#আমি_সেই_চারুলতা
#Shuvra_Ahmed_Priya
#পর্বঃ২৪ (প্রথম পরিচ্ছেদের সমাপ্তি)
_______________________
– তার মানে আপনার সকল খু*নের সঙ্গী হামিদ ছিলো?
– হুম।
– আর কেউ ছিলো কি?
চারু উত্তর দেয়না। চারুর এরূপ নিরুত্তর থাকাটা ভীষণ বিরক্ত লাগছে সাজিদের কাছে। সবসময় লাগে। তবে হিমেলের মুখে দেখা যাচ্ছে অসন্তোষ। সে আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই ফেললো,
– শিহাব সত্যিই তোমার ভাই?
চারু এবারেও উত্তর দেয়না। ও নিজেই জানেনা এর উত্তর কি দেওয়া যেতে পারে। শিহাব যেমন ওর ভাই না তেমনি ভাইও। কি অদ্ভুত এক গোলকধাঁধায় বারবার ফেসে যাচ্ছে সে। সেই মূহুর্তে ঘরে প্রবেশ করলো সীমা। সে এসেই বলতে শুরু করলো,
– চারুলতা তোমার কেইসটা কালকেই কোর্টে উঠবে। এতগুলো খু*নের শা*স্তি কি হবে সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো? প্রস্তুত থেকো।
– আর আমার সাথে যারা এই জঘন্য আচরণ করলো তাদের কি কোনো শা*স্তি হবেনা?
– তুমি তো নিজের হাতেই তাদের শা*স্তি দিয়েছো।
– তাহলে আমি কেনো শা*স্তি পাবো? পাপীদের শা*স্তি দেওয়ার কারণে যদি আমার মৃ*ত্যুদণ্ড হয় তবে কি আমাকে মৃ*ত্যুদণ্ড দেওয়ায় জজ সাহেবকেও কেউ মৃ*ত্যুদণ্ড দেবে?
– বাজে কথা বলো না। তুমি শা*স্তি দেওয়ার কে? তুমি তাদের আইনের হাতে তুলে দিতে পারতে।
– পুলিশের কাছে তো আমি গিয়েছিলাম। কি প্রতিদান পেয়েছি আমি? পুলিশ নিজেই জড়িত ছিলো এইসব অপরাধের সাথে।
– চারুলতা! একজন অন ডিউটি পুলিশ অফিসারের সাথে আপনি এভাবে কথা বলতে পারেন না। আপনি অপরাধ করেছেন যখন শা*স্তি আপনাকে পেতেই হবে।(সাজিদ)
– তাকে না মা*রলে আমার শান্তি হবেনা। আমাকে তাকে খোজার একটা সুযোগ করে দিন। তারপর আপনারা আমাকে যেই শা*স্তি দেবেন আমি সেটা মেনে নেবো। এমনকি মৃ*ত্যুদণ্ডও।
– কে সে? বস?
চারু উত্তর দিতে পারছেনা। তার বারবার মনে হচ্ছে সে নিজের প্রতিশোধ সম্পূর্ণ করতে পারবেনা। হিমেল আর সীমা তার উপর দয়া করলেও সাজিদের মাঝে এখনো তেমন কোনো লক্ষ্মণ দেখা যাচ্ছেনা। তবে কি সাজিদের জন্যই আটকে যাবে সে? হাজারো মেয়ের জীবন ধ্বংসকারী এমনি এমনি বেঁচে যাবে? চারুলতার মতো আরো হাজারো চারুলতা জন্ম নেবে?
– আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করছি আপনি আমাকে তাকে খুজতে সাহায্য করুন। তাকে শা*স্তি দিতে দিন। তারপর আমাকে মে*রে ফেললেও আমার কোনো আফসোস থাকবেনা।
– সেটা সম্পূর্ণ আইনের হাতে ছেড়ে দিন। আমরা শাস্তি দেবো তাকে।
– তাকে আমি নিজের হাতে খু*ন করতে চাই।
– একজন পুলিশ অফিসার হয়ে আমি আপনাকে এইটা করতে দিতে পারিনা চারুলতা।
– দয়া করুন আমার উপর।
– হামিদ এখন কোথায়?
– কেনো?
