জীবনের নানা রং পর্ব-১১

0
645

#ধারাবাহিকগল্প
#জীবনের নানা রং
পর্ব-এগারো
মাহাবুবা বিথী

শিউলির হাসপাতালে ভর্তির খবর শুনে শেফালী কেবিনে চলে আসে।জাবেদ শেফালীকে দেখে শিউলিকে বললো
—-তোমরা দুবোন গল্প কর,আমি বিলের কাউন্টার থেকে ঘুরে আসছি।আজকেই রিলিজ দিবে।
আসলে জাবেদ শেফালীকে একটু এড়িয়ে গেলো।ও চলে যাবার পর শেফালী শিউলিকে বললো,
—-এখন কেমন আছিস।নিজের দিকে একটু খেয়াল রাখতে পারলি না।
শিউলি বললো,
—–আপু এটা একটা দুর্ঘটনা।হঠাৎ দুর্ঘটনার উপর কারো হাত থাকে না।
শেফালী বললো,
—-সব কিছুকেই দুর্ঘটনার উপর দায় চাপিয়ে দিলে হয় না।নিজের ভালোটা বুঝতে হয়।
শেফালী আরও বলে,
—-পৃথিবীকে ভালো করে চেনার আগেই সংসার নামক খাঁচাটায় ঢুকে পড়েছিস।পড়াশোনাও তো করলি না।তুমি নিজেকে যদি ভাল না বাসো এই পৃথিবীর
কেউ তোমাকে ভালোবাসবে না।সংসারে তুমি রান্না করবে শ্বশুর শাশুড়ী স্বামী সন্তান সবার দেখাশোনা করবে সবাইকে অফুরন্ত ভালোবাসা দিবে, আত্মীয়স্বজন ও সামাজিক দায়দায়িত্ব পালন করবে, ছেলেমেয়েরাও বড় হয়ে নিজেদের মতো নিজেকে গড়ে নিবে শুধু দিনশেষে তোমাকে ভালবাসার জায়গাটায় ধুলোর আস্তর আর শ্যাওলা পড়ে থাকবে।
সবার আগে সবাইকে মনে রাখতে হয়,

health and fitness

তাই সংসারে সবাইকে ভালবাসিস ক্ষতি নেই কিন্তু নিজেকেও ভালবাসিস।
শিউলি ভাবছে, আপু একদম সঠিক কথাই বলেছে।এমন সময় দরজায় নক করে জাবেদ রুমে আসলো।শেফালী জাবেদকে বললো,
—-আবেদ ভাইকে তোমরা কখনও মানসিক ডাক্তার দেখাওনি।
জাবেদ বললো,
—-না কখনও দেখানো হয়নি।আম্মা পীর ফকির আর কবিরাজী করেছে।তবে আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলেছি।
শেফালী জাবেদকে বললো
—-ঢাকায় এখন অনেক ভালো মানসিক হাসপাতাল আছে।তুমি খোঁজ নাও।আল্লাহ তোমাদের অনেক বড় বিপদ থেকে বাঁচিয়েছে।আমার মনে হয়,ওনি সিজোফ্রেনিক রোগী।ওনাকে কিছুদিন হাসপাতালে ভর্তি করে রেখো।
জাবেদ বললো,
—-আমিও তাই ভাবছি।
শেফালী জাবেদ আর শিউলির কাছে বিদায় নিলো।যাবার আগে জাবেদকে বললো,
—-জাবেদ, বিয়ের পরে প্রতিটি মানুষ আমি থেকে আমাদের হয়।তাই আমাদের এই জীবনটায় সুখী হলে দুজনকেই সুখী হওয়া উচিত।কাউকে দুঃখ দেওয়ার জন্য বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া উচিত নয়।তাই তুমি আমার বোনটার দিকে খেয়াল রেখো ও যেন অকারণে দুঃখ না পায়।
শেফালী চলে যাবার পর শিউলি আর জাবেদও কুমিল্লার পথে রওয়ানা হয়।ওরা কুমিল্লা পৌছাতে বিকেল হয়ে যায়।

পরদিন শুক্রবার।জাবেদ শিউলিকে সকালে শোয়া থেকে উঠতে দেয় না।বিশ্রামে থাকতে বলে সকালের নাস্তা বাহির থেকে কিনে আনে।জাবেদের মার কাছে বিষয়টা ভালো লাগে না।জাবেদ টেবিলে নাস্তা দিয়ে দেয়।চুলায় চায়ের পানি চাপায়।এসব দেখে জাবেদের মা মরিয়ম জাবেদকে বলে,
—–কিরে কোনদিন তোর হাতে একগ্লাস পানি ঢেলে খায়নি তোর কষ্ট হবে বলে।বিয়ের পর তোর দিন এতোই খারাপ হলো সংসারের মেয়ে মানুষের কাজগুলো তোকে এখন করতে হচ্ছে।
—–শোন মা।কাজের গায়ে নাম লেখা থাকে না।মেয়েদের কাজ না ছেলেদের কাজ।আর ঢাকায় তো আমি নিজের কাজ নিজেই করি।আমার ঘরের রান্না বাথরুম ধোওয়া ঘর পরিস্কার করা সব তো আমি নিজেই করি।তুমি তো জানো।তখনতো কিছু বললে না। তবে আজ কেন এ প্রশ্ন তুলছো।
—এখন মায়ের কথা শুনতে খারাপ লাগবে।বিয়ে করলে ছেলেরা পর হয়ে যায়।
—-সময়ই বলে দিবে মা আমি তোমার পর না আপন।এখন টেবিলে বসো।পরোটাগুলো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।

