#ধারাবাহিকগল্প
#জীবনের নানা রং
পর্ব–তেরো
মাহাবুবা বিথী
সারারাত শিউলি দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি।ওর শরীরে একটা প্রাণ বেড়ে উঠছে।প্রথম মা হওয়ার অনুভূতীতে শারীরিক জটিলতায় অভ্যস্ত হতে ওর সময় লাগছে।গতরাতে জাবেদ বাসায় ছিলো।ওর ও রাতে ঘুম হয়নি।রাতে বেশ কয়েকবার
শিউলির বমি হয়েছে।জাবেদ ও রাতে ওকে ফলের জুস স্লাইন বানিয়ে দিয়েছে।ভোরের দিকে ওরা দুজন ঘুমিয়েছে।
সকালে দরজা নক করার শব্দে ওদের ঘুম ভেঙ্গে গেলো।শিউলি ওয়াশরুম থেকে ফ্রেস হয়ে এসে রান্না ঘরে গিয়ে চায়ের কেটলি চুলায় চাপিয়ে দিলো।শিউলির আবারো বমি বমি লাগছে।দৌড়ে ওয়াশ রুমে চলে গেলো। ওয়াশ রুম থেকে শুনতে পাচ্ছে,
—শাশুড়ী চায়ের কেটলির পানিটা ফেলে দিলো
তারপর গজ গজ করে বললো,
—গোসল না করে আবার রান্না ঘরে ঢুকেছে।এদের কোনো লাজ শরম নেই
শিউলির মেজাজটা চড়ে গেলো।ও এসে শাশুড়ীকে বললো
—মা কাল সারারাত আমার বমি হয়েছে।শরীরটা ভালো ছিলো না।আপনার ছেলে স্লাইন বানিয়ে দিয়েছে তাই বিছানা থেকে উঠতে পারলাম। আর আপনি আছেন আপনার গোসল নিয়ে।
শাশুড়ী বললো,
—-দেখে মনে হয় ভাজা মাছটা উলটে খেতে পারো না।মুখে মুখে তর্কের বেলায় ষোল আনার উপরে আঠারো আনা।
শাশুড়ী আবারো বললো,
—যাও গোসল করে আসো। অত ন্যাকা সাজতে হবে না।গোসল করে রান্না ঘরে ঢুকবে এটাই আমার শেষ কথা।
শেফালী রুমে চলে আসলো।জাবেদ বললো,
—–শরীর খারাপ লাগলে গোসল করো না।তুমি মাথাটা ধুয়ে নাও।এরপর পরনের কাপড় বদলে নাও।মা বুঝতে পারবে না।কি করবে বলো?তোমাকে তো আগেই বলেছি, মাকে একটু ম্যানেজ করে নিও।তুমি ফ্রেস হয়ে আসো, আমি হোটেল থেকে খাবার কিনে আনছি।
জাবেদ চলে যাওয়ার পর শিউলি পরনের কাপড় বদলে মাথাটা হালকা ধুয়ে রান্না ঘরে এসে চুলায় চায়ের কেটলি চাপিয়ে দিলো।জাবেদ খাবার কিনে আনার পর শিউলি টেবিল সাজিয়ে দিলো।চা বানিয়ে নিয়ে শিউলি সবার সাথে বসে নাস্তা করে নিলো।
শিউলির শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে সময়গুলো খুব একটা ভালো যাচ্ছে না।ডাক্তার জাবেদকে বলেছে
শিউলি যেন খুব হাসি খুশী থাকে।অফিস থেকে সাতদিনের ছুটি নেয় জাবেদ।শিউলিকে নিয়ে কক্সবাজার যাবে। বিয়ের পর ওদের কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয়নি।শিউলির বাচ্চা কনসিভ করা,এবরশোন হয়ে যাওয়া এইসব নানা কাহিনীতে ওদের কোথাও বেড়ানো হয়নি।তারপর শিউলি আবার কনসিভ করেছে।মনটা ওর খুব বিমর্ষ থাকে। কাল শিউলির জন্মদিন।জাবেদ আগে থেকে শিউলিকে কিছু জানায়নি।জাবেদ ট্রেনের টিকিট কেটে বাড়ী ফিরে।ওরা প্রথম চিটাগাং যাবে ওখানে একরাত থাকবে।তারপর মাইক্রো করে কক্সবাজার যাবে।শিউলি খুব সারপ্রাইজড হবে।
