অন্তর্লীন_প্রণয় পর্ব-০৯
সাদিয়া মেহরুজ দোলা
খোলা আকাশের নিচে দু’হাত মেলে দাঁড়িয়ে আছে আয়ন্তিকা। চোখজোড়া বন্ধ তার। অধরের যুগলের মাঝে স্নান হাসি বিদ্যমান। ঠিক এমন এক চমৎকার দেখতে স্থানেই তো আসতে চেয়েছিলো সে! চোখ খুলে সামনে তাকাতে চারিপাশে অন্ধকারে নিমজ্জিত দেখে সে। তবুও যেন এক রকম প্রশান্তি আছে এতে। একমুঠো ভালোলাগা রয়েছে পূর্ণ রূপে।
অহর্নিশ আয়ন্তিকার হতে অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে। ইহান, সারা, অয়ন, নুশি তার পাশে বসে আড্ডাতে মশগুল। কিন্তু অহর্নিশের সেদিকে কোনো ধ্যান নেই, সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আয়ন্তিকার দিকে। ইহান তা খেয়াল করা মাত্রই টিটকারি মেরে বলল,
-‘ আমাগো অহর্নিশ যে দিনকে দিন বউ ছাড়া আর কিছুই বুঝতেছে না! কাহিনি কিন্তু ভালা না অয়ন।’
অহর্নিশ এবার সটান হয়ে বসলো।ইহানের বর্তমান বলা কথাটি তার মোটেও ভালো লাগেনি।ভ্রু যুগল কুঁচকে নিয়ে ও ইহানকে বলল,
-‘ থাপ্পড় চিনোস? ডাইরেক্ট কানের নিচে লাগাবো। ‘
তদ্রুপ অয়ন কথার মধ্যিখানে ফোড়ন কেটে বলল,
-‘ থাপ্পড় কেন? সত্যি কথা কইলেই দোষ না?’
-‘ কোনটা সত্যি কথা?’
-‘ এইযে, পিচ্চি বাচ্চা বউরে ছাড়া যে তুমি আর কিছুই বুঝো না দিন দিন। তা কি সত্যি না?’
ইহান উঠে এসে বসলো অহর্নিশের পাশে।শার্টের কলারে হাত লাগিয়ে নিয়ে একটু আধটু ঠিক করে নিলো। অতঃপর কর্কশ কন্ঠে বলল,
-‘ এই তোর শরম করে নারে? বুড়া হইয়া এতো ছোট মাইয়ারে বিয়া করস। ছিহ্! ‘
নীরবতা ভূমিকা পালন করা সারা এবার প্রশ্নোত্তর সুরে বলল,
-‘ কথা সেটা না গাইজ! কথা হচ্ছে, অহর্নিশ তুই সাফিয়া কে আঁটকে রেখেছিস কেনো? এটা যে মিডিয়া পর্যন্ত চলে গেছে জানিস? কেও যদি জানে তুই ওকে কিডন্যাপ করেছিস তাহলে তোকে ওরা জেলে পাঠাবে। বুঝতে পারছিস? ‘
অহর্নিশ তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
-‘ আমাকে জেলে পাঠাবে?লাইক রিয়েলি?হাউ ফানি! সাফিয়া কে আঁটকে রাখার কোনো শখ নেই আমার মধ্যে। ঐ মেয়ে আয়ন্তিকা কে মেরে ফেলার প্লান করছিলো। ইমাজিন করতে পারছিস?জানে মেরে ফেলার ফাঁদ পাতছিলো ও। এতো সহজে ছেড়ে দিই কি করে?অহর্নিশের ব্যাক্তিগত সম্পদে হাত বাড়ানোর সাহস ঘুচিয়ে দিবো। পূর্ণ শাস্তি না দেয়া অব্দি ওকে ছাড়ছিনা আমি। ‘
এবার নুশি কথা বলার জন্য প্রস্তুতি নেয়। হতাশার সুরে ও বলল,
-‘ ব্যাক্তিগত সম্পদ? হাহ্! আয়ন্তিকার প্রতি এতো পিরীতি দেখাইতেছিস যে? ভুলে যাসনা জাষ্ট একটা এগ্রিমেন্ট, একটা মিস্ট্রি সলভের জন্য তুই ওকে বিয়ে করেছিলি। এখন এসব আলগা পিরীতি দেখাস কিভাবে? ‘
সারা, অয়ন ইহান বিস্ফোরিত চাহনি নিয়ে নুশির দিকে দৃষ্টিপাত নিবদ্ধ করে। বিষ্নয়কর চাহনি তাদের তিন জনের! একই সাথে তারা বলল, ‘হোয়াট? কি বলিস এসব?’
বন্ধুমহলের আড্ডা ছেড়ে তৎক্ষনাৎ উঠে চলে যায় অহর্নিশ। যাওয়ার আগে কড়া দৃষ্টিপাত সে নুশির দিকে স্থাপন করে গিয়েছে। তাতে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়েছে নুশি। মানুষ কতটা নিম্নমানের হতে পারে তা তার দেখা হ’য়ে গেছে। এক পর্যায়ে নুশিও কাওকে আর কিছু না বলে উঠে চলে যায়। ভালো লাগছে না তার কিছু। সবকিছু বিরক্তিকর, তিক্তময় লাগছে তার কাছে। তিক্ত কাঁটায় পূর্ণ চারিপাশ।
সারা, অয়ন, ইহান ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কিছুই বুঝলো না। একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করার এক পর্যায়ে ইহান বলল,
-‘ কি ছিলো এটা? নুশি এইটা কি বলল?’
________________________
আশপাশ বেশ মনোযোগী দৃষ্টি দিয়ে গহীন চোখে পরখ করছিলো আয়ন্তিকা। ঠিক তখনি তার পাশে এসে দাঁড়ায় অহর্নিশ। অহর্নিশের চেহারা কালো করা। আঁধার নেমেছে যেনো। কি কারণে অহর্নিশ এমন চেহারা বানিয়ে রেখেছে? তা আয়ন্তিকার জানার ইচ্ছে জাগ্রত হলেও জিজ্ঞেস করার মতো অনুপ্রেরণা পেলোনা নিভৃত হতে! তাই সে চুপ রইল।সামনের দিকে পা যুগল ফেলে এগোতে নিতেই ‘উহ্’ করে উঠলো সে!
অহর্নিশের অস্থিরতা মিশ্রিত দৃষ্টি। ব্যাকুল কন্ঠে সে বলল,
-‘ আর ইউ ওকে?’
আয়ন্তিকা চোখ মুখ কুঁচকে ব্যাথা মিটিয়ে নেয়ার প্রয়াস চালায়। মুখ দিয়ে সে অস্ফুটস্বরে বলল,
-‘ ঠিক আছি আমি। কিছু হয়নি আমার। একটু ব্যাথা পেয়েছিলাম জাষ্ট। ‘
অহর্নিশের অস্থির মন আয়ন্তিকার কথাটা গ্রহণ করতে পারলো না। তার বিশ্বাস হলো না। তাই সে নিচু হয়ে বসে পড়লো। আয়ন্তিকার পা টেনে দেখে এক নির্দিষ্ট জায়গাতে লালচে রূপ ধারণ করছে। কিছুটা দূরেই পড়ে আছে ইটের এক সুক্ষ্ম কোণা। সেই ছোট ইটের টুকরোটাই যে আয়ন্তিকার আঘাত পাওয়ার উৎস তা বুঝতে বেগ পেতে হলো না তার।
অহর্নিশ এবার মাথা উঁচু করে দেখলো আয়ন্তিকা চোখ মুখ কুঁচকে নিয়ে পাশের বাশটা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। অহর্নিশ ব্যাঙ্গাত্বক সুরে বলল,
-‘ ব্যাথা পাওনি তুমি তাই না?’
আয়ন্তিকার নিভৃতে হতে এবার শব্দফালি এলো
‘ধরা পড়ে গেছিস তুই আয়ন্তিকা। ‘ শুষ্ক ঢোক গিলে আয়ন্তিকা আমতা আমতা করে বলল,
-‘ ইয়ে মানে… পেয়েছি। অতোটা না। এখন ব্যাথা করছে না আর। আপনি প্লিজ পা ছাড়ুন। চারপাশে সবাই দেখছে। উঠে দাঁড়ান আপনি। ‘
অহর্নিশ উঠে দাঁড়ালো ঠিকই। তবে সে এবার আয়ন্তিকা কে চমকে দিয়ে তাকে কোলে তুলে নিলো। শক্ত করে জরীয়ে নিয়ে হাঁটা শুরু করল সে।
আয়ন্তিকার বিষ্ময়কর দৃষ্টি। চমকিত পানে সে তাকিয়ে আছে অহর্নিশের মুখশ্রীর দিকে। অহর্নিশ সামনে আগায়। উদ্দেশ্য তার সামনের হোটেলটি। তারা যে স্থানটিতে এসেছিলো তার ঠিক পাঁচ মিনিট ব্যাবধানে একটা হোটেল রয়েছে। হোটেলটা মূলত পর্যটকদের বিশ্রামের জন্য বিশেষ করে তৈরি করা।
আয়ন্তিকা চারিপাশে তাকিয়ে ইতস্তত বোধ করে বলল,
-‘ সমস্যা কি আপনার? হুটহাট উদ্ভট কাজ করার রোগ আছে আপনার?’
অহর্নিশ আঁড়চোখে তাকায় আয়ন্তিকার দিকে। পরবর্তীতে সে সামনে দৃষ্টি দিয়ে বলল,
-‘ এই পা নিয়ে তুমি হাঁটতে পারবে?’
-‘ পারবো না কেনো সেটা বলুন। অতি স্বল্প আঘাত ছিলো। এই আঘাতে হাঁটতে না পারার কি আছে?’
অহর্নিশ আয়ন্তিকার বলা বর্তমান কথার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বলল না। আয়ন্তিকা কি বুঝবে তার মনের অবস্থা? এই পিচ্চি আয়ন্তিকার হালকা, অতি সামান্য আঘাত লাগলেও যে আজকাল অহর্নিশের পাগল পাগল লাগে। অনুভূত হয় সে নিজে আঘাত পেয়েছে। অথচ পলিটিক্স করার সুবাদে প্রায়ই একটু আধটু আঘাত প্রাপ্ত হয়েছে সে।তখনকার ব্যাথাগুলো নিছকই তার কাছে নগ্ন মনে হয়। কিন্তু আয়ন্তিকার হাতে হালকা করে একটু গুতো লাগলেও তার কেমন অস্থির অস্থির লাগে।
প্রায় অনেকক্ষণ পর অহর্নিশ তার অধর যুগল প্রসারিত করে বলল,
-‘ দেখে চলতে পারো না? আজ সাবধানে চলাফেরা করলে তো এই আঘাত টা লাগতো না। যদিওবা বাচ্চা বলে কথা। টিনেজারদের কৌতূহল, ছটফট করার স্বভাবটা বেশিই থাকে। ‘
শেষোক্ত কথাটা কিছুটা ব্যাঙ্গ করে বলল অহর্নিশ। আয়ন্তিকা অহর্নিশের মুখশ্রীর প্রতি গহীন চোখে তাকায়। সে এবার সাহস নিয়ে কর্কশ কন্ঠে বলল,
-‘ তো আমায় বিয়ে করেছেন কেনো হ্যা?অদ্ভুত! পূর্ণ বয়সের কাওকে বিয়ে করলেই পারতেন। বর্তমানে আপনাকে আমায় নিয়ে যে ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে তাও করতে হতো না। অযথাই আমার মতো বাচ্চা কে বিয়ে করে এখন আমাকে খোঁটা দিচ্ছেন। ‘
আয়ন্তিকার কন্ঠস্বর খানিকটা উঁচু হওয়াতে আশপাশের কয়েকজন মানুষ তাদের দু’জনের দিকে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছে। এতে করে লজ্জায় পড়ে যায় আয়ন্তিকা। তার এখন নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারা এমন ফিলিং’স জাগছে মনে।
আয়ন্তিকার অবস্থা দেখে ঠোঁট বাকিয়ে হেঁসে দেয় অহর্নিশ। ডান ভ্রু উঁচু করে সে বলল,
-‘ পিচ্চি বাচ্চাকে বিয়ে করলে লাভ বেশি ইউ নো? এরা হয় জেলির মতো সফট! আদর করতে ইচ্ছে করে সর্বদা। টিনেজার হওয়াতে বেশিরভাগই ভীতু প্রকৃতির হয়। তাই তাদের কে নিজের আয়ত্তে রাখা যায়। বড়দের বিয়ে করলে লাভ নেই।এরা হ্যাজবেন্ড দের ভয় পায়না।নিজেদের মর্জিতে চলে। ধমকালে উল্টো ধমক দিয়ে বসে। যদিও সবাই না।কিছু কিছু! তবুও রিস্ক নেয়ার কোনো মানে হয়? তোমাকে বিয়ে করার মেইন কারণটা হচ্ছে তোমাকে দেখলেই জাষ্ট আদর করতে ইচ্ছে করে। এই যে কোলে নিয়েছি। আমার তো মনে হচ্ছে কোনো তুলতুলে বস্তু আমার কোলে। একটা চুমু খাই?’
আয়ন্তিকা কিংকর্তব্যবিমুঢ়!লাজুকলতা রূপ ধারণ করেছে সে। দুই ওষ্ঠদ্বয়ের মাঝে ব্যাবধান তৈরি করে সে হা করে তাকিয়ে আছে অহর্নিশের দিকে। তার নিভৃত হতে বারংবার বলছে, এটা কে? অহর্নিশ তো? নাকি অহর্নিশ রূপে অন্য কেও? তবে আয়ন্তিকা নিশ্চিত হলো এই লোক অহর্নিশ হতেই পারে না। তার ভয়ংকর মানব তো ছিলো ভয়ংকর স্বভাবের। গাম্ভীর্যের অধিকারী। আর ইনি তো…
আয়ন্তিকা অবিশ্বাস্য চাহনি দিয়ে বলল,
-‘ আপনি কে?আ..আপনি ঠি..ঠিক আছেন?’
স্ব- শব্দে হেঁসে দেয় অহর্নিশ। সে জানতো আয়ন্তিকা এমন কিছুই তাকে জিজ্ঞেস করবে। প্রতুত্তরে অহর্নিশ বলল,
-‘ আমি তোমার একমাত্র হ্যান্ডসাম বর। ভুলে গেছো? পায়ে আঘাত পেয়ে সৃতিশক্তি চলে গেলো কিভাবে? স্ট্রেঞ্জ! ‘
আয়ন্তিকা থতমত খায়। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না এটা অহর্নিশ। পদে পদে সে অহর্নিশ এর কথায় অবাকের চূড়ান্ত সীমা অতিক্রম করছে। তৎক্ষনাৎ
আয়ন্তিকার মনে পড়লো সারার কথা। সারা বলেছিল অহর্নিশ হাস্যরসক মানুষ, গাম্ভীর্যপূর্ণ স্বভাবের নয়। তবে কি তাই সত্যি? এতোদিন ভুল ধারণা নিয়ে ছিলো সে?
হাঁটার পথে অহর্নিশের অবলোকন হয় আয়ন্তিকার ওষ্ঠযুগল! বাঁকা হাসি দেয় সে। নিজের ইচ্ছে কেনো অপূর্ণ রাখবে? যেখানে এই পুরো মানুষটাই তার। টুপ করে জনমানবের দৃষ্টি এড়িয়ে লিফট এ উঠে সে আয়ন্তিকার খয়েরী বর্ণের ঠোঁটে শব্দ করে একটা চুমু খায়। প্রথম চুমু খেয়ে মাথা উঁচু করে খানিক বাদে ফের সে মাথা নিচু করে দ্বিতীয়বার একই কাজ করে। পরবর্তীতে অহর্নিশ সটান হয়ে সামনের দিকে দৃষ্টিপাত নিবদ্ধ করে নেয়। অদ্ভুতুরে হাসি তার অধর কোণে বহাল!
চলবে…
#সাদিয়া_মেহরুজ_দোলা
#দ্র: গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম। নাইস, নেক্সট না লিখে আজ গঠনমূলক মন্তব্য করার চেষ্টা করবেন। রিকুয়েষ্ট এটা! গল্পটা যারা যারা পড়ছেন তাদের সবাইকে আজ দেখতে চাই। সাইলেন্ট পাঠক পাঠিকাদের ও। লেখনীতে কোনো ভুলত্রুটি থাকলে তা ধরিয়ে দিবেন। শুধরে নেয়ার চেষ্টা করবো আমি। ভালোবাসা অবিরাম।