– যেই অপরাধ আপনি করেছেন সেই অপরাধে সেও সমান অপরাধী। শা*স্তি হলে দুজনেরই হবে।
চারু চমকে উঠে সাজিদের দিকে তাকালো। তার চোখদুটো টলমল করে উঠলো জলে। সত্যিই কান্নারত অবস্থাতেই মেয়েদের আসল সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। চারু ধরা গলায় বললো,
– আমি বলবো না। সব দোষ, সব পাপ, সবই আমার। আমার ভাইকে এর মধ্যে টানবেন না। তাকে সুন্দর একটা জীবন পেতে দিন।
– অপরাধ সেও করেছে।
– এই পৃথিবীতে আমার ভাই ছাড়া আমার কেউ নেই। আমার জীবন শেষ হয়ে গেলেও আমি তাকে আপনাদের হাতে তুলে দেবোনা। আমি মারা গেলো কারোর কিছু যাবে আসবেনা। আমার ভাই হয়তো একটু কষ্ট পাবে। কিন্তু আমার ভাইয়ের সাথে আরো দুটো জীবন জড়ানো রয়েছে। তার মেয়ে আর তার স্ত্রী দুজনের জীবনেই সে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তার অনুপুস্থিতে সে দুটো জীবনও সম্পূর্ণ শেষ হয়ে যাবে। আমি সেটা কখনোই হতে দেবো না।
– আপনার ভাইয়ের মেয়ের কথা না হয় মানলাম কিন্তু তার স্ত্রীর ব্যাপারে কেনো ভাবছেন আপনি? সে তো পছন্দ করেনা আপনাকে।
– আমার ভাইকে তো নিজের জীবন দিয়ে ভালোবাসে। আমিও ভালোবাসি। এদিক থেকে আমরা সম্পূর্ণ অভিন্ন। যে আমার ভাইকে ভালোবাসে আমি কখনোই তার খারাপ চাইনা। আমার ভাইকে দয়া করে এসবের মাঝে টানবেন না।
– নাজিমুদ্দিনকে কিভাবে খু*ন করলেন?
– আগে বলুন এসবের মাঝে আপনি আমার ভাইকে টানবেন না।
– এমনটা হবেনা। সে দোষ করেছে সে শা*স্তি পাবে।
– আমি বলবো না আমার ভাই কোথায়। নাজিমুদ্দিনকে কিভাবে খু*ন করেছি সেটাও বলবোনা। যতক্ষণ না অবধি আপনি আমাকে কথা দেবেন আমি কিচ্ছু বলবো না।
– কোন ভাইয়ের জন্য এত ত্যাগ স্বীকার করছেন? এতই যদি সে আপনার ভালো চাইতো তাহলে থানায় এসে আপনাকে আত্মসমর্পণের বুদ্ধি সে দিতো না।
– সে কোনো বুদ্ধি দেয়নি আমাকে। আমি নিজেই এসেছিলাম।
– আটকায়নি কেনো?
– তারও হাত বাধা ছিলো।
– সম্পূর্ণই অযুহাত।
– হলে হোক। আমার ভাইকে আমি কোনো শা*স্তি পেতে দেবো না।
★
এইটাই ছিলো শেষ বার চারুর সাথে সাজিদের কথোপকথন। এর পর চারু আর একটা কথাও বলেনি। সাজিদ অনেক চেষ্টা করেও তার মুখ থেকে কিচ্ছু বের করতে পারেনি। যতক্ষণ না পর্যন্ত তাকে কথা দেওয়া হবে হামিদকে এই কেসে টানা হবেনা ততক্ষণ অবধি সে কিছুই বলবেনা। রাত অনেক হয়েছে, কালই চারুকে কোর্টে নেওয়া হবে। এর মধ্যে সব ঘটনাই জানা প্রয়োজন। অতঃপর সাজিদ সিদ্ধান্ত নিলো চারুর দেওয়া শর্তই সে মেনে নেবে। হামিদের নাম কোথাও সে আনবেনা। এই শর্তেই চারুকে পরবর্তী ঘটনা বলতে বললো সে,
★
নাজিমুদ্দিনের শহর থেকে ফিরে আসার পরে আর দেরি করেনি তারা। মাঝে ঘটেছে আরো এক ঘটনা। হামিদের সম্পূর্ণ নিষেধ হয়ে গেছে চারুর সাথে দেখা করার কিন্তু ছেলেরা নিজে যদি ঠিক থাকে তবে তাদের আটকানোর সাধ্য কারোর নেই তাই হামিদকেও শতভাগ আটকানো গেলোনা। কোনোমতে সুযোগ নিয়েই বেড়িয়ে পড়তো সে চারুর সাথে দেখা করতে। এরই মাঝে নাজিমুদ্দিনকে খু*ন করার জন্য হাতে সম্পূর্ণ এক রাত থাকা প্রয়োজন ছিলো, যা হামিদের ছিলোনা কিন্তু হামিদও হার মানার ছেলে নয়। সে ঠিকই বের করে নিয়েছিলো নিজের সময়। সুযোগ বুঝে গ্রামে যায় হামিদ। একাই গিয়েছিলো। এইবার পরিকল্পনা ভিন্ন। এইবার ওরা নাজিমুদ্দিনের কাছে যাবেনা, নাজিমুদ্দিন ওদের কাছে আসবে। হামিদ গ্রামে গিয়ে নাজিমুদ্দিনের সাথে দেখা করে বাজারে। এমন একটা ভাব নিয়ে দেখা করে যেনো হঠাৎ দেখা হলো তার সাথে। সে প্রথমেই গিয়ে জড়িয়ে ধরলো নাজিমুদ্দিনকে। নাজিমুদ্দিন হামিদকে দেখে হতভম্ব হয়ে গেলো।
– ভালো আছেন বাপজান?
