#টিট_ফর_ট্যাট
#Alisha_Anjum
#পর্ব_১৮
বিষাক্ত এক মুহূর্ত আমায় ঘিরে যেন নৃত্য করে যাচ্ছে। মা ঠাঁই দাড়িয়ে আছে মূর্তির মতো। হৃদ ঠোঁট কামড়ে আমার অবচেতন নীরবকে নামালো ভ্যানগাড়ি থেকে। আমার চক্ষু শীতল। সুধা মেয়েটা দাড়িয়ে আমার কাছে। আমি অনিমেষ দেখছি আমার নীরবকে। ও কি ঘুমিয়েছে? ইশ! মাথা দিয়ে তো রক্ত পরছে। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলাম। বড় উঠোনে পাটি পাতা। আলগোছে নীরবকে শুইয়ে দেওয়া হলো। আমার যেন কান্ড জ্ঞান হারিয়ে গেলো। অতি শোকে কি আমি পাথর? পারার চাচিরা মিনিটের মধ্যে ভির জমিয়ে ফেলল উঠোনে। আমার গলায় নীরবের সাদা ওড়নাটা বিদ্যমান। তার বন্ধ চোখ আমি মানতে পারছি না। কপাল থেকে পরা দরদর ধারার রক্ত যেন আময় মৃত্যু যন্ত্রণা দিচ্ছে। আমি পাগল হয়ে কপালে সাদা ওড়নাটা চেপে ধরলাম। হঠাৎ কানে এলো কারো কন্ঠ
— আহারে! সাদা ওড়না যে বিধবার প্রতিক। পোলাটা আগেই ইঙ্গিত দিছিলো।
কথাটা শুনে আমার হৃদপিণ্ড যেন ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। অবুঝ টলমটলে চোখে চাইলাম মহিলাটার পানে। একটু পর আবার উন্মাদ হয়ে হৃদকে খুজতে লাগলাম। সে একটু দূরেই মুখে দু’হাত চেপে বসে আছে। আমি আমার নীরবের মাথা কোলে তুলে নিয়ে হৃদের উদ্দেশ্যে বললাম
— ও হৃদ? ওরা কি বলে? আমার নীরবের কি হয়েছে? ও কথা বলছে না কেন? এই শোনো তুমি কিন্তু বলবে না আমার নীরব আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আমি কিন্তু মানবো না। সবকিছু তছনছ করে দেবো।
আমার কথায় হৃদ সেকেন্ড দুয়েক আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। মুখে কিছু একটা বলার জন্য কথা টেনে আলতেই আচমকা সে বুক কাঁপিয়ে ফুপিয়ে উঠলো। ধ্বক করে উঠলো আমার হৃদয়। ইতিমধ্যেই জেরিন এগিয়ে এলো। সাথে এলো একজন মধ্যবয়স্ক লোক। তিনি নীরবের হাতটা হাতে নিলেন। পার্লস চেক করবে কি? আমি অধির আগ্রহে তাকিয়ে আছি। কি সমস্যা এদের? এ গ্রামে কি ডাক্তার নেই?
