#টিট_ফর_ট্যাট
#Alisha_Anjum
#পর্ব_১৭
ব্যাস্ততার অস্তিত্ব প্রতিটি মানুষে ছেয়ে গেছে। কোরবানির পশু জবাই করে সব কার্য সম্পাদন করে বাড়ির ছেলেরা বাড়িতে পৌছেছে তিনটার নাগাদ। নীরবের শার্টে রক্ত লেগেছিল। তা বহু যুদ্ধ করে ধুয়ে পরিষ্কার করেছি। নীরব তখন বেঘোরে ঘুমোয়। আমিও ঘুমোতে চেয়েছিলাম কিন্তু আপন শাশুড়ি, চাচি শাশুড়ি কাজে লাগিয়ে দিয়েছিল। এখন মাংস ধুয়ে পরিষ্কার করেছি। এরই মধ্যে বাড়িসুদ্ধ জোয়ার উঠেছে বিয়ে নিয়ে। আজই নাকি বিয়ে পরানো হবে। আজ রাতেই হৃদ আর সুধার বিয়ে। বুঝলাম না বিষয়টা! আমার জানা তথ্য অনুযায়ী ঈদের দু’দিন পর বিয়ে হওয়ার কথা। হঠাৎ কি হলো?
— ভাবি? আপনি উঠুন আমি মাংস ধুই। আপনার হয়তো অভ্যাস নেই কষ্ট হচ্ছে।
আমার চিন্তার মাঝেই এমন স্নেহ বাণী। বুকটা ভরে গেলো। সম্মুখে তাকিয়ে দেখি সুধা মেয়েটা দাড়িয়ে আছে। মুখে অত্যন্ত মায়াময় হাসি। স্যামবরণ মুখটায় মায়ার ছোটাছুটি। এ মেয়েটাকে আমার বেশ লাগে। তার চোখের মায়ায় আমি মেয়ে হয়েও মুগ্ধ হই।
— না না। কষ্ট কি? আপনি যান। মেহেদী লাগাবেন না হাতে? আজই তো বিয়ে হবে।
আমার কথার নিমিত্তে সুধা খোলা আকাশের নিচে টিউবওয়েলের হাতল চাপতে চাপতে বলল
— আর জায়গাই নেই হাতে। কাল ঈদের জন্য হাতের চার পিঠেই মেহেদী লাগিয়েছি।
আমি বড় পাতিলটা থেকে মাংস ধুয়ে অন্য পাতিলে রাখছিলাম। সুধার কথা শুনে মুচকি হাসি নিয়ে চাইলাম তার দিকে। সে টিউবওয়েল ছেড়ে বসলো মাংস ভর্তি পাতিলের কাছে। আমায় ঠেলে উঠিয়ে দিতে দিতে বলল
— আপনি ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হন। আপনাকে দিয়ে এ কাজ হবে না। পারবেন না, জান।
আমি লজ্জা মিশ্রিত এক কৃতজ্ঞতার হাসি দিলাম। আমি যে একটা নিষ্কর্মা তা এই মেয়েটা বুঝে গেছে। সত্যি বলতে মাথার উপর খেলা আকাশ। তার থেকে আসা কড়া সূর্যের আলোয় আমার অবস্থা রফাদফা। কখনো মাংস ধোয়ার আশেপাশেও যাই নি। মা চাচিরা সব কাজ করেছে। আমায় কাজে ডাকলে নানান অজুহাত দিয়ে আমি নাই। কিন্তু সুধা অনেক ভালো একটা মেয়ে। ও শহুরে এবং গ্রামীণ দুই পরিবেশেই বসত করা মেয়ে। বাবার ঢাকা বিশাল ব্যাবসা আর মায়ের এখানে গ্রামীণ জীবন। সে দু’টোই উপভোগ করে। অহংকারের ছিটেফোঁটাও আমি তার মধ্যে দেখিনি।
— ভাবি আপনি ঘরে যান। ঘেমে তো শেষ আপনি। আমার ঘরে এসি লাগানো আছে। চাইলে আমার ঘরে গিয়ে বসতে পারেন।
কথাটা বলে সুধা খুব টিপটাপ করে আবার কাজে মনোযোগী হলো। আমি অস্তিত্বে পরলাম। যাওয়া কি ঠিক হবে? বিয়ের কণে এভাবে কাজ করছে! আমার আকাশ ছোঁয়া অস্তিত্ব আর সমুদ্র পরিমাণ ভাবনার মাঝেই হঠাৎ ডাক এলো। নীরব বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাকাতেই সে হাতের ইশারায় ডেকে উঠলো আমায়। আমি আর এক সেকেন্ড অপচয় না করে দৌড়ে চলে গেলাম স্বামীর নিকট। নীরব চলে গেলো ঘরে। আমি তার পিছু পিছু হেঁটে পৌছালাম রুমে। নীরব গায়ে পাঞ্জাবি চাপাতে চাপাতে বলল
