করে যাচ্ছেন এবং সে অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছেন মহিলাগণ। কেউবা মাংস কেটে কেটে ছোট টুকরো করে যাচ্ছেন কেউবা ভূরি পরিষ্কারে লেগে আছেন। সেদিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর শাশুড়ির দিকে এগুলো উল্লাসী৷ পাশে বসে ক্ষীণ গলায় বললো,
-“খিচুড়ি হয়ে গেছে।”
-“মাংস রান্নার জন্য তাইলে পেঁয়াজ মরিচ কেঁটে নাও। এই রহিমা, এক পাতিল মাংস ধুয়ে রান্নাঘরে দিয়া আসো তো।”
মোরশেদা বেগমের আদেশ পেয়ে বয়স্ক এক মহিলা কলাপাতার উপর থেকে কিছু মাংস বড়সড় এক পাতিলে উঠিয়ে পা বাড়ালো বাড়ির ভেতরের দিকে। তার যাত্রাপথের দিকে তাকিয়ে লম্বা একটি দম ফেললো উল্লাসী। তারপর আমতাআমতা করে শাশুড়ির উদ্দেশ্যে বললো,
-“আমি কী আজ বাবার বাড়িতে যেতে পারি?”
চোয়াল শক্ত হয়ে এল মোরশেদা বেগমের। ছেলের বউয়ের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে বললেন,
-“এই কথা আমারে বলছো ঠিকাছে। তোমার শ্বশুরের কানে যেন এই কথা না যায়!”
ঢোক গিলে মাটির দিকে তাকিয়ে উল্লাসী মোরশেদা বেগমের কথায় সম্মতি জানাতেই তিনি আবারও বলে উঠলেন,
-“স্বামীর ঘরই মেয়েদের সব। একবার বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি আসার পর ভুলেও মুখের ফাঁক দিয়ে বাবার বাড়ির নাম নেয়া বারণ। আর এ নিষেধ আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং তার কুরআনে করেছেন। বুঝেছো?”
-“হু..”
-“সর্ব সময় মাথায় রাখবা তুমি হাজী বাড়ির বউ। তোমার যেন ধ্যানজ্ঞান চিন্তাভাবনা এখন সবটাই এই হাজী বাড়িকে ঘিরেই হয়৷”
-“জ্বি, আচ্ছা..”
-“আর সবসময় এটা মাথায় রাখবা স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত। স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা একথা তার কুরআনে বলেছেন। স্বামী যা আদেশ দেবে চোখবুঁজে তা পালন করবা। কোনোরকম টুশব্দ তার বিপরীতে করবা না। এতে স্বামী তো নারাজ হবেই সঙ্গে আল্লাহ তায়ালা নিজেও নারাজ হবে। বুঝলা কিছু?”
-“হু..”
-“তাইলে এখন যাও। মাংস তাড়াতাড়ি তুলে দাও। তোমার শ্বশুর নামায পড়ে আসলো হয়তো!”
মোরশেদা বেগমের আদেশ অনুযায়ী বাড়ির ভেতরের দিকে পা বাড়াতেই তার ডাকে আবারও ফিরে এল উল্লাসী। নিরব দৃষ্টিতে মাটির দিকে চেয়ে বললো,
-“বলুন..”
-“শহরে যাচ্ছো.. ভালো কথা। তবে বাইরে বেরুলে ঢেকে ঢুকে চলবা। খোলামেলা যা হবা সব স্বামীর সামনে। পরপুরুষদের সামনে শরীর দেখিয়ে চলা মেয়েরাই বেশ্যা। তাছাড়া…”
মোরশেদা বেগমের কথার মাঝে তাকে থামিয়ে দিল চৈতালি। ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটিয়ে সে বললো,
-“এসব কে বলেছে তোমাকে, চাচী? কুরআনে এসবের উল্লেখ আছে?”
-“তোর চাচাজান বলছে। কেন? তোর কী উনার কথায় সন্দেহ আছে?”