— ছেলেটা বেঁচে নেই।
কথাটা বলতেই বুঝলাম লোকটা ডাক্তার। আমি বিশ্বাস করি না। জেরিন আচমকা হাউমাউ করে কান্না করে দিলো। এমন সময় হঠাৎ কোলাহল। বামে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি বেশ কজন মহিলাদের একটা জটলা পেকে গেছে। সুধা দৌড়ে চলে গেলো। আমার শাশুড়ি মা নাকি অজ্ঞান হয়ে গেছে। চাচি শাশুড়ি চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিলো। ছুটে এসে আমার নীরবের পায়ের কাছে বসে। বাপ বাপ করে ডাকতে লাগলো। আমাি বাধভাঙ্গা অশ্রু ক্ষরণে তাকিয়ে দেখছি তাকে। ধুর! আমার নীরবের কিচ্ছু হয়নি। আমি বুকে তীব্র কষ্ট চেপে বললাম
— মা আপনি কাঁদবেন না। আমার নীরবের কিচ্ছু হয়নি।
কথাটা বলেই নীরবের দিকে তাকিয়ে তাকে ডাকতে লাগলাম। কপালে ছোট্ট একটা চুমু দিলাম। ইশ! বজ্জাত ডাক্তারের ঠোঁটটা অন্নেক সুন্দর। মিনিট গেলো পাঁচেক। ডেকেই যাচ্ছি তাকে৷ কিন্তু সে সাড়া দিচ্ছে না কেন? হঠাৎ আমার বুকটা ধ্বক করে উঠলো। কে যেন তখনই আসলো। নীরবের হাতের মাপ নিতে। আমার সহ্য হলো না। এরা এমন করছে কেন? শুধু শুধু আমার বুকের জ্বালা বাড়াচ্ছে। উঠে দাড়িয়ে গিয়ে যুবক ছেলেটাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম। চিৎকার করে বলে উঠলাম
— খবরদার দাফনের কাপড় আনতে পারবে না। আমি বিশ্বাস করি না আমার নীরবকে কিছু হয়েছে। আমি ঢাকা নেবো আমার স্বামীকে।
কথাটা বলে ঘরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম৷ ফোন করবো বাবাকে। বাবা গাড়ি নিয়ে এসে নিয়ে যাবে আমাকে আর নীরবকে । ভাবনা অনুযায়ী পা বাড়াতেই হঠাৎ জেরিন চেচিয়ে উঠলো। প্রতিবেশী চারিদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো
— আপনারা ওকে একটু সামলান। ওর মাথা ঠিক নেই। ওর স্বামী ওকে ছেড়ে গেছে। নীলিমা তুমি শান্ত হও।
কথাটা বলেতেই কিছু মহিলা এসে আমায় জাপ্টে ধরলো। আমার যেন তরতর করে রাগের মাত্রা বেড়ে গেলো। ইচ্ছে হলো ঐ কালনাগিনীকে ধরে এনে একশো বার মামরি আর জীবিত করি। সইলো না চমার রাগ। মুখে যা এলো বকে গেলাম।
— তুই চুপ কর। আমার স্বামীকে তুই মারলি। আল্লাহ সইবে না। ও নাহ… আমার নীরবের কিচ্ছু হয়নি। ডাক্তার তুই আনছিস না? তোর আনা ডাক্তারে আমি বিশ্বাস করবো? কক্ষনো না। মরে গেলেও না। আমি আমার কলিজাকে ঢাকা নিয়ে যাবো।
কথাগুলো বলতে বলতে সর্ব শক্তি দিয়ে ছোটাছুটি করে দৌড়ে চলে গেলাম নীরবের কাছে। তার মুখটা দুহাতে আদর করতে করতে বললাম
— এই ডাক্তার, উঠেন না। ওরা কিসব বলে। আমার আল্লাহ আমার সাথে এমন করতেই পারে না। বিশ্বাস করি না আমি। ধরর! চোখ খুলুন তো স্বামী। ওদের বুঝিয়ে দেন আপনার নীলিমা সবসময় ঠিক বলে। আমাদের রব আমাদের সাথে আছে।
