আমি সেই চারুলতা পর্ব-২৬

0
1908

#আমি_সেই_চারুলতা
#Shuvra_Ahmed_Priya
#পর্বঃ২৬ (দ্বিতীয় খন্ড)
_______________________

সাজিদের বাড়িটা খুবই সুন্দর। ঢাকা শহরে এত বড় জায়গা নিয়ে কেউ এমন বিল্ডিং তৈরি করেনা। সাজিদের মায়ের ভাষ্যমতে, এইটি সাজিদের বাবার পঁচিশ বছরের পরিশ্রম। বাড়িটা ডুপ্লেক্স হলেও এর চারপাশে মস্ত বাগান। বাগানে একটি জলের ফোয়ারা এবং একটি বড় সাইজের সুইমিংপুলের পুল। অন্যপাশে গাড়ি পার্ক করার সুবিধা আছে। ডুপ্লেক্স বাড়িটিতে মোট ১৩ টি ঘর আছে। আর একটা ঘর আছে ছাদের উপর। চারু সেখানেই থাকে। ছাদের উপর কৃত্রিম ঘাস লাগানো হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের ফুলগাছ সেখানে। ফুলগুলো যত্ন করার জন্য মালি থাকলেও ছাদের উপরের ফুলগুলো যত্ন করে চারু। সময় কাটানোর একটি ভালো মাধ্যম এইটি। তাছাড়াও ছাদে একটি মাঝারি সাইজের সুইমিংপুল রয়েছে। স্বচ্ছ টলটলে পানির দিকে চেয়ে থাকতেও ভালো লাগে চারুর। অতিরিক্ত প্রয়োজন না হলে চারুর নীচে যাওয়া নিষেধ এমনকি সাজিদ ছাড়া নীচের কারোরও উপরে উঠা নিষেধ। যদিও সে নিষেধাজ্ঞা ভেঙে পুতুল বেশ কয়েকবার ছাদে এসেছিলো। সাজিদের মাও এসেছিলো তবে চারু কখনোই নীচে যায়নি। সাজিদের ওকে নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভোগার কারণ ও জানে। কি দরকার শুধু শুধু তার ভয় বাড়িয়ে দেবার?
চারু যেই ঘরটাতে আছে সেটাও দারুণ সুন্দর। ঘরের সাথে লাগোয়া ট্যারেস আছে। সেই ট্যারেসে একটা ছোট বেতের দোলনা আছে ও সেটাকে কৃত্রিম ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। ট্যারেসে দাঁড়িয়ে দেখা যায় অসম্ভব সুন্দর তারা ভরা আকাশ তবে সেই আকাশ মোটেও গ্রামের মতো এত সুন্দর নয়। আসবাব বলতে, একটা রাউন্ড বেড, দেওয়ালের সাথে লাগোয়া আলমিরা, মস্ত এক বুক সেলভ এবং সেই বুক সেলভ ভর্তি বই রয়েছে সেখানে। সময় কাটানোর জন্য বই পড়াও একটি ভালো মাধ্যম। একটা স্টাডি টেবিল। এই জিনিসগুলোতেই ভরে গেছে ঘর। ঘর বেশি বড় না হলেও অসম্ভব সুন্দর গোছানো। লাগোয়া ওয়াশরুম, কিচেন সবই আছে। অবশ্য কিচেনে রান্নাবান্নার প্রয়োজন হয়না। খাবার নিচের থেকেই আসে। চারুকে নিয়ে সাজিদের সাথে ওর মায়ের কি কথা হয়েছে সেটা চারু জানেনা। সাজিদ কি তাকে জানিয়েছে চারু একজনকে জেল পলাতক আসামী? নাও জানাতে পারে, যেহেতু সেই চারুকে পালাতে সাহায্য করেছিলো।