-“সন্দেহ না তবে চাচাজানের জানায় তাহলে ভুল আছে। এমন কিছুই কুরআনে লেখা নেই যাতে একজন মেয়ের তার পিতামাতার সাথে সম্পর্ক নষ্ট হবে। বরং কুরআনে লেখা আছে রক্তের সম্পর্ক ছিন্নকারী কখনোই জান্নাতে প্রবেশ করবে না। তাছাড়া তুমি যে স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত, কথাটি বললে এটা ভুল। সঠিক হচ্ছে মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। তবে একটি মেয়ের জান্নাতে প্রবেশের জন্য যে চারটি জিনিস জরুরী তার মাঝে একটি হলো স্বামীর সন্তুষ্টি। স্বামীকে সম্মান করা প্রতিটি নারীর কর্তব্য।”
-“ওই একই তো হলো। ঘুরেফিরে বেহেশত যাওয়া তো স্বামীর উপরই নির্ভরশীল।”
-“২৫ শতাংশ.. বাদবাকি ৭৫ তো নয়।”
-“ধুর.. যা তো তুই। তুই কী তোর চাচাজানের চেয়ে বেশি জানোস? উনি হজ্ব করে আসছেন।”
-“হজ্ব করে আসলেই সবাই হাজী হয় না গো, চাচী।”
বলেই জিহবা কামড়ে মোরশেদা বেগমের দিকে তাকালো চৈতালি। প্রচুর ক্ষেপেছেন উনি। তবে আশেপাশে থাকা মহিলাদের জন্য তা মুখে প্রকাশ করতে না পারলেও তার বড়বড় দুটো চোখ দিয়ে ঠিকই গিলে ফেলছেন তাকে। সেদিক থেকে দ্রুত নজর সরিয়ে উল্লাসীর দিকে দিল চৈতালি। মেয়েটি অবুঝ বেশে তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে। এত অবুঝ মেয়েও বুঝি পৃথিবীর বুকে আছে! মেয়েটির বয়স খুব বেশি না হলেও কমও তো নয়। সংসার জগৎ নিয়ে এসব সাধারণ কথা বোঝার মত বয়স তার হয়েছে। সে নিজেও এবয়সী থাকতেই প্রেম শুরু করেছিল মুবিনের সঙ্গে। সেসময়ে খুব বুঝতো সে এসব। তবে তার মতোই কেনো হতে হবে উল্লাসীকে? সকলের বিকাস শক্তি তো এক নয়। তাছাড়া এসব নিয়ে চিন্তাভাবনার মত তার হাতে বহু সময় ছিল। সেসময় টুকু তো উল্লাসীর নাও থাকতে পারে! সে হয়তো ঘোরপ্যাঁচযুক্ত এই জগত নিয়ে কখনো ভাবেই নি! তাছাড়া মেয়েটি তো সৎমার কাছে থেকে মানুষ। প্রতিবন্ধী এক বোনও রয়েছে। বাস্তব হোক বা কল্পনা.. এসব নিয়ে ভাবার তার সময় কোথায়? হঠাৎ চৈতালির মনে পড়লো শিশুর পরিচর্যা নামের বইটির কথা। যার মলাটে স্পষ্ট ভাষায় লেখা রয়েছে, প্রতিটি শিশুর মানসিক বিকাসে তার বাবামায়ের ভালোবাসা এবং সান্নিধ্যের বিকল্প নেই। বইটি গতবছর মুবিন দিয়েছিল তাকে। এবং বইয়ের প্রথম পাতায় লিখে দিয়েছিল, বাবুর মাকে আদর্শ মা হবার পথ খুঁজে দিল বাবুর বাবা। যা দেখে দুদিন যাবৎ লজ্জায় মুবিনের সামনে যেতে পারেনি সে। এত বেশি অসভ্য কেনো মুবিন?

হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিল মুবিন। দশটা বেজে কুড়ি মিনিট। সারাদিনের খাটাখাটির পর এর মাঝে সকলেই ঘুমিয়ে পড়েছে। খুব ধীরে সদর দরজা খুলে চৈতালির বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো সে। সাড়ে দশটার সময় বাড়ির পেছনের বাগানে তাকে উপস্থিত থাকতে বলেছে চৈতালি। নানান ঝামেলার কারণে সারাদিনে চোখাচোখি হলেও ভালোভাবে একটিবারও দেখা হয়নি দুজনের। কথা তো দূরস্থান!
উড়ুউড়ু মনে বাগানে পায়চারী করছিলো মুবিন। হঠাৎ পাশ থেকে চৈতালির মধুর গলার স্বর কানে এল তার। অদ্ভুত এক মায়া আছে এই মেয়ের গলায়। একবার শুনলে তার ঘোর কানে লেগে থাকে বহুদিন…
-“নিশিতে যাইও ফুলবনে রে ভোমরা।
নিশিতে যাইও ফুলবনে…
নিশিতে যাইও ফুলবনে রে ভোমরা।
নিশিতে যাইও ফুলবনে…
জ্বালায়ে চান্দের বাতি
আমি জেগে রব সারা-রাতি গো।
কব কথা শিশিরের সনে রে ভোমরা।
নিশিতে যাইও ফুলবনে…”
চাঁদের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠা চৈতালির মুখের দিকে তাকিয়ে কয়েক কদম এগুলো মুবিন। তার কোমর চেপে ধরে নিজের দিকে টেনে বললো,
-“অসাধারণ… বিয়ের পর প্রতি রাতে আমি, তুমি, আমাদের ভালোবাসাবাসি এবং তোমার এই গান… ভাবলেই মন চায় তোমাকে আজই নিজের করে নেই!”
