আমি সেই চারুলতা পর্ব-৪০

0
1961

#আমি_সেই_চারুলতা
#Shuvra_Priya (স্নেহা)
|৪০|
_________________________

– শুনেন আপনে ওই মাইয়ার সাথে আর কথা বলবেন না।
– কোন মাইয়া?
– চারুর বান্ধবী বিন্দিয়া।
– ক্যান কি হইছে?
– ওই মাইয়া আপনেরে পছন্দ করে।
– তো কি হইছে? একজন মানুষ আরেকজন মানুষরে পছন্দ করবো সেইটাই স্বাভাবিক।
– ওই মাইয়া আপনেরে আমার কাছ থেইকা কাইড়া নিতে চায়। আপনেরে পাওয়ার স্বপ্ন দেখে। আপনে ওর সাথে আর কথা কইবেন না। আমারে ছাড়া যদি আপনে কোনো মাইয়ার দিকে তাকান, তাইলে যেনো আপনের চোখ অন্ধ হইয়া যায়। দরকার হইলে অন্ধ স্বামী নিয়া আমি সারাজীবন পার করমু।
– কিসব আজাইরা কথা বলতাছো? ও তো চারুর বান্ধবী।
– আমি জানি। সব জাইনাই বলতাছি।
হামিদ ভ্রু কুচকে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করলো। ফাতেমার কথায় ঠিক কতটা সত্যতা আছে?
– তোমার কোথাও ভুল হইতাছে না তো?
– দেহেন, এত কথা আমি কইতে পারমু না। আপনে আর ওর সাথে কথা কইবেন না।
– লতা ঘুম থেইকা উঠছে?
– কথা বদলাইতাছেন ক্যান?
– কই বদলাইলাম কথা? অনেকক্ষণ যাবত দেখতাছি না তাই দেখতে ইচ্ছা করতাছে।
– ও চারুর কাছে আছে। পুতুল আর লতাকে নাস্তা করাইতাছে।
– আমি দেইখা আসি।
হামিদ আর সেখানে দাঁড়ালো না। খুব অস্বস্তি হচ্ছিলো এইসব শুনতে। বিন্দিয়াকে নিয়ে কখনো তার মনে আলাদা কোনো ভাবনা ছিলোনা। এখনো নেই। ফাতেমার সাথে এই বিষয় নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না বিধায় এভাবে উঠে চলে এলো। লতা আর পুতুল মোটামুটি চারুর গলায় ঝুলে আছে, কিন্তু খেতে চাইছেনা। দুজনকেই চারু বকে বকে খাওয়াচ্ছে তবে চারুর ধমকে দুজনের একজনকেও ভয় পেতে দেখা গেলোনা।
– আমার আম্মাজান কি করে?
হামিদের আওয়াজ পেতে একলাফে লতা তার কোলে উঠে গেলো। হামিদও বুকে জড়িয়ে নিলো মেয়েকে।
– ফুপ্পি কি বকা দিচ্ছে মা?
লতা ঠোঁট ফুলিয়ে হ্যাঁ জানালো। লতার এহেন আচরণে হামিদ এবং চারু দুজনেই হেসে উঠলো।
– তোমার মেয়েটা প্রচুর আহ্লাদী জানো? ওর নাম লতা না হয়ে আহ্লাদী হওয়া উচিত ছিলো।
– ইশশ রে! আকিকা দিয়া দিছি, নইলে ওর নাম আমি আহ্লাদীই দিতাম। সুন্দর নাম।
– আমি আর খা-বো-না মা।
পুতুল টেনে টেনে বললো কথাটা। প্রতিউত্তরে চারু ধমক দিয়ে আরেকটু খাওয়ালেও পুরোটা শেষ করাতে পারলো না। আজকাল পুতুল চারুকে একদমই ভয় পায়না। পুতুল দৌড়ে ছুটে গেলো ঘরে।
– আমি কহনো ভাবি নাই, তুই পুতুলরে এত সহজে মাইনা নিতে পারবি। বেশ চিন্তা করতাম এই মাইয়াটারে নিয়া।
– না মানার কি আছে?