– হ ভালাই। তুই এইহানে?
– আপনের লগেই দেহা করতে আইছিলাম। কেমন আছেন আপনারা? মানে আপনে আর শেফালী আম্মা।
– শেফালী আর নাই।
– ক্যান কই গেছে?
– কিছুদিন আগেই কে জানি ওরে খারাপ ভাবে মা*ইরা ফালায়া গেছে।
– হায় আল্লাহ! কি কন এইগুলা? ক্যামনে হইলো?
– জানিনা। যে পুলিশে তদন্ত করতাছিলো তারও খু*ন হইছে।
– অবস্থা তো তাইলে খারাপ। আপনে এহন কেমন আছেন?
– আছি কোনোমতন।
– কোনো মতে আছি কইলে অয়? আপনে আমার লগে আইসা পড়েন। আপনের পোলা থাকতে আপনে কোনোমতন থাকবেন ক্যা?
– চারু তোর লগে?
হামিদ হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লো। এইবার সে জানে চারুর খোঁজ পাওয়ার জন্য হলেও নাজিমুদ্দিন ওর সাথে যেতে রাজি হবে। হলোও তাই।
– তুই চারুরে কই পাইলি?
– হাটতে হাটতে রাস্তায় দেখা হইয়া গেছিলো। তারপর ওরে আমি আমার লগে নিয়া যাই। তারপর থেইকা আর গ্রামে আসি নাই। কাল হঠাৎ আপনের কথা খুব মনে পড়তাছিলো তাই আইসা পড়লাম।
নাজিমুদ্দিন হামিদের সাথে চলে গেলো চারুর সন্ধানে। চারু এখন যেই বাড়িটাতে আছে সেখানে নিয়ে রাখলো হামিদ তাকে। চারু তখনও নাজিমুদ্দিনের সামনে আসেনি।
নাজিমুদ্দিন আসবে শুনে চারু খুবই যত্ন নিয়ে বিরিয়ানি রান্না করেছে। প্রথমেই ফ্রিজ থেকে শেফালীর মাংস বের করেছে। তারপর সেটাকে ভালো করে ধুয়ে টুক*রো টুক*রো করেলো। তারপর আধখাওয়া কলিজাটাকে হাতে তুলে নিলো। খুব যত্ন সহকারে সেটাকে আলাদা করে তুলে নিয়ে গরম তেলে মচমচে করে ভাজলো। তারপর ধীরে ধীরে এক এক মশলা দিয়ে বিরিয়ানি রান্না করলো। চারুর হাতের বিরিয়ানি নাজিমুদ্দিন খুবই পছন্দ করতো। যদিও কখনো সে বলেনি সেটা তবে ঘরে বিরিয়ানি রান্নার কথা হলেই নাজিমুদ্দিন চারুকে বিশেষ ভাবে রান্না করতে বলতো। আজও নাজিমুদ্দিনের জন্য চারুই রান্না করলো তবে এইটা তার প্রিয়তম স্ত্রীর মাংসের রান্না বিরিয়ানি যা তার জীবনের শেষ খাওয়া। খাওয়া শুরু করার আগে হামিদ এক বোতল ম*দ নিয়ে বসলো নাজিমুদ্দিনের সামনে। সে মানা করলোনা বরং হামিদ ম*দ খায় জেনে তার নিজের ছেলের উপর গর্ববোধ হতে লাগলো। হ্যাঁ তার ছেলে। হামিদই তো সত্যিকারের তার ছেলে।
– চারু কই? ওরে ডাক।
– ওরে আপনের জন্য বিরিয়ানি রান্না করতে পাঠাইছি। রান্না হইলেই আসবো।
– তো এহন আইসা একবার দেহা কইরা যাইবো না?