কতদিন দেখা হয়না হামিদের সাথে। লতার সাথেও দেখা হয়না। মেয়েটা নিশ্চয়ই এতদিনে বড় হয়ে গেছে। হামিদ চারুর সাথে মিলিয়ে মেয়ের নাম রেখেছে লতা। যথারীতি এইটাও ফাতেমার পছন্দ হয়নি কিন্তু হামিদ অন্য ঘাটের মাছ। ফাতেমার পছন্দ নয় বলে সে নাম তো বদল করলোই না বরং লতা নাম রেখে মেয়ের আকিকাও করিয়ে ফেললো। রাগ, দুঃখ, কষ্ট, অপমান সহ্য করতে না পেরে ফাতেমা এরপর মেয়েকে নিয়ে নিজের বাপের বাড়ি পাড়ি জমালো। হামিদের কোনো হেলদোল ছিলো না ফাতেমাকে নিয়ে। কেনো যেনো এতদিনেও ফাতেমার জন্য ভালোবাসাটা আসেনি। যদি ফাতেমা হিংসুক না হয়ে সহজ সরল হতো তাহলে বোধহয় আসতো। হামিদ অসম্ভব ভালোবাসে চারুকে আর ফাতেমা তাকে সহ্যই করতে পারেনা তাই সম্ভবত হামিদও এখনো মানতে পারেনি তাকে। তবে হামিদের পক্ষে ফাতেমাকে ছেড়ে থাকা সম্ভব হলেও লতাকে ছেড়ে থাকা সম্ভব নয়। নিজের আত্মসম্মানবোধ বিসর্জন দিয়ে হামিদ গিয়েছিলো ফাতেমা আর লতাকে আনতে কিন্তু ফাতেমা আসতে নারাজ। হামিদকে শর্ত দিলো, সে যদি চারুর সাথে আর যোগাযোগ না রাখে তবেই সে হামিদের বাড়ি ফিরবে। হামিদও পাল্টা উত্তর করলো, “তোর আসতে হইবো না। তুই না আসলে আমি বাঁচি। তুই আমার মাইয়ারে দে।” হামিদের এই কথায় ফাতেমা আবারও তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। মেয়েকেও দিলো না সে নিজেও আসলো না। হামিদও আবার কম যায়না। রাতের অন্ধকারে সে চুপিচুপি গিয়ে লতাকে নিয়ে চলে এসেছে। বাসার একটা কাক পক্ষীও টের পায়নি।
হামিদের এই নিজের মেয়েকে চুরির কথা যতবার চারুর মনে পড়ে ততবারই উচ্চস্বরে হেসে উঠে সে। এইবারও তার ব্যতিক্রম ঘটলো না। গল্পের আসল লেখিকা শুভ্রা আহমেদ প্রিয়া। এইভাবে কে নিজের মেয়েকে চুরি করে? চারুর হাসি দেখে ভ্রু কুচকায় হামিদ। বাহবা পাওয়ার আশায় বলে, “চুরি বিদ্যা মহা বিদ্যা, যদি না পড়ো ধরা।” হামিদের এই কথায় আবারও হেসে উঠলো চারু। আর ওইদিকে ফাতেমার বাসায় তো মেয়েকে হারানোর শোকে কান্নাকাটি লেগে গেছে। ফাতেমা যখন লতাকে হামিদের কাছে দেখলো তখন তার চেহারাটা দেখার মতো ছিলো। ভূত দেখার মতো চমকে উঠেছিলো ফাতেমা। সে এও বুঝতে পেরেছিলো, যেহেতু লতা হামিদের কাছে তাই হামিদ আর ওকে নিতে আসবেনা তাই সে নিজে নিজেই চলে এসেছিলো হামিদের বাড়িতে৷ এইসব অবশ্য অনেকদিন আগের কথা। নাজিমুদ্দিন ওরফে সুবহানের খু*নেরও আগে।

আচ্ছা সাজিদ তখন কি বললো? সাজিদ কিভাবে চারুর কাছে কৃতজ্ঞ হতে পারে? তবে কি সাজিদেরও সেই তথাকথিত বসের সাথে কোনো পুরোনো শত্রুতা আছে? কিংবা এমন কি হতে পারে নাজিমুদ্দিনের সাথে সাজিদের কোনোভাবে সম্পর্ক আছে? হতেও পারে, নাজিমুদ্দিন তথা সুবহানের তো চরিত্রের ঠিক নেই। হতে পারে সাজিদও কোনোভাবে তার ছেলে। কিন্তু নাহ! এই হিসেব কোনোভাবেই মিললো না। নাজিমুদ্দিনের ছেলে হওয়ার কথা না সাজিদের। নীচে ড্রইংরুমে সাজিদের বাবার একটা ছবি খুব বড় করে টাঙানো আছে। বাবার সাথে