– অনেক কিছুই আছে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার ও তোর নিজের মাইয়া না।
– সৎ মায়ের কষ্ট আমি জানি। আমি কখনো চাইনা কেউ আমাকে শেফালীর সাথে তুলনা করুক। ওর দায়িত্ব এখন আমার, আর আমি সর্বোচ্চ দিয়ে সেই দায়িত্ব পালন করবো। আমি ওকে একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ দিতে চাই।
– আর তোর ভবিষ্যৎ? সেই যে কবে এইচএসসি দিলি আর তো কোনো খবরই নাই তোর পড়াশোনার।
– মেডিকেলে এপ্লাই করবো ভাবছি।
– কোনোদিন একটা অক্ষরও তো পড়তে দেখলাম না। মেডিকেল পড়া এত সহজ না। সবাই চান্স পায়না।
– আমি না পারলে আমার মেয়ে পড়বে।
– বাহ! মেয়ের প্রতি অনেক ভালোবাসা জন্মাইছে দেখা যায়।
– সত্যি বলতে আগে ছিলোনা জানো! শুধুই কর্তব্যবোধ থেকে সবটা করেছি। একদিন প্রচুর ঝড় হচ্ছিলো, সাথে বজ্রপাত। পুতুল বজ্রপাতের শব্দে খুব ভয় পায় সেটা আমি জানতাম না। তাই ওকে ঘরে বসিয়ে আমি চলে গেলাম রান্নাঘর। এমন সময়েই খুব জোরে বজ্রপাত হতেই পুতুল মা মা বলে চিৎকার করে উঠলো। আমি দৌড়ে গেলাম ঘরের দিকে। আমাকে পেয়েই শক্ত করে সেদিন মেয়েটা আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলো। সেদিন বুঝেছিলাম, এই মেয়েটার কাছে আমি সত্যিই একটা ভরসার জায়গা। মাকে তার সন্তান যতটা ভরসা করে এই মেয়েটাও আমাকে ঠিক ততটাই ভরসা করে। এরপর আর পারিনি তাকে দূরে সরিয়ে রাখতে। স্কুলে যখন প্যারেন্টস মিটিং হলো, মেয়েটা অতিরিক্ত উচ্ছ্বাস নিয়ে আমাকে সবার কাছে নিজের মা হিসেবে পরিচয় দিলো। সেদিন তার চোখেমুখে থাকা খুশি দেখেই বুঝেছিলাম আমাকে পেয়ে ঠিক কতটা খুশি সে। এরপরও তাকে দূরে সরিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। মেয়েটা আমাকে প্রচন্ড ভরসা করে আর একইসাথে ভালোও বাসে। কেনো আমি জানিনা। তার প্রতি এত অনুরাগ আমি দেখাইনি কিন্তু তার অনুরাগে আমি তাকে ভালোবাসতে বাধ্য হয়েছি বলা চলে। মা মানেই একটা নিরাপত্তা। একটা নির্ভরযোগ্য আবাসস্থল। এই সময়ে একটা মেয়ের তার মাকে কতটা প্রয়োজন হয় আমি সেটা জানি। মায়ের মাধ্যমে আমার যে ঘাটতিটা পূরণ হয়নি আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করি সে ঘাটতি যেনো পুতুলের মাঝে না আসে। এই বয়সেই মেয়েরা সবচেয়ে বেশি হয়রানির স্বীকার হয় পুরুষ শাসিত সমাজে। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেটা নিজের নিজের আপন মানুষের মানুষের দ্বারা। শুনতে ঘৃণার হলেও সত্য যে, বাবা, ভাই, মামা, কাকা, বাবার খুব ভালো বন্ধু এইধরণের আপন মানুষের কাছেই আজ মেয়েরা সুরক্ষিত নয়। তোমার মনে আছে, আমাকে যখন হাসপাতালে নিয়ে যেতে আমার অবস্থা খুবই খারাপ ছিলো। জামাল হোসেন ঠিকঠাকভাবে চিকিৎসা করায়নি আমার। তুমিই পরবর্তীতে ডক্টর দেখিয়েছিলে। সেখানে গাইনি চেম্বারে যাওয়ার পর আমি এক মেয়েকে দেখেছিলাম যে বাচ্চা নষ্ট করতে এসেছিলো। ভেবেছিলাম বাচ্চাটা তার বয়ফ্রেন্ডের। কিন্তু কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর জানতে পারলাম বাচ্চাটা তার নিজের বাবার। সেদিনই প্রতিজ্ঞা নিয়েছিলাম, আমার যদি কখনো কোনো মেয়ে হয়, আমি তাকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেবো। আমার মেয়ে যার কাছে যেতে অস্বস্তি বোধ করে তার কাছে কখনোই আমি আমার মেয়েকে যেতে দেবোনা। সেটা যদি তার নিজের বাবা হয় তাও না। আমার মেয়ের সবচেয়ে ভালো বন্ধু হবো আমি যার সাথে সে নিঃসংশয়ে সব বলতে পারবে। মা আমাকে সবসময় বুঝলেও তার সাথে আমার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি কারণ সমাজ। মা প্রচন্ড সমাজরক্ষা করতে চাইতো, তাই সে সকলক্ষেত্রে আমাদেরই শাসন করতো। আমাদের দোষ না থাকলেও করতো। আমি এইসব সো কল্ড সমাজব্যবস্থা মানিনা। আমার মেয়ে যেখানে দোষ করেনি সেখানে এক বিন্দুও শাস্তি আমি তাকে দেবোনা। সে দোষ করলে অবশ্যই শাস্তি পাবে তবে নির্দোষ হলে তার জন্য নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে লড়াই করবো আমি। জানো, এখন আমার এক মূহুর্তের জন্যও মনে হয়না এই মেয়েটা আমার নিজের মেয়ে নয়। শেষ কয়েকটা দিন আমার মনে হয়েছিলো, স্বামী সন্তান নিয়ে আমি যথেষ্ট সুখী আছি। আমার আর কাউকে চাওয়ার নেই। কিচ্ছু চাওয়ার নেই। দুনিয়ার সর্বোচ্চ সুখ আমি আমার এই ছোট্ট সংসারেই পেয়ে গেছি।
– সেই সংসার নিয়াই ক্যান থাকলি না চারু? ক্যান এইভাবে জীবনডা বিপদে ফেলতাছস? তোর বা সিফাত ভাইয়ের কিছু হইলে এই মাইয়াডার কি হইবো একবার ভাবছস?
– কেনো তুমি আছো না? তুমি দেখবেনা আমার মেয়েটাকে?
– অবশ্যই আমি দেখমু। কিন্তু মা-বাপের অভাব কি আদেও কেউ পুরন করতে পারে?
– এই লড়াইয়ে আমার জীবন যাবে এমনটা কেনো ভাবছো তুমি? হতে পারে আমরা বেঁচে গেলাম আর এই নরপিশা*চরা শাস্তি পেয়ে গেলো।
– সেইটা হইলে তো ভালোই হয়। কিন্তু তারা তো আর সাধারণ মানুষ না। তাদের শা*স্তি দেওয়া কি এতটাই সহজ?
– বাদ দাও তাদের কথা। ভালো লাগছেনা। তোমরা তো কিছুই করলেনা, এখন যা করার আমাকেই করতে হবে।
– কি করবি?
