হৃদমাঝারে_আছো_তুমি তৃতীয়_পর্ব

হৃদমাঝারে_আছো_তুমি
তৃতীয়_পর্ব
#তাসনূমা_ফারেহীন

অধরার চেঁচামেচি শুনে ঘুম ভাঙে তারিনের। কারণ জিজ্ঞেস করে জানতে পারে অপ্সরাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মুহূর্তেই আৎকে উঠে তারিন। তৎক্ষণাৎ হাতঘড়িতে সময় দেখলো ভোর ছয়টা বেজে ত্রিশ মিনিট। পাঁচ বছরের বাচ্চা মেয়ে এত সকালে কোথায় গেলো?

অধরার মতো তারিনের মনেও বেশ অস্থিরতা এবং দুঃশ্চিন্তা কাজ করছে। রায়হানকে কল করলে দুবার কেটে গিয়ে তৃতীয়বারে বেলায় ফোন রিসিভ হলো। অপ্সরা কথা জিজ্ঞেস করায় বললো অপ্সরা তার কাছেও যায়নি। অধরা এবার অনেক ভেঙ্গে পড়ে। অপ্সরাই তার একমাত্র বেঁচে থাকার সম্বল। তারিনেরও মাথা কাজ করছে না। তারিন অপ্সরাকে নিজের মেয়ের মতোন ভালোবাসে। তাই তারিনেরও প্রচুর চিন্তা হচ্ছে।

তারিন অপ্সরাকে শান্তনা দিতে থাকে। এই বয়সে বাচ্চারা একটু চঞ্চল হয়েই থাকে। অপ্সরা সে তুলনায় একটু বেশিই চঞ্চল। বাবার মতো হয়েছে কিনা! তাইতো মেয়ের প্রতি অধরার টান আরো বেশি। কিন্তু চিন্তার বিষয় এখনো অপ্সরা ফিরে আসছে না কেন। চঞ্চল হলেও অপ্সরা কখনো এত সময় বাহিরে থাকেনি। তারিন মনে প্রাণে দোয়া করতে থাকে, অপ্সরার যেন কোন বিপদ না হয়।

রায়হান অপ্সরাকে খুঁজতে বেরিয়েছে। অনেক খোঁজার পরেও না পেয়ে রায়হান বিরক্ত বোধ করছে। অপ্সরাকে সাথে না এনে রায়হানকে এভাবে ফিরে আসতে দেখে তারিন খুব অবাক হয়। রায়হান জানালো অপ্সরাকে সে খুঁজে পায়নি। তারিনের যেন মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। শেষ আশার আলোও নিভে গেলো যেন। পুলিশে ইনফর্ম করার পাশাপাশি তারিনও অপ্সরাকে খুঁজতে যাওয়ার জেদ ধরে। ইতিমধ্যে অধরা সেন্সলেস হয়ে পড়েছে। তারিন যেতে চাইলে মাঝখানে বাঁধ সাধে রায়হান।

– ‘কোথায় যাচ্ছো তারিন?’

– ‘অপ্সরাকে খুঁজতে যাচ্ছি।’

– ‘অধরাকে এমনাবস্থায় রেখে যাওয়াটা কী ঠিক হচ্ছে তারিন? মেয়েকে হারিয়ে বেচারীর বেহাল দশা।’

– ‘অপ্সরা হারিয়ে যায়নি। আমি জানি সে আশেপাশেই আছে। আমি ঠিকি ওকে খুঁজে আনবো।’

– ‘ধৈর্য ধরো তারিন। পুলিশ অপ্সরাকে খুঁজছে। খুব শীঘ্রই অপ্সরাকে তারা খুঁজে আনবে। ভরসা রাখো তাদের উপর।’

– ‘ভরসা তো আমি তোমার উপরেও করেছিলাম রায়হান! কিন্তু সবার মতো তুমিও আমায় নিরাশ করলে। ডাক্তারকে কল করে দিয়েছি। তিনি এর মাঝেই এসে পড়বেন। আমাকে আটকানোর মোটেও চেষ্টা করবেনা। নয়তো আমার জেদ সম্পর্কে তুমি খুব ভালোভাবেই অবগত।’

– ‘তারিন…!’