– রান্ধা শেষ কইরা আসুক।
হামিদ অনেক কথা বলতে বলতে এক গ্লাস দিয়েই অনেকটা সময় কাটিয়ে দিলো অপরদিকে নাজিমুদ্দিনের চার গ্লাস নেওয়া শেষ। কিছুটা মাতাল হলেও জ্ঞান তার ছিলো। পরিপূর্ণ মাতাল সে হয়নি। এমন সময়েই ঘরে প্রবেশ করলো চারু। তার হাতে বিরিয়ানির প্লেট আর উপর কলিজা ছড়ানো হয়েছে বিরিয়ানিটাকে সাজানোর উদ্দেশ্যে। তারই সাথে প্লেটে দুটো শসা, একটা মরিচ এবং এক টুকরো লেবু। আজও চারু সেজেছে লাল রঙে। আজ তো আবারও লাল রঙের মেলা বসবে। চারুকে দেখেই নাজিমুদ্দিন বললো,
– জামাইর বাসা থেইকা পালায়া আসছস ক্যান? তুই জানস জামাই তোরে কত খুজছে?
চারু উত্তর না দিয়ে বিরিয়ানিটা তার দিকে এগিয়ে দিলো।
– কি রে কথা কস না ক্যান?
– কই একবারও তো নিতে আসেনি।
– ও কি জানে তুই কই আছস?
– কোথায় আছে সে?
– সব শেষ হইয়া গেছে। এহন আর জাইনা কি করবি?
চারু কথা বাড়ালো না। সে জানে তার কি হয়েছে। নাজিমুদ্দিন বিরিয়ানি খেতে শুরু করলো। ম*দ খেলে সবকিছুতেই যেনো একটা বিশেষ বিশেষত্ব মিশে যায়। নাজিমুদ্দিনের সাথেও সেটাই হলো। গভীর আবেশের সাথে বিরিয়ানির স্বাদ নিচ্ছে সে। মানুষ হয়তো অমৃত খেলেও এত স্বাদ পায় না।
– কি রে হামিদ তুই খাবি না?
হামিদ চমকে উঠলো। এইসব কি বলছে নাজিমুদ্দিন? ওকে এই বিরিয়ানি খেতে বলছে?
– আপনে খান না। আমি পরে খামু।
– ক্যান? পরে ক্যান খাবি? এহনই খা। আমি খাওয়ায়া দিতাছি।
নাজিমুদ্দিন একপ্রকার জোর করেই বিরিয়ানিটা হামিদের মুখে ভরে দিলো কিন্তু হামিদ সেটা গিলতে পারলো। এই মাংসটা শেফালীর ভাবতেই কেমন গা গুলিয়ে এলো। বমি করে ঘর ভাসিয়ে দিলো সম্পূর্ণ ঘর। নাজিমুদ্দিন হতভম্ব হয়ে গেলো। চারু কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলো হামিদের দিকে।
– তুই বমি করলি ক্যান? কি আছে এই বিরিয়ানিতে?
– জাতে মাতাল তালে ঠিক।
– মানে?
– না কিছু না। এই বিরিয়ানি আমারে খাওয়ায়া আপনে ভালা করলেন না। এইটা বিশেষ ভাবে আপনের লাইগা রান্ধা হইছিলো।
– সত্যি কইরা বল কি মিশাইছস।
– কিছুই মেশাইনি এখানে। দাঁড়ান আমি খেয়ে সেটার প্রমান দিচ্ছি।
নাজিমুদ্দিনের প্লেট থেকে নিয়ে চারু সেটা নিজের মুখে তুলে দিলো। হামিদ নিজের চোখ বন্ধ করে নিলো। একজন স্বাভাবিক মানুষ জন্য এই দৃশ্য যেমন ভয়ংকর তেমনি জঘন্য। নাজিমুদ্দিন আর দ্বিমত করলো না। সে তৃপ্তির সাথে সম্পূর্ণ বিরিয়ানি খেয়ে নিলো।
– কেমন হইছে?
– খুব মজার। এমন মজার বিরিয়ানি আমি আগে কহোনো খাই নাই। আইজ না আসলে অনেক বড় কিছু হারায়া ফেলতাম।
– মজার তো হইবো। দুইজন মানুষের পরিশ্রম বইলা কথা।
– দুইজন মানুষ?