– সেইটা নাহয় তুমি না-ই জানলে। ভাবিকে একবার গ্রামটা ঘুরিয়ে দেখিয়ো তো। আমিই যেতাম কিন্তু সময় করতে পারছিনা।
– না আমি যামুনা। ওরে নিয়া যদি আমি রাস্তায় বের হই সবাই অবাক হইয়া তাকায়া থাকে। কেউ কেউ তো ওর গায়ের রঙ নিয়া কটু কথাও বলে। আমার খুব আত্মসম্মানে লাগে, আমার এমন কালো বউ।
– কালো কি আল্লাহ বানায় নি?
– বানাইবো না ক্যান? অবশ্যই আল্লাহ বানাইছে। সব মানুষের ভিন্ন রুচিবোধও আল্লাহই বানাইছে। আমার কালা পছন্দ না, এইটা তো আল্লাহরই দেওয়া।
– এইটা নিজের ব্যক্তিগত মনোভাব। যাক, সেসব বাদ দাও। তোমার মেয়েটা কিন্তু দারুণ মিষ্টি।
– হুম ঠিক বলছস। দেখলেই পরান জুরায়া যায়।
– এখন থেকেই রূপচর্চা করানো শুরু করে দাও। বড় হলে কিন্তু অনেক মেয়ে-ই কালো হয়ে যায়।
– রূপচর্চা করাইলে কি ন্যাচেরাল স্কিন থাকে নাকি?
– কালো হয়ে যায় যদি? তখন তো মেয়েকে তুমি ভালোবাসবে না। কালো মেয়ে কে ভালোবাসবে বলো?
– পাগল হইছস তুই?
– পাগল হওয়ার কি আছে? তোমার মেয়ে কালো হয়ে গেলে তোমার নিজেরও তার বিয়ে নিয়ে চিন্তা হবে। বিয়ের পর স্বামীর ভালোবাসা পাবেনা। বাবার বাড়ি এসে বাবার ভালোবাসা পাবেনা। এরচেয়ে ভালো এখন থেকেই রূপচর্চা শুরু করাও।
– মানে? কি কইতে চাইতাছস তুই? আমার মাইয়া কালো হইলে আমি তারে ভালোবাসমু না? ক্যান বাসমু না আজব! ও তো আমারই মাইয়া। গায়ের রঙের জন্য আমি আমার মাইয়ারে ফালাইয়া দিমু?
– ভাবিও তো তোমার বউ। তবে কালো রঙের জন্য তাকে কেনো অবহেলা করছো?
– তুই ওর সাথে আমার মাইয়ার তুলনা করতাছস?
– কেনো করবো না? তোমার মেয়ে যেমন তোমার কাছে আদরের, ভালোবাসার তেমনি ভাবিও তার বাবা-মায়ের কাছে আদরের।
– আরে ধুর, ওরে কেউই ভালোবাসেনা। বাপের বাড়ি গেলে দুইদিনও টিকতে পারেনা। ও থাকলেও কারোর কিছু যায় আসেনা, ও না থাকলেও কারোর কিছু যায় আসেনা।
– যায় আসে। ভাবি না থাকলে কারোর অনেক কিছু যাবে আসবে। এত ভেতরে যাচ্ছিনা আমি। তুমি নিজের মেয়েটাকে দেখো। মা ছাড়া একটা মেয়ে কতটা অসহায় তা তোমরা ছেলেরা কল্পনাও করতে পারবেনা। প্রতি পদে পদে সে বিপথে গেলেও তাকে ঠিক করার কেউ থাকবেনা।
– আমার মাইয়া আমারেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। মা না থাকলেও ও অনায়াসে আমার কাছে কোনো সমস্যা ছাড়াই থাকতে পারবো।
– সম্পূর্ণ ভুল ধারণা নিয়ে থাকছো তুমি। তোমার স্ত্রীকে তোমার প্রয়োজন না হলেও সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তোমার মেয়ের।
– আমার ব্যাপারটাও একবার দেখ। সব মানুষেরই নিজের বউরে নিয়া একটা এক্সপেকটেশন থাকে। আমারও ছিলো। আর স্বাভাবিক ভাবেই আমি সুন্দর বউ চাইছিলাম। হ্যাঁ, আমি যদি অসুন্দর হইতাম তাইলে হয়তো আমি এমন করতাম না। কিন্তু আমার তো কোনো দিক দিয়াই কম নাই, তবে আমি কি এমন কিছু ডিজার্ভ করি?