রায়হানের কোন কথা না শুনেই তারিন বেরিয়ে পড়লো। তারিনের কাছে অপ্সরাকে খুঁজে পাওয়া এখন সবথেকে বেশি জরুরী।

সকাল সাড়ে সাতটা।

সোহান বর্তমানে চারদিক ঘুরে ঘুরে প্রকৃতির সৌন্দর্য নিহারণে ব্যস্ত। মনের মাঝে নানা রকম দ্বন্দ্ব চলছে। রাতে বৃষ্টির সাথে হঠাৎ বর্জ্যপাত আর লোডশেডিং এর কারণে ভালোভাবে ঘুম হয়নি। দুশ্চিন্তার কারণে এমনিতেও তার রাতে ঘুম আসতো না। আর যার ফলে তার মন বেজায় খারাপ। মনের বিরক্তি কাটানোর প্রয়াসেই প্রকৃতির আশ্রয় নেয়া। সকালের শীতল পবণ মন এবং স্বাস্থ্য দুটোই ভালো রাখে। বৃষ্টিপাতের ফলে পাহাড়ের বিভিন্ন জায়গা পিচ্ছিল হয়ে আছে যা খুবি বিপজ্জনক। একটি ভুল পদক্ষেপের কারণে খাদে পড়ে জীবননাশের আশংকা আছে। ফলে চারপাশে তেমন কেউ নেই। সোহানের মতো যাদের জীবনের ভয় নেই একমাত্র তারাই হয়তো ঝুঁকি নিচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সোহান। একসময় তার মনেও ভয় কাজ করতো। তা হলো, আপনজনদের হারিয়ে ফেলার ভয়!

হঠাৎ দূর থেকে একটি মেয়েকে ছুটে আসতে দেখে মুখে বিস্ময়ের ছাপ ফুটে উঠে। মেয়েটির বয়স বড়জোর চার-পাঁচ হবে। চোখে-মুখে ভয়, যেন কারো থেকে প্রাণ বাঁচাতে এদিকে ছুটে আসছে। মেয়ে না বলে বাচ্চা বললেই ভালো। কেন যেন বাচ্চাটির সাথে তারিনের চেহারার অদ্ভুদ মিল খুঁজে পেল সোহান। এটি তার মনের ভুলও হতে পারে। অবচেতন মন সবসময় কেবল তারিনকে নিয়ে ভাবে তাই ভুল হওয়া অস্বাভাবিক নয়। সোহানের কল্পনার অবসান ঘটে মেয়েটিকে সামনে এগিয়ে আসতে দেখে। সামনের অংশটি অনেক পিচ্ছিল। পা দেবার সাথে সাথে মেয়েটি পা পিছলে গিয়ে খাদের দিকে পড়ে যেতে লাগে। সোহান খুব দ্রুত মেয়েটির হাত ধরে নেয় এবং নিশ্চিত মৃত্যু থেকে তাকে বাঁচিয়ে নেয়।

সোহান বাচ্চাটিকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে বললো,

– ‘তুমি ঠিক আছো?’

বাচ্চাটি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লো। যার অর্থ সে ঠিক আছে। সোহান নিশ্চিন্তের হাফ ছাড়ে। এক মুহূর্তের জন্য ভেবেছিলো সে হয়তো বাচ্চাটিকে বাঁচাতে পারবেনা। বাচ্চাটি তাকে বললো,

– ‘থ্যাংক্স।’

পাঁচ বছরের ছোট্ট মেয়ে। মুখে কিছুটা জড়তা বিদ্যমান। আদো আদো কন্ঠে সোহানকে ধন্যবাদ জানালো। তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ দেখে সোহান দুষ্টুমির স্বরে বলল,

– ‘থ্যাংক্স কেন?’
– ‘আন্টি আমায় বলেছে, বিপদে যারা সাহায্য করে তাদের থ্যাংক্স বলতে!’
– ‘ওহ্ আচ্ছা। তোমার আন্টিতো তাহলে খুব ভালো।’
– ‘হ্যাঁ! আন্টি আমায় অনেক ভালোবাসে।’
– ‘কিন্তু তোমার আন্টি কোথায়? একা একা এত সকালে এখানে কী করছো?’

বাচ্চা মেয়েটি এবার কিছুক্ষণ চুপ থাকলো। কিছু সময় পর নিরবতা কাটিয়ে বললো,

– ‘আপনিও ঐ লোকগুলোর মতো পঁচা নাতো?’

সোহানের মনে এবার সন্দেহ জাগে। সন্দেহ নিয়েই বললো,

– ‘কোন লোকগুলো?’

– ‘যারা আমাকে জোর করে একটা অন্ধকার ঘরে বন্দি করে রেখেছিলো। আমার অনেক ভয় করছিলো। অনেক কষ্টে তাদের সাথে লুকোচুরি খেলে আমি এখানে চলে এসেছি। যেমনটা আমি আন্টির সাথে করতাম। কিন্তু কিছুতেই আন্টিকে খুঁজে পাচ্ছিনা। আংকেল, আপনি কী আমায় আন্টির কাছে নিয়ে যাবেন? আন্টিকে বললে আন্টি ওই লোকগুলোকে বকে দেবে।’

সোহান এবার সবকিছু বুঝতে পারলো।

– ‘বুঝলাম। কিন্তু লোকগুলো এখন কোথায়?’