সেদিন বাহিরে পূর্ণশশীর জোৎস্না।আজ সারাদিন জাবেদ ফোনদিয়ে শিউলির কোনো খোঁজ নেয়নি।শিউলির খুব কান্না পাচ্ছে।শিউলি ভাবছে, আগে তো ও এতো আবেগী ছিলো না।বাচ্চাটা কনসিভ করাতে একটুতেই চোখে পানি ঝরে।জানালা দিয়ে জোৎস্নার আলোয় ঘরটা প্রচন্ড আলোকিত।ইস জাবেদ যদি ঘরে থাকতো শিউলি আজ জাবেদকে নিয়ে জোৎস্নার আলোয় নিজেকে স্নান করাতো।তবে শিউলি বুঝতে পারে ও জাবেদকে খুব বেশী ভালোবেসে ফেলেছে।কাউকে এতো বেশী ভালবাসতে নেই এতে হয়তো নিজের জন্য আর কোনো ভালবাসা অবশিষ্ট থাকে না।তাই শিউলি ভাবে ওর আবেগের লাগামটায় রাশ টেনে ধরতে হবে।
রাত বারোটা বাজে।পুরো শহর ঘুমিয়ে পড়েছে।হঠাৎ দরজায় কে যেন নক করছে।শিউলির শাশুড়ি দরজা খুলে জাবেদকে দেখে ওনার চক্ষুচড়ক গাছে।মরিয়ম ছেলে জাবেদকে বললো,
—-কিরে এতো রাতে তুই কোথা থেকে আসলি?
জাবেদ বললো,
—-এদিকে একটা কাজে আসছিলাম।
মরিয়ম ছেলেকে বললো,
—–কাজে আসলি না অকাজে আসলি আমিতো দেখতে যায়নি।তবে এইটুকু বুঝতে পারছি কালে কালে অনেক কিছুই দেখতে হবে।
জাবেদ কথা না বাড়িয়ে রুমের দিকে যেতে গিয়ে শুনতে পেলো,মা মরিয়ম বলছে,
—-এদের আদিখ্যাতা দেখলে শরীর জ্বলে যায়
এতরাতে দরজায় নক করার শব্দে শিউলি অবাক হয়।ও জেগেই ছিলো।দরজা খুলে জাবেদকে দেখে জড়িয়ে ধরে ওর চোখটা ভিজে উঠলো।জাবেদও ওকে বুকের সাথে মিশে জড়িয়ে ধরলো।
পরদিন খুব ভোরে শিউলির ঘুম ভেঙ্গে যায়।হঠাৎ চোখে পানির ঝাপটায় জাবেদের ও ঘুম ভেঙ্গে যায়।তাকিয়ে দেখে শিউলি দাঁড়িয়ে আছে।চুলের আগা বেয়ে টপ টপ করে পানি ঝরছে।মুখে ক্লান্তির ছাপ।মাতৃত্বের কারণে হয়তো ছাপটা পড়েছে।তারপরও ওকে খুব সুন্দর লাগছে,শিউলি জাবেদকে বললো,
—-ড্যাব ড্যাব করে কি দেখছো।ওঠো চা খাবে।
জাবেদ বলে,
—–মহারানী আপনাকে দেখছি।
শিউলি বললো,
—–আমাকে নতুন করে দেখার কিছু নাই।একটু পড়েই মার বকুনিতে ভালবাসার তেল ঝরে যাবে।আমি রান্না ঘরে গেলাম।তুমি ফ্রেস হয়ে আসো।
সকালের নাস্তা সবাই খাওয়ার পর দুপুরের রান্নার দায়িত্ব নেয় জাবেদ।মা আর বউকে বলে আজ তোমাদের ছুটি আমি রান্না করবো।তুলি ভাইয়ের কাছে রান্নার মেনু জানতে চায়।জাবেদ বলে,
—-ভূনা খিচুরী,আচারী মুরগীর মাংস, গরুর মাংস ভূনা আর ইলিশ মাছ ভাজি।
তুলি ভাইকে বলছে,
—-আইটেমের নাম শুনেই জিভে পানি আসছে।তো তোমার উপলক্ষ্য কি?