সাজিদের চেহারার বেশ মিল। তাই এই অপশনটা সম্ভবত বাদ পড়ে গেলো। বাকি রইলো বসের সাথে যোগসূত্র কিন্তু বস কে সেটা তো এখনো জানাই হলোনা। সাজিদের ভাষ্যমতে, চারু এমন কিছু করে ফেলেছে যা সাজিদ অনেক চেষ্টা করেও করতে পারেনি। কিন্তু বস কে তো চারু মারতেই পারেনি এমনকি তার পরিচয়ও জানেনা। তবে কি কারণ হতে পারে? আর কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ চারু খুজে পাচ্ছেনা। সাজিদের বউয়ের সম্পর্কে তেমন কিছু জানেনা চারু। সে মা*রা গেছে নাকি জীবিত আছে তাও জানেনা। কোনোভাবে কি সাজিদের স্ত্রী এসবের সাথে কানেক্টেড থাকতে পারে? চারু সাজিদের বউয়ের একটি ছবি পেয়েছিলো পুতুলের কাছে। সে তো বলেছিল তার মা মারা যায়নি। অবশ্য পুতুলের কথা ধরা যায়না। বাচ্চাদের অনেক সময় অনেক কিছু বলে শান্তনা দেওয়া হয়। চারুর মনে হয়েছিলো সে এখন সব রহস্য, প্যাচ থেকে বেড়িয়ে এসেছে, কিন্তু নাহ! মনে হচ্ছে রহস্য কেবল শুরু। এমনই চিন্তাভাবনার মাঝে হঠাৎই কিছু ভাঙার আওয়াজ পেয়ে চমকে উঠলো চারু। এমন বিকট শব্দে সাজিদের নিষেধও ভুলে গেলো যেনো সে। দ্রুত দৌড়ে নীচে নামলো। জিন্স, টপস পড়া একটা মেয়ে। মাথায় একটি মর্ডান হিজাব বাধা, চেহারায় ভারী মেইক-আপ। চোখের সানগ্লাসটি খুলে টপসের গলায় ঝুলিয়ে রেখেছে। তার চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে সে-ই সম্ভবত এই শব্দটার মূল উৎস। বড় ফুলদানিটার বিভিন্ন অংশে ভেঙে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। একপাশের সোফায় নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে আছে সাজিদ। মেয়েটিকে কেমন চেনাচেনা লাগছে চারুর কাছে। এইটা সম্ভবত সায়মা। সাজিদের প্রাক্তন স্ত্রী। অবশ্য প্রাক্তন নাকি বর্তমান সেইটা চারু জানেনা। পুতুল বলেছিলো তার বাবা মা একসাথে থাকেনা। মেয়েটা তাহলে ঠিকই বলেছিলো। ওর মা বেঁচে আছে। এমন সময়েই মেয়েটি চিৎকার করে বললো,
– তুমি আমাকে আমার মেয়ে ফেরত দেবে কি না সেইটা বলো।
– কখনোই না।
– সাজিদ আমাকে রাগাবে না।
– তুমি হয়তো ভুলে যাচ্ছো কোর্ট পুতুলকে আমার কাছে থাকার অনুমতি দিয়েছে।
– তুমি হয়তো ভুলে গেছো আমার কারনেই তুমি পুতুলের কাস্টাডি পেয়েছো।
সাজিদের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। চোখেমুখে কঠোর ভাব। সাজিদের এইরূপ থেকে কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেলো সায়মা।
– তোমার লজ্জা করেনা পুতুলকে নিজের মেয়ে দাবি করতে? সেদিন যখন কোর্টে সবার সামনে বলেছিলে আমার মেয়ে তোমার চাই না তখন লজ্জা লাগেনি নিজের মেয়েকে অস্বীকার করতে? এখন কোন মুখে আমার মেয়েকে চাইতে এসেছো?
