#ধারাবাহিকগল্প
#জীবনের নানা রং
পর্ব–আট
মাহাবুবা বিথী
পরদিন ওদের বউভাত।জাবেদ খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ে শিউলিকে ডেকে দিলো। শিউলি ও নামাজ পড়ে নিলো।তারপর শাশুড়ীর কথা অনুসারে রান্না ঘরে ঢুকলো।চুলায় চায়ের পানি চাপিয়েছে।কাজের খালাও চলে এসে থালা বাসন মাঝা শুরু করেছে।
এমন সময় শাশুড়ী এসে চুলো থেকে চায়ের পানিটা ফেলে দিলো।শিউলিকে বললো,
—-তুমি গোসল করে আসো।বাসি কাপড়ে আমার ঘরের কাজ কখনও করবে না।
শিউলির অস্বস্তি হলো।বাসায় শ্বশুর ও জাবেদ আছে।শাশুড়ী মা বেশ জোরে শিউলিকে কথাগুলো বললো।ওর লজ্জাও লাগছে।বাড়ির সবাই কি ভাবছে কে জানে।জাবেদের সাথে ওর এখনও সে সম্পর্ক হয়নি।শায়লা যদিও বলেছিলো সকালে গোসল করে বের হতে।কেন যে ভূলে গেলো আর শাশুড়ী মার কথা শুনতে হলো।নিজের উপর ওর খুব রাগ হচ্ছে।
—–ঠিক আছে আম্মা।
শিউলি ঘরে এসে গোসল করে ধোয়া কাপড় পড়ে রান্না ঘরে গেলো।
সবাই কে সকালের চা দিয়ে নাস্তা রেডী করলো।এর মাঝে তুলি এসে বললো,
—-ভাবি আমার জামাটা একটু আয়রন করে দিও।
—-ঠিক আছে তুলি। তুমি আমার রুমে রেখে আসো।
শিউলি তাড়াতাড়ি সবাইকে নাস্তা দিয়ে দিলো।
বাড়িতেই সামিয়ানা খাটিয়ে বৌভাতের আয়োজন করা হয়েছে।ভোর থেকে বাবুর্চি এসে রান্না শুরু করেছে।একটু পরেই আত্মীয় স্বজন সবাই আসা শুরু করবে।শিউলি রান্নাঘরের কাজ গুছিয়ে ঘরে চলে গেলাে।
জাবেদ ও রেডী হয়ে বাবুর্চিদের তদারকি করতে গেলো।শিউলি ফ্রেস হয়ে এসে তুলির জামাটা আয়রন করছে আর ভাবছে,
বিয়ে করে সংসারে ঢুকাটা সহজ।কিন্তু প্রতিমূহুর্তে সংসারের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া এতো সহজ নয়।এ বাড়িতে অনেক কিছুই এই দু,দিনে শিউলিকে আহত করেছে কিন্তু যে মানুষটাকে কেন্দ্র করে ওর জীবনটা যাপিত সেই মানুষটাকে এখন পর্যন্ত ওকে ভালো মানুষ বলেই মনে হচ্ছে।
নিতান্ত মধ্যবিত্ত পরিবারে পারিবারিক টানাপোড়েনে শিউলি বেড়ে উঠেছে।প্রতিদিন মারধর চিৎকার চেঁচামেচি ঘরে লেগেই থাকতো।চোখের সামনে মায়ের অপমান সহ্য করতে হতো।বাবা থেকেও বাবার আদর কপালে জোটেনি।শেফালী আর শিউলি পিঠাপিঠি।মা সারাক্ষণ ওদের বিয়ের চিন্তায় অস্থির।শেফালীর মানসিক জাের অনেক বেশী।সংসারের জটিলতায় বিয়ের প্রতি আগ্রহ নেই অথবা দায়িত্বের কারণে বিয়ে করতে চায় না। ওদের মা রাহেলা বেগম মেয়েদের বিয়ের টেনশনে ঘুমাতে পারে না।শিউলি সে ক্ষেত্রে নরম প্রকৃতির মেয়ে।মায়ের বোঝা হালকা করতে অগত্যা শিউলিকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়।
জীবনের রুঢ় বাস্তবতা শিউলিকে এটাই শিখিয়ে দিয়েছে এই পৃথিবীতে আপন বলে আদৌ কেউ হয় কিনা।যাকে আপন ভেবে নিজের চেনা জগতটা ছেড়ে এসেছে জীবনের প্রয়োজনে কতটা আপন হবে সময় তা বলে দিবে।
কে যেন দরজায় নক করছে।দরজা খুলে দেখে তুলি দাঁড়িয়ে আছে
—-ভাবি আমার জামাটা আয়রন করা হয়েছে।তুমি এখনও রেডী হওনি।ভাইয়া আমাকে বললো,তুমি রেডী হয়েছো কিনা খোঁজ নিতে।আর আধঘন্টার মধ্যে তোমাদের বাড়ির লোক এসে পড়বে
তুলি ওর জামাটা নিয়ে চলে যাবার পর শিউলি রেডী হলো।এমন সময় জাবেদ এসে ঘরে ঢুকলো,
—শিউলি তুমি রেডী তো
—-হুম
জাবেদকে দেখলে ওর বুকের ভিতর ধুকপুকানি শুরু হয়। হঠাৎ আচমকা জাবেদ ওকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায়।লজ্জায় শিউলি চোখ বন্ধ করে রাখে।জাবেদের আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করে।জাবেদ শিউলিকে বলে,