– হুম। চারুলতা আর শেফালী। শেফালী মাংস দিছে আর চারু রান্না করছে।
মা*তাল আছে বিধায় হামিদের কথার মর্মদ্বার করতে পারলো না নাজিমুদ্দিন। হামিদ আরো আধা বোতল ম*দ খায়িয়ে দিলো নাজিমুদ্দিনকে। এইবার সে সম্পূর্ণ মাতাল।
– বাপজান।
– হুম?
– বস কে?
– অভি।
হামিদ চমকে উঠলো এবং চারুর মুখে ফুটে উঠলো বিষ্ময়। এই অভিটা আবার কে? আর সুবহানই বা কে?
– অভি? অভি কে?
– আমাগো বস।
– তাইলে সুবহান কে?
– বসের ছদ্মনাম। কেবল চাইর জন মানুষ বসের আসল নাম জানে।
– তারমানে সুবহান সম্পূর্ণ নকল নাম?
– না। সুবহানও আছে। সুবহানের নাম ব্যাবহার করতাছে বস।
– সুবহান কে?
– আমি।
– কি সব পাগলের মতন কথা কইতাছেন?
– ঠিকই তো কইতাছি। আসল নাম দিয়া কি আর অন্ধকার জগতে ঢোকা যায়? তাই তো আমি বস রে কইলাম হে যেনো আমার নাম দিয়া যায়। এহন যেই কয়জন তারে চেনে সবাই সুবহান নামে চেনে। আসল নামটা শুধু আমরা চাইর জন জানি।
– তাইলে নাজিমুদ্দিন কে?
– নাজিমুদ্দিন বলতে কেউ নাই।
হামিদের মাথা ঘুরছে। এইসব কিছু আর সে নিতে পারছেনা। নাজিমুদ্দিনের কথা যেনো সকল প্যাচ আরো বাড়িয়ে দিলো। কি একটা অবস্থা এইটা? সুবহান সুবহান নয়, সে অভি। নাজিমুদ্দিন নাজিমুদ্দিন নয়, সে সুবহান। এইটা কি ধরনের গোলকধাঁধা? চারুর অবস্থাও একই কিন্তু সে ঠিক করলো এই ব্যাপারটা নিয়ে পরবর্তীতে আরো ঘাটাঘাটি করবে সে। এখন অন্য প্রশ্ন করার আছে তার।
– শিহাব কি আপনার ছেলে।
– একদিকে হ আবার অন্যদিকে না।
– মানে?
– শিহাব আমার পোলা কিন্তু রক্তের সম্পর্ক নাই।
– বুঝি নি আমি।
– আমি তো মনে কর অনেক গুলা বিয়া করছি। তার মধ্যে বেশিরভাগই অসহায় মাইয়া। শিহাবের মাও এমনই ছিলো। প্রেমিকের কাছে ধোকা খাইয়া আত্মহত্যা করতে গেছিলো। পরে জানতে পারে শিহাব পেটে। পরে বাপ মা মোটা অংকের যৌতুক দিয়া আমার লগে তার বিয়া দেয়। এতে হয় কি ট্যাকাও পাই আবার মাইয়াও পাওয়া যায়। শিহাব রে জন্ম দিতে যাইয়াই তার মা মারা যায়। আমি ক্যান পরের সন্তান পালতে যামু তাই হাসপাতালে ফালায়া রাইখা আসছি। ওই হিসেবে শিহাবরে কিন্তু আমার সত পোলা বলা যায়।
নাজিমুদ্দিন হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে এমনভাবে কথাগুলো বলছেন যেনো তিনি কোনো সিরিয়াস কথা বলছেন। খুবই গর্বের একটা কাজ করেছেন তিনি। তবুও চারু এই ভেবে হাপ ছাড়লো যাই হোক, শিহাবের সাথে তার কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই। কিন্তু তারপরও কোনো না কোনো ভাবে সম্পর্ক টা ভাই বোনের ই হয়ে গেলো। খুবই জঘন্য একটা ব্যাপার।
– তবে যাই বল, বিয়া অনেক গুলা করলেও আমার নিজের ঔরসজাত সন্তান কিন্তু হাতে গোনা মাত্র ছয় টা। তারমধ্যে তুই আর হামিদও আছস। কিন্তু তোদের কোনো পরিচয় নাই। নাজিমুদ্দিনই নাই তার ছেলে মেয়ে আসবো কই থেইকা? এক কথায় তোরা কিন্তু অস্তিত্বহীন। তয়, ব্যাপারটা বুঝিস, আমার দুই পোলা মাইয়াই একমাত্র আমার মানে সুবহানের পরিচয়ে বড় হইতাছে। ওদের মা ই কিন্তু আমার আসল বউ। আর বাকি যারা আছে তাদের কারোই পরিচয় নাই।
– এইসব করার উদ্দেশ্য কি শুধুই টাকা? টাকার জন্য এইসব জঘন্য খেলা খেলছো তুমি আর তোমার বস?