– হ্যাঁ তখন চাইনি কিন্তু এখন চাচ্ছি।
– হ্যাঁ সব তো তোমার ইচ্ছা অনুযায়ী হবে। মা নামের কলঙ্ক তুমি। তুমি কি মনে করেছো, তুমি কেনো এখানে এসেছো আমি জানিনা? পুতুলের আঠারো বছর হলে সে আমার সব সম্পত্তির মালিক হবে এইটা জেনেই তুমি লোভে পড়ে গেছো তবে ভালো করে শুনে রাখো, তোমার এই নোংরা ইচ্ছে আমি কখনোই চরিতার্থ হতে দেবো না।
– পুলিশ ডাকবো আমি।
সাজিদ মুচকি হাসলো। হাসার মতো কথাই বলেছে সায়মা।
– একজন পুলিশকে অপর একজন পুলিশের ভয় দেখাচ্ছ? পুতুলের কাস্টাডির লিগ্যাল নোটিশ আছে আমার কাছে। তুমি কিচ্ছু করতে পারবেনা।
– আমি তোমার নামে হ্যারাসমেন্টের কেইস করবো। তোমার ক্যারিয়ার বাতিল করে দেবো।
– চেষ্টা করে দেখতে পারো আর হ্যাঁ, কেসে যদি বাই এনি চান্স তুমি হেরে যাও আমি রিটার্ন তোমার নামে মানহানির মামলা করবো। এতে কিন্তু তোমার ক্যারিয়ারও শেষ হয়ে যাবে।
– আমাকে হুমকি দিচ্ছো? কাজটা ভালো করছো না সাজিদ।
– আমার ভালো মন্দ নাহয় না-ই বুঝলে তুমি।
– দেখো সাজিদ, তোমার কাছে দুইটা অপশন আছে। হয় তুমি আমার কাছে পুতুলকে দিয়ে দাও নইলে আমরা পুতুলের মুখের দিকে তাকিয়ে আবার নতুন করে সব শুরু করি।
সায়মার কথা শুনে উচ্চস্বরে হেসে উঠলো সাজিদ। তো এতদিন পরে পুতুলকে নিতে আসার এই কারণ।
– কখনোই না সায়মা। আমার রুচিবোধ এতটাও নিম্নপর্যায় পৌঁছে যায়নি।
– তুমি আমাকে অপমান করছো সাজিদ।
– তা তো করছিই।
– তোমাকে আমি দেখে নেবো। আমিও দেখবো পুতুলকে কিভাবে তুমি নিজের কাছে রাখো।
– তোমার মতো স্বার্থ লোভী মহিলার কাছে আমি কখনোই আমার মেয়েকে দেবোনা। যা খুশি করে নিতে পারো।
মেয়েটি আর দাঁড়ালো না। নিজের হাই হিল জুতোয় শব্দ করতে করতে বেড়িয়ে গেলো বাসা থেকে। এতক্ষণে চারু বুঝতে পারলো ও কি করেছে। ও দুজনের ব্যক্তিগত কথা তাদের অনুমতি ছাড়াই শুনে নিয়েছে। এমন বিবেকহীনের মতো কাজ করায় নিজের উপরই বিরক্ত হলো চারু। চুপচাপ উঠে গেলো ছাদের দিকে।

বর্ষাকাল এসে গেছে। প্রায় আকাশের মন খারাপ ভাবটা লক্ষ্য করা যায়। মাঝেমাঝে তো তার কান্নাও দেখা যায়। বর্ষাকালের এই বৃষ্টিটা দারুণ লাগে চারুর কাছে। কতদিন ভেজা হয়না। তবে চারু এখন আর সাহস করে ভিজতে পারেনা। ও জানে, অসুস্থ হয়ে গেলে ওর সেবা করার মতো কেউ নেই। ও মারা গেলেও ওর পরিবারের কেউ জানতেও পারবেনা। অবশ্য চারুর পরিবার বলতে এখন শুধু হামিদ-ই আছে। নাহ! এত সহজে মরা যাবেনা। ওই বস নামক নরপিশাচটাকে শাস্তি না দিয়ে তো নয়ই। আগে তার শাস্তি হোক, তারপর মরেও শান্তি পাবে চারুলতা। বেলি ফুলের গাছটাতে দারুণ ফুল ফুটেছে। সম্পূর্ণ ছাদ ফুলের সুভাষে সুভাসিত হয়ে আছে। কে জানে বেলির গন্ধ এত মিষ্টি কেনো? মিষ্টি তো হবেই। বেলি তো পবিত্র ফুল। পবিত্র সবকিছুই অসম্ভব সুন্দর ও আকর্ষণীয় হয়ে থাকে। সবাই বাজারে গিয়ে তাজা ফুলটাই খোজে। বিকেলের