– সৃষ্টিকর্তাই উত্তর পরিকল্পনাকারী। তিনিই তোমার ভাগ্য ভাবির সাথে জুড়ে দিয়েছিলেন। তুমি নিশ্চয়ই তার চেয়ে বেশি বোঝোনা। হ্যাঁ এক্সপেকটেশন থাকতেই পারে। স্বাভাবিক, সবারই এক্সপেকটেশন থাকবে কিন্তু তাই বলে সে এক্সপেকটেশন যে পূরণ হবে তেমন তো কোনো কথা নেই। এই স্বাভাবিক বিষয়টা কেনো মানতে পারছো না তুমি?
– আমি তো চেষ্টা করতাছি। আমি কি কহনো কোনো কিছুতে তারে কষ্ট দিছি? ভালো খাইতে দেই, পড়তে দেই। সবই তো দেই।
– একটা মেয়ে তার স্বামীর কাছে শুধু খাওয়া পরার জন্য আসেনা। মানসিক শান্তিও চায়। ভালোবাসাও চায়। খাওয়া পরার অভাব হয়তো সে কষ্ট হলেও পূরণ করতে পারবে কিন্তু ভালোবাসার অভাব সে কখনোই পূরণ করতে পারবেনা। ভাবি হতে পারে কালো কিন্তু তার ভেতর যে স্বচ্ছ ভালোবাসাটা আছে, সেটা এই পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র ভালোবাসা। দুনিয়ার সব ভালোবাসা একত্রিত করেও তুমি সে ভালোবাসা কিনতে পারবেনা। অনেক সুন্দর মেয়ে তুমি বিয়ে করতে পারো কিন্তু তুমি যে ভালোবাসা পাবে তার নিঃশ্চয়তা নেই। এখন ভালোবাসা পাচ্ছো তাই অভাবটা অনুভব করতে পারছোনা। ভালোবাসা ছাড়া মানুষ কখনো বাঁচতে পারেনা।

★★★

সারা উঠোন জুড়ে পায়চারি করছে সিফাত। হাতে বেশ ভালো একটা মুঠোফোন তবে চোখেমুখে বিরক্তি। চারু অনেকক্ষণ যাবত লক্ষ্য করে যাচ্ছে তাকে। একপর্যায়ে আর সহ্য করতে না পেরে বলেই ফেললো,
– সমস্যা কি আপনার? সারা উঠোন জুড়ে এভাবে পায়চারি করছেন কেনো?
– পায়চারি কি সাধে করছি? নেটওয়ার্কের অবস্থা একেবারে যাচ্ছেতাই। কারোর সাথে যোগাযোগ হচ্ছেনা আমার।
– সেটাই কি স্বাভাবিক নয়? আপনি তো জানতেনই এখানে কোনোপ্রকার উন্নত প্রযুক্তি পৌছায়নি। উনিশ শতকের মতো গ্রাম।
– ছয় বছরেও এমন অবস্থা হবে সেটা ভাবিনি।
– গ্রামের উন্নতির চেষ্টাই করা হয়না, উন্নয়ন হবে কিভাবে?