জাবেদ বলে,
—-রান্না করতে উপলক্ষ্য লাগবে কেন?ঢাকায় তো আমি নিজের রান্না নিজে করে খাই।তাই ইচ্ছে হলো,তোদের সবাইকে একটু রান্না করে খাওয়াই।
দুপুরে খাওয়ার পর জাবেদ কক্সবাজারে যাওয়ার ট্রেনের টিকিট টা শিউলির হাতে দিয়ে বললো,
—-মহারানী আপনার জন্মদিনের উপহার।
আনন্দে শিউলির মুখটা ঝলমল করে উঠলো।বিয়ের আগে কতবার মার কাছে বায়না করেছে কক্সবাজারে যেতে চেয়েছে, মা তখন বলতো,
—–স্বামীর সাথে ঘুরতে যাবি।আমি নিজেই কোনোদিন সংসারের চারদেয়ালের ভিতর থেকে বের হয়নি। সংসারের যাপিত জীবনের যাঁতাকলে নিজেকে নিঃশেষ করে গেলাম।তোদের জন্য দোয়া করি,আমার মতো জীবন তোদের যেন না হয়।
শিউলি ভাবছে,আল্লাহপাক মার দোয়া কবুল করেছে
বিয়ের পর শারীরির নানা জটিলতায় সাংসারিক ঝামেলায় ঘুরতে যাওয়া হয়নি।সন্কোচ লজ্জায় জাবেদকে বলতে ও পারেনি।ওর খুব ভালোলাগছে জাবিদ ওর মনটা বুঝতে পেরেছে।ও খুশী হয়ে জাবেদকে বললো,
—–একটু শপিং এর দর কার ছিলো।খুব সুন্দর একটা নাইটি কেনার ইচ্ছা ছিলো।সাগরে নামার জন্য কিছু মোটা কাপড়ের থ্রীপিচ কেনার দরকার ছিলো।ভিজে গেলে যেন শরীর দেখা না যায়।আর একটা সানস্কীন লোশন।তুমি মার কাছে অনুমতি নিয়েছো?
জাবেদ বললো,
—–ও নিয়ে তুমি ভেবো না।অনুমতি আমি ঠিক আদায় করে নিবো।
সন্ধার পর চা খাওয়ার পর জাবেদ ওর বাবা মার কাছে শিউলিকে নিয়ে কক্সবাজারে যাওয়ার কথা বলাতে জাবেদের মা তেলেবেগুনি জ্বলে গিয়ে বললো,
—–তোকে যে এতো কষ্ট করে বড় করে তুললাম,আমাকে নিয়ে তোর কোনদিন বেড়াতে যেতে ইচ্ছে করলো না।এমনকি তোদের সাথে তুলির নেওয়ার কথা বলতে পারতি।তা না বলে উড়ে এসে জুড়ে বসা মানুষের জন্য তোর দরদ উথলে উঠলো।
জাবেদ বললো,
—–আমি তোমাকে বহুবার বলেছি।তুমি আবেদ ভাইকে রেখে কোথাও বেড়াতে যেতে চাওনি।
জাবেদের মা বললো,
—তুই তো জোর ও করিসনি।যাক পুরোনো কথা তুলতে চাই না।তবে এসময় বৌমাকে নিয়ে বেড়ানো ঠিক হবে না।প্রথম বাচ্চাটা এবরশোন হয়েছে।তাই তোদের আরও সাবধানে থাকা দর কার।তাছাড়া সাগরে প্রতিবছর কত মানুষ ডুবে মারা যায়।সে সব অশরীরিরা ঘুরে বেড়ায়।প্রসুতি মেয়েদের উপর ওদের একটা নজর থাকে।
জাবেদের মনটা খারাপ হয়ে গেলো।আবার মায়ের কথাটা উড়িয়ে দিতে পারছে না।জাবেদ ভাবছে, শিউলি বাহিরে যাওয়ার কথা শুনে এতো খুশী হয়েছিলো। ওকেই বা এখন কি বলবে?
শিউলি ঘরে থেকেই জাবেদ আর ওর শাশুড়ীর কথা শুনতে পেলো।ও বুঝতে পারছে,জাবেদের মনটা অনেক খারাপ হয়ে যাবে।যদিও শিউলি বুঝতে পারলো শাশুড়ী কৌশল করে ওর যাওয়াটা ভেস্তে দিলো। ছেলেকেও কায়দা করে হাতে রাখলো। ছেলের অনাগত সন্তানের জন্য ওনার দরদ উথলে উঠছে। সময় বলে দিবে কতটা ভালবাসেন। শিউলিও
জাবেদকে কিছু বুঝতে দিলো না।মনের কষ্ট মনে চেপে রাখলো। আর নিজেকে সামলে নিয়ে ভাবলো,
“জীবন কখনও সহজ সরল পথে হাঁটে না।তাই এই কাঁটা বিছানো পথে চলতে গিয়ে সহজ সরল মেয়েরা সাংসারিক কূটকৌশলে নিজেকে জটিল করে তুলতে বাধ্য হয়।”
চলবে