বাসি হয়ে যাওয়া ফুল কিনতে চায় কে? অবশ্য আরো একটা উদাহরণ দেওয়া যায়, সারাদিন নেশায় বুদ হয়ে থেকে সারারাত পতিতা পল্লীতে কাটানো ছেলেটাও বিয়ের জন্য পবিত্র তথা ভার্জিন মেয়ে খোজে। কি হাস্যকর! ঘন মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে চারু। এখানে আসার পর সাজিদ তাকে একটা ফোন কিনে দিয়েছিলো। সেটা থেকেই চারু সাজিদকে ছাদে আসতে বলেছিলো। নিশ্চয়ই কিছুক্ষণ মধ্যেই চলে আসবে। ফোন থাকার শর্তেও চারু হামিদের সাথে যোগাযোগ করেনা। গল্পের আসল লেখিকা শুভ্রা আহমেদ প্রিয়া। হতে পারে এইটা সাজিদের কোনো ফাদ। হামিদকে ধরতে চায় সে চারুর মাধ্যমে। আজকাল কাউকেই আর ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারেনা চারু। মাঝে মাঝে তো মনে হয় আয়নায় থাকা প্রতিবিম্ব টাও বুঝি তার সাথে বেইমানি করছে। নাজিমুদ্দিনকে খু*ন করার আগে আরো এক কঠিন সত্য জানতে পেরেছিলো চারু। অবশ্য তার জীবনই মিথ্যার চাদরে জড়িত, যে চাদর সর্বদা আড়াল করে রেখেছে সত্যকে। কে জানে সাজিদ আসলেই কেমন?

মেঘাচ্ছন্ন সকালে চারুর ক্ষুদে বার্তা পেয়ে ছাদে এসেছে সাজিদ। চারুকে কোথাও দেখা যাচ্ছেনা তবে সে অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো বেলি ফুলের গাছটিকে। এই গাছটিকে কেনার পরে কখনো এতে ফুল ধরেনি। হাজারো পরিচর্চার পরেও কখনো গাছটিতে ফুল ধরেনি বরং গাছটির অবনতিই ঘটেছে। সাজিদ ভেবেছিলো এই গাছটিতে আর কখনো ফুল ধরবেনা বরং অচিরেই গাছটি মারা যেতে চলেছে। আগে কখনো এই গাছটিকে লক্ষ্যই করেনি সাজিদ কিন্তু আজ হঠাৎই চোখ পড়ে যাওয়ায় বিষ্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে আছে সে৷ এইটা কিভাবে হলো? অনান্য সকল গাছের থেকে এই গাছটিতে বেশি ফুল ফুটেছে। বেলি ফুল কি সত্যিই এত মোহনীয়? সাজিদ যে চারুর ক্ষুদে বার্তায় এখানে এসেছিলো সেটা দিব্যি ভুলে গিয়ে মোহগ্রস্তের মতো এগিয়ে গেলো গাছটির দিকে।
– আপনি কখন এলেন? আর এসে আমার সাথে দেখা না করে এখানে কি করছেন?
– এই গাছে এত ফুল কিভাবে ফুটলো চারুলতা?
– সৃষ্টিকর্তার দান!
– বুঝতে পেরেছি কিন্তু আগে কখনো গাছটিতে এত ফুল ফোটেনি। প্রকৃতপক্ষে কোনো ফুলই ফোটেনি।
চারু কিছু বললোনা। ও কখনোই এই গাছটির মধ্যে অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করেনি।
– বস সম্পর্কিত কিছু জানতে পারলেন?
– এখনো নয়। তবে চেষ্টা চলছে।
– কতদিন লাগবে?
– খুব শীঘ্রই সুরহা হবে। চারুলতা!
– হুম।
– নাজিমুদ্দিন মানে সুবহানের কলিজা কি করেছেন?
– হামিদ খেয়ে ফেলেছে।
– চারুলতা প্লিজ মিথ্যা বলবেন না। আজ এমনিই আমার মেজাজ বিগড়ে আছে।
– মিথ্যা বলিনি। সত্যিই বলেছি।
– আপনার ভাই যেখানে আপনাকে কলিজা খেতে মানা করছে সেখানে সেটা ও খেয়ে নিয়েছে। কথাটা কি বিশ্বাসযোগ্য?
– আমি কখন বললাম আমার ভাই খেয়েছে?