– আরে না। আবার হ্যাঁ।
– মানে?
– মানে যৌতুক ট্যাকার জন্য করি না কিন্তু টাকা ঠিকই কামাই। শত শত মাইয়া দিয়া ট্যাকা কামাইছি আমরা। প্রথমে গরীব ঘরের অসহায় মাইয়া গুলারে টার্গেট বানাইতাম তারপর বিদেশে নিয়া বিক্রি কইরা মোটা টাকা কামাইতাম। মনোরমারেও এই উদ্দেশ্য নিয়াই বিয়া করছিলাম। কিন্তু মনোরমার বাপ আবার বড়লোক। সহজে হইতো না তাই প্ল্যান পরিবর্তন করলাম। আর বেচারা শাওন তো সব জাইনাই ফাইসা গেলো। না জানলে আজ দিব্যি ভালা থাকতো।
– শাওন ভাই? শাওন ভাইয়ের সাথে কি করেছো তুমি?
– আমি করি নাই। বস করছে।
– কি করেছে?
– শাওন এই কথাগুলা জাইনা গেছিলো। খুব শীঘ্রই তোরেও জানায়া দিতো তাই দিয়া দিলাম পাগলের ঔষধ। মানষিক ভারসাম্য হারায়া ফেললো। সবাই ভাবতাছে তোর প্রেমে পইড়া পাগল হইয়া গেছে বেচারা। তুই ও তো এইটাই জানতি। তোর বিয়া হইছে বইলাই শাওনের আজ এই অবস্থা। আসলে এমন কিছুই হয় নাই। আমরাই তার এ অবস্থা করছি।
চারু যতটা না অবাক হলো তারচেয়ে বেশি অবাক হলো হামিদ। চারুর সাথে শাওনের সম্পর্কের কথা সে জানতো না। চারুও অতন্ত্য সুকৌশলে সেটা তার কাছ থেকে আড়াল করে গেছে। কিন্তু শাওনের অবস্থা সে বলেছিলো। শাওনের এ অবস্থার জন্যে যে নাজিমুদ্দিন দায়ী থাকতে পারে সেটা বিন্দুমাত্রও ভাবেনি সে।
– সে কোথায় আছে?
– হাসপাতালে। শিহাব নিয়া গেছে তারে ওই হাসপাতালে। হাসপাতালের নাম সিহাশ্বরী মেডিকেল কলেজ এন্ড হসপিটাল।
চারু আর কিছু বলতে পারছেনা। এসব জেনেই নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগছে। কিন্তু সামনে অনেক কিছুই জানার বাকি আছে তার।
– চারু রে নিয়া কি প্ল্যান ছিলো আপনাদের? ক্যান এত বড় খেলা খেললেন ওরে নিয়া? আর চারুর জন্মের আগে বসের নজর ক্যামনে ওর উপর পড়লো?
– প্রথম থেইকা বলমু নাকি মাঝ খান থেইকা?