— আমি যাচ্ছি। দই আনতে হবে। আজ রাতেই বিয়ে। তুমি সাবধানে থেকো।
— আজই কেন বিয়ে? আত্নীয়রা আসবে কখন? বিয়ে না দুদিন পর হওয়ার কথা ছিল।
নীরব নীল পাঞ্জাবির হাতা গুটাতে গুটতে জবাব দিলো
— ভাইয়ার পরশু দিন ব্যাংকের একটা ভাইবা আছে। তাই চাইছে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়েটা করে চলে যাবে।
হৃদের সম্পর্কে এমন তথ্য শুনে বেশ অবাক হলাম। সে নাকি ব্যাবসা করবে? বিন্দু বিন্দু কৌতুহল মনে জরো হলো। তবুও আগ্রহ দেখিয়ে শুধানোর প্রয়োজন বোধ করলাম না। ভাবনা ছেড়ে নীরবকে পরিপাটি হতে সাহায্যে লেগে পরলাম। জুতো জোড়া পরিষ্কার করে রুমের দরজায় রাখলাম। নিজের পরিবর্তনে নিজে লজ্জায় লালও হলাম। হঠাৎ দুদিন হলো স্বামী সেবায় আমি নিয়োজিত হয়ে গেছি। বাহ! নীলিমা অনেক কাজ শিখে গেছে।
— এই নীলিমা আমার ঘড়িটা কোথায়?
নীরবের ডাক। আমি তড়িঘড়ি করে চলে গেলাম তার কাছে। তোলপাড় করে খুঁজতে লেগে পরলাম। বহু কষ্টে খুঁজে পেয়ে তার দিকে নজর করতেই পিলে চমকে উঠলো আমার হৃদয়। নীরবের মুখ থমথমে। চোখে মুখে ছটফটে ভাব। মনটা আমার নিমেষেই কু ডেকে উঠলো। আস্তে করে ডেকে উঠলাম তাকে
— কিছু হয়েছে?
নীরব যেন আনার প্রশ্নে নতুন করে হুঁশে ফিরলো। চোখের মণি অস্থির চিত্তে রেখে সে মুখে জোর করে টেনে আনলো হাসি। মুখে বলল
— নাহ, কিছু না।
— ভালো লাগছে না?
আমি শান্ত ধীর কন্ঠে প্রশ্ন করলাম। নীরব থমকে গেলো। তার মুখে নেমে এলো মুষড়ে পরা অভিব্যক্তি। ভেতরটা আমার দুমড়ে মুচড়ে যেতে লাগলো। স্বামীর সঙ্কট জনক বদন কি এভাবেই পোড়ায় সকল স্ত্রীর বুক? এই একটা মানুষের ‘মন ভালো’ না বিষয়টা যেন আমার সব প্রশান্তি কেড়ে নিলো।
— ভালো লাগছে না নীলিমা। মনের মধ্যে যেন কোনো শান্তি নেই আমার।
কথাটা বলে নীরব ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলল। আমার হাত পা যেন অবশ হয়ে গেলো। কি হয়েছে তার? সুন্দর মুখটা চুপসানো। একটুও মানাচ্ছে না। আমি অভিমানে ঝড়ে পরা কন্ঠ নিয়ে বললাম
— এমন করে থাকবেন না তো। কিচ্ছু হয়নি আপনার। শুধু শুধু কেমন মুখ করে আছে।
আমার কথায় নীরব নিঃশব্দে হাসলো। উহু! আজ মন না দুলিয়ে সেই হাসি দুঃখের সুর বাজালো আমার মনে। কেমন নিরস সেই হাসি। আগের মতো জীবন্ত নয়। নীরব হাসি মুছে আমার দুই বাহু আলতো করে ধরলো। আমার আঁখিতে আঁখি রেখে গভীর কন্ঠে বলল
— নীলিমা ভীষণ ভালোবাসি তোমায়। আমি এপাড়ে এবং ওপাড়ে শুধুই তোমাকে চাই। তোমার এই হাতটা ধরেই আমি একসাথে পুলসিরাত পারি দিতে চাই। দুজনে মিলে একটা জান্নাত চাই।