– সবাই কোথায় বলুন তো। কাউকে দেখা যাচ্ছেনা।
– ভাইয়া ভাবিকে আর লতাকে নিয়ে গেছে গ্রাম দেখাতে। আর পুতুলের বার্গার খেতে ইচ্ছে করছে কিন্তু এই গ্রামের আশেপাশের কোনো গ্রামে বার্গার আছে কি না সন্দেহ। তাই হিমেল তাকে নিয়ে কোনো বার্গার স্টল খুজতে গেছে। হিমেল কতবার বলেছিলো, “তুমি বাচ্চা মেয়ে এতদুর যেতে হবেনা। তুমি এখানেই থাকো আমি নিয়ে আসবো।” কিন্তু মেয়ে তার কথা শুনলে তো। একপ্রকার কান্নাকাটি করে চলে গেলো।
– আজকাল মেয়েটা ভীষণ জেদি হয়েছে। এই রোদে কোথায় কোথায় ঘুরছে কে জানে!
– আপনি কিছু খাবেন?
– জোর করে থাকছি সেটাই কত, আবার খাওয়া দাওয়া। রাগ করবেন না?
– জোর করে আসুন আর যেভাবেই আসুন, আপনি এখন আমাদের মেহমান। মেহমানকে ক্ষুদার্ত রাখার মনোভাব আমার অন্তত নেই।
আপনি কি আমার উপর খুব বেশি রেগে আছেন বেলিফুল? মাফ কি করা যায়না? একটিবারের জন্যও কি আবার আপন করে নেওয়া যায়না?
– না।
– একটা প্রশ্ন করি?
– কি?
– আপনি কি এখনো শিহাবকে ভালোবাসেন?
চারু উত্তর দেয়না। স্বামীকে বলা যায়না সে অন্য পুরুষকে ভালোবাসে। অবশ্য ভালোবাসে বললেও হয়তো এখন ভুল হবে। সাধারণ কিছুটা অনুভূতিই অবশিষ্ট আছে তার প্রতি। এই মানুষটাই বোধহয় নিঃস্বার্থভাবে চারুকে এতটা ভালোবেসেছিলো। শাওনের ভালোবাসায় খাদ থাকলেও শিহাবের ভালোবাসায় ছিলোনা। শাওন তো পাওয়ার জন্য ভালোবেসেছিল আর শিহাব পাবেনা জেনেও ভালোবেসেছিলো,
– বলুন না বেলিফুল! এখনো ভালোবাসেন তাকে?
– আমি যদি এখন আপনার মন রক্ষার্থে না বলি তবে সেটা মিথ্যা হবে। তবে এটাও সত্য যে তার প্রতি অনুভূতি খুবই সামান্য। এই সামান্য অনুভূতি থাকলে কি খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে সিফাত? আমি আপনার জায়গা তাকে দেইনি কিংবা আপনাকেও তার জায়গা দেইনি। আপনারা দুজনেই আমার দু’রকম ভালোবাসা। আপনি আমার স্বামী, যার সাথে আমার আত্মার সম্পর্ক। হাজারো বাধা বিপত্তি আসলেও তা আমি অস্বীকার করতে পারবোনা আর শিহাব আমার কাছে খুবই সম্মানের একটা জায়গা। দুজন কখনোই এক নয়। দুজনকে যদি আমি দুই জায়গা থেকে ভালোবাসি তবে কি আপনার খুব বেশি অসুবিধা হবে?