– প্রথম থেইকা বলেন।
– আমার নাম সুবহান। বাংলাদেশের ছোট একটা গ্রামে আমার জন্ম হয়। জন্মের সময় মা মইরা যায় আর বাপ জন্মের আগেই মইরা গেছিলো। এগারো বছর বয়সে বাসা থেইকা বাইর হইয়া আসি। ওইহানে কেউই আমারে পছন্দ করতো না। ভাবতো আমার জন্যই আমার বাপ মা মরছে। এগারো বছর বয়সে আমি আমার বড় ভাইরে লইয়া বাসা থেইকা বাইর হইয়া আসি। ভাইয়ের বয়স তহন তেরো। প্রথম প্রথম চুরি চামারি কইরা পেট চালাইতাম। এক পর্যায়ে গিয়া ছোট খাটো চুরিতে আর মন ভরতো না। বড় কিছু কামাই করতে চাইলাম আমরা দুই ভাই। ড্রা*গসের ব্যাবসা শুরু করলাম। বেশিদূর আগাইতে পারি নাই। তার আগেই ধরা পইড়া গেলাম পুলিশের কাছে কিন্তু পুলিশে আছিলো বসের সহযোগী। আমাগো চুরির কৌশল আর ছল ছাতুড়ি দেইখা আমাগো নিজের দলে নেওনের সিদ্ধান্ত নেয়। এর পর থেইকাই আমরা বসের লগে কাজ করি। ছোট থেইকাই সুন্দর ছিলাম তাই আমার কাম ছিলো মাইয়াগো নিজের জালে ফাসায়া বাইরে নিয়া বিক্রি কইরা দিমু। এই কাম করার পর প্রচুর ট্যাকা কামাইতে লাগলাম। দুই হাতে কামাইতাম। তোরা কি জীবনে খাওন পরনের অভাব দেখছস? অন্য সবাই তিন বেলা খাইতে পারতো না আর তোরা কি সুন্দর সারা বছর সুন্দর কইরা হাইসা খেইলা চলতি। ওইটুকু জমি দিয়া কি আর এ সম্ভব? এরই মাঝে ভাইয়েরে বিয়া করাইলাম। আসল বিয়া করাইছিলাম। মাইয়াও মনে কর আমাগো লগেই কাম করতো। পাক্কা *** ছিলো সে। আমাগোও কোনো সমস্যা ছিলো না। উপরি পাওনা হিসাবে ভাইয়ের অনুমতিতে আমিও তার লগে অনেক সময় কাটাইছি।
– আপনের ভাবির লগেও আপনের অনৈতিক সম্পর্ক ছিলো?
– হ ছিলো। কিন্তু সমস্যা হইলো গিয়া, দুরের শহরে একটা কামে গেছিলাম। ওইহান থেইকা আইসা শুনি তার বাচ্চা হইবো কিন্তু ভালা কথা অবশ্য বাচ্চাটা আমার ভাইয়েরই ছিলো। অবশ্য অন্য কারোর হইলেও সমস্যা ছিলো না।
– এত কথা শুনতে পারমু না। মূল কথায় আহেন এহন। চারুর কাছে কি চান?
– মনোরমারে মূলত বিয়া করছিলাম টাকার জন্য। হাত তহন একেবারে খালি। তহনই মনোরমার সন্ধান আমি পাই। বড়লোক বাপ, ভালা যৌতুক দিবো। যৌতুক তো দিলোই অনেক আবার একটা বাড়িও দিলো। মনোরমা যেহেতু বড়লোক বাপের মাইয়া ছিলো তাই তারে এমনে এমনে পাচার করন যাইবো না। প্রথমে বাপের বাড়ির লগে ওর সব সম্পর্ক নষ্ট করতে হইবো। করলামও তাই। ঝামেলা বাজায়া দিয়া সব সম্পর্ক নষ্ট কইরা দিলাম কিন্তু ঝামেলা বাধলো ততদিনে হামিদ পেটে আইসা যায়। বাচ্চা নষ্ট করতে চাইলেও মনোরমা করতে দিলো না। একপ্রকার জিদ কইরাই হামিদরে নিলো সে। হামিদরে নেওয়ায় ঝামেলা বাইড়া গেলো। এহন এই বাচ্চা পালনের জন্য তারে দরকার ছিলো। প্ল্যান করলাম হামিদরে একটা সময় আমাগো দলে টাইনা নিমু। কিন্তু এমন হইলো না। হামিদ ছিলো খুবই নরম স্বভাবের। মানুষের কষ্ট সহ্য হইতো না তার। মায়ের মতন হইছিলো। মনোরমার চেহারার শ্রী খুব একটা ভালা ছিলো না। তারে বিক্রির মাধ্যমে বিরাট অঙ্কের টাকা পাওয়া যাইতো না। তাই বসের কথায় আরেকটা বাচ্চা নেওনের কথা ভাবি। মাইয়া নিতে চাইছিলাম। হইলোও মাইয়া। একদম পরীর মতন আছিলো। চারুর জন্মেরও অনেক আগেই তার দিকে নজর পড়ছিলো বসের আর হইয়া যাওনের পরে তো শুধু বড় হওনের অপেক্ষা। ধীরে ধীরে বড় হইতে লাগলো আর অনেক বেশি সুন্দর হইতে লাগলো কিন্তু মনোরমা শান্ত স্বভাবের হইলেও তার জিদটা ছিলো বেশি। চারুরে নিয়া কোনো প্ল্যান সফল করতে দিতো না। তাই শিহাবের দোহাই দিয়া তারে মারধোর করি। সবাই ভাবে এমনিই মারি কিন্তু প্ল্যান ছিলো খু*ন করনের। তাইলে আর কোনো বাধা থাকবো না। প্ল্যান কইরাই মনোরমারে খু*ন করলাম আমি ওইদিন আর বিয়া কইরা আনলাম শেফালীরে।
হামিদ স্তব্ধ হয়ে গেলো। নাজিমুদ্দিন ইচ্ছাকৃত মে*রে ফেলেছে মনোরমাকে? শুধুমাত্র নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য?