বাচ্চা মেয়েটি হাতের ইশারায় তাদের দেখালো। অর্থাৎ বাচ্চা মেয়েটির কথা সত্য। ওদের থেকে বাঁচতে, পালাতে গিয়ে খাদে পড়ে যাচ্ছিলো। সোহান পুনরায় বললো,

– ‘আংকেল, তুমি কী আরো কিছুক্ষণ লুকোচুরি খেলবে?’

মেয়েটি বিনাবাক্যে রাজি হয়ে গেলো। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাতেই সোহান বললো,

– ‘ওকে, তাহলে লুকিয়ে পড়ো। আংকেল এক নিমেষেই তোমাকে খুঁজে বের করে ফেলবো।’

– ‘না, পারবেন না। আমি তাহলে আরো ভালো করে লুকোবো যাতে কেউ খুঁজে না পায়।’

বলেই বাচ্চা মেয়েটি ঝোঁপের আড়ালে গিয়ে কোথায় যেন লুকিয়ে পড়লো। সোহান খুব সুপরিকল্পিত ভাবে অপহরণকারীদের বিভ্রান্ত করে ভুল পথে পাঠিয়ে দিলো।

অপ্সরা বেশ অনেকক্ষণ ধরেই এক জায়গায় বসে আছে। হঠাৎ কারো গলা শোনে ভয় পেয়ে গেলো।

– ‘ধাপ্পা! এবার যাবে কোথায়?’

বাচ্চা মেয়েটি কাঁদার স্বরে বললো,

– ‘আমাকে ধরে ফেললো! ধুর হেরে গেলাম।’

অপ্সরা কাঁদতে শুরু করলে সোহান তার কান্না থামানোর জন্য তাকে কিছু চকলেট দিলো। ভ্রমণকালীন চকলেটগুলো কখন কিনেছিল ঠিক খেয়াল নেই। তবে ভালোই হলো! কাজে লেগে গেলো। অপ্সরা হাত বাড়িয়ে সোহানকে বললো,

– ‘আমার বন্ধু হবেন?’

সোহান বললো,

– ‘কিন্তু আমি তো আপনার নাম-ই জানিনা মিস.।’

– ‘আমার নাম অপ্সরা। এবার বন্ধু হবেন?’

অপ্সরা নামটি শোনার পর সোহানের মনে সন্দেহ জাগে। তবুও তা প্রকাশ না করেই বললো।

– ‘হওয়া যায়। কিন্তু বন্ধুরা তো একে অপরকে আপনি বলে না।’

– ‘আন্টি বলেছে, অপরিচিতদের আপনি বলতে হয়।’

– ‘বাহ্! আপনার আন্টি তো অনেক ভালো ভালো কথা বলে। তবে, যেহেতু আমি তোমার নাম জানি, তাহলে তো আমরা পরিচিতই হলাম!’

– ‘তাও অবশ্য ঠিক।’

– ‘আচ্ছা, তুমি আমাকেই কেন তোমার বন্ধু করতে চাইলে?’

– ‘কারণ আমার তেমন কোন বন্ধু নেই। আন্টি কারো সাথেই মিশতে দেয় না। সবাইকেই শুধু এনিমি এনিমি বলে।’

– ‘এটা তো খুবই পঁচা কথা। তোমার আন্টিকে আমি ইচ্ছেমতো বকে দেবো।’

– ‘না, আমার আন্টিকে একদম বকবে না আংকেল। আমার আন্টি খুব ভালো। রাগ করলেও আমায় প্রচুর ভালোবাসে।’

– ‘আচ্ছা ঠিকাছে। তা তোমার আন্টি কোথায়? চলো তোমার আন্টির কাছে যাওয়া যাক। আর এই সুযোগে আমারো তোমার আন্টির সাথে দেখা হয়ে যাবে।’

– ‘অপ্সরা….!’

হঠাৎ পেছন থেকে কারো ডাক শুনে সোহান উঠে দাঁড়ায়। নিশ্চয়ই অপ্সরার আন্টি তাকে খুঁজতে এসেছে।হাসিমুখে ওদিকে ফিরে তার আন্টিকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই চর এসে পড়ে তার গালে। হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকাতেই দেখতে পায় সে আর কেউ নয় তারিন!

– ‘লজ্জা করলো না এমন একটা জঘন্য কাজ করতে? ছিহঃ এতটা নিচে নেমে গেছেন আপনি? তুমি আমার ঘৃণারও যোগ্য নও। ইন্সপেক্টর…! এরেস্ট হিম।’

– ‘আরেহ্…!’ (সোহান)

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here