এর মাঝে ফ্রেস হয়ে শিউলি রান্না ঘরে চলে আসলো।জাবেদ শিউলিকে বললো,
—-এতক্ষণ তো মা লেকচার দিলো।এখন কি তুমি লেকচার দিবে।যদি লেকচার দিতে না চাও টেবিলে খেতে বসে যাও। আমি চা নিয়ে আসছি।
সবাই নাস্তা করার পর জাবেদ ওর মা বাবার সাথে আবেদের বিষয়ে কথা বললো,
—-বাবা,আমি ভাইয়ার ব্যাপারে ডাক্তারের সাথে কথা বলেছি।
মরিয়ম বিবি ছেলেকে বললো,
—-তুই আমাকে জিজ্ঞাসা না করেই ডাক্তারের সাথে কথা বললি।একবার তো আমাকে বলতে পারতি।
জাবেদ বললো,
—-মা তুমি না বুঝেই রাগ করছো।এতোদিন ভাইয়াকে কবিরাজি করলে কোনো তো লাভ হলো না।বরং দিন দিন ভাইয়ার অবস্থা খারাপ হচ্ছে।তোমাকে আগেই বলেছিলাম।আমার কথা শুনলে ভাইয়া এতোদিনে কিছুটা সুস্থ হতো।
—বউয়ের কথা শুনে অসুস্থ ভাইটাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছিস।শোন,বউ গেলে বউ পাওয়া যায়।ভাই গেলে ভাই পাবি না।
—-মা,তুমি আমাকে ভাইয়ার ব্যাপারে আজ এই কথা বলছো।তুমি মনে হয় ভূলে গেছো আমার অনার্স পরীক্ষার দুদিন আগে ভাইয়া আমার নোট খাতা গুলো পুকুরে ফেলে দেয়।যার ফলে আমার রেজাল্ট ভালো হলো না।সেই খেসারত আজও দিয়ে যাচ্ছি।
—সেই কারণে জমি বিক্রি করে ব্যবসা করার জন্য তোর হাতে টাকা তুলে দিয়েছি।
—-তা দিয়েছে।আমিও ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য লড়াই করে যাচ্ছি।কিন্তু আমার নিজের লালন করা স্বপ্নটা হারিয়ে ফেলেছি।
মরিয়ম বেগম আর কিছু না বলে উঠে চলে গেলেন।কিন্তু শিউলির উপর মনে মনে খুব নাখোশ হলেন।
জাবেদ ওর বাবাকে বললো,
—বাবা আমি কালকে ভাইয়াকে হাসপাতালে ভর্তি করবো।তোমার আমার সাথে যাওয়ার দরকার নাই।তুমি পরে ভাইয়াকে দেখতে যেও।
—জাবেদ ও সুস্থ হবে তো বাবা।
—-এতোদিন ভাইয়া সুস্থ হয় নাই।দিন তো থেমে থাকে নাই।আজ একটু ডাক্তার দেখিয়ে চেষ্টা করি।দেখি কি হয়।তবে ডাক্তার আশাবাদী।ইনশাআল্লাহ ভাইয়া হয়তো পুরোপুরি সুস্থ হবে না।কিছুটা উন্নতি হয়তো হবে।দেখা যাক কি হয়।

এরপরদিন জাবেদ আবেদকে নিয়ে ঢাকায় চলে যায়।শিউলি সকালে নাস্তা খাওয়ার পর শাশুড়িকে দুপুরে কি রান্না হবে জিজ্ঞাসা করে।একঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকার পর শাশুড়ী রান্নার ফর্দ দেয়।তারপর শিউলিকে বলে,
—-শোন মেয়ে এই পৃথিবীতে মায়ের ভালবাসার তুলনা নাই।এখনও তো ছেলেপুলের মা হওনি।তোমাকে একটা গল্প বলি,এক প্রেমিক তার প্রেমিকাকে বলে আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।প্রেমিকা বলে প্রমান দাও।প্রেমিক বলে কি প্রমান চাও বলো।প্রেমিকা বলে তোমার মায়ের কলিজা আমার জন্য আনতে পারবে।প্রেমে অন্ধ প্রেমিক বলে পারবো।প্রেমিক মাকে খুন করে কলিজাটা প্রেমিকার জন্য নিয়ে দৌড়াতে থাকে।এমন সময় হোঁচট খেয়ে প্রেমিকটা পড়ে যায়।মায়ের কলিজা তখন বলে উঠে,ব্যথা পেলি বাবা।আস্তে দৌড় দে।বুঝেছো এই হচ্ছে মায়ের ভালোবাসা।
—-এই গল্প মা আমি আমার দাদীর মুখে বহুবার শুনেছি।আজকে আপনার মুখে শুনলাম।দুদিন পর হয়তো আমিও আমার বৌমাকে শোনাব।তবে দিন বদলাচ্ছে তো আমাদের বৌমারা এই রকম গাঁজাখুরী গল্প শুনতে চাইবে না।হয়তো বা আমরাও বলবো না।

শিউলি কথা বলার সুযোগ না দিয়ে রান্না ঘরে চলে গেলো।রান্না ঘরে শিউলি শুনতে পেলো শাশুড়ী ওকে ডাইনী, মায়াবিনী বলছে।ওনার ছেলেকে শিউলি যাদুটোনা করেছে।শিউলি শাশুড়ীর কথাগুলিকে উপেক্ষা করে গেলো।অনেক সময় উপেক্ষা করেও কথার জবাব দেওয়া যায়।কারন কথায় কথা বাড়ে।আবেদ ভাইকে হাসপাতালে ভর্তির কারণে ওনার হয়তো মন খারাপ।শিউলিকে এসব বলে উনি হয়তো সান্তনা খুঁজে পান। এভাবেই শিউলির মতো মেয়েরা সংসার সংসার খেলায় যাপিত জীবনের দহন বেলার সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here