-“তো নাও না! কারো বারন আছে?”
-“অধৈর্য হয়ও না বালিকা। সবুরে মেওয়া ফলে।”
-“কচু ফলে.. দেখি, চশমাখানা খোলো তো।”
-“কেনো?”
নিজেই মুবিনের চশমা খুলে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে চৈতালি বললো,
-“এবার চোখজোড়া বন্ধ করো।”
সময় নিল না মুবিন। পরম সুখে চোখজোড়া বুজতেই পা উঁচিয়ে তার চোখে উপর নিজের ঠোঁটজোড়া ঠেকালো চৈতালি। নিজের ভালোবাসার রঙ ছড়িয়ে দিল মুবিনের চোখজোড়ায়।

ট্রেন ছেড়েছে অনেক্ক্ষণ। ফার্স্ট ক্লাসের একটা কামড়া বুক করেছে মেসবাহ। সেখানে অস্থির মনে পায়চারী করে যাচ্ছে সে। বাবার কথামতো উল্লাসীকে সাথে নিয়ে এলেও অস্থির মন কোনোভাবেই শান্ত হচ্ছে না তার। কয়েক দন্ড চুপচাপ বেডে বসে পাশে বসা উল্লাসীর উদ্দেশ্যে মেসবাহ বললো,
-“ঢাকায় পৌছুতে আরও পাঁচ ঘন্টা লাগবে। খারাপ লাগছেনা তো তোমার?”
-“না..”
-“এই প্রথম ট্রেনে চড়লে?”
-“উহু.. ছোটমার বাড়িতে গিয়েছিলাম একবার ট্রেনে।”
ছোটমা কে? প্রশ্ন করতে গিয়েও করলো না মেসবাহ। অযথা কথাবার্তা না চালিয়ে আসল কথা বলা উচিৎ ভেবে ধীর গলায় বললো,
-“আমি একজন ডক্টর। সোসাইটিতে আমার সম্মান রয়েছে। আলাদা জায়গা রয়েছে। আর আমি চাইনা তা নষ্ট হোক।”
থামলো মেসবাহ। লম্বা একটি দম ছেড়ে গলা খানিকটা গম্ভীর করে আবারও বললো,
-“আমাদের বিয়ের ব্যপারটা আমরা দুজনেই গোপন রাখবো। যদি ওখানের কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে তুমি তার জবাব দেবে না। মোটকথা তুমি ফ্ল্যাট ছেড়ে কখনো বেরুবেই না। আশেপাশের সকলকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করবে।”
-“আচ্ছা..”
-“আর আমি তোমাকে আমার দুঃসম্পর্কের বোন হিসেবে সকলকে পরিচয় করিয়ে দিব। আমার খাওয়াদাওয়ার সমস্যা হয় বলে আম্মা গ্রাম থেকে তোমাকে পাঠিয়েছে রান্নাবান্না করার জন্য। তোমার এতে কোনো সমস্যা আছে?”
-“উহু…”
-“থ্যাংকস…”
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো মেসবাহ। যদিওবা তার জানা নেই ঠিক ক’দিন এভাবে সকলের কাছ থেকে সবকিছু লুকিয়ে রাখতে পারবে সে। তবুও আগবাড়িয়ে নিজের এই জঘন্য অপরাধের কথা কাওকে না জানানোর সিদ্ধান্ত নিলো সে। এতে শুধু তার সম্মানহানি নয় সাথে চরিত্র নিয়েও নানান বাজে কথা শুনতে হবে তার। যা একজন সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে মোটেও কাম্য নয়। অপরদিকে শাশুড়ির কথামতো স্বামীর কথার বিপরীতে টু শব্দ করলো না উল্লাসী। উদাস মনে সে তাকিয়ে রইলো ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে। খুব কষ্ট হচ্ছে তার ফেলে আসা গ্রামটির জন্য। সুহার জন্য, বাবার জন্য। আর কী কখনোই সে দেখা পাবে না তাদের?

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here