—-আমি না ছেড়ে দিলে তুমিতো নিজেকে ছাড়াতে পারবে না।চোখ বন্ধ করে রাখলে আরোও ছাড়বো না।আমি দেখতে খারাপ নাকি তোমার পাশে আমাকে মানায় না।আমার চোখে চোখ রেখে কথা বলবে তারপর ছাড়বো।
অতঃপর শিউলি
জাবেদের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
—-ছাড়ো কেউ আবার এসে পড়বে
—-আসুক সমস্যা নেই।আমি আমার বউকে জড়িয়ে ধরেছি।একবার দেখলে দ্বিতীয়বার এ রুমে কেউ ঢুকবে না।
এমন সময় তুলি দরজায় নক করে বললো,
—ভাইয়া ভাবির বাড়ির লোকজন এসে পড়েছে।
জাবেদ রুম থেকে বের হয়ে ড্রইং রুমে গেলো।
জাবেদের মা বাবা খালা চাচী শিউলিদের বাড়ির মানুষগুলোকে বসানোর ব্যবস্থা করলো।শেফালীকে দেখে জাবেদের মা বললো,
—-তোমার মা আসলো না
—না আন্টি।আম্মার শরীর ভালো না
জাবেদের খালা জাবেদের চাচীকে ফিসফিস করে বললো,
—-ও হচ্ছে শেফালী শিউলির বড়।ওকে দেখতে গেছিলাম।বুবু শিউলিকে পছন্দ করেছে।
জাবেদের চাচী বললো,
—-মেয়ের কি কোনো খুঁত আছে।
—-না,কিছু তো শুনি নাই। বুবুর কাছে বয়স বেশি মনে হয়েছে।
এর মধ্যে জাবেদের বাবা সবাইকে সরবত দিলো।শেফালী এদের ফিসফাস দেখে সরুপার দুই মেয়েকে নিয়ে শিউলির কাছে চলে গেলো।
দুপুর দুটো বাজে। শিউলিদের বাড়ির সবাইকে খেতে বসিয়ে দেওয়া হলো।সবার খাওয়া হয়ে গেলে জাবেদের মা আবেদকে খাওয়ানের জন্য খাবার নিয়ে ঘরে গেলো।কিন্তু ঘরে আবেদকে খুঁজে পেলো না।আজকে আবেদকে গোসল করানোর পর আবেদ ঘুমিয়ে পড়েছিলো।তাই ওকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়নি।দরজার ছিটকিনিটা লাগানো ছিলো।এতো লোকজনের মাঝে কেউ হয়তো দরজার ছিটকিনি খুলে ফেলেছে।আবেদের মা চিৎকার দিয়ে বললো
—-আমার আবেদ কই।জাবেদ আবেদ মনে হয় হারাইয়া গেলো।কোন অলক্ষুনীর জন্য এই অবস্থা হলো।
জাবেদ দৌড়ে মার কাছে গিয়ে বললো,
—-মা তুমি চিন্তা করো না।আমি এখুনি ভাইয়াকে খুঁজে আনছি।
—–তুই তোর ভাইটার খেয়াল রাখতে পারলি না।বিয়া কইরা ভাইটাকে পর করে দিলি।
জাবেদের বাবা ওর মাকে বললো,
—-মেহমানদের সামনে কি আবোল তাবোল বলছো।জাবেদ কি করে খেয়াল রাখবে।তোমার আর তুলির খেয়াল রাখা উচিত ছিলো
—-তোমার কাছে তো আবোল তাবোল মনে হবে।সন্তানতো আমার।আমি এর জ্বালা বুঝি।
এরমধ্যে এলাকার একজন পরিচিত মানুষ আবেদ কে বাসায় দিয়ে গেলো।এখানে আবেদকে সবাই চেনে। আবেদের বাবা জাবেদকে ফোন দিয়ে খবর দিলো।জাবেদ এসে ভাইকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখলো।
এসব দেখে শেফালীর মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো।যদিও জাবেদের মার কথায় শেফালী কিছু মনে করে নাই।সন্তানকে খুঁজে না পেয়ে হয়তো উল্টাপাল্টা কিছু বলে ফেলেছে তারপরও শিউলির জন্য চিন্তা হচ্ছে।জাবেদ তো ঢাকায় থাকে।শিউলিকে তো এখানেই থাকতে হবে।পাগলীটা কি করে সব সামলে চলবে শেফালী এই চিন্তায় অস্থির।
কপালে যদি সুখ না থাকে দেয়ালে মাথা ঠুকে লাভ নেই এতে শুধু ব্যথাই বাড়ে ভাগ্য আর সুপ্রসন্ন হয় না।
রমজান আর সরুপা জাবেদের মা বাবা আত্মীয় স্বজনের কাছে বিদায় নিলো।এরপর জাবেদ আর শিউলিকে নিয়ে ওদের বাড়ির পথে রওয়ানা হলো।
বাড়িতে পৌঁছানোর পর রাহেলা বেগম সরবত আর পায়েস দিয়ে মিষ্টিমুখ করে মেয়ে আর জামাইকে বরণ করে নিলেন।
রাহেলা বেগম শেফালীকে শিউলির শ্বশুর বাড়ি
সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলো,
—–শেফালী জাবেদের মা বাবা কেমন?আর ওর পাগল ভাইটা কি বেশী পাগলামী করে?