চোখ ভর্তি জল নিয়ে তাকে ডাকছি। কিন্তু সাড়া দিচ্ছে না কেন। আমার এবার হুট করে বুকে ভয় জমে গেলো। কেউ বুঝি কলিজাটা বিষাক্ত দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরলো। ধরফর বুকে আমি সাদা ওড়নাটা গলা থেকে নামালাম। হুট করে সম্পূর্ণ ওড়না তার রক্তে লালল করে দিয়ে পুনরায় ডেকে উঠলাম
— ডাক্তার, ডাক্তার?… এই যে চোখ খোলেন। আপনার বেগম ডাকে তো আপনাকে। খুব রাগ হচ্ছে কিন্তু। আচ্ছা আমার কি দোষ আপনি বলেন। এই যে কানে ধরছি। আপনি যা যা বলবেন আমি সব শুনবো।…. দেখেন আপনি আমি আপনার ওড়নাটা সাদা রাখিনি। এই যে আপনার রক্তে লাল করে দিয়েছি। একটা চাচি কুসংস্কার বলছিলো সাদা ওড়নায় স্বামী মরে। আমি লাল করে দিলাম এবার চোখ খুলুন? আজ না শুক্রবার, মসজিদে যাবেন না? আমায় খুদবা শোনাবেন না? আপনার মাথার টুপিতে আমার জন্য জিলাপি আনবেন না? ও ডাক্তার চোখ খোলেন প্লিজ। আপনার বন্ধ চোখ আমাকে খুব পোড়াচ্ছে। আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তো!এবার আমি গগন কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠলাম। অসম্ভব! আমি মানি না। কষ্ট হচ্ছে প্রচুর। এ কেমন যন্ত্রণা? বুকটা ফেটে যাচ্ছে আমার। আমি এই কষ্ট মানবো না। বসা থেকে উঠে দৌড়ে চলে গেলাম হৃদের কাছে। মাটিতে লুটিয়ে পরলাম। তার কাছে হাত জোর করে বললাম
— আমার নীরব কে বলো তাড়াতাড়ি চোখ খুলতে। আমি মারাই যাবো হৃদ। আমার দম আটকে আসছে।
হৃদের মাথা নত। কিছুই বললো না সে। আমি চরপাশে তাকালাম। সবার চোখে অশ্রু। আবার নীরবের দিকে তাকালাম। আমার রাগ হলো ভীষণ। গটগট করে চলে গেলাম তার কাছে। এবার কাছে বসে। সজোরে ধাক্কা দিলাম তার নিস্তেজ শরীরটা। উঠবে না কেন? আক্রশ আর পোড়া বুকে চিৎকার করে বলে উঠলাম
— তোর মনে এই ছিল? তুই এইভাবে বেইমানি করবি? উঠ তাড়াতাড়ি। এই ডাক্তার। আমি কিন্তু রাগ করেছি ভীষণ। এমন করে যদি চলেই যাবা তাহলে আমায় কেন নিলা না।
কথাটা বলতে বলতে মুখে হাত চেপে একশো আকাশসম দুঃখ নিয়ে কেঁদে উঠলাম। তীব্র কষ্টে আমার সম্বোধন এলোমেলো। ভয়ংকর চিৎকার করে উঠলাম । আল্লাহর আরশ কি কেঁপে উঠে না? আমার চিৎকার কি যাচ্ছে না তার কাছে? নতুন করে ক্ষতবিক্ষত হৃদয় নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললাম
— ভিক্ষা চাই আমি আমার নীরবকে। এই অসহায় মেয়েকে তুমি ফিরিয়ে দিবা? তুমি তো দয়াহীন না। তুমি মোটেও এমন করতে পারো না। আমার নবীর উছিলায় তুমি আমায় ভিক্ষা দেও তার জান। আমি কি নিয়ে বাঁচবো বলো?
