আমি সেই চারুলতা পর্ব-১৫

0
1966

#আমি_সেই_চারুলতা
#Shuvra_Ahmed_Priya
#পর্বঃ১৫
_______________________

কেটে গেছে আরো ছয়টা মাস।
সেদিনের পর থেকে চারু প্রতিদিন গ্রামে একবার হলেও খোজ নিতো তবে সেটা বেশিদিন টিকলো না। পুকুর পাড়ে পা পিছলে পড়ে গিয়ে চারু বেশ জোরেসোরেই পায়ে এবং কোমড়ে ব্যাথা পায়। জামাল হোসেন কবিরাজ দেখানোর পর সে কিছু ঔষধ দেয় এবং পরিপূর্ণভাবে বিছানা থেকে উঠতে মানা করে দেয়। ডাক্তারের কাছে গেলে যেটা দেড় থেকে দুই মাসের মধ্যে ঠিক হয়ে যেতো কবিরাজের চিকিৎসায় সেটা ঠিক হতে পাঁচ মাস লেগে যায়। চারুর কাজকর্মে সাহায্য করার জন্য জামাল হোসেন কোথাও থেকে এক মহিলাকে এনেছে। সেই বাড়ির সকল কাজ করে থাকে। তবে চারু জানে, এই মহিলা শুধুই বাসায় কাজ করার একটা বাহানা মাত্র। চারু অসুস্থ বিধায় জামাল হোসেন নিজের জন্য এই মেয়েটাকে নিয়ে এসেছে। রাতের বেলা চারু ঘুমিয়ে পড়ার পরেই সে ওই মেয়েটার ঘরে চলে যায় আবার ভোর হওয়ার কিছুক্ষণ আগে ফিরে আসে। সে মনে করে চারু বোধহয় এসব কিছুই জানেনা কিন্তু ঘুমের ভান ধরে প্রতিটা ঘটনাই প্রত্যক্ষ করে চারু। অবশ্য চারুর যে কষ্ট হয় এমনটা নয়। জামাল হোসেনকে ভালোবাসলে নিশ্চয়ই কষ্ট হতো কিন্তু যেহেতু চারু তাকে ভালোবাসে না তাই খুব একটা কষ্ট হয়না। শুধুমাত্র কষ্ট হয় নিজের এই করুন পরিণতি দেখে। মনোরমা বেঁচে থাকলে আজ ওর জীবনটা এমন হতোনা। এইটাই বোধহয় ওর মা কে খুন করার শাস্তি যা চারু এখন পেয়ে চলেছে। একেরপর এক এমন ঘটনাগুলো চারুকে কিছুতেই দুর্বল করতে পারছেনা। চারু এইসব দেখে নিজেকে আরো শক্তভাবে গড়ে তুলছে। মাত্র ১৬ বছর বয়সেই কত কিছু দেখতে হচ্ছে তাকে। কে জানে আরো কত কি দেখতে হবে। চারু সুস্থ হয়েছে প্রায় একমাস। তাও সম্পূর্ণ সুস্থ হয়নি, বেশি হাটাচলা করতে পারেনা। ভারি কাজ করতে পারেনা। এরই মাঝে চারুর এস এস সি পরীক্ষা হয়েছে। বিন্দিয়া বলেছে এই ছয়মাসে হামিদ অসংখ্যবার এসেছে গ্রামে। কেউই তাকে কোনো সাহায্য করেনি কিন্তু একবার বিন্দিয়ার সাথে আংশিক কথা হয়েছিলো পরে সেখানে নাজিমুদ্দিনের কারণে ঝামেলা লেগে যায়। বিন্দিয়ার কথার সারমর্ম এইরূপ যে,
বাবা গ্রামের বাইরে থাকায় বিন্দিয়া আর ওর মা সেদিন বাজারে গিয়েছিলো। হঠাৎই তার মা দেখলো সে কোনো একটি দোকানে মাংসের ব্যাগটা ফেলে রেখে এসেছে তাই বিন্দিয়াকে রেখে সে ব্যাগটা আনতে গেলো। বিন্দিয়া প্রায় পনেরো মিনিটের মতো দাঁড়িয়ে ছিলো এমন সময়ই বিন্দিয়া দূর থেকে দেখলো হামিদকে। সে হাত বাড়িয়ে হামিদকে ডাকছিলো। হামিদ বিন্দিয়াকে চিনতো না। সে ভেবেছিলো এমনিই বুঝি কেউ ডাকছে তাই সে ধীরে সুস্থে এগিয়ে এলো বিন্দিয়ার দিকে।
– আপনি কি আমারে ডাকছিলেন?
– হ্যাঁ ভাইয়া। আমি বিন্দিয়া, চারুর বান্ধবী। আমি জানি চারু কই।
হামিদ একপ্রকার উত্তেজিত হয়ে হয়ে জিজ্ঞেস করলো কোথায় সে। বিন্দিয়া কিছু বলতেই যাবে তার আগেই সে তার মা কে আসতে দেখলো। বিন্দিয়া জানে ও আর কিছু বলতে পারবেনা তাই দ্রুত বললো,
– চারুর বিয়া পাশের গ্রামের জামাল হোসেনের সাথে হইছে। বাড়ির ঠিকানা,,,
বাড়ির ঠিকানা আর বিন্দিয়ার বলা হলো না। এর আগেই বিন্দিয়ার মা চলে এসেই বিন্দিয়াকে থামিয়ে দিলো।
– চাচি, চাচি আপনে দয়া করে আমাকে সাহায্য করেন। বিশ্বাস করেন চারু খুবই কষ্টে আছে। আমারে ওর ঠিকানাটা দিয়া দেন চাচি।
– দেহো বাবা, আমি তোমাগো ছোট থেইকাই চিনি। আমি এইটাও বুঝছি তুমি তোমার বইনেরে অনেক ভালোবাসো। কিন্তু তার তো এহন বিয়া হইয়া গেছে। বিয়ার পরে জামাইয়ের ঘরই মাইয়াগো আসল ঘর বাপ। তুমি ওরে সংসারটা করতে দাও। শুধু শুধু বইনের ঘরটা ভাইঙ্গা দিও না।
– চাচি চারুর বয়স এহন ১৬। এই বয়সে চল্লিশের উপর একটা লোকের সাথে ও ক্যামনে সংসার করবো? আমি তো ওর ভালাই চাই চাচি। আমারে ওর ঠিকানাটা জানতে দেন চাচি।
– ভাগ্যের লিখন কেউ বদলাইতে পারেনা বাপ। উপর থেইকা সবার জুড়ি ঠিক হইয়াই থাকে। ওইটা তো আর বদলান যায় না। চারু সুখেই আছে। ও যহন আসছিলো তখন ওরে দেখছিলাম কি হাসিখুশি মাইয়া।
– আচ্ছা চাচি আপনে আমারে ঠিকানাটা দেন। আমি যদি দেহি চারু সুখে আছো তাইলে ওরে আনমু না। আপনি দয়া কইরা ঠিকানা টা দেন।
– দিমুই তো। তোমার বইন তুমি দেখবা না? কয়েকটা দিন যাউক। তুমি একটু শান্ত হও। শান্ত মাথায় চিন্তাভাবনা করো তাহলেই দিমু।
– চাচি আপনে বুঝতাছেন না। চারু সত্যিই ভালো নাই। ওর জন্মদাতা বাপ আর শেফালী কোনোদিন ওরে ভালো জায়গায় বিয়া দিবো না। যার নিজের এত জঘন্য রূচি তারা ক্যামনে চারুর ভালা বিয়া দিবো? তাদের সম্পর্কে জানলে আপনে তাদের মুখে থুতু ছিটাইতে চাইবেন। তারা সম্পর্কে,,,
হামিদের কথার মাঝখানেই আগমন ঘটলো নাজিমুদ্দিনের। বিন্দিয়ার মায়ের সামনে সে যথাসম্ভব হামিদের সাথে ভালো আচরণ করার চেষ্টা করছে তাকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে কিন্তু হামিদ নিজের অবস্থানে অনড়। সে আর ওই বাড়িতে ফিরে যাবেনা। চারুকে নিয়ে সারাজীবনের মতো এখান থেকে দূরে চলে যাবে সে। একপর্যায়ে সহ্য না করতে পেরে বলেই ফেললো সে,
– আপনের মতো জঘন্য বাপ থাকার চেয়ে মইরা যাওয়া ভালো। একটুও কষ্ট হয়না আপনের চারুর জন্য? ও তো আপনেরই মাইয়া। আপনের ঔরসজাত সন্তান। আপনে ক্যামনে ওর সাথে এমনটা করতে পারলেন? লজ্জা করলো না নিজের মাইয়ারে এমন একটা লোকের লগে বিয়া দিতে? আপনেরে কা’ইটা টুকরা টুকরা কইরা ফালাইলেও আমার শান্তি হইবো না।
হামিদের উচ্চস্বরে কথাটা শুনে তিনজনই হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। নাজিমুদ্দিন নিজেও অবাক দৃষ্টিতে তাকালেন হামিদের দিকে। চারুর সাথে এত ভালোবাসা তো তার কোনোকালেই ছিলোনা। সবসময় ঝগড়াই হতো তাহলে এত ভালোবাসা হঠাৎ কোথা থেকে এলো? নাকি আগেই ছিলো কিন্তু সুপ্ত অবস্থায়। হামিদ আর সহ্য করতে না পেরে হাটু গেরে মাটিতে বসে পড়লো। দুহাত জোর করে নাজিমুদ্দিনের কাছে বললো,
– আপনে দয়া কইরা চারুর ঠিকানাটা আমারে দেন। বিশ্বাস করেন চারুরে নিয়া আমি অনেক দূরে চইলা যামু। আর কখনো আপনেগো সামনে আইসা দাঁড়ামু না। আপনাগো কষ্ট দিমু না। শুধুমাত্র আমারে চারুর ঠিকানাটা দিয়া দেন।
নাজিমুদ্দিন অবাকের পর অবাক হচ্ছে। একটু আগেই হামিদ যেখানে চিৎকার করছিলো এখন সে অসহায় একজন মানুষের মতো হাতজোড় করে ভিক্ষা চাইছে। নিজের আদরের ছেলে আজ বড়ই অপরিচিত মনে হচ্ছে তার কাছে। নাজিমুদ্দিনের উত্তর না পেয়ে আবারো গর্জে উঠলো হামিদ,
– আপনে কি মনে করছেন, চারুর ঠিকানা না দিলে আমি ওরে খুজতে পারমুনা? আকাশ পাতাল সব এক কইরা হইলেও আমি ওরে খুজবো। পৃথিবীটা গোল, একটা সময় না একটা সময় ঠিকই আমাদের দেখা হইবো। সেইদিন আমি আপনাদের কি অবস্থা করবো আপনেরা কল্পনাও করতে পারবেন না।
বজ্রকঠিন শব্দে হামিদ কথাটা বলেই সেখান থেকে প্রস্থান করলো। হঠাৎই বিন্দিয়ার মনে হলো হামিদকে সে পাশের গ্রাম বলছে কিন্তু গ্রামের নাম বলেনি। গ্রামের চারিপাশে আরো চারটা গ্রাম আছে। কে জানে হামিদ এবার কোন গ্রামে চারুকে খুজবে। নিজের বোকামির কথা ভেবে নিজেকেই দুটো থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে হলো বিন্দিয়ার।

চারুর এস এস সি পরীক্ষা শেষ হয়েছে কিছুদিন আগেই। জামাল হোসেন এর মাঝে আর কোনো ঝামেলা করেনি। চারু সুস্থ হয়ে উঠতেই জামাল হোসেন কাজের মেয়েটিকে এখন ছাড়াতে চাইছে। চারু কোনো প্রতিউত্তর করলোনা। মেয়েটিকে এখন দরকারই বা কি? তার প্রয়োজনও বোধহয় ফুরিয়ে এসেছে। কিছুদিন পরে আবার নতুন কাউকে ভালো লাগবে। অস্বাভাবিক নয়। কাজের মেয়েটিকে ছাড়ানোর কিছুদিন পরেই জামাল হোসেন একদিন চারুর পাশে এসে বসলো। চারুর কোনো ভাবান্তর হলোনা তবে জামাল হোসেনকে দেখে মনে হচ্ছে সে চারুকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলতে চায়। অবশ্য এখন গুরুত্বপূর্ণ কথা ছাড়া আর কোনো কথা হয়না তাদের মাঝে।
– চারু শুনো। তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।
– বলে ফেলুন।
– তুমি তো সবুজরে চিনোই। আমার বন্ধু কম ভাই বেশি।
– ভূমিকা না করে মূল কথাটা বলুন।
– এত সবুর কম ক্যান তোমার? ধীরে সুস্থে শুনো। আর কথা শুইনা চিল্লাইবা না। আস্তেধীরে কথা কইবা আর মনে রাখবা আমি তোমার স্বামী আমার সব কথা তুমি মাইনা চলবা। আমি যা কমু সব।
– কি বলবেন বললেই হয়। এত ভনিতা কেনো করছেন?
– তুমি তো জানো সবুজের বউ মরলো বছর দুয়েক হইছে।
– আমি বুঝতে পারছিনা আপনি এত ভনিতা করছেন কেনো? সরাসরি বলুন।
– আচ্ছা শুনো। সবুজের বউ মরলো দুই বছর হইছে। বেচারা সারাক্ষণই একলা থাকে। সময় কাটানোর জন্য ওর একটা মানুষ দরকার। আমাগো সাথে আইসা থাকে কিন্তু তুমি হেইডা পছন্দ করোনা। আমি কই কি তুমি ওরে মানা কইরো না। ও আসলে ভালো কইরা ওর আদর যত্ন কইরো।
– পারবোনা। তাকে বিয়ে করিয়ে দিন।
– পারবা না ক্যান? পারতে হইবোই। আর বিয়া কইরা এত খরচের কোনো দরকার আছে? তুমি তো আছোই। আমার বউ মানে সবুজের বউ। সমস্যা কই? যেমনে রাতে আমার শয্যাসঙ্গী হও তেমনে সবুজেরও হইবা। অসুবিধা কি? সবুজ তো আর বাইরের কেউ না কিংবা পরপুরুষও না। ও হইলো আমার অংশ তাই আমার শয্যাসঙ্গী হওয়া যা সবুজের শয্যাসঙ্গী হওয়াও তা।
চারু কয়েক মূহুর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলো। জামাল হোসেনের কথা তার কানে ঢুকছেনা। এইটা কি বললো সে? এইসব নোংরা কথাবার্তার মানে কি? কথাটা কর্ণকুহর অবধি পৌছাতেই চারুর শরীরের প্রতিটা রক্তকণা অবধি গর্জে উঠলো।
– পাগল হয়ে গেছেন আপনি? লজ্জা করছেনা নিজের স্ত্রীকে এমন কুপ্রস্তাব দিতে?
– লজ্জা লাগবো ক্যান? তোমার আম্মায় তো এই শর্তেই আমার কাছ থেইকা এক লাখ টাকার বিনিময়ে তোমারে আমার কাছে বিক্রি করছে। কথা ছিলো বিয়ার কয়দিন পর থেইকা তুমি নামেমাত্র আমার বউ থাকবা কিন্তু তোমার আমার আর সবুজের দুইজনের বউ হইয়াই থাকতে হইবো। আমি নেহাৎ ভালা মানুষ দেইখা তোমারে এক বছর সময় দিছি। লেখাপড়া করাইছি।
প্রচন্ড রাগে চারু হাতের পাশে থাকা স্টিলের একটি গ্লাস ছুড়ে মারলো জামাল হোসেনের দিলে। গ্লাসটি সরাসরি তার কপাল বরাবর লাগলো। এতে জামাল হোসেন চটে গিয়ে নিজের আসল রূপে ফিরতে লাগলো যা এতদিন লুকায়িত ছিলো চারু হতে। চারুর চুলের মুঠি ধরে গালে থাপ্পড় দিলো জামাল হোসেন,
– এত ত্যাজ ক্যান তোর? তুই আমারে মারতে চাস? এত সাহস কে দিছে তোরে?
চারু এত সহজে ছেড়ে দিতে নারাজ তাকে। এহেন নোংরা নরকের কীটগুলোকে শেষ করে দেওয়া উচিত। খোলা দুহাত দিয়ে এলোপাতাড়ি মেরে চলেছে কিন্তু চারুর কিশোরী দুহাত জামাল হোসেন নামক নরপিশাচ টির সাথে পেরে উঠে না। এরই মাঝে ঘরে প্রবেশ করলো সবুজ আলী। তাকে দেখেই ঠোঁটের কোণে ভয়ানক এক হাসির উদ্রেক ঘটলো জামাল হোসেনের।
– তোর যা করার তুই কর। আমি ধইরা রাখছি ওরে।
জামাল হোসেনের কথা শুনে চারু অবাক নেত্রে তাকালো তার দিকে। কতটা নোংরা মানসিকতা সম্পন্ন মানুষ হলে এভাবে নিজের স্ত্রীকে অন্য কারোর ভোগের পাত্রী হিসাবে নিজের হাতে তুলে দেয়?

★★★

চারু থেমে গেলো। তিন জোড়া আঁখি অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার দিকে। তাদের প্রত্যেকেরই মনে হয়েছিলো জামাল হোসেনের অনুপুস্থিতে সবুজ আলী বোধহয় সেটার সুযোগ নিয়েছিলো। কিন্তু এভাবে স্বামীর সামনে চারুকে ধর্ষণ করা হয়েছিলো এ কথা কল্পনাতেও কেউ আনতে পারেনি তাও আবার তার স্বামীর সম্মতিতে। এতক্ষণ যাবত সকল ঘটনা চারু কঠিন হয়েই বলছিলো। তার মুখে অনুভূতির লেশমাত্র ছিলোনা। মায়ের মৃত্যুর কথা বলার সময়েও তার চোখে জল আসেনি কিন্তু এখন তার আঁখিদ্বয় জলে পরিপূর্ণ।

– সহজ সরল নিরীহ চারুলতার মৃত্যু ঘটেছিলো সেদিন। আজ আপনারা যেই চারুলতাকে দেখছেন, সেই নৃশংস চারুলতার জন্ম হয়েছিলো সেদিন থেকে। সেদিন থেকেই ধীরে ধীরে এই চারুলতার জন্ম হয়েছে। তাদের কলিজা খেয়েও আমার শান্তি হয়। আচ্ছা আরো কত নৃসংসভাবে তাদের হত্যা করলে আমার শান্তি হতো বলতে পারেন? এভাবেই তাদের কাছে আমি সম্পূর্ণ বন্দি থাকি ছয়টা মাস। বাড়ি থেকে বের অবধি হতে পারতাম না। আমার ভাই চলে যাওয়ার দেড় বছর হয়ে গিয়েছিলো এবং সে ফিরে আসার এক বছর হয়ে গিয়েছিলো কিন্তু তাও তার সাক্ষাৎ মেলেনি। আমি তো এটাও জানতাম না একটা বছর হয়ে যাওয়ার পরেও সে এখনো আমাকে খুজছে কি না। খোজার কি কথা?
– আপনার মৃত্যু ঘটেছিলো এই কারণ নাহয় বুঝলাম তবে হামিদের মৃত্যুর কথা বলেছিলেন কেনো?
– মিথ্যা তো বলিনি। তার তো জন্মই তো হয়নি। অবশ্য মৃত্যুও হয়নি।
– বুঝিনি আপনার কথা।
চারু উত্তর না দিয়ে নিশ্চুপ হয়ে গেলো। কি এক নিদারুণ অস্বস্তি ভীর করেছে তার ভিতর। সে মূহুর্তে ও জানতোও না ওর জীবনের নিয়ন্ত্রক জামাল হোসেন নয়। সবুজ আলীও এমন করার সুযোগ পেতো না যদি না সেই অজ্ঞাত ব্যক্তি সেই অনুমতি দিতো। এইসব কিছুর পেছনে লুকিয়ে থাকা কে সেই অজ্ঞাত ঘাতক? তাকে খুন না করা অবধি চারুর হত্যা তৃষ্ণা মিটবে না।

চার দেওয়ালের মাঝে বন্দিনী অবস্থায় থাকতে হয়েছে চারুকে অর্ধবছর। কিন্তু এই লম্বা সময়ে হাজার অত্যাচার সহ্য করার পরেও চারু নত স্বীকার করেনি। মেনে নেয়নি তাদের অন্যায়। প্রতিটি মূহুর্তে যতটা সম্ভব প্রতিবাদী হয়েছে সে। এত কঠিন মনোবল দেখে মাঝেমাঝে টলে গিয়েছিলো জামাল হোসেন। এরপর বেশ কয়েকদিন তারা চারুর কাছে আসতো না। খাবার, পানি কিছুই দিতো না। নিজেকে সামলে আবার নতুন দমে অত্যাচার শুরু করতো চারুর উপর। তারপরেও দমে যেতো না। কিন্তু চারু একদিন সক্ষম হয়েছিলো সেখান থেকে পালাতে।