– না হবে না। আপনার মনে যে এখনো আমার জন্য জায়গা আছে তাতেই আমি খুশি। তবে শিহাব যদি আবার আপনার কাছে ফিরতে চায় তবে আবার আমাক্ব রেখে চলে যাবেন না যেনো। আমি পুরোপুরি শেষ হয়ে যাবো। আপনি অন্য কারোর হতে পারেননা। আগে যা হবার হয়েছে এখন আপনার সবটুকু আমার। আমার বেলিফুলের এক বিন্দু ভাগও আমি কাউকে দেবো না।
– শিহাব অনেক ভালো কাউকে ডিজার্ভ করে। আমি তার যোগ্য নই। সে আবার আমাকে ফিরিয়ে নিতে চাইলেও আমি যাবোনা, যেতে পারবোনা। ব্যাস আমার এখন সুন্দর একটা সংসার আছে। একটা ছোট্ট মেয়ে আছে। তাকে ছেড়ে কোথাও যাওয়ার মতো দুঃসাহস আমি করবো না। আমার সংসারেই আমি বেশ আছি।
– স্বামীও কিন্তু আছে।
চারু উত্তর দেয়না। চোখ বন্ধ করে কিছু একটা ভেবে আবার রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতেই সাজিদ আষ্টেপৃষ্টে তাকে জড়িয়ে ধরে,
– আর কতদিন আপনি রেগে থাকবেন আমার উপর? দুনিয়ার সবার ভালোবাসা আপনার চোখে পড়ে শুধু আমার ভালোবাসাটাই আপনার চোখে পড়েনা তাই না? আমি কিন্তু ভীষণ রকমের জেলাস নিজের জিনিসের প্রতি৷ আপনি অন্য কাউকে ভালোবাসেন সেক্ষেত্রে আমি কিছু করতে পারবোনা। পারলে হয়তো আপনাকে তাকে ভালোবাসতে দিতাম না। এখন সেটা যেহেতু আমার হাতে নেই তাই আপনি আমাকে প্রচুর ভালোবাসবেন। এতটাই ভালোবাসবেন যেনো অন্যদের ভালোবাসা তার কাছে ফিকে হয়।
– ওমনি আমি জিনিস হয়ে গেলাম?
– হুম হয়ে গেলেন। আপনি আমার জিনিস। শুধুই আমার জিনিস।

★★★

– আপনি এইখানে? কেমন আছেন?
মিহি সুরেলা একটি নারীকণ্ঠ পেয়ে পেছনে ফিরে তাকালো হামিদ। হামিদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে বিন্দিয়া। বিন্দিয়াকে দেখে কিছুটা রাগ হলো হামিদের। একটা মানুষ কতটা ব্যক্তিত্বহীন হলে বিবাহিত জেনেও একটা ছেলের পিছু এভাবে করতে পারে।
– ক্যান? আমার কি এইহানে আসা মানা?
– না মানা হইবো ক্যান? আমি তো এমনেই জিজ্ঞেস করতাছিলাম এইহানে কি করেন।
– আমি কই যামু, কি করমু তার অনুমতি নিশ্চয়ই আমি তোমার থেইকা নিমু না।
হামিদের এই কঠোর উত্তরে কিছুটা দমে যায় বিন্দিয়া। হামিদের এহেন আচরণের উদ্দেশ্য উদঘাটন করতে পারেনা সে।
– আপনি এমন করতাছেন ক্যান আমার সাথে?
– আমি তোমার সাথে কিছুই করি নাই। যেই কাজে আসছো সেই কাজ করে বাসায় যাও। যার তার আদিক্ষেতা আমার পছন্দ না।
– আমি অদিক্ষেতা করতাছি? আপনে বুঝেন না আমি এমন ক্যান করি?
– না বুঝিনা।
– ক্যান বুঝেন না? আপনেরা দুই ভাই-বোন এমন ক্যান? ক্যান আপনেরা অন্যের অনুভূতি বুঝেন না তার মূল্য দিতে পারেন না?
– তোমার অনুভূতির মানে থাকলে নিশ্চয়ই দাম দিতাম। দামহীন অনুভূতির মর্যাদা দিতে গেলে নিজেরেই ছোট হইতে হয়।
– আমি ভালোবাসি আপনেরে। নিজের সবটা দিয়া সবসময় ভালোবাসছি তয় ক্যান আপনে আমার অনুভূতির দাম দিবেন না?
– কারণ আমার বউ, বাচ্চা আছে।
– তো আপনের কালা বউরে ছাইড়া দেন। আর না ছাড়তে চাইলে না ছাড়েন একটা মানুষের কি দুই বউ থাকেনা?
– পাগল হইছো তুমি?