– একটু আগেই তো বললেন হামিদ খেয়েছে।
– ঠিকই বলেছিলাম। হামিদ খেয়েছে।
সাজিদের ইচ্ছে হচ্ছে নিজের মাথার সবগুলো চুল ছিড়ে ফেলতে। এই মেয়ে এমন কেনো? বড্ড রহস্যময়! তার মতো এমন জাদরেল পুলিশ অফিসার কি না এইটুকু বাচ্চা মেয়ের কাছে নাকানি চুবানি খাচ্ছে। নাহ! এইটা মেনে নেওয়া যায়না।
– আচ্ছা কলিজার কথা বাদ দিন। আপনি বলুন, শাওনের কি হয়েছিলো। আপনি সেদিন বলেছিলেন শাওনকে খুন করা হয়েছিলো।
– পরোক্ষভাবে।
– যেভাবেই হোক, খুন তো হয়েছে। কি করে হলো?
চারু উত্তর না দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে রইলো। সাজিদ ভেবে পায়না এই মেঘলা আকাশে কি এমন আছে চারু এভাবে তার প্রেমিকের মতো তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। বেশ রাগও হচ্ছে তার উপর।
– আপনার বাবা কি সত্যিই হিন্দু ছিলেন?
– না। ব্রাহ্মণ ছিলেন।
– একই তো হলো।
– না এক না। হিন্দু আর ব্রাহ্মণ সম্পূর্ণ আলাদা।
– পার্থক্য কোথায়?
– ব্রাহ্মণ আলাদা একটা ধর্ম। খুবই উচ্চ মর্যাদাবান ধর্ম। ব্রাহ্মণরা নিজেদের ঐতিহ্য পালনে বেশ সতর্ক। বেশিরভাগ ব্রাহ্মণই খুব ধার্মিক হন এবং দেবতার সন্তুষ্টির জন্য তাদের সেবায় নিয়োজিত থাকতে ভালোবাসেন। হিন্দুরা ব্রাহ্মণদের অতিথি হিসেবে পেলে খুবই খুশি হন।
– নাজিমুদ্দিন তথা সুবহান কিভাবে বিগড়ে গেলো?
– ইসলামে নফস বলে একটা কথা আছে। এই নফসের কারণেই সে বিগড়ে গেছে। যদি পরিবারের সাথে থাকতো তাহলে সম্ভবত ভালো একজন ব্রাহ্মণ হতো। পরিবার থেকে সরে গিয়ে নিজের ধর্মের উপর বিশ্বাস হারিয়েছে। নিজের ধর্মকে কলঙ্কিত করেছে। ইসলাম ধর্মের নামে নিজের স্বার্থ হাসিল করে ইসলাম ধর্মকেও কলঙ্কিত করেছে। বলেছিলাম না জঘন্য এক মানুষ।
– সে যদি সত্যিই ব্রাহ্মণ হয় তাহলে নিশ্চয়ই তার নাম নাজিমুদ্দিন বা সুবহান নয়। অর্থাৎ এ দুটিও নকল নাম।
– তার আসল নাম আর নকল নামে কোনো পার্থক্য নেই। দুটোই ইউজলেস।
– আরেকটা ঘাপলা খেয়াল করেছেন কি?
চারু জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে সাজিদের দিকে তাকালো।
– নাজিমুদ্দিনের ভাষ্যমতে সে ১১ বছর বয়সে বসের কাছে কাজ করা শুরু করেছে অর্থাৎ বস নিশ্চয়ই নাজিমুদ্দিনের থেকেও অনেক বড় আর আপনার ভাষ্যমতে বসের বয়স ২৫-২৬। হিসেব কিন্তু মিলছেনা চারুলতা।
চারুলতা চমকে উঠলো। আসলেই তো সে এমন ভাবে কিছু ভেবে দেখেনি। তাহলে সত্য কি আর মিথ্যাই বা কি? বস কে?
– আমি কিন্তু দুইটি সম্ভাবনার কথা ভাবছি চারুলতা। প্রথমত, আপনি যেহেতু তার চেহারা দেখেননি শুধু আন্দাজ করেছেন তাই বলবো আপনার আন্দাজ ভুল। অবশ্য এইটা হওয়ার সম্ভবনা কম কারণ ২৫ বছর বয়স মানে সে যুবক। একজন যুবকের শক্তি এবং কণ্ঠস্বর দুটোতেই আলাদা তেজ থাকে। বুড়ো মানুষের মধ্যে এইসব পাবেন না। দ্বিতীয় সম্ভাবনাটা কিন্তু বেশ লজিক্যাল।
– আর সেটা কি?