—–শোন মা, জন্ম থেকে যাদের কপাল পোড়া তার কি আর কপাল পোড়ার ভয় থাকে?দোয়া করো তোমার মেয়েটা যেন জামাই নিয়ে সুখে শান্তিতে ঘর করতে পারে।
রাহেলা বেগম শেফালীর দিকে তাকিয়ে বললেন
—-তুই এতো চাঁছা ছোলা কথা কেন বলিস?স্বাভাবিক কথা বলতে পারিস না।
—-না মা,পারিনা।আমাদের জীবনটা তো কখনও স্বাভাবিক ছিলো না।ভাঙ্গাচোরা জীবনে কোনো স্বাভাবিকতা থাকে না।
রাহেলা বেগম আর কথা না বাড়িয়ে মেয়ে আর জামাইয়ের জন্য ডিনারের ব্যবস্থা করলেন।
শিউলি আর জাবেদ পরিবারের সবার সাথে ডিনার সেরে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লো।সারাদিনে যে পরিমান ধকল গেলো শোয়ার সাথে সাথেই দু,জনেই ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেলো।
পরদিন বিকালে শিউলি বিদায়ের সময় মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলো।রাশেদ আর শাহেদকে বললো,
—তোদের ছোটো আপুটা আর তোদের জ্বালাবে না।যখন তখন তোদের সাথে ঝগড়া খুনসুটি হবে না।ও বাড়িতে আমি তোদেরকে খুব মিস করবো।
এরপর শিউলি শেফালীকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদলো।শেফালী শিউলিকে বললো
—-এতো কাঁদিস না।শক্ত হতে শেখো।চোখের পানির অনেক দাম।যত্র তত্র এটা ফেলতে হয় না।আবেগের স্রোতে ভেসে চলা আমাদের জীবন নয়।জীবনের বাস্তবতা আমাদের শিখিয়ে দিয়েছে লড়াই করে কি করে বেঁচে থাকতে হয়।নতুন জায়গা নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে প্রথম একটু সমস্যা হবে।কিন্তু মানিয়ে নেওয়াটাই জীবন।
এরপর শেফালী জাবেদকে বললো,
—-শোন ভাই যে তোমার জন্য তার নিজের চেনা জগতটা ছেড়ে গেলো তাকে সারাজীবন তুমি আগলে রেখো।তাতেই ওর জীবন পূর্ণতা পাবে।
জাবেদ আর শিউলি কুমিল্লার পথে রওয়ানা হলো।বাসায় পৌঁছাতে বেশ রাত হলো।শিউলি পোশাক বদলে ফ্রেস হয়ে টেবিলে খাবার দিয়ে দিলো।পরিবারের সবাই একসাথে রাতের ডিনার সেরে নিলো।জাবেদ খাওয়া শেষ করে রুমে চলে গেলো। জাবেদের ছুটিও শেষ হতে চললো। কাল বাদে পরশু ঢাকায় গিয়ে আবার অফিস করতে হবে।শিউলি এঁটো বাসন রান্না ঘরে গুছিয়ে রেখে বেডরুমে চলে আসলো।
তারপর লাইট অফ করে শুয়ে পড়লো।বাহিরে পূর্ণশশীটা মেঘের আড়ালে লুকিয়ে গেলো।মূহু মূহু মেঘের গর্জনে প্রকৃতিতে ঝড়ো বাতাস বইছে।তারসাথে মুষলধারে বৃষ্টি ঝড়ছে।আর দুটি শুদ্ধ দেহ
মন সমস্ত দুঃখ বেদনাকে দূরে ঠেলে প্রণয়ের ঝড়ে স্বর্গীয়সুখে নিজেদের আপন করে নিলো।
চলবে