– পাগল হওনের কি আছে? ফাতেমা ভাবি তো এমনেই কত কালা। আপনেরও সুন্দর বউ পাওনের অধিকার আছে। তাছাড়া আমি তো তারে ছাইড়া দিতে কইতাছি না। আপনের পায়ের এক কোনায় আমারে দয়া কইরা ঠাই দেন।
– বাজে কথা কইবা না। এইটা কোনোদিনও সম্ভব না।
– ক্যান সম্ভব না? আমাগো ধর্মও তো পোলাগো চার বিয়ার সুযোগ দিছে। আপনে তো খালি দুইটা বিয়াই করবেন।

★★★

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। বাইরের চৌকিটার একপাশে বসে আরাম করে বার্গার খাচ্ছে পুতুল। চারিদিকে হাওয়া বইছে। প্রকৃতি দেখলেই অনুমান করা যায় কিছুক্ষণ পর বড়সড় ঝড় হবে। চৌকির অপরপাশে বসে আছে হিমেল আর হিমেলের মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসে আছে চারু। হিমেলের হাতে একটি পুরোনো খাতা। খাতাটি দেখেই চারু বুঝতে পারলো এটি মাস্টারমশাইয়ের খাতা। ছোটবেলায় এই ধরনের খাতাতেই মাস্টারমশাই সকলের নাম, পরিচয় লিখে রাখতো কিন্তু এই খাতা হিমেলের কাছে কেনো?
চারুকে অবশ্য প্রশ্ন করতে হলোনা,
– তোমার মনে নিশ্চয়ই প্রশ্ন জাগছে, এই পুরোনো খাতাটা আমার কাছে কেনো?
– প্রশ্নটা যখন জানেন তখন উত্তরটাও বলে দিন।
– স্কুলে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ চলছিলো। কোনো কাজ ছিলোনা বলে এমনিই এটা সেটা ঘাটাঘাটি করছিলাম, তার মধ্যে এই খাতাটায় আমি ভয়ানক একটা জিনিস জানতে পেরেছি চারুলতা।
– তথ্যটা পরে শুনবো আগে আপনি বলুন, আপনাকে এইগুলো ধরতে দেওয়ার কথা নয়। আপনি কিভাবে এসব এত সহজে ঘাটাঘাটি করলেন?
– মাস্টারমশাইকে তোমার কথা বলতেই তিনি আর কিছু বলেননি।
– ঠিক আছে। এখন বলুন কি জানলেন?
– আগে তুমি বলো শিহাবের নাম কি?
– মানে?
– মানে শিহাবের সম্পূর্ণ নাম কি?
– সেটা তো জানিনা।
– তাহলে তুমি এইটা দেখো।
চারু খাতাটা নিতেই গোটা গোটা অক্ষরে চোখ পড়লো একটা নামে, “শিহাব আজমীর অভি” পিতার নাম, আনন্দমোহন আজমীর রহিম।
চারু থমকে গেলো। এই গ্রামের জমিদারের নাম আনন্দমোহন আজমীর রহিম, আর তারই বড় ছেলে শিহাব। চারু স্তব্ধ হয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নামটির দিকে। এইটা কি শুধুই কাকতালীয়? চারুর মনে হচ্ছে প্রকৃতির ঝড়ের চেয়েও বড় ঝড় বয়ে যাচ্ছে ওর বুকে।

বিঃদ্রঃ আমি বাসায় নেই। বাসার বাইরে অন্যকোথাও লেখালেখি করা কতটা কষ্টের সেটা এক লেখিকাই জানে। একেবারেই লেখার স্পেস পাইনি। রিচেকও হয়নি। কষ্ট করে লিখেছি, তাই যারা পড়ছেন সবাই প্লিজ রেসপন্স করবেন।😇

_______________________

To Be Continued…
®শুভ্রা আহমেদ প্রিয়া

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here