সেদিন জামাল হোসেন ও সবুজ আলী দুজনেই মদের বোতল নিয়ে ঘরে ঢুকেছিলো। তারা জানতো চারুর এ গন্ধ সহ্য হয়না তাই চারুর সামনে বসেই পুরো বোতল শেষ করেছিলো। সেদিন চারুর পা বাধা হয়নি। শুধুমাত্র দুই হাত বেধে রাখা ছিলো। এতদিনে দড়ি খোলার কিছু কৌশল রপ্ত করতে পেরেছিলো চারু। সেই বিদ্যা কাজে লাগিয়েই সে তার হাতের দড়ি আলগা করে নেয়। মাতাল দুই কাপুরষ সেটা লক্ষ্যও করেনি। জামাল হোসেন কাছাকাছি আসতেই সুযোগ বুঝে চারু খুব জোরে তার অন্ডকোষ বরাবর লাথি মারলো। জামাল হোসেন ব্যথায় চিৎকার করে উঠলো কিন্তু মাতাল বিধায় তেমন সুবিধা করতে পারলো না। চারু ততক্ষণে নিজের হাতের বাধন সম্পূর্ণ খুলে ফেলেছিলো। সবুজ আলী এগিয়ে আসতেই চারু মদের বোতলটা দিয়ে সর্বশক্তি নিয়ে সবুজ আলীর মাথায় আঘাত করে। ফলাফল সেও লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। চারু সুযোগটা ছাড়েনা। কোনোরকমে গায়ে ওড়না জড়িয়ে ছুটে চলে রাস্তা ধরে। কিন্তু কোথায় যাবে সে। যাওয়ার কোনো জায়গা নেই তার। সে ছুটে চলে পুলিশ স্টেশনের দিকে। এই সময় এভাবে চারুকে দেখে পুলিশ অফিসার বেশ অবাক হয়।
– আপনি? কে আপনি? আর আপনার এ অবস্থা কেনো?
– আমাকে বাঁচান। দয়া করে আমাকে বাচান।
– আপনি বসুন। আগে পানি পান করুন তারপর সম্পূর্ণ ঘটনা খুলে বলুন।
এতটা রাস্তা দৌড়ে আসায় চারু খুব বেশি ক্লান্ত ছিলো তাই সে এক ঢোকে সম্পূর্ণ গ্লাস পানিই পান করলো। তারপর নিজের বিয়ে থেকে শুরু করে সমস্ত ঘটনাই খুলে বললো।
– লোকটার সাথে আপনার বিয়ে হয়েছিলো?
– হ্যাঁ।
– স্ট্রেঞ্জ। নিজের স্ত্রীর সাথে কেউ এমনটা কিভাবে করতে পারে? আপনি চিন্তা করবেন না আপনাকে সুরক্ষা দেবে পুলিশ। আপনি গিয়ে ওয়েটিং রুমে বসুন তারপর আপনাকে নিয়ে গিয়েই তাদের এরেস্ট করবো।
চারু তার কথা বিশ্বাস করে উঠে দাঁড়ায়। শার্টের নেইম প্লটে পুলিশটির নাম লেখা ছিলো হোসেন। নামটা দেখেই ওয়েটিং রুমের দিকে পা বাড়ায় সে। এনার নামে অনেক কিছুই শুনেছে চারু। উনিই নাকি এই গ্রামের সবচেয়ে সৎ পুলিশ অফিসার। তবে ওনাকে বিশ্বাস করে ওয়েটিং রুমে বসে থাকাই ছিলো চারুর জীবনে সর্বোচ্চ দ্বিতীয় ভুল।
প্রায় কয়েকঘন্টা যাবত ওয়েটিং রুমে বসে থেকে চারু ভাবলো এইবার জামাল হোসেনকে ধরতে যাওয়া উচিত নইলে সে পালিয়ে যেতে পারে তাই সে যখন পুলিশ অফিসার হোসেনকে কথাটা বলতেই যাবে তখনই স্তব্ধ হয়ে যায় সে। জামাল হোসেন বসে আছে পুলিশ অফিসার হোসেনের মুখোমুখি। তারা দুজন নিজেদের মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা নিয়ে আলোচনা করছে বিধায় চারু এখনো তাদের দৃষ্টিগোচর হয়নি।
– চারু এহন কই আছে?
– তাকে ওয়েটিং রুমে বসিয়ে রেখেছি। আপনার কি কান্ড জ্ঞান বলে কিছু নেই? মেয়েটা যদি আমার কাছে না এসে অন্য কোথাও চলে আসতো তখন? তখন কি করতেন? বস আপনাকে জীবন্ত কবর দিতো। আমাদের এতদিনের পরিশ্রম এই মেয়ে।
– আমি বুঝি নাই এই মাইয়া এমন কিছু করবো। এর তেজ অনেক বেশি। এহোনো পোষ মানে নাই কিন্তু এমনে পালায়া আসতে পারবো ওইটা ভাবি নাই।
– আপনারা মদ খেয়ে টলবেন আর সুযোগ পেয়ে কি এই মেয়ে বসে থাকবে?
– এইটাই ভুল হইয়া গেছে তবে আমার মনে হয় বসের কাছে যাওয়ার পরেও মাইয়া পালায়া যাইবো।
– যাক গে। তাতে আমাদের কি? আমাদের কাজ সহীহ সালামত মেয়েটাকে বসের কাছে পৌছায়া দেওয়া। তারপর পালালো নাকি পালালো না সেইটা আমাদের দেখার কথা না।
– এইটা একখান কাজের কথা কইছেন।
– মাইয়া তো দেখতে ভালোই সুন্দরী। কাচা হলুদের মতো গায়ের রঙ। একটু দেবেন নাকি? টেস্ট করে দেখি। যতই হোক ও এখন আপনার বউ বলে কথা।
– আমার বউ হইলে কি করবো? বসের অর্ডার ছাড়া কিচ্ছু হইবো না। টানা একবছর বসের খেদমত কইরা সবুজ এই সুযোগ পাইছে। বস আপনেরে এমন সুযোগ দেয় নাই।
– আরে জামাল ভাই, বস জানবে না।
– জানলে টুকরা টুকরা কইরা ফালাইবো। স্যারের কথা ছাড়া আমরা বাতরুমেও যাইতে পারিনা।
– আরে আমিও তো এতবছর ধরেই বসের সেবা করছি। তার সব কথা মানি। গ্রামে আমি এখন সৎ পুলিশ অফিসার নামে পরিচিত। সবাই আমাকে চেনে আমাকে সম্মান করে। এইটাতে তো বসেরই সুবিধা হয়। সকল কালো টাকা আমার হিসেবে যায় স্যারের কাছে। কেউ সন্দেহও করেনা কারণ আমি তো একজন সৎ পুলিশ অফিসার।
কথাটা বলেই উচ্চস্বরে হেসে উঠলো পুলিশ অফিসার হোসেন যেনো সে খুব বড় একটা জোক বলে ফেলেছে। চারু বেশ ভালোই অনুমান করতে পারছে কত বড় বিপদের মধ্যে রয়েছে সে। চারু ছুটে বেড়িয়ে আসতে চাইলো থানা থেকে কিন্তু ভাগ্য এভারেও তার সহায় হলো না। পালানোর আগেই একজন তাকে দেখে নিলো। এবং বন্দি করে তাকে জামাল হোসেন ও হোসেনের সামনে আনা হলো। পুলিশ অফিসার হোসেনের মুখে দেখা গেলো তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসি,
– ওহ, তো তুমি তাহলে সব জেনেই গেছো? সমস্যা নেই বসকেই ফোন করছি দেখি বস তোমার জন্য কি ব্যবস্থা নেয়।

বিঃদ্রঃ সাধারণত রাইটিং ব্লক ছুটতে আমার চার-পাঁচদিন লাগে কিন্তু এবার প্রায় একসপ্তাহ পার হয়ে যাওয়ার পরেও রাইটিং ব্লক থেকে বের হতে পারছিনা। কিভাবে যে লিখছি আল্লাহই ভালো জানেন। আর কাহিনি গুলো খুব দ্রুত এগোচ্ছে সেটা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন। আরো ৫-৭ টা পর্ব পরেই প্রথম পরিচ্ছেদের সমাপ্তি টানবো। ২য় পরিচ্ছেদে আনতে খুব বেশি সময়ও নেবো না। রিচেক করা হয়নি। হ্যাপি রিডিং।

#স্নেহা_ইসলাম_প্রিয়া

(কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ)

To Be Continued….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here