– এই পর্যন্ত সব ঠিকই ছিলো কিন্তু সমস্যা হইছিলো মনোরমার মরনের পরে। শান্ত শিষ্ট হামিদ হঠাৎই কেমন বাঘ হইয়া গেলো। তার সামনে চারুরে কিছুই কওন যাইতো না। আমরা হামিদরে নিয়া চিন্তায় পইড়া গেলাম। একপর্যায়ে রাগারাগি কইরা সে নিজেই বাসা থেইকা বাইর হইয়া গেলো। তারপর সব কাম প্ল্যান অনুযায়ী হইলো। কিন্তু জামাল হোসেনের লগে চারুর বিয়ার পরেই সব কেমন এলোমেলো হইয়া গেলো। বস যেনো আমারে একেবারে ভুইলাই গেলো। কোনোকিছুতেই আর পাত্তা দিতো না। কেমন হারামী বল। এমনটা কেউ করে? কি করি নাই আমি তার জন্য?
– নিজের মেয়ের বিরুদ্ধে এমন জঘন্য পরিকল্পনা করতে রুচিতে বাধলো না?
– না। তোরে তো জন্মই দিছিলাম এর জন্য। তাছাড়া তুই দুনিয়া থেইকা হারায়া গেলেও কেউ কোনো খোজ পাইতো না। খুজতোও না। কারণ তোর তো কোনো অস্তিত্বই নাই। হামিদেরও অস্তিত্ব নাই। যেইহানে নাজিমুদ্দিন বলতেই কেউ নাই ওইহানে তার পোলা মাইয়া আহে কই থেইকা? নাজিমুদ্দিনও নাই, চারুও নাই হামিদও নাই।
চারু স্তব্ধ হয়ে গেলো যেনো। এই ছোট কথাটা তার কানে বারবার বাজছে। তার কোনো অস্তিত্ব নেই। হামিদের কোনো অস্তিত্ব নেই। কিন্তু আজ এই অস্তিত্ব হীন চারুর কাছেই পতন ঘটবে এ অসুরের। চারু হাতে তুলে নিলো ধারালো সেই ছু*ড়িটা।
– কি রে তুই কি করতাছস?
– বল তো কি করি?
– ওইটা নামা।
– আজ আমার হাতে পতন ঘটবে আরেক অসুরের।
– মানে? কি চাস তুই?
– তোর মৃত্যু।
#স্নেহা_ইসলাম_প্রিয়া
(কপি নিষেধ)
প্রথম পরিচ্ছেদের সমাপ্তি….
বিঃদ্রঃ খুবই তাড়াহুড়োর মধ্যে প্রথম পরিচ্ছেদের সমাপ্তি টানলাম। এখনো অনেক রহস্য বের হওয়া বাকি যা বের হবে দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে। রমজানের আগে যেমন তেমন করে প্রথম পরিচ্ছেদটা শেষ করে দিলাম। প্রশ্ন কিন্তু এখনো অনেক গুলো থেকেই যায়। জানি, আজ এ সমাপ্তিতে অনেকেই সন্তুষ্ট না কিন্তু এমনই সমাপ্তি টানার ইচ্ছে ছিলো আমার। হ্যাঁ আরো কিছু লেখার ছিলো। সময়ের অভাবে লেখা হলো না। নাজিমুদ্দিনের খু*ন যারা দেখতে চাইছিলেন তারা হতাশ হবেন না। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে পাবেন সেটি। খুব বেশি দেরি করবো না দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ আনতে। আজকের পর্বে অন্তত সবাইকে দেখতে চাই। একটা রিয়েক্ট দিতে কিন্তু আপনাদের দুই সেকেন্ডের বেশি লাগে না কিন্তু সেটা উৎসাহ দেয় অনেক। সবাইকে ধন্যবাদ। রিচেক হয়নি। হ্যাপি রিডিং।