– এই ধরনের একটা গ্যাং ২৫ বছরের একটা যুবক পরিচালনা করে ভাবাটা নেহাৎই বোকামি। আমার মতে তার আরও সঙ্গী রয়েছে। তারা তূলনামূলক বয়স্ক এবং তাদের মধ্যেই কারোর কাছে নাজিমুদ্দিন পড়েছিলো সম্ভবত। খারাপ সঙ্গে পড়ে তার ধর্মজ্ঞান হারিয়ে যায়। এমন একটা সেনসেটিভ ধর্ম থেকে বেড়িয়ে পাপাচারে লিপ্ত হয় সে। আপনার মা কেও মিথ্যা বলেই সে বিয়ে করেছিলো। উনি নিশ্চয়ই জানতেন না নাজিমুদ্দিন ওরফে সুবহান উনি মুসলিম নন। উনি ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের। এইটা জানলে নিশ্চয়ই উনি নাজিমুদ্দিনকে বিয়ে করতেন না।
– দ্বিতীয় সম্ভাবনা বেশ লজিক্যাল। আমার মাথায় কিচ্ছু যাচ্ছেনা। সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। আমার সুন্দর সাজানো জীবনটা এলোমেলো করে দিয়েছে সে। ক্ষমার অযোগ্য!
– কার সাথে জীবন সাজানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন চারুলতা? শিহাব নাকি শাওন।
– শাওন ভাই ছিলো আমার কিশোরী বয়সের আবেগ। সে বয়সটাতে আমি বাস্তবতা বুঝতে পারিনি তবে নিঃসন্দেহে শাওন ভাই আমাকে খুবই ভালোবাসতো। তার মতো জীবনসঙ্গী ভাগ্য করেই পাওয়া যায়। আমার এত সুবর্ণ সৌভাগ্য কোথায়?
– আর শিহাব?
– তার সম্পর্কে আমি আর কিছু ভাবতে চাই না।
– কেনো? শিহাব আপনার ভাই এই কারণে? আপনাদের বাবা মা কিন্তু আলাদা। এমন বিয়ে কিন্তু ইসলামে জায়েজ আছে।
– জানি কিন্তু আমি কখনোই তার যোগ্য ছিলাম না। এখনো নেই। সে ভালো কিছু ডিজার্ভ করে। তাছাড়া সম্পর্ক যেভাবেই হোক, সে এক দিক থেকে আমার ভাই-ই হয়৷ আমি ভাই বোনের সম্পর্ককে কখনো অপবিত্রতায় ঠেলতে চাইনা। তার সম্পর্কে কিছু ভাবতে চাইনা। সে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।
– তাও তো তাকেই ভালোবাসেন।
– খুব ইচ্ছে করছে আপনার মুখের উপর বলে দেই বাসি না কিন্তু তাহলে মিথ্যে বলা হবে।
– যদি কখনো সুযোগ পান শিহাবের কাছে ফেরত যাওয়ার। শিহাব নিজে নিতে চায় আপনাকে?
– যাওয়ার দরজা বন্ধ। সেটাকে খোলার ইচ্ছেও আমার নেই। আমার অভিশপ্ত জীবনে তাকে জড়ানোর মতো দুঃসাহস আমি কল্পনায়ও করবোনা।
– সে কিন্তু এখনো অপেক্ষা করছে তার স্বর্ণলতার জন্য। আর ৩৪ বছর বয়সী একজন পুরুষের এই অনুভূতিকে নিশ্চয়ই আপনি আবেগ বলবেন না। আবেগের বয়স অনেক আগেই পার করেছে সে।

বিঃদ্রঃ আগামী পর্ব শনিবার আসবে। নেক্সট না বলে দয়া করে গঠনমূলক মন্তব্য করুন। এই রোজায় গল্প লিখি তো শুধুই আপনাদের উৎসাহের জন্যই।

২য় বিঃদ্রঃ গত পর্বে আপনাদের মন্তব্য দেখে বুঝতে পারলাম আপনারা অনেকেই গল্পটা ভুলে গেছেন। সবাইকে একটু রিভাইস করে আসার অনুরোধ রইলো।

#শুভ্রা_আহমেদ_প্রিয়া (স্নেহা)

(কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ)

To Be Continued….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here