উর্ধে দুই হাত তুলেছি। আচল পাতা আমার। লোকলজ্জা, পরিস্থিতি ভুলে গেছি আমি। এই আচল দিয়ে ভিক্ষা চাইছি আমি। একসময় কথাগুলো বলতে বলতে গলা নিস্তেজ হয়ে এলো। শরীর ছেড়ে দিচ্ছে সমস্ত শক্তি। কাঁদতে কাদতে লুটিয়ে পরলাম নীরবের বুকে।” আমার মন বিশ্বাস করে না” কথাটা মুখ আমার অবসরবিহীন জপ করে যাচ্ছে। মাথা রাখলাম তার বুকে। চোখের জ্বলে আপন বুকটা ভিজে গেছে। নীরবের পাঞ্জাবিটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরলাম। কত স্মৃতি মনে উথলে উঠলে। তার সাথে ঘুরে বেরানো, দুষ্টুমি, তার বলা কওয়া হীন আচমকা খাওয়া চুমু। এই হীরের নাকফুলটা। আরো কত! আজ পনেরো দিনেই সে কত স্মৃতি গড়েছে। ভেজা চোখ আর দুঃখে ভেঙে যাওয়া বুক নিয়ে ভাবছিলাম তার স্মৃতি। এমন সময় হুট করে আমার বুক মাতোয়ারা হলো আশার আলোয়। নীরবের বুকের ধুকপুক শুনলাম না? পুরোদমে কান্না স্তব্ধ করে দিলাম। কান পেতে রইলাম। হ্যা, তার হৃদপিণ্ড সচল। আমি লাফিয়ে উঠে পরলাম। পরম করুনা ময়ের দরবারে শুকরিয়া জানাতে ভুললাম না। আমি যেন আশার আলো পেলে পুনঃশক্তি পেলাম। ঠিক তখনই চোখে পরলো কোনে এক ছেলে বড়ই পাতা নিয়ে আসছে। ছুটে গিয়ে ছেলেটার হাত থেকে ফেলে দিলাম পাতা। কিসের বড়ই পাতার গরম পানি হবে? আমার নীরব বেঁচে আছে না? আমি উচ্চস্বরে বললাম
— কেউ বড়ই পাতার গরম পানি করবেন না। কবর খুঁড়বেন না। দোহাই আপনাদের আমার কষ্ট হয়। বুকটা ফেটে যায় আমার। আমার স্বামী বেঁচে আছে।
— নীলিমা? নাটক কারার একটা লিমিট আছে। লজ্জাহীন মেয়ে। ভাসুরের সাথে অবৈধ সম্পর্ক করে স্বামীকে মেরেছো। এতোক্ষণ চুপ ছিলাম। এখন আর থাকবো না।….. আপনারা সবাই তাড়াতাড়ি সমাধির ব্যাবস্থা করুন।
জেরিনের কুৎসিত বাণী। আমি কি করবো ওকে ভেবে পেলাম না। জোর করে আমার স্বামীকে কেঁড়ে নিতে চাইছে? আম রাগ আর দমিয়ে রাখতে পারলাম না। ছুটে গিয়ে হাত নয় তীব্র ঘৃণা নিয়ে পা দিয়ে আঘাত করলাম জেরিনের পেটে। কিছু কথা বলবো রেগে এমন সময় উঠোনে ছড়িয়ে পরলো পুলিশ বাহিনী। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। মানে কি? ওরা কেন? এমন সময় আমার মনের প্রশ্নের উত্তর করে উঠলো এক পুলিশ
— আমরা লাশ নিয়ে যাবো। তদন্ত করবো। খবর পেয়েছি এটা মার্ডার।
কথাটা শুনেই আমার সর্বাঙ্গ ঝিনঝিন করে উঠলো। পুলিশ নেওয়া মানে কাটাকাটি। আতঙ্ক পুরো গ্রাস করলো আমায়। আমি এখন বাঁচাবো কিভাবে নীরবকে? দু’হাতে নিজের মুখ চেপে ধরলাম। হঠাৎ আমার মনে হলো। যাই হোক আমি আমার নীরবের কিছু হতে দেবো না। দৌড়ে চলে গেলাম কাচারি ঘরে। কোথায় যেন গরু জবাই করে অস্রপাতি রেখেছে না? খুজতে খুজতে একটা বড় দা পেলাম। নিয়ে চলে এলাম বাইরে। মাগরিবের আজান কানে ভেসে আসছে। আধার পরছে প্রকৃতিতে। তিনজন পুলিশ মাত্রই এগিয়ে গেছে নীরবের অবচেতন দেহের কাছে। আমি জোরে পা চালিয়ে যাচ্ছি। তারা স্পর্শ কারার পূর্ব লগ্নেই আমি দাপট নিয়ে পেছন থেকে বলে উঠলাম
— খবরদার কেউ হাত দেবেন না আমার স্বামীর গায়ে। আমি কিন্তু একদম কুপিয়ে মেরে ফেলবো তাকে।
চলবে……..
( বহু কষ্টে লিখছি। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।)