কথাগুলো পলকহীন তাকিয়ে বয়ান করে নীরব প্রস্থান করলো আমার সম্মুখ হতে। আমার বুকের মাঝে তুলে গেলো হাহাকারের রব। আমি ঠাঁই দাড়িয়ে রইলাম। তার ঘড়ি আমার হাতেই রয়ে গেলো। স্বামীর সব কথা, অভিপ্রায় আমার মন একটুও বুঝলো না। অবুঝের মতো শুধু তাকিয়ে রইলাম হাতের নিস্তেজ ঘড়িটার দিকে। হঠাৎ উনি এমন কথা কেনো বললেন? তার মুখে আমি কখনো এমন আবেগের সুর শুনিনি। অশান্ত মন নিয়ে বেশিক্ষণ থাকতে পারলাম না ঘরে। ছুটে বেড়িয়ে গেলাম নীরবের উদ্দেশ্যে। উঠোনে আসতেই চোখে পরলো নীরব আর মাকে। আঁচলে ঘাম মুছে দিচ্ছেন খুব যত্নে। নীরবের মুখে তবুও সজীবতার বড় অভাব। পাশে বেশ কিছু মহিলারা ছিল। মুখে সকলের ঝলমলে হাসি। ইয়ার্কি তামাশায় মসগুল। বলছে কেউ কেউ, “ছেলে এতো বড় হয়ে গেছে এখনো মায়ে মনে তুলে খাওয়ায়”। শাশুড়ি মা শুধু হাসছেন। নীরব মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে যেতে লাগলো। অযাচিত কারণে আমিও যেতে লাগলাম তার পিছু পিছু। এমন সময় হঠাৎ দেখি জেরিন সাজ সজ্জা করে পরিপাটি হয়ে বেরোচ্ছে। আচমকা বুকের ভেতরটা ধ্বক করে উঠলো। ও কোথায় যাবে? চটজলদি হেঁটে জেরিনের পিছু নিলাম। বাড়ির বাইরে একটু খোলা, নির্জন জায়গায় আসতেই হুট করে চেপে ধরলাম জেরিনের হাত। সে বুঝি চমকে উঠলো। পেছন ফিরে তাকাতেই আমি তাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করলাম
— কোথায় যাচ্ছেন আপনি?
জেরিনের মুখ শুকিয়ে গেলো। বিবর্ণমুখে বলল
— তোমাকে কৈফিয়ত দিতে হবে নাকি।
— আলবাত দিতে হবে। আপনি নীরবের পিছনে কেন যাচ্ছেন?
— ওকে মারতে। তোমাকে বলেছিলাম না সে আমার না হলে আমি অন্য কারো হতে দেবো না। তোমার উপর সে ভীষণ আসক্ত।
কথাটা বলেই জেরিন ঝাড়ি দিয়ে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। ভীষণ রাগ হলো আমার। সে হাঁটার জন্য একপা এগুতেই আমি ল্যাং মারে দিলাম। আচমকা চলতে বাঁধা পেয়ে সে পরতে পরতে সম্মুখের গাছের সাথে আঘাত পেলো। শক্ত, মোটা গাছ কপালে লেগে ঠাস করে শব্দ হলো। জেরিনের মুখ থেকে বেরিয়ে এলো মৃদু ব্যাথাতুর ধ্বনি। চোখে আমি অপরিসীম রাগ নিয়ে বললাম
— একবার যা বলেছেন দ্বিতীয় বার তা মুখেও আনার সাহস করবেন না। আমার নীরবের দিকে চোখ তুলে তাকালেও চোখ তুলে নেবো আমি। আমি ওয়ার্নিং দিচ্ছি আপনাকে। খুব খারাপ হবে কিন্তু। আমার প্রাণের চেয়েও বেশি প্রিয় আমার স্বামী।
কথাগুলো বলে ভুলের কোনো স্থান রাখলাম না। তার হতটা ধরে টেনে হিঁতড়ে নিয়ে যেতে লাগলাম রুমে। ওকে দরজা দিয়ে বন্দিই করে রাখবো আমি। কোন সাহসে সে আমার নীরবক… ভাবতেও আমার কলিজা ফেটে যায়